নীলিমায় কালো মেঘ পর্ব-৫

0
523

নীলিমায় কালো মেঘ
পর্ব-৫

ভাবনা আলাদা বাসা নিয়েছে শুনে আবিরের চোখ চড়কগাছ। আলাদা বাসা নেবার মত এত দুঃসাহস হয় কি করে ভেবেই সে অবাক! ছেলের কাছে এ খবর শুনে গতকাল আবিরের মা এসেছে গ্রাম থেকে। বউকে প্রথম থেকে শাসনে না রাখার এটাই নাকি ফলাফল বারবার আবিরকে মনে করিয়ে দিচ্ছে সে।
ভাবনার সাথে কথা বলবে সেই ইচ্ছেটুকুও নেই যেন আর আবিরের। আবির রাতে অফিস থেকে ফেরার পরে আবিরের মা ভাবনাকে আর আবিরকে ড্রয়িং রুমে ডাকলো। এমনভাবে সবাই চুপচাপ বসে আছে যেন বিচারসভা চলছে । আসামী ভাবনা আর আবিরের মা বিচারক।
প্রথমে আবিরের মা ই শুরু করলো।

– বউ মা, আসার পর থেকে তোমার সাথে এ ব্যাপারে কথা বলার সুযোগ হয়নি। আবিরের কাছে শুনলাম তুমি নাকি আবার চাকরি নিয়েছো। এটা কি সত্যি?

– জ্বী, ঠিক শুনেছেন।

– তোমার হঠাৎ আবার চাকরি করার শখ হল কেনো?

– মা, আমি হঠাৎ করে চাকরি করছিনা আর শখের বশেও করছিনা। চাকরি আমি আগেও করতাম আর মাঝখানে বিপদে পড়ে ছেড়েছিলাম। আপনি সবই জানেন । নতুন করে আর কী বলবো!

– তখন করতে কারণ তোমার প্রয়োজন ছিল কিন্তু এখন?

– এখনও প্রয়োজন তাই করতে চাচ্ছি।

– আবির কি তোমার চাহিদা ,শখ, আহ্লাদ পূরণ করতে ব্যর্থ হচ্ছে ?

– আমি ওসব ব্যাপার এখন তুলতে চাচ্ছিনা।

– তুলবেনা কেনো ? অবশ্যই তুলবে!

– মা, এগুলি আমাদের স্বামী স্ত্রীর একদমই ব্যক্তিগত সমস্যা । আমি এসব বিষয় নিয়ে প্লিজ আলোচনা করতে চাইনা। সন্তান বড় হলে তাদের কিছু কিছু বিষয়ে মা বাবাদের ইন্টারফেয়ার না করাটাই ভালো। আমি এসব ব্যাপারে আমার মা বাবার সাথেও কখনো কথা বলিনা।

– বেশ তো! আমরা মুর্খ মানুষ অনেক কিছুই হয়তো বুঝিনা। তোমরা এ যুগের মডার্ন মেয়ে। তোমাদের মত এত কী আর বুঝি?

– মা , আপনি এভাবে বলছেন কেনো? আমি আপনাকে হার্ট করার জন্য কথাটা বলিনি।

– একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আবিরের মা বললেন, ঠিক আছে চাকরি করবে বুঝলাম তুমি আলাদা বাসা কেনো নিয়েছো? তুমি কি আবিরের সাথে সংসার করতে চাওনা আর?

– সেটা কখন বললাম? আপনার ছেলেকে জিজ্ঞেস করুন সেটা বলেছি কিনা!

– আমার ছেলেটা জন্মের পর থেকেই হাবাগোবা। সবকিছু সরল ভাবে চিন্তা করে । তোমাদের মত এত মডার্ন হতে পারেনি। তাই ও হয়তো তোমার এসব বুদ্ধির সাথে পেরে উঠবেনা। এটা আমার মনে হলো তাই বলছি।

