নীলিমায় কালো মেঘ,পর্ব:৯+১০

0
1872

#নীলিমায়_কালো_মেঘ
#পর্ব_৯

এত বড় পোস্টে ভাবনাকে দেখে তার কলিগরা কিছুতেই সহ্য করতে পারছেনা। ভাবনাকে দেখলেই নানান ভাবে চোখ ইশারা করে একে অপরের সাথে টিপ্পনী কাটে। ভাবনা যে কিছু বোঝেনা তা নয়। সে সবই বোঝে । তাকে নিয়ে যে আড়ালে আবডালে নানান ধরণের মুখরোচক গল্প হয় সেটা সে ঠিকই টের পায়। খুব চেষ্টা করছে এসবে নিজেকে মানিয়ে নিতে। জীবনে কোনো কিছুই সহজে পাওয়া যায়না। এই পর্যন্ত আসতে তাকে কত কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে সে কথা অন্যরা কী করে বুঝবে? বিয়ের পর থেকে প্রতিনিয়ত তাকে পদে পদে নানানভাবে বাধাগ্রস্ত হতে হয়েছে। কোনোকিছুই খুব সহজে তার জীবনে আসেনি। তবে এইবার কেন যেন সবকিছু তার কাছে সবকিছু খুব সহজে হাতের নাগালে চলে এসেছে বলে মনে হয়। কোনোদিন স্বপ্নেও ভাবেনি এত বড় পদ তার জন্য অপেক্ষা করছে। বিয়ের আগে এমন বড় বড় স্বপ্ন দেখত! কিন্তু বিয়ের পরে শুধুমাত্র তিনবেলা খেয়ে পরে সম্মানের সাথে টিকে থাকাটাই তার কাছে স্বপ্ন ছিলো। এর অধিক কোনোকিছুই সে চায়নি। মেঘ না চাইতেই বৃষ্টির মত তার জীবনে ঘটে গেল এমন ঘটনা।
মাস প্রায় শেষ হয়ে এলো। নতুন দায়িত্ব বেশ নিষ্ঠা আর দায়িত্বের সাথে ভালোভাবেই পালন করেছে ভাবনা। রায়হান সাহেবের বাবা এই অফিসের এমডি সামাদ সাহেব সিঙ্গাপুর থেকে ফিরে ছেলের এমন সিদ্ধান্তে খুব রাগ করেছিলেন। মাসুদ সাহেব তার বাল্যকালের বন্ধু। একসাথে বেড়ে ওঠা দুজনের। মাসুদ সাহেব যে ক্ষমতার অপব্যবহার করে বা কিছুটা লোভী একথা জানা স্বত্তেও সে তার বন্ধুকে কখনো চাকরীচ্যুত করার কথা ভাবেনি। এই মাস কয়েক হলো ছেলের হাতে এই কোম্পানীর দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন এখানে তার দায়িত্ব শেষ। কিন্তু মাসুদ সাহেবকে এভাবে অবসরে পাঠানোতে সে কিছুটা বিমর্ষ হয়ে পড়েন। নিজেই কিছুদিন আবার তদারকি করছেন সবকিছু। মাসুদ সাহেবের সব ধরণের দুর্নীতির প্রমাণপত্র হাতে পেয়ে ছেলের সিদ্ধান্তে আস্থা আসে তার। ভাবনাকে সহকারী হিসাবরক্ষক থেকে মাসুদ সাহেবের জায়গায় পদন্নোতি দেয়াতে প্রথমে খুব ক্ষেপে গেলেও এই একমাসে ভাবনার কর্মদক্ষতা, দূরদর্শিতা আর বিভিন্ন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের নমনীয়তায় সত্যিই তিনি মুগ্ধ হয়েছেন। কোম্পানী পরিচালনায় এমন নবীন আর দক্ষ ব্যবস্থাপনারই প্রয়োজন। সেকেলে মনোভাব এখন যুগের সাথে তাল মিলিয়ে অগ্রসর হতে গিয়ে দ্বারে দ্বারে ধাক্কা খাচ্ছে যেন। তাই সত্যি পরিবর্তনের খুব প্রয়োজন। এটা তিনি নিজেই অনুভব করছেন এখন। তার ছেলে এই লাইনে নতুন হলেও সে যে বিচক্ষণতায় তাকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে এ কথা সে মুখে না বললেও ঠিকই বুঝে গেছে। ভাবনা প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসী আর ট্যালেন্ট একটা মেয়ে । সামাদ সাহেবের দৃঢ় বিশ্বাস ভাবনাকে যে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে সে সঠিকভাবে পালন করতে পারবে।
কোম্পানীর মাসিক সভায় ভাবনাকে সহকারী ব্যবস্থাপক হিসেবে পার্মানেন্ট করার জন্য সিদ্ধান্ত নেয়া হলো। সামাদ সাহেব ভাবনাকে এই পোস্টের জন্য এপ্রুভ করে দিলেন। ভাবনার দু’চোখ বেয়ে যেন খুশির বন্যা বয়ে যাচ্ছে। সভায় রায়হান সাহেব ফুলের তোড়া দিয়ে ভাবনাকে আনুষ্ঠানিকভাবে এই পদে অভিষিক্ত হওয়ার জন্য সবার সামনে অভিনন্দন জানালেন।
ভাবনার কাছে সবকিছুই স্বপ্নের মত লাগছে। কী থেকে কী হয়ে গেলো ?এভাবে তার জীবনের বাঁক ঘুরে যাবে সে ভাবতেই অবাক হচ্ছে। আজ আবিরকে সব কথা খুলে বলবে। সময় হয়েছে। এতদিন বড় কষ্টে সে এত বড় সাকসেসের কথা সবার কাছে লুকিয়েছে। আবিরের খুশি খুশি মুখটা সে কল্পনাতে এখনই যেন দেখছে।

