#নীলিমায়_কালো_মেঘ
#পর্ব_৭+৮
অফিসের নোংরা চালে চাকরিটা চলেই গেলো ভাবনার। কিছুই করার নেই তার। কার কাছে যাবে বুঝতে পারছেনা সে। অফিসের কেউই যে তাকে কোনো সাহায্য করবেনা এটা সে ভালোভাবেই বুঝতে পারছে। তাকে সাহায্য করার চক্করে নিজেরা বিপদের মধ্যে জড়াতে চাইছেনা কেউই ।
খুব কষ্টে থমথমে মুখ নিয়ে বাসায় ফিরলো সে। মাথায় শুধু একটা চিন্তাই ঘুরপাক খাচ্ছে আবিরকে কি করে বলবে সে? আবির নিজের চাকরি হারিয়ে এমনিতে দুনিয়ার টেনশনে আছে। এর মধ্যে নতুন করে এই খবর কী করে সে বলবে? পুরো পৃথিবীটা অন্ধকার লাগছে তার কাছে। কীভাবে চলবে তার সংসার?
এতদিন চাকরি করেছে ঠিকই কিন্তু জমাতে পারেনি তেমন কিছুই। সংসারের জন্য এটা সেটা কিনতে যেয়ে হাত একদমই খালি। এমন পরিস্থিতি হবে সে ভাবতে পারেনি কখনই। এত তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরেছে দেখে ভাবনার শাশুড়ি খানিকটা অবাক হলেন।
– বউমা, এত তাড়াতাড়ি ফিরলে যে?
– মা, শরীরটা ভালোনা। তাই চলে এসেছি। আবির তো ফেরেনি তাইনা?
– নাহ! প্রতিদিনই বের হয় ।না জানি কই কই ঘোরে ছেলেটা? জায়নামাজে বসে এত দোয়া করছি আল্লাহ কি এই মায়ের ডাক শুনছেনা? ছেলেটা এমন উদ্ভ্রান্তের মত পথে পথে ঘুরে । না জানি কবে এই কষ্টের দিনগুলি শেষ হবে ওর?
– ভাবনা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, দোয়া করেন। নিশ্চয়ই খুব তাড়াতাড়ি এর অবসান হবে, ইনশাআল্লাহ!
– আল্লাহ জানেন। যাও হাত মুখ ধুয়ে নেও ।
– আচ্ছা, মা।
ভাবনা রুমে ঢুকে ওয়াশরুমে যেয়ে অঝোর ধারায় কাঁদছে। কি হবে কিছুই বুঝতে পারছেনা। চাকরি হারানোর কষ্টের চাইতে মাসুদ সাহেব তাকে পুরো অফিসের সামনে যেভাবে অপমান করেছে সেটাকে সে ভুলতেই পারছেনা। আর অফিসের বাকি সবাই মুখ টিপে হেসে হেসে তাকে নিয়ে যে তিরস্কার করেছে সেগুলি খুব উপভোগ করেছে যেন অফিসের সবাই! চোখের সামনে শুধু সেগুলিই ভাসছে তার। কিছুতেই ভুলতে পারছেনা সে। ট্যাপ ছেড়ে দিয়ে কতক্ষণ কেঁদেছে নিজেরই হুশ নেই । হঠাৎ ওয়াশরুমের দরজায় কেউ নক করছে দেখে তাড়াতাড়ি নাকেমুখে পানি দিয়ে সে বের হলো।
– আবির, তুমি কখন এলে?
– এসেছি বেশ কিছু সময় আগে। আধঘণ্টার বেশি তো নিশ্চয়ই হয়েছে। এসেই দেখছি তুমি ওয়াশরুমে। মায়ের কাছে শুনলাম বাসায় এসেছো । শরীর নাকি খারাপ! কি হয়েছে তোমার নাক চোখ ফোলা কেনো ?
– ভাবনা ধরা পড়ার ভয়ে তাড়াতাড়ি করে বলল, কই তেমন কিছুনা তো? এই সাইনাসের সমস্যাটা বেড়েছে । মাথা চোখ ব্যথা হচ্ছিলো খুব তাই চলে এসেছি। ভয়ের কিছু নেই।
– তুমি কি আমার কাছে কিছু লুকাচ্ছো, ভাবনা?