– মা, আমি আলাদা বাসা নিয়েছি আপনার ছেলের জন্যই। তাকে অনেকবার অনুরোধ করেছি যাতে আমরা মায়ের কাছে থাকতে পারি। কিন্তু সে কিছুতেই রাজী না। ওই বাসাতে আমার আলাদা রুম আছে।এতবড় বাসা। আমাদের থাকতে কোনো অসুবিধাই হতোনা। সেখানে থাকলে সমস্যা কি আমার মাথায় আসেনা। যাই হোক পরে আপনার ছেলের কথাই মেনে নিয়েছি। ঠিক আছে মায়ের বাসায় না থাকি , তাদের বাসার পাশেই একটা বাসা নেই। তাতে আমি প্রতিদিন মেয়েটাকে তাদের বাসাতে রেখে অফিসে যেতে পারবো। কিন্তু তার তাতেও আপত্তি। আমাদের বাসায় থাকতে তার আপত্তি বুঝলাম আলাদা বাসা নিয়ে থাকতে তার কী সমস্যা সেটা বুঝতে পারছিনা। এটা তো আমাদের নিজস্ব ফ্লাট না । এখানেও ভাড়া দিয়ে থাকি ওখনেও ভাড়া দিয়েই থাকবো তাহলে সমস্যা কোথায় তার? আবিরকে অনেক বুঝিয়েছি, জোরাজুরি করেছি। ঝগড়া ফ্যাসাদও হয়েছে এ নিয়ে। এক পর্যায়ে সে বলেছে প্রয়োজন হলে সে একা থাকবে তবুও অন্যত্র বাসা নিলে সে সেখানে যাবেনা।

– আবির যেহেতু চাচ্ছেনা তুমি কেনো শুধু শুধু ঝামেলা বাড়াচ্ছো?

– আমি কি ঝামেলা করছি? ঝামেলা তো করছে আবিরই। আমার কথা আমি অন্যায়টা কি করেছি যে আবির এটা চাচ্ছেনা?

– তাই বলে একটা মেয়ে হয়ে এতটা সাহস দেখানো একটু বেশি হয়ে গেলোনা? তুমি কি আমার ছেলেকে ছেড়েই আলাদা থাকবে?

– তেমনটা আশা করিনা আর করছিও না। আমি চাচ্ছি সেও আমাদের সাথেই থাকবে। এই বাসাটা ছেড়ে দিলেই ঝামেলা শেষ।

এতক্ষণ আবির চুপচাপ মাথা নিচু করে দুজনের কথা শুনছিলো। আবির মাথা তুলে বলল,

– আর যদি না যাই?

– ভাবনা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, তবে আমি আমার মেয়েকে নিয়ে একাই যাবো। আমাকে সেই সব মেয়েদের দলে ভেবে কখনই ভুল করবেনা যে আমি ওদের মত বেচারী আর অবলা হয়ে আত্মসম্মানবোধ, বিবেকবোধ বিসর্জন দিয়ে ধুঁকে ধুঁকে আমার সারাজীবন পার করবো। কারণ এই এক বছরে অনেক কিছু চিনেছি, অনেক কিছু শিখেছি। তাই বাকি জীবন এভাবে পার করতে আমি মোটেই ইচ্ছুক না। মন চাইলে আমার সাথে আসতে পারো আর যদি ভেবেই থাকো সম্পর্কটা এই পর্যন্তই দেন আমার আর কিছু বলার থাকবেনা। আমিও তাহলে ভেবে দেখবো। পারস্পারিক আস্থা, শ্রদ্ধাবোধ, সহানুভূতি যে সম্পর্কে না থাকে সেখানে আর যাই থাক ভালোবাসা থাকতে পারেনা। তারপরেও যদি কারো মনে হয় সেখনে ভালোবাসার অস্তিত্ব বিদ্যমান ,আমি বলব সেটা সম্পূর্ণরূপে অভিনয়। অভিনয় করে বাস্তব জীবন পার করা যায়না। সেটা নাটক সিনেমাতেই বেশি ভালো মানায়।

ভাবনা আর এক মুহূর্ত সেখানে না দাঁড়িয়ে হনহন করে নিজের রুমের দিকে চলে গেলো।
ভাবনার চলে যাবার দিকে তাকিয়ে থেকে তার আত্মপ্রত্যয় আর কথা বলার ধরণ দেখে আবিরের মায়ের চোয়াল যেন ঝুলে পড়লো । এ কোন ভাবনাকে দেখছে সে! এতটা দৃঢ়তা আর স্বাধীনচেতা মনোভাব যে মেয়ের তাকে দমানোর সাধ্য মনে হয়না তার ছেলের বা তার আছে। অনেক ভেবেচিন্তেই সামনে আগাতে হবে। হুট করে রাগের বশে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া যাবেনা।