বাসায় ফেরার পথে বাসের দুলুনিতে কখন যে চোখটা বুজে আসলো সে টেরই পায়নি। চোখ বন্ধ করতেই ভাবনা দেখতে পাচ্ছে আবির তার সাক্সেসের খবর শুনে খুশিতে বাম হাতে তার কোমর জড়িয়ে ধরে ডান হাতে কপালের চুলগুলি সরিয়ে আলতো করে চুমু দিচ্ছে ভাবনার কপালে। ভাবতেই ভাবনা শিহরিত হয়ে উঠল। আজ যেন পথ কমছেই না। এই কদিন ধরে অফিস থেকে যেতে দেরী হচ্ছে দেখে প্রায়ই আবিরের কাছে নানান বাহানায় মিথ্যা অজুহাত দাঁড় করিয়েছে। নিজের কাছেই খুব খারাপ লাগছিলো এভাবে প্রতিনিয়ত আবিরকে মিথ্যে বলার জন্য। অবশেষে আজ সে সবকথা খুলে বলবে। আবির কতদিন মন খুলে কথা বলেনা , হাসেনা। আবিরের একটা চাকরী বড্ড প্রয়োজন। পুরুষ মানুষ এভাবে বসে থাকলে ধীরে ধীরে মানসিক রোগী হয়ে যাবে। এই ক’মাস ধরে আবির একটা জবের জন্য কোথায় কোথায় না ধর্না দিয়েছে। ভাবনা মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে ডিরেক্টর রায়হান সাহেবের সাথে আবিরের ব্যাপারে কথা বলবে। তাদের কত ব্যবসা ! কোথাও না কোথাও ঠিকই আবিরের জন্য একটা ব্যবস্থা সে করে দিতে পারবে। আজকাল রায়হান সাহেবের সাথে তার সম্পর্কটাও বেশ ভালো যাচ্ছে। সে তার সমস্যার কথা বললে সে নিশ্চয়ই কোনো না কোনো সমাধান দিবেন। আগামীকাল রায়হান সাহেব আসবেন অফিসে। তাই কালকেই কথা বলবে সে!
বাসায় আসার পথে হাতে করে তার শাশুড়ি আর জারার পছন্দের নানান ধরণের খাবারদাবার কিনে ফেললো। অনেকদিন ধরে হিসেবের বাইরে কোনোকিছু কেনাকাটা করতে গেলেই পুরো মাস কীভাবে চলবে এই কথাটিই মনে এসেছে। কিন্তু আজ আর কোনো বাধা নেই। এখন তার বেতন ডবল হয়ে গেছে। তাই সে চাইলেই সবার জন্য তার পছন্দমত কেনাকাটা করতে পারবে। ভাবতেই চোখ ভিজে উঠল তার। কতদিন মেয়েটাকে তার পছন্দের কিছু কিনে দেয়া হয়না। মেয়েটাও বুঝতো। এতটুকুন মেয়ে যেদিন থেকে বুঝতে পেরেছে বাবার চাকরী নেই , মাকেই পুরো সংসার টানতে হবে সেদিনের পর থেকে কখনো অফিস থেকে ফেরার পরে ভাবনার কাছে একটা চকলেটও আবদার করেনি সে। আজ মেয়ের জন্য নানান রকমের চকলেট কিনেছে ভাবনা।

এদিকে আবির খুব চিন্তিত হয়ে বারবার ফোন দিয়েই যাচ্ছে। ভাবনা মিটিংয়ের সময় ফোন সাইলেন্ট করেছিল । সেভাবেই আছে ব্যাগের ভেতর। তাই আবিরের ফোনের শব্দও সে টের পাচ্ছেনা। অন্যদিন ন’টার ভেতরে পৌঁছে যায় । কিন্তু আজ বাসায় পৌঁছাতে সাড়ে দশটা বেজে গেলো।
ভাবনাকে দেখেই আবির যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো।

– এত দেরী করলে যে? রাস্তাঘাটের যে অবস্থা! খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম ।
– এত ভয় পাবার কি আছে? আমি কি বাচ্চা, ডার্লিং?
– ছেলেদের জন্যই চলাফেরা রিস্ক সেখানে তুমি একটা মেয়ে।
– ভাবনা খানিকিটা হেসে বলল, ভয় নেই গো! আমার কিচ্ছু হবেনা। তোমার বউ এমন আহামরি কেউনা যে তাকে নিয়ে টানাটানি শুরু হয়ে যাবে!
– উহু, এটা ভুল বললে । আমার বউ পৃথিবীর সেরা সুন্দরী। তাকে নিয়ে আমার মত গোবাচারা স্বামীর ভয় হবে এটাই স্বাভাবিক।
– হাহাহা!
আবির ভাবনার হাতের ব্যাগগুলির দিকে তাকিয়ে বলল, বুঝতে পেরেছি তোমার দেরী হবার কারণ। এসব আবার কিনতে গেলে কেনো? আমাকে লিস্ট দিতে আমি নিয়ে আসতাম।
– আরে নাহ। তেমন কিছু না। মা আর জারার জন্য কিছু খাবার দাবার। অফিসে মিটিং ছিল তাই দেরী হয়েছে। আচ্ছা, বাদ দাও এসব কথা! জারা কোথায়? টের পাচ্ছিনা একদম। আমি এলাম তাও খবর নেই।
– দাদীর সাথে লুডু খেলে। তাই হয়ত টের পায়নি। ফ্রেশ হয়ে নাও । তোমাকে একটা খবর বলব।
– তাই? আমার কাছেও একটা খবর আছে জনাব! মিটিমিটি হেসে বলল ভাবনা।
– ওকে তবে তুমি বল!
– উহু তুমি।
– আচ্ছা, আচ্ছা! আগে চেঞ্জ করো। তারপরে আমিই প্রথমে বলবো । ওকে?
– ওকে।

আবিরকে আজ বেশ কিছুদিন পরে খুব ফ্রেশ লাগছে। ভাবনার ভালো লাগছে এটা দেখে। তার প্রমোশনের খবর শুনলে হয়তো আরো খুশি হবে এমনটা ভাবতে ভাবতে সে ওয়াশরূমে গেলো ফ্রেশ হতে। ওয়াশরুম থেকে বেরিয়েই পেছন থেকে যেয়ে আবিরকে দুই বাহুতে আবদ্ধ করলো। আবিরও যেন এমন কিছুর অপেক্ষায় ছিল। হেঁচকা টানে ভাবনাকে সামনে এনে তার বুকের সাথে জড়িয়ে নিলো। ভাবনার নাকের সাথে নাক ঘষতে ঘষতে সে বলল, ম্যাডামের কষ্টের দিন বুঝি এবার ঘুচবে। এই ক’টা মাস কি কষ্টটাই না করেছেন আমার সংসারের জন্য!
– এ কেমন কথা ? সংসার বুঝি তোমার একার?
– সরি , সরি ! ভুল হয়ে গেছে। ক্ষমা করে দিবেন।
– এবার বল কি বলছিলে। জব হয়েছে ?
– হুম!

– মানে ? চাকরী পেয়েছ তুমি? উত্তেজিত হয়ে বলল ভাবনা।

– ইয়েস ম্যাম। এই গরীব বেকার ছোটখাটো একটা চাকরী যোগার করতে পেরেছে অবশেষে।

– ওয়াও! এতক্ষণে বললে? কংগ্রাচুলেশানস! বলেই ভাবনা শক্ত করে আবিরকে জড়িয়ে ধরলো।

– থ্যাংক ইউ সো মাচ!

– এবার বল কোথায় জব হয়েছে?

– একটা রিয়েল স্টেট কোম্পানীতে সেলস এন্ড কাস্টমার সার্ভিস অফিসার হিসেবে । অফিস আপাতত তেজগাঁওতে । বেতন আগের চেয়ে কিছুটা কম। ভাবলাম একদম বসে থাকার চেয়ে এটা বা কম কীসে! কি বল?

– অসুবিধা নেই। তাতে কি! খুব খুশি হলাম তোমার খবরটা শুনে। তোমার জন্য খুব চিন্তা হতো এতদিন। যাক চিন্তা তবে কমলো। মাকে বলেছো এই সুখবর? তোমার জন্য খুব চিন্তা করেছে এতদিন।

– হুম, জানিয়েছি। মাও খুব খুশি। কিন্তু এখন নতুন সমস্যা হলো মাকে রাখবো কার কাছে? বললাম আপনের বাসায় রেখে আসার কথা । কিন্তু তাতেও রাজি না সে। কি যে করি!

– এক কাজ কর! বড় আপার মেয়ে কুহেলীর তো এসএসসি পরীক্ষা শেষ হবে ক’দিন বাদে । তখন তো একদম ফ্রী থাকবে বাড়ীতে। আমাদের এখানে নিয়ে এস। কিছুদিনের জন্য নিরিবিলি এখানে বেড়িয়ে যাক। মায়েরও ভালো লাগবে খুব।

– খুব ভাল কথা মনে করেছো । আপাকে কালকেই ফোন দিব আমি। যাক তিন মাস তো থাকতে পারবে এখানে। এরপরের চিন্তা এরপরে করবো । আপাতত চিন্তামুক্ত। কুহেলীও কিছুদিন ধরে এখানে বেড়াতে আসার কথা বলেছিলো । আমি ওর কথা একদমই ভুলে গিয়েছিলাম নিজের টেনশনে।

– কালই ফোন দাও আপাকে। আর তোমার জয়েনিং ডেট কবে?

– নেক্সট মান্থে।

– তবে তো ভালোই হল। তুমি নিজে যেয়ে নিয়ে এসো কুহেলীকে। দুলাভাই ছেলেমেয়ের ব্যাপারে কেমন খুঁতখুঁতে তা তো জানোই। পারলে আপার সাথে কথা বলে দুলাভাইয়ের সাথেও কথা বলো।

– ঠিক বলেছো। আচ্ছা, আমাকে কী যেন খবর বলবে বলেছিলে ? আমি তো একদমই ভুলে গিয়েছিলাম । বল দেখি কী খুশির খবর অপেক্ষা করছে আমার জন্য? একদিনে এত খুশির খবর হজম করতে পারবো তো? মায়ের ব্যাপার নিয়ে কি যে টেনশনে ছিলাম ! তুমি এক চুটকিতে সমাধান দিয়ে দিলে। মাঝেমাঝে মনে হয় তোমার কাছে বুঝি সব কিছুর সমাধান পাওয়া যাবে।

– হাহাহা। মজার কথা বললে। আমিও তোমার খবর শুনে আমার খবর বলার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম।

– হুম এবার বল!

– আমার প্রমোশন হয়েছে।

– আলহামদুলিল্লাহ! তবে কি এবার চীফ একাউন্ট্যান্ট? তাহলে তোমার নাক উঁচু দিলরুবা ম্যাডামের পোস্টটা পেয়েই গেলে। উনি কি জব ছেড়ে দিয়েছেন নাকি ফায়ার হয়েছেন?

– আরে নাহ! ওসব কিছুই না। উনি উনার জায়গায় ঠিকঠাক আছেন। আমি চীফ টিফ কিছু না এসিসট্যান্টই আছি।

– মানে কি ? তুমি না বললে প্রমোশন হয়েছে।

– হয়েছে তো! তবে একাউন্ট্যান্ট না। এসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার হিসেবে।

– ফান করছো না তো?

– আরে নাহ! ফান করবো কেনো ? আমি মাসুদ সাহেবের জায়গাতে রিপ্লেস হয়েছি।

– ওহ মাই গড! এসব কী বলছো ? এটা কী করে সম্ভব!

– সম্ভব সাহেব! সবই সম্ভব! আপনার বউয়ের উপর আস্থা নেই কি?

– আস্থা অবশ্যই আছে। তাই বলে এত বড় পোস্ট?

– তোমার বিশ্বাস হচ্ছেনা? আমি তোমাকে আমার প্রমোশন লেটার দেখাচ্ছি। ওয়ান মিনিট!

ভাবনা ঝটপট করে তার ব্যাগ থেকে প্রমোশন লেটার বের করে আবিরের হাতে দিল। আবির এক নজর চোখ বুলিয়ে নিলো। সে খুশি হলো কি অখুশি হলো সেটা ভাবনা বুঝতে পারলোনা।
– ভাগ্য তো খুলে গেছে একদম !
– তা বলতে পারো।
– বেতন তো বেশ পাবে দেখছি।
– যে গাধার খাটুনি খাটতে হয় তাতে বেতনটা ঠিকই আছে। গত একমাস আমার যে পরিমাণ ফাইলপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করতে হয়েছে তা মনে হয় আমার এই দেড় বছরেও হয়নি।
– গত এক মাসে মানে কি? তুমি না বললে তোমার এই মাসে প্রমোশন হয়েছে!
– গত মাস থেকে কাজ করছি। এইমাসে পার্মানেন্ট হলাম। তোমাকে বলিনি কারণ শেষ পর্যন্ত যদি টিকতে না পারি তাই। আজই কনফার্ম হলাম । আজ এমডি স্যার নিজেই মিটিংয়ে এনাউন্স করেছেন। প্রথমে আমাকে তার বন্ধু মানে মাসুদ সাহেবকে বাদ দিয়ে তার এই পোস্টে আনার জন্য রায়হান স্যারের উপর খুব ক্ষেপেছিলেন। পরে আমার পার্ফম্যান্সে সন্তুষ্ট হয়ে ছেলের সিদ্ধান্তে খুশিই হয়েছেন। নিজেই আজকে সবার সামনে আমার খুব প্রশংসা করেছেন।
– বেশ তো ! আজকাল অনেক কথাই গোপন করতে শিখেছো দেখছি এতবড় পোস্টে তোমাকে কোন স্বার্থে চাকরী দিলো ব্যাপারটা কেমন যেন অড মনে হচ্ছে না! আর এতকিছু ঘটে গেছে অথচ আমাকে জানানোর প্রয়োজন মনে করোনি।
– ভেরি সরি, আবির। আমি ভেবেছিলাম তুমি দুশ্চিন্তা করবে তাই। এটা আমার জন্য একটা চ্যালেঞ্জ ছিলো। তাই অযথা তোমাকেও টেনশনে রাখতে চাইনি। প্লিজ, বুঝতে চেষ্টা করো। আর আমি এ পদে আগে যিনি ছিলেন তার চেয়ে যোগ্য তাই আমার এখানে আসার সৌভাগ্য হয়েছে। আর কিছুই না। এখানে অড লাগার কি আছে? আমার কাছেও প্রথমে অবাক লেগেছিলো। পরে ভেবে দেখলাম আমার যোগ্যতা অনুযায়ী ঠিকই আছে। আমি মাসুদ সাহেবের থেকে সবদিক থেকে যোগ্য !
– ইটস ওকে। বুঝতে পেরেছি। চল, খেতে যাবে। খুব খিদে পেয়েছে।
ভাবনা কিছুটা অবাক হলো মনে মনে। ভেবেছিলো আবির কত খুশি হবে। অথচ তার ছিটেফোঁটাও দেখছেনা। উলটো কিসব বলছে। খুব কষ্ট পেল ভাবনা।