পরেরদিন সকালে আবির ভাবনাকে বলল, ঠিক আছে আমি তোমার সাথে যাবো। বাড়িওয়ালী খালাকে বাসা ছাড়ার কথা বলে এসো আজ।
ভাবনা এ কথা শুনে ভাবলেশহীন ভাবে শুধু বলল, ঠিক আছে।

ভাবনার এমন নিরুত্তাপ উত্তরে আবির খানিকটা দমে গেল যেন। সে মনে করেছিলো তার এই কথা শুনে ভাবনা হয়তো খুব খুশি হবে। খুশি হয়ে তাকে জড়িয়ে ধরবে । অথবা ধন্যবাদটুকু তো নিশ্চয়ই দিবে। কিন্তু তেমন কিছুই হলোনা। ভাবনার চেহারায় একবিন্দু পরিবর্তন দেখতে পেলনা সে। ভাবনা খুব মনোযোগ দিয়ে মেয়ের কাপড়চোপড় ভাঁজ করায় ব্যস্ত!

ভাবনাকে দেখে মনে হচ্ছে আবিরের পক্ষ থেকে এমন উত্তর আসবে এটা সে আগে থেকেই জানতো। ভাবনার এমন আচরণে খুব মেজাজ খারাপ লাগছে আবিরের। নিজেকে কী মনে করে সে? অনেক বড় কেউ হয়ে গিয়েছে?

ভাবনাকে কিছু বলতে যাবে মনে মনে এমনটা ঠিক করেছে মুখ খুলবে ঠিক তার আগ মুহূর্তে ভাবনা মেয়েকে কোলে করে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। যেন সেও বুঝতে পেরেছে আবির হয়তো এখন কিছু বলবে। আর কথা বাড়ালে কথা বাড়তেই থাকবে সেটা সে চায়না। আবির যেতে চেয়েছে এটাতেই খুশি আপাতত! তবে এটা সে নিশ্চিত ছিলো যে আবির তার সাথে যেতে না করতে পারবেনা।