– আগে মায়ের সাথে কথা বলে আসি । তারপরে খাবার দিচ্ছি। একটু অপেক্ষা করো।
– ঠিক আছে।
– আবির , তুমি খুশি হওনি?
– খুশি হবোনা কেনো?
– তবে আমাকে কংগ্রাচুলেট করার কথা কি ভুলে গেলে?
– ওহ, সো সরি! অনেক অনেক অভিনন্দন। পেশা জীবনে এভাবেই সাফল্যের সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছে যাও সেই দোয়া করি।

পরেরদিন সকালে খুব মনমরা হয়ে বসে আছে দেখে আবিরের মা ছেলের পাশে এসে বসলো। পাশে এসে বসার পরেও আবির তার সাথে কোনো কথাবার্তা বলছেনা দেখে আবিরের মা নিজে থেকে বোঝার চেষ্টা করছে আবিরকে। এতদিন পরে চাকরী হয়েছে তার তো হাসিখুশি থাকার কথা। তবে এমন কেন?

– বাবা, কোনো কারণে কি তোর মন খারাপ? এভাবে বসে আছিস যে!
– একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সে তার মাকে বলল, না মা! তেমন কিছু নাহ! এমনিতেই।
– তুই বললেই হবে আমি তোর মুখ দেখেই মনের খবর টের পাই। আমার কাছে বল কী হয়েছে। না হলে আমারও খুব অস্থির লাগবে।
– বললাম না কিছুনা। তোমাকে নিয়ে খুব চিন্তা হচ্ছিলো। আমার অফিস শুরু হলে কীভাবে থাকবে তাই! আপাতত কিচজুদিনের জন্য একটা সমাধান পেয়েছি। কুহেলীর এক্সাম শেষ হলে আসবে এখানে। আমি আপা দুলাভাই দুজনের সাথেই কথা বলেছি। তারা রাজী।
– ভালো করেছিস। কতদিন দেখিনা কুহুকে। ভালোই হবে জারারও একজন সঙ্গী হবে। কিন্তু বাবা আসল কথাই তো বলছিস না। কি হয়েছে তোর? চাকরী নিয়ে কোনো সমস্যা? এ চাকরী ভালো না হলে করার দরকার নেই। সামনে আরো ভালো চাকরী পাবি।
– তেমন কিছু না ,মা। বললাম না তোমার জন্য মন খারাপ ছিলো।
– কথা ঘুরাবিনা একদম! নিজেই তো বললি কুহু আসছে। তবে আবার কিসের চিন্তা? তুই কি ভাবনার কোনো ব্যাপারে চিন্তিত?
– আবির কিছুটা চুপ করে থেকে বলল, মা সত্যি করে বলতো আমি কি ভাবনার অযোগ্য ? ওর পাশে নিজেকে আজকাল বড্ড বেমানান লাগে। নিজের প্রতি লজ্জা হচ্ছে খুব।
– এমন হবে কেনো ? অযোগ্য হলে কি তোকে বিয়ে করতো ? এত বছর পরে এসব কী বলছিস? ও কি তোকে এমন কিছু বলেছে?
– নাহ! এমনিতে মনে হলো। আচ্ছা , আমি একটু বাইরে যাবো একটা কাজ আছে। তাড়াতাড়িই চলে আসবো । তুমি সাবধানে থেকো। বলেই আবির ওর মাকে আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে বারিয়ে গেলো। আবিরের মা বুঝতে পারলো হয়তো নিজের কাছ থেকে পালিয়ে বাঁচার জন্যই সে এমন করছে।
আবির চলে যাবার পরে তার মা ছেলের দুশ্চিন্তার কারণ কিছুটা হলেও বুঝতে পেরেছে। কাল রাতে ভাবনার প্রমোশনের খবর শুনে সারারাত খুব হাঁসফাঁস করে রাত কেটেছে আবিরের মত আবিরের মায়েরও। ছেলের চেয়ে বউয়ের আয় রোজগার বেশি হলে সেই সংসারে কি আর শান্তি থাকে?
বউয়ের কাছে স্বামীর মূল্য কোথায় যেয়ে দাঁড়াবে এটা যেন সে নিমিষেই দেখতে পেলো। এমনিতেই ভাবনা ইচ্ছেমত চলাফেরা করে তার উপর যদি এভাবে দিনদিন তার ছেলেকে ছাড়িয়ে যেতে থাকে তবে সামনে যে খুব ভাল কিছু অপেক্ষা করছেনা এটা নিয়ে আবিরের মত সেও খুব দুশ্চিন্তায় আছে। ভাবনার স্বেচ্ছাচারিতার কথা সে ভুলে যায়নি। ভাবনা তার চাকরী করার জন্য আবিরকে ছেড়েই বাসা নিয়েছিলো এখানে। সে তার ইচ্ছেমত এটা সেটা কেনাকাটা করে। আবিরকে জানানোর প্রয়োজন মনে করেনা। এতদিন তো তবু সহ্য করা গেছে কিন্তু এখন যে ভাবনা তার নিজের বানানো নিয়মনীতি এই সংসারে প্রয়োগ করতে শুরু করবে এতে আর বেশি দেরী নেই। আবিরের জন্য খুব মায়া হচ্ছে তার মায়ের। এতদিন আবিরের এই সংসারে যাও ক্ষমতা ছিলো এখন তাও হারাবে। এমন করে মূল্যহীন হয়ে কীভাবে পুরো জীবন কাটবে তার ছেলের? কতদিন ধরে সে ভাবনাকে বলছে আরেকটা বাচ্চা নিতে সেদিকে কোনো কান নেই তার বউয়ের। তার নাকি এই একটা মেয়ে হলেই চলবে! এ কেমন কথা! তার ছেলের বংশ বাড়াতে হবেনা। আসল কথা হচ্ছে চাকরী ছাড়তে হবে বাচ্চা নিলে তাই সে বাচ্চা নিতে চাচ্ছেনা। আবিরের চাকরী হয়েছে শোনার পর থেকে সে মনে মনে সারাদিন ভেবে রেখেছে ভাবনাকে এবার জোর করে ধরবে একটা বাচ্চা নেবার জন্য। মরার আগে একটা নাতীর মুখ দেখতে চায় সে। কিন্তু কোথায় কী? উলটো বউ যে খবর শুনিয়েছে তাতে এ জীবনে আর নাতীর মুখ দেখা হবে বলে তার মনে হচ্ছেনা। গতকাল রাতে মা বোনদের কাছে যেভাবে খুশি হয়ে হয়ে ফোনে তার প্রমোশনের কথা বলছিলো তাতে মনে হচ্ছে ভাবনা এখন হাওয়ায় ভাসছে। এই মুহূর্তে বাচ্চা নেবার জন্য বেশি জোরাজুরি করলে সংসার রেখেই না হাঁটা দেয় সেই ভয় এখন আবিরের মায়ের।