প্রায় বছর পেরিয়ে গেছে ভাবনা এই অফিসে জয়েন করেছে। এক বছরের মধ্যেই সে বেশ সুনাম কুড়িয়েছে তার কাজের মাধ্যমে। কিছুদিন আগে অফিসের এসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার মাসুদ সাহেবের বেশ বড়সড় একটা ঘাপলা তার কারণেই হাতেনাতে ধরা পড়েছে ব্রাঞ্চ ম্যানেজার সাঈদ সাহেবের কাছে। খুব বিশ্বাস করে আজকাল ভাবনাকে সে। ভাবনার এমন জনপ্রিয়তায় অফিসের একদল খুব হিংসা করে তাকে। চিফ একাউণ্ট্যান্ট দিলরুবা বেগম খুব দুশিন্তায় আছে তার পদ নিয়ে । ভাবনা খুবই শার্প ব্রেইনের একটা মেয়ে। খুবই সিরিয়াস কাজের বিষয়ে। কোনো ধরণের টুকিটাকি ভুলও তার নজর এড়ায়না। তাছাড়া আজকাল ভাবনা উর্ধ্বতনদের বেশ নজরে পড়েছে। মাঝমাঝে তো এমন হয় যে তার কাজেরও খুঁত খুঁজে বের করে এই মেয়ে। দিলরুবা বেগম এই অফিসে আট বছর ধরে আছে। বয়স চল্লিশ পার করেছে হয়তো বেশ আগেই। তার তুলনাতে ভাবনা বাচ্চা মেয়েই বলা যায়। তার আন্ডারে ভাবনা ছাড়াও আরো তিনটা ছেলে এসিস্ট্যান্ট একাউন্ট্যান্ট হিসেবে আছে। ভাবনা তাকে প্রচুর সম্মান করে। সেও ভাবনার এমন কর্তব্যপরায়ণতা আর নিষ্ঠার জন্য উপরে উপরে ভাবনার খুব প্রশংসা করে। মেয়েটা যে এই পদের চেয়েও আরো ভাল কোন পদ ডিজার্ভ করে এটা সে ভাল করেই টের পায়। তাই খুব ভয় হচ্ছে এই পদ না কোনোভাবে হারিয়ে ফেলে সে। এতবড় কোম্পনিতে সে প্রধান হিসাবরক্ষক হিসেবে কর্মরত আছে । নিশ্চয়ই যোগ্য বলেই আছে। কিন্তু ভাবনাকে মাঝেমাঝে তার ভয় হয়। মেয়েটা এত ট্যালেন্ট! এতকিছু বুঝে। হিসাবরক্ষকদের মাঝে সে সবার চেয়ে জুনিয়র হলেও তার মেধা আর কার্যদক্ষতা দিয়ে তাকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে একদম। হিসাব রক্ষণ ছাড়াও আজকাল সে কোম্পানির কার্যপলিসি সম্পর্কেও নানান ধরণের মতামত দিয়ে থাকে বিভিন্ন মিটিংয়ে। এবং তার দেওয়া আইডিয়াগুলো খুব প্রশংসিত সবার কাছে। বিশেষ করে মাসুদ সাহেবের ঘাপলা ধরে ফেলার পর থেকে ম্যানেজার সাঈদ সাহেব তো ভাবনাকে খুব পছন্দ করে। মাসুদ সাহেব বেশ কিছুদিন ধরেই নানানভাবে ক্লায়েন্টদের সাথে জালিয়াতি করছে। এটা তার কানে আসলেও কিছুতেই ব্যাপারটা প্রমাণ করতে পারছিলেন না। কিন্তু এই ধূর্ত মাসুদ সাহেব ভাবনার বুদ্ধির জাল থেকে বের হতে পারেনি কোনোমতেই। ভাবনা বেশ কিছুদিন ধরে জাল বিছিয়ে বসেছিলো মাসুদ সাহেবের লেনদেন সংক্রান্ত ঝামেলা ধরার জন্য। তার ফাঁদে অবশেষে ধরা পড়েছে সে। ভাবনা অফিসে জয়েন করার পর থেকেই বুঝতে পারছিলো এই লোকটার মধ্যে কিছু তো চলছে । বাবার বয়সী মানুষটাকে এভাবে হেনস্তা করতে খুব খারাপ লাগছিলো কিন্তু কোম্পানীর স্বার্থে সে আবেগকে ঝেড়ে ফেলে পেশাদার আচরণ করেছে।
ভাবনার এমন পেশাদার আচরণে মালিকপক্ষ খুব খুশি। মাসুদ সাহেবকে তার উপযুক্ত শাস্তিও দেয়া হয়েছে। ভাবনার খুব খারাপ লাগছে উনার জন্য । কিন্তু কিছুই করার নেই। এভাবে চলতে থাকলে তাদের উপরই এর দায়ভার এসে চাপবে । তাই সে তার জায়গায় ঠিক আছে।

জারা স্কুলে যেতে শুরু করেছে। বাসার কাছে একটা স্কুলে ভর্তি করেছে। ভাবনা বা আবির অফিসে যাবার সময় স্কুলে রেখে যায় আর ভাবনার মা এসে ছুটির সময়ে নিয়ে যায়। এখন ভাবনার বাবার অবস্থা আগের থেকে কিছুটা ভাল। হুইল চেয়ারে নিজে নিজেই চলাফেরা করতে পারে। বাসায় দু জন কাজের মানুষ সবসময় থাকে। জারা খুব গোছানো হয়েছে। খুবই লক্ষী । নিজের বইখাতা, কাপড়চোপড় নিজেই গোছগাছ করে রাখে। নিজের হাতে খাবার খেতে পারে। বাসায় টিচার আসলে নিজেই আগ্রহ সহকারে খাতাপত্র নিয়ে বসে পড়ে হোমওয়ার্ক করতে। নাতীকে কাছে পেয়ে দিন খুব ভাল কাটে ভাবনার মা বাবার। রাতে বাসায় ফেরার পথে মেয়েকে নিয়ে যায় ভাবনা।
আবিরের সাথে তেমন ঝামেলাও হচ্ছেনা আজকাল। আবিরের জন্য অফিস দূরে হয়ে যায় তারপরেও সে মেনে নিয়েছে।
এদিকে হঠাৎ আবিরের মা খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছে বেশ কিছুদিন। ছোট ছেলে আপন যেয়ে নিয়ে এসেছে গ্রাম থেকে । ওর বাসাতেই আছে ক’দিন হলো। আপন বিয়ে করেছে মাস কয়েক আগে। ওর বউকে নিয়ে সাবলেটে এক রুম ভাড়া নিয়ে থাকে। সেখানে থাকতে খুব অসুবিধা হচ্ছে আবিরের মায়ের। আবির আর ভাবনা ছুটির দিন তাকে দেখতে যেয়ে তাদের এই অবস্থা দেখে তাকে তাদের বাসাতে নিয়ে আসলো। তাছাড়া আবিরের মার শারীরিক অবস্থা খুব বেশি ভালো না। সবসময় ডাক্তারের ফলোআপে থাকতে হবে। উনি গ্রামে যাবার জন্য অস্থির হয়ে পড়েছে। আবির আর ভাবনা অনেক বুঝয়ে নিয়ে আসলো তাদের বাসাতে।

আবিরের মায়ের সারাদিন একা একা থাকতে খুব অস্থির লাগে। সে বলল, জারাকে তার কাছে যেন রেখে যায়। আবিরও তাই চাইছে। এভাবে একা একা কি করে সে থাকবে। এ নিয়ে ভাবনার সাথে কথা বলতেই ভাবনা আবিরকে বুঝিয়ে বলল, তার শাশুরি কোনোমতেই জারাকে সামলাতে পারবেনা। জারার সারাদিনের রুটিন মুখস্ত জারার নানুর। তাছাড়া স্কুল থেকে নিয়ে আসা কোনো ভাবেই উনার পক্ষে সম্ভব না। তাছাড়া জারাও ওর দাদীর সাথে খুব বেশি এটাচড না। দাদীর সাথে আগ বাড়িয়ে তেমন কথা বলেনা। আবির বলল, কিছুদিন থাকতে থাকতে জারা ওর দাদীর সাথেও নানা নানুর মত এটাচড হয়ে যাবে। এদিকে এ কথা শুনে ভাবনার মা বাবারও খুব মন খারাপ। জারার সাথেই তাদের সারাদিন কাটে । জারাকে ছাড়া তারাই বা থাকবে কি করে। জারা যতক্ষণ তাদের বাসাতে থাকে খুব ভালো সময় কাটে তাদের। তাছাড়া ওখানে না থাকলে ওর জন্য সারাদিন দুশ্চিন্তা হবে। কি করবে ভেবে পাচ্ছেনা ভাবনা।
আবির প্রচন্ড রাগ করছে ভাবনার এমন ব্যবহারে। এ ক’দিন ধরে তার মা একা একা থাকতে দম আটকে আসছে তার। ছেলে বাসায় আসলেই খুব অনুনয় করে হয় গ্রামে দিয়ে আসতে বা আপনের বাসাতে রেখে আসতে। গ্রামে একা থাকলেও সেখানে বাড়ির উপর অন্য মানুষের সাথে কথাবার্তা বলে সময় কেটে যায় তার। কিন্তু এখানে সারাদিন একা একদমই থাকতে পারছেনা সে। খাবার দাবার সব রেডি করে রেখে যায় ভাবনা। ফ্রিজ থেকে বের করে শুধু ওভেনে গরম করে নিলেই হয়। আর সারাদিন টিভি দেখেই সময় পার হয় । খুব বিরক্ত লাগে তার।
চারপাশে যেসব ঘটনা ঘটছে তাই অপরিচিত কাজের মানুষের কাছে রেখে যেতেও ভয় হচ্ছে আবিরের। ভাবনার উপর রাগ করেই বা কী হবে? জারা কিছুতেই তার দাদীর কাছে থাকবেনা। তাছাড়া সবচেয়ে বড় কথা স্কুল থেকে আনাটাই বিপদ। তার উপর তার মায়ের যে শারিরীক অবস্থা তাতে সে জারাকে ভালোভাবে দেখে রাখতেও পারবে বলে মনে হচ্ছেনা।