চলবে……

#নীলিমায়_কালো_মেঘ
#পর্ব_১০

“তোর বউ কি আর এমনি এমনি এত বড় পদে প্রমোশন পেয়েছে ? খোঁজখবর করে দেখ নিশ্চিত ওই ডিরেক্টর ব্যাটার তোর বউকে নিয়ে বদ মতলব আছে। ভাবি কোনো ট্রাপে পড়ার আগে ওখান থেকে সরিয়ে আন।”— বারবার মিজানের বলা কথাগুলি মাথায় ঘুরছে আবিরের। সত্যিই কি এমন কিছু ঘটছে ?
মিজান আবিরের পুরানো বন্ধু । মিজানের ইলেকট্রনিকস মালপত্রের দোকান আছে। আবির সুযোগ পেলেই মিজানের কাছে যেয়ে বসে। দু বন্ধু নানান ধরণের সুখ দুঃখের গল্পগুজব করে। নিজেকে হালকা করতে মিজানের কাছে ভাবনার প্রমোশনের কথা বলতেই মিজান এ কথা বলে উঠলো। মিজানকে তখন মুখের উপর ধমক দিয়ে থামিয়ে দিলেও তার মনের মধ্যে সেই থেকে খচখচ করছে। আসলেই তো রায়হান সাহেবের সাথে ভাবনার কোনো , নাহ! কিছুই ভাবতে পারছেনা আবির। ভাবনাকে সে পাগলের মত ভালোবাসে। আর ভাবনাও তাকে। ভাবনার প্রতি তার অগাধ বিশ্বাস। ভাবনা এমনটা যে কোনোদিনও করবেনা এটা সে জানে কিন্তু এই রায়হান সাহেবের কি ভরসা? খুব দুশ্চিন্তা হচ্ছে আবিরের। কিন্তু এসব কথা ভাবনার কাছে সে বলবে কী করে ? ভাবনা ব্যাপারটা যদি অন্যভাবে নেয়! সত্যিই ভাবনা যদি এমন কিছু করে তবে সে মরে যাবে। ভাবনাকে ছাড়া নিজেকে চিন্তাও করতে পারেনা আবির।

প্রায় দু’মাস কেটে গেছে। ভাবনার জন্য চিন্তা কিছুতেই কাটছেনা আবিরের। ভাবনার অফিসের সবাইকে নিয়ে পিকনিকের আয়োজন করা হয়েছে ।পুরো পরিবারের দাওয়াত। আবির ইচ্ছে করেই অফিসের দোহাই দিয়ে ভাবনার সাথে গেলোনা। ভাবনা খুব মন খারাপ করে শুধু তার মেয়েকে নিয়েই গেলো। আবির এতটা হীনমন্যতায় ভুগছে যে ভাবনার সাথে তার অফিসে যেতেও খুব বিবেকে বাধা দিচ্ছে। ভাবনার পাশে নিজেকে বড্ড বেমানান লাগে । ভাবনার অফিসের সবাই যাতে তাকে নিয়ে হাসাহাসি না করে তাই ইচ্ছে করেই ভাবনার সাথে গেলোনা আবির।

অফিসের একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে কথা বলার জন্য ভাবনা রায়হান সাহেবের কেবিনে প্রবেশ করল। ঢুকতেই দেখলো রায়হান সাহেবের মুড অফ।
– স্যার ,আমি কি ভুল সময়ে চলে এলাম ?
– নো , ইটস ওকে। বসুন । এনি এমার্জেন্সী?
– স্যার , একজন ক্লায়েন্টের ব্যাপারে কথা বলতে এসেছিলাম।
– হ্যা বলুন।
ভাবনা কথা শুরু করতে যাবে ঠিক তখন রায়হান সাহেবের ফোনটা বেজে উঠল।
– এক্সকিউজ মি!
– শিওর স্যার!
– হ্যা, আশা বল! আরে ভাই আমি সিরিয়াল না পেলে কি করবো বল! বললাম অন্য ডাক্তার দেখাও। দেশে কি নিওরোসার্জনের অভাব নাকি! উনাকে দেখাতে হলে এক সপ্তাহ আগে থেকে সিরিয়াল দিতে হয় সে তো তুমি জানোই । এমন করে হুট করে বললেই কি সিরিয়াল পাওয়া যায়? আমি কয়েক জায়গায় কন্ট্যাক্ট করেছি কিন্তু হচ্ছেনা। এখন কি করি বল! সকাল থেকে এ নিয়ে মুড খুব খারাপ ।আর তার উপর তুমি এভাবে প্রেসার ক্রিয়েট করলে কি করে হবে ? আব্বাকে বল কিছুদিন এখানে থাকতে। এর মধ্যে আমি ব্যবস্থা করতে পারব। এই সুযোগে নাতীদের সাথে ক’টা দিন বেড়ানো হবে। আচ্ছা রাখছি। দেখি কি করা যায়! কোনো ব্যবস্থা হলে আমি তোমাকে ফোন দিবো ।
কথা শেষ করে রায়হান সাহেব বললেন, এক্সট্রিমলি সরি! আপনাকে বসিয়ে রেখেছি। এবার বলুন

– ইটস ওকে স্যার! নো প্রবলেম। কার সিরিয়াল পাচ্ছেন না?
– আর বলবেন না। আমার শশুরের জন্য। উনার ব্রেইন স্ট্রোক হয়েছিলো বেশ কয়েকবছর আগে। সেই থেকেই ক্ষ্যাপা মেজাজের মানুষ। আগে স্থানীয় একটা কলেজের প্রিন্সিপাল ছিলেন। এমনিতেই কড়া মেজাজের মানুষ আর এখন তো পুরাই সোনায় সোহাগা। আমার বাসায় এলে উনার ভয়ে আমার বাসার কাজের মানুষ থেকে শুরু করে সবাইই ভয়ে থরথর করে কাঁপতে থাকি। কখন না কাকে কোন বেফাঁস কথা বলে ফেলে। এখানে আসলে সর্বোচ্চ দু’দিনের বেশি থাকেন না। উনি রেগুলার যে ডাক্তারের ফলো আপে থাকেন প্রতিবার দেখানো শেষ করে পরের বারের সিরিয়াল দিয়ে যান। কিন্তু এবার সমস্যা ফিল করায় আগেভাগেই চলে এসেছেন। এসেই ডাক্তারের সিরিয়ালের জন্য মেয়ের সাথে ভাঙচুর শুরু করার মত অবস্থা করেছে। তাছাড়া আমার মিসেসকেও এবার একটু উনাকে দেখাতে হবে । আমার সেকেন্ড বেবিটা হওয়ার পর থেকে ও নানান ধরণের সমস্যা ফিল করছে। মাইগ্রেনের সমস্যা মনে করে মেডিসিন খাচ্ছে কিন্তু তেমন ইম্প্রুভ হচ্ছেনা। তাই ভাবছে উনাকেই দেখাবে। একসাথে কাজ হয়ে যাবে। তাছাড়া উনি খুব ভালো ডাক্তার। আমার শশুরের তো এমন অবস্থা হয়েছিলো উনি বাঁচবে বলেই কেউ আশা করিনি। চিটাগং থেকে একদম মরার মতই নিয়ে এসেছিলাম । উনার ট্রিট্মেন্টে আল্লাহর রহমতে এখন পর্যন্ত আছে আমাদের মাঝে। কিন্তু ঝামেলা হচ্ছে উনার সিরিয়াল পাচ্ছিনা। বারবার ফোন দিয়েও লাইন বিজি পাচ্ছি। আর ডাক্তারের নাম্বার তো পাচ্ছিইনা। এদিকে আমার শশুর তো বোঝার পাত্র না। সে এই ডাক্তারই দেখাবে। তা কীভাবে কী হবে সে নিয়ে মাথাব্যথা নেই। বললাম অন্য ডাক্তার দেখাই আপাতত। সপ্তাহ খানেক পরেই উনাকে দেখাবেন না হয় আরেকবার। কিন্তু নাহ! সে নাছোরবান্দা!
– মুরুব্বীরা এমনই। বাচ্চাদের মত জিদ ধরে। এখানে উনাদের কোনো দোষ নেই। বয়সটাই এমন! তাছাড়া উনি হয়তো ওই ডাক্তারকে ভরসা পায় তাই অন্য কাউকে দেখাতে সাহস পাচ্ছেন না।
– সবই বুঝতে পারছি। কিন্তু এখানে আমার কি করার আছে বলুন! আমি আমার মত করে চেষ্টা করেছি। কিন্তু সিরিয়ালই দিতে পারছিনা । উনি আজ বা কালের মধ্যেই দেখাতে চাচ্ছেন।
– স্যার ,কিছু মনে না করলে কোন ডাক্তারকে দেখাচ্ছেন জানতে পারি কি?
– অবশ্যই! আপনি নাম শুনে থাকবেন উনার । নিওরোসায়েন্স হসপিটালের ডাক্তার উনি, ডঃ আতাউর রহমান। আমরা অবশ্য উনার এলিফ্যান্ট রোডের চেম্বারে দেখাই। হসপিটালে তো উনাকে সেভাবে পাওয়াই যায়না। এত বড় সার্জন। ব্যস্ত থাকেন খুব।
– ভাবনা মৃদু হেসে বলল, এখন চারটা বাজে তাইতো! উনি এখন মে বি বাসায় আছেন ।
– স্ট্রেঞ্জ! আপনি কী করে জানেন?
– দেখছি স্যার!

ভাবনা ফোন বের করে তার বড় বোনকে ফোন দিল। কয়েকবার রিং বাজতেই ওপাশ থেকে উত্তর এলো।

– হ্যা ভাবনা বল!
– আপি, দুলাভাই কই এখন?
– এই তো বাসাতেই আছে এখনো । একটু পরেই বের হবে ।কেনো রে?
– একটু দুলাভাইর কাছে দে তো! কথা আছে।
– আচ্ছা, দাঁড়া !দিচ্ছি।

প্রায় মিনিটখানেক বাদে ওপাশ থেকে ভাবনার দুলাভাই রেস্পন্স করলো।

– হ্যা ছোট গিন্নি, বল! এই অবেলায় দুলাভাইকে মনে পড়লো কেনো! আজকাল তো তুমি মহাব্যস্ত ! এতবড় কোম্পানীর এসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার। আমাদের সাথে কথা বলার সময় কই!
– কি যে বলেন না , দুলাভাই! একটা হেল্প লাগবে এজন্য ফোন দিয়েছি। না করতে পারবেন না ,কিন্তু।
– কি হেল্প বল! তুমি হেল্প চাইলে না করতে পারি! সাধ্যের মধ্যে চেও কিন্তু। আবার লজ্জায় ফেলে দিওনা ।
– সাধ্যের বাইরে নয় অবশ্যই। আপনি চিন্তামুক্ত থাকতে পারেন।
– ঠিক আছে ,বল তবে।
– আমাদের ডিরেক্টর স্যারের শশুর আপনার পেশেন্ট। উনি চিটাগং থেকে আসেন। বহুদিন ধরে আপনাকে দেখাচ্ছেন। উনার সিরিয়াল আরো পনেরো দিন পরে দেওয়া। কিন্তু হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় আবার ঢাকাতে এসেছেন আপনাকে দেখাতে। কিন্তু সমস্যা আপনার সিরিয়াল পাচ্ছেনা। স্যারের ওয়াইফকেও নাকি দেখাবে। এখন কেমনে আজ দেখাবে সেই ব্যবস্থা করে দেন, প্লিজ।
– কিন্তু গিন্নী , রুলস ব্রেক করি কীভাবে? রোগী যে কজন দেখি তা তো ফিল আপ।
– সে আমি জানিনা। উনি আপনাকে ছাড়া অন্য কাউকে দেখবেনা। আজ না হয় দু জন বেশি দেখলেন। আপনি আপনার সেক্রেটারি টিপু ভাইকে ফোন দিয়ে বলেন আজ আর দুইজনের নাম লিস্টে আনতে । আপনি অনুমতি দিলে আমি টিপু ভাইকে উনাদের নাম লিস্ট করতে বলছি।
– উমমম! আচ্ছা, বলে দাও । আমি টিপুকে বলে দিচ্ছি। তুমি উনাদের নাম রেজিস্টার করে দাও। আজ নির্ঘাত তোমার আপির হাতে মার খেতে হবে। এমনিতেই প্রতিরাতে দেরী করে আসার জন্য তোমার আপা আর ভাগ্নে দুইজনের কাছে বকাঝকা খেতে খেতে জীবন তেজপাতা। আরো দেরী করে ফিরবো জানলে কি হবে বুঝতে পারছো!
– হাহাহা! আমি আপিকে বলে দিবো । আপনি টেনশনমুক্ত হয়ে রোগী দেখেন আজ। তবে অন্যদিন অবশ্যই করতে পারবোনা কিন্তু। তাই বাসায় একটু তাড়াতাড়িই ফিরবেন আশা করছি। এত টাকা পয়সা দিয়ে কী হবে বলেন। অনেক হয়েছে এবার একটু রাইয়ান ,রিদওয়ানের সাথে সময় কাটান । ওরা অনেক মিস করে আপনাকে।
– হুম! বুঝতে পেরেছি সব এক পাল্লার লোক।
– হাহাহা। রাখছি তবে দুলাভাই। অনেক ধন্যবাদ। দেখা হবে তাড়াতাড়ি। আল্লাহ হাফেজ।
ভাবনা ফোন রেখে বলল, স্যার ব্যবস্থা হয়ে গেছে । আপনি আংকেলের আর ম্যাডামের নাম আর ফোন নাম্বারটা লিখে দেন আমি এখনি সিরিয়াল দিয়ে দিচ্ছি ।