বোনদের কাছে গ্রামে খবর পাঠিয়েছে ভালো দেখে একজন মানুষ খুঁজে পাঠাতে যাতে তার মায়ের পাশে থাকতে পারে। কিন্তু তেমন কাউকে পাচ্ছেও না। কি যে করবে বুঝতে পারছেনা আবির।
জারাকে বাসাতে রেখে না যাবার কারণে ভাবনার সাথে ভালোভাবে কথা বলেনা তার শাশুরি। ছেলের কাছে প্রতিদিনই এই নালিশ সেই নালিশ।

রাতে আবিরের বাহুতে শুয়ে ভাবনা আস্তে করে বলল,

-আচ্ছা একটা কথা বলি আবার রাগ করোনা। মা যেহেতু আমাদের এখানে থাকতে চাচ্ছেনা। আর গ্রামে তাকে পাঠানোও যাবেনা। পনেরো দিন পর পর ডাক্তারের কাছে যেতে হয় তাই বলছি কি আপনের ওখানে রেখে আসলে হয়না ? আপনের বউ তো সারাদিন বাসাতেই থাকে। আপনের বাসা ছোট এজন্য তো ওখানে থাকতে সমস্যা। তুমি এক কাজ করনা! আপনকে বল দুই বেডরুমের বাসা দেখতে। বাড়তি যা খরচ হয় আমরা দিয়ে দিবো। মাকে একা রেখে যেতে আমারও খারাপ লাগে খুব। সারাদিন চিন্তা হয়। কয়েকবার ফোন দিয়ে খোঁজখবর নিই যদিও । কিন্তু তাতে কি আর উনার একাকীত্ব কাটে। বলেছিলাম আমার মায়ের কাছে যেয়ে থাকতে ।রাতে জারার সাথে আসতো কিন্তু তাতেও উনি কোনোভাবে রাজী নন। তুমি তো জানোই মা আমার বাসার কাউকে কেন জানিনা বিশেষ পছন্দ করেন না। অথচ আপনের শশুর শাশুরির সাথে কত ভাব! আমার বাবা মা থাক দূরের কথা আমাকেও কোনোদিন উনি আপন মনে করতে পারলেন না। অফিসে বসে ফোন করলে খুব ভালোভাবে কথাও বলেন না। যেন ফোনটা রাখতে পারলেই উনি বাঁচেন । যাক সেসব আমার কপাল।
কথা শেষ করার আগেই আবির এক ঝটকায় তার হাতটা ভাবনার মাথার নিচ থেকে সরিয়ে নিয়ে এলো।

– সুযোগ পেলেই মায়ের বদনাম করতে ছাড়োনা তুমি। আপন হতে হলে আপন হবার মত যোগ্যতা অর্জন করতে হয়, ভাবনা।

– মানে?

– আমার মা অসুস্থ! কই এটা তো বলতে পারতে মায়ের জন্য না হয় জবটা ছেড়ে দিই। বাসাতে উনাকে সার্বক্ষণিক দেখাশোনা এখন খুব প্রয়োজন। উনি বাঁচবেনই বা কত বছর। মেয়েটাকে পর্যন্ত উনার কাছে রাখতে সাহস পাওনা।

– আবির! জারাই উনার সাথে থাকতে চায়না। নাতীর সাথে উনারই তো বন্ডিং নেই। জারার ছোটবেলা থেকে যদি সাথে থাকতেন তবে হয়তো এমনটা হতোনা। যাক ,সেসব কথা বাদ দাও ! কোনোকিছু হলেই আমার চাকরির কথা আগে মনে আসে। কই আমার বাবাও তো একসময় পুরো বিছানায় ছিলেন। তখন সে বাসাতে আমার প্রয়োজনে আমি থাকতে চেয়েছিলাম কি বলেছিলে মনে আছে ? আমার বাবা মায়ের বাজার সদাই করার জন্য নাকি তোমাকে নিচ্ছি। একথা কিন্তু তোমার মাই বলেছিলো। যাক, ওগুলি বলে শুধু শুধু পুরানো কথা টানতে চাইনা। আমি আপন হওয়ার যোগ্যতা রাখিনা বেশ ভালো কথা। এত বছরে যখন আপন হতে পারিনি আর আপন হওয়ার আশাও রাখিনা কারো কাছে।

ভাবনার কথা শুনে আবিরের মেজাজ আরো খারাপ হয়ে গেলো। চুপচাপ সে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here