– উনি আপনার কি হন? কিছুটা অবাক হয়ে বললেন রায়হান সাহেব।
– আমার বড় দুলাভাই।
– আপন দুলাভাই?
– জী স্যার! আমরা তিন বোন । আমি সবার ছোট ।
– মাই গড! সমাধান এত কাছে আর আমি হা হুতোশ করে মরছি। অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে। কি বাঁচা যে বাঁচালেন ! আমার শশুর আমাকে পাগল করে ফেলছে একদম। আমি তো খুব চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম এই নিয়ে। আজকে বাসায় যাবো কি করে সে চিন্তায় অস্থির ছিলাম। উনাকে আমি খুব ভয় পাই। যাই হোক বেঁচে গেলাম। আপনাকে ধন্যবাদ দিলেও আপনার উপকারের প্রতিদান দেওয়া শেষ হবেনা। আমি এখনি আমার ওয়াইফকে জানাচ্ছি । আপনি এই নাম রেজিস্ট্রি করে দেন।
– এ আর এমন কি স্যার! এভাবে লজ্জা দিবেন না , প্লিজ! আপনার উপকারে আসতে পেরেছি এটা সত্যিই আমার ভাগ্য।
– থ্যাংক ইউ সো মাচ।

আগামীকাল আবিরের জন্মদিন। ভাবনা মনে মনে ভেবে রেখেছে আজ অফিস ছুটি হলে আবিরসহ ঘরের সবাইকে নিয়ে কোনো ভালো রেস্টুরেন্টে ডিনার করবে। আগে কোনোকিছু জানালো না সে আবিরকে । পরেরদিন খুব তাড়াতাড়ি অফিস থেকে বেরিয়ে সে তার শাশুড়ি, কুহেলী আর জারাকে নিয়ে রেস্টুরেন্টে পৌঁছে গেলো। আবিরকে ফোন দিয়ে জানালো সেখানে আসতে। কিছুক্ষণের মধ্যে আবির পৌঁছে গেলো। ভাবনা তাকে আগে কিছুই জানায়নি। আবির এতবড় রেস্টুরেন্টে সবাইকে দেখে বেশ অবাক হয়ে যায়। ভাবনা আগেই টেবিল বুকিং দিয়ে রেখেছিলো। ভাবনা খেয়াল করলো আবির এত আয়োজন দেখে সারপ্রাইজ হবার পরিবর্তে কেন যেন খুব বিরক্ত বোধ করছে। আবির পৌঁছাতেই তাদের টেবিলে বেশ সুন্দর একটা কেক এসে পৌঁছালো। আবিরের সব কিছুতেই কেমন বিরক্তি! মুখে প্রকাশ না করলেও ভাবনা ব্যাপারটা অনুধাবন করতে পারছে। কোনোরকম করে খাবার দাবার শেষ করে তারা বাসায় আসলো।
আবির তেমন বেশি কথাবার্তা বলছেনা ভাবনার সাথে। রাতে ঘুমানোর আগে আগে ভাবনা আলমারী থেকে একটা শপিংব্যাগ বের করে আবিরের হাতে দিলো।

– কি আছে এর ভেতরে?
– খুলেই দেখোনা!
– তুমিই খুল।
– আশাহত মনে ভাবনা খুলে বলল, একটা শার্ট আর একটা টাই। পরে দেখনা সব ঠিক আছে কিনা! কালার পছন্দ হয়েছে তোমার?
– খুব ঘুম আসছে ভাবনা। সারাদিন তোমার মত এসি কেবিনে বসে কাটানোর সৌভাগ্য কই আমার। কাস্টমার হ্যান্ডেল করতেই সময় চলে যায় । তার উপর আজ এত দেরী হলো বাসায় ফিরতে। এখন এসব ভালো লাগছেনা। প্লিজ!
– এভাবে কেনো বলছো? তোমার জন্য একটা গিফট এনেছিলাম। দেখতো ঠিকঠাক আছে কিনা!
– রেস্টুরেন্টে এত টাকা খরচ করলে আবার গিফট কেনো? নাকি ক’দিন আগে তোমার বার্থডে তে আমি কিছুই করতে পারিনি সেটা মনে করিয়ে দিচ্ছো?
– আবির! এসব কি বলছো? আমি সেই রেস্টুরেন্টে বসেই খেয়াল করেছি তুমি খুব বিরক্তিভাব দেখাচ্ছো। আমি কি এমন করেছি? আমি কি তোমার বার্থডে একটু স্পেশাল করে সেলিব্রেট করতে পারিনা।
– হ্যা পারো। তবে আমাদের স্ট্যাটাসের সাথে মিল রেখে। এতগুলি টাকা খরচ করে অমন রেস্টুরেন্টে যাবার দরকার কি ছিলো? তার উপর আবার এত দামী পোশাক আর টাই এনেছো।
– টাকাটা তো আমিই দিয়েছি তাইনা! তবে তোমার সমস্যা কোথায়?
– ইয়েস! এটাই আমার সমস্যা। তুমি যে এভাবে কথায় কথায় টাকার গরম দেখাও এগুলি আমার পছন্দ না। এই যে দামী শার্ট আর টাই নিয়ে এসেছো এটা পরে যাবার মত জায়গা আমার নেই। এগুলি না হলেও চলতো। এই দামে আমি তিনটা শার্ট কিনতে পারতাম অনায়সে।
– আবির! আমার মন চেয়েছে তাই কিনেছি। আমি কি আমার পছন্দের কিছু তোমাকে গিফট করতে পারিনা?
– হ্যা পারো! তবে আমাদের সামর্থ্যের বাইরে না অবশ্যই। আজকাল তোমার খরুচে হাত যেভাবে চলছে এজন্য সাবধান করলাম।
– আমি তো লোন করে কিছুই কিনিনি। তাহলে অন্যায় কোথায়?
– অন্যায় তোমার না। অন্যায় আমার। আমি এখন ঘুমাবো ,প্লিজ! আমি খুব টায়ার্ড । বলতে বলতেই শার্টের প্যাকেট টা ছুড়ে ফেলার মত করেই চেয়ারের উপর রেখে সে মশারীর মধ্যে ঢুকে গেলো।
আবিরের এমন আচরণ দেখে ভাবনার দু’চোখ বেয়ে ফোয়ারা নামলো । আবির এমন কেনো হয়ে যাচ্ছে দিনদিন? ভাবনার চোখের কোনা বেয়ে ঝরঝর করে পানি ঝরে পড়ার আগেই খুব গোপনে ওড়নার আঁচলে মুছে নিলো। সুযোগ পেলেই আবির তাকে নানান ভাবে খোঁচা মারা কথা বলে। ভাবনা সব হজম করে নীরবে। ভাবনার শাশুড়িও একইভাবে ছেলের মত কথাবার্তা বলে।

সেদিন খাবার টেবিলে জারা ইলিশ মাছ খাবার খুব আবদার করছে। ইলিশ ওর খুব পছন্দ। বিশেষ করে ইলিশের ডিম হলে জারার আর কিছুই লাগেনা। মাস পেরিয়ে গেছে ঘরে ইলিশ আনা হচ্ছেনা। এখন ইলিশের সিজন না তাই আশেপাশে ইলিশ পাওয়া যাচ্ছেনা তাছাড়া দামও বেশ চড়া। বাজারের দায়িত্ব আবিরের উপর। ভাবনার কখনো এদিকটা দেখতে হয়না। মেয়ের আবদারের ব্যাপারটা মাথায় রেখে অফিস থেকে ফেরার পথে সুপারশপে ঢুকলো।
ইলিশের দাম সত্যিই খুব চড়া। একটু ডিম আছে এমন ধরণের মাছের হালি চার হাজারের উপর। এক হালিই আছে। ভাবনা পার্স চেক করে দেখলো হাজার পাঁচেক এর মত টাকা আছে। সে চারটা মাছই নিল। তাছাড়া ইলিশ মাছ জারার মত আবির আর তার শাশুড়িরও খুব পছন্দ। তাই ইচ্ছে করেই এক হালি মাছ কিনলো।
বাসায় ফিরে দেখলো আবির রান্নাঘরে ঘুটুরঘাটুর করছে। ভাবনা সরাসরি রান্নাঘরে চলে গেলো মাছ রাখার জন্য। সিংকের উপর ব্যাগটা রেখে আবিরকে বলল, কী ব্যাপার তুমি এখানে কি করছো? আমেনা খালা কোথায়?
– উনার ছেলে অসুস্থ। তাই রাতে আসবেনা। ফোন করে জানিয়ে দিয়েছে।
– আচ্ছা সরো তবে। আমিই দেখছি।
– তুমি চেঞ্জ করে আসো।
– হুম। আসছি তবে।
ভাবনা রান্নাঘরে ঢুকে দেখল আবির মাছগুলি নাড়িয়ে চাড়িয়ে দেখছে।
– কেমন কিনলাম? ঠকিনি তো!
– ভালোই। তবে এগুলি ছয়শো টাকা পিসের বেশি হবার কথা নাহ! এত দামে কেনো নিয়েছো?
– জারা আবদার করলো তাই নিয়ে এলাম।
– তাই বলে এতগুলি? এই টাকাতে তো বলা যায় সারা মাসের মাছ বাজার হয়ে যায় আমাদের। তাছাড়া জারা মাছ খেতে চেয়েছে আমিও শুনেছি। আমি কি পারতামনা আমার মেয়ের জন্য মাছ আনতে? আমি শুক্রবারে নিয়ে আসতাম। এখানে মহল্লার বাজারে এখন ইলিশ বেচেনা। ছুটির দিন ছাড়া তাই সম্ভব না মাছ কেনা।
– জারা কি আমার মেয়েনা? আমি কি মাছ এনে অন্যায় করেছি?
– অন্যায়ের কথা কেনো ? এত দাম দিয়ে সুপারশপ দিয়ে কেনার কী দরকার? ওরা দরকারের থেকে সবসময় বেশি দাম নেয় ।
– সমস্যা হয়নি তো! আমি ম্যানেজ করেছি। আমার পার্সে টাকা ছিল তাই নিয়ে এলাম।
– হুম, ম্যানেজ তুমি করেছো সেকথা তো জানি। তোমার পার্সে আজকাল চকচকে নোট থাকে যখন খুশি সবই করতে পারো । ঠিক আছে আমি গেলাম। তখনই তিনটে মাছ ফ্রিজে রেখে সে একটা মাছ কেটেকুটে রান্না করলো। জারা মাছের ডিম পেয়ে সে কি খুশি! আবিরের প্লেটে এক টুকরো মাছ তুলে দিতে যেতেই আবির প্লেট সরিয়ে নিলো। ভাবনার খুব খারাপ লাগছে আবিরের এমন আচরণে। সে নিজেও অভিমানে তার প্লেটের টুকরো বাটিতে তুলে রাখলো।

ভাবনা আবিরের কথার আর এমন আচরণের অর্থ ঠিকই বুঝেছে। আবির ঘরের বাজার সদাইয়ের দায়িত্ব নিয়েছে আর ভাবনা বাসা ভাড়া দেয়। মাঝেমাঝে ভাবনা টুকটাক বাজার সদাই করলে আবিরের কেন যেন খুব লাগে। ভাবনা ব্যাপারটা বুঝতে পারে কিন্তু না বোঝার ভাণ করে এড়িয়ে যায়। আবির সবকিছু খুব মেপেমেপে কিনে। হাত খুলে খরচ করা সম্ভব নয়। তার উপর কাজের বুয়ার রান্নাবান্না। ভাবনা নিজে থেকে এটা সেটা নিয়ে আসে। এটা আবিরের মায়ের চোখে পড়লে ছেলের কানে পৌঁছে দেন সময়মতই। এটা নিয়ে আবির শুরু হয়ে যায় ভাবনার সাথে।
আবিরকে ছোট দেখাতে নাকি ভাবনা এসব করে। ভাবনা কোনোভাবেই আবিরের এমন আচরণকে শোধরাতে পারছেনা আবার মেনে নিতেও পারছেনা। মনে মনে শুধু ছটপট করছে সে।

আজ অফিসে ঢুকতেই পিয়ন এসে জানালো রায়হান সাহেব তাকে কেবিনে ডেকেছে। ভাবনার খুব ভয় হলো এত সকালে তো কোনোদিন ডাকেনা। আজ কেনো? কোনো ভুল করে বসেনি তো সে?

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here