– আরে নাহ কি লুকাবো? বাবুকে আনতে গেলেনা?
– জারা ওর নানুর কাছে যাবে আজকে। বেশ কিছুদিন ধরে যাচ্ছেনা তাই নানুর কথা মনে পড়ছে। তাই ওই বাসাতে দিয়ে এসেছি। আমি তো বলে এসেছি তুমি অফিস থেকে আসার পথে নিয়ে আসবে।
– আচ্ছা, তবে থাকুক । পরে নিয়ে আসবো। দেখি দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করি।
– তোমাকে করতে হবেনা। আমি করেছি। রেস্ট নাও ।আমি তোমার খাবার এখানে নিয়ে আসছি।
ভাবনা আর কথা বাড়ালোনা। সেও চাচ্ছে আবিরের সামনে থেকে পালাতে। যাক, এই সুযোগে কিছু সময় একা থাকতে পারবে সে। আবির বেরিয়ে যাবার পরে ফোনটা হাতে নিতেই দেখলো ম্যানেজার সাহেবের দুইটা মিসড কল। বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠলো তার।
তাড়াতাড়ি করে ব্যাক করতেই দেখলো ফোন বিজি। কিছুক্ষণ ধরে ট্রাই করেও পাচ্ছেনা। বারবার লাইন বিজি দেখাচ্ছে। অফিসে বসে তো দু’বার ফোন দিয়েছিল সে কিন্তু ফোন বন্ধ বলছিল বারবার। আর এখন আবার বিজি বলছে । প্রতিটি মুহূর্ত যেন তার কয়েক ঘণ্টার কত মনে হচ্ছে। বারবার দিয়েও পাচ্ছেনা বলে মনে হচ্ছিলো যেন দম আটকে আসছে তার।
চেষ্টা করতে করতে অবশেষে ফোনের লাইন পেলো। ম্যানেজার সাহেব খুব বেশি কথা বললেন না ভাবনার সাথে। শুধু বলল, “আগামীকাল এগারোটা থেকে বারোটার মধ্যে যেকোনো সময় একবার দেখা করবেন আমার রুমে এসে। “
ভাবনা আর কিছু বলার সুযোগ পেলোনা। সত্যিই কি ম্যানেজার সাহেব তাকে মাসুদ সাহেবের বিরুদ্ধে ইউস করেছে ? বুঝতে পারছেনা সে। আগামীকাল অফিস আওয়ারে যেতে না বলে এগারোটা বারোটার মধ্যে যেতে বলেছে কেনো ? তবে কি চাকরিটা আর পাচ্ছেনা সে? হয়তো কিছু টাকা কম্পেন্সেশান বাবদ ধরিয়ে দেবার জন্য ডেকেছে তাকে? কিছুই ভাবতে পারছেনা ভাবনা। কি হবে ? কীভাবে চলবে তার সংসার? তার মেয়ের পড়াশোনার কি হবে?
ভাবনার এমন মানসিক অস্থিরতা দেখে আবির বারবার জিজ্ঞেস করছে কোনো সমস্যা হয়েছে কিনা! ভাবনা জানালো , এই সামান্য শারীরিক সমস্যা ছাড়া আর কিছু না। ঠিকমত ঘুম হলে ঠিক হয়ে যাবে।
কিন্তু রাতে দু চোখের পাতা এক করতে পারছেনা সে। সারারাত না ঘুমিয়ে এপাশ ওপাশ করে কাটিয়ে দিলো ।
ফজরের নামাজের পর কিছুটা ঘুম আসলো। আটটা বেজে যাবার পরেও সে উঠছেনা দেখে আবির ডেকে তুললো।
– কি ব্যাপার? শরীর কি বেশি খারাপ? আজ আর অফিসে যাবেনা?
– না, এখনো একটু সমস্যা লাগছে। আজ দশটার দিকে বেরুবো।
– আজ না হয় ছুটি নাও।
– না, সম্ভব নাহ। যেতে হবে।
– আচ্ছা, তাহলে আর ঘন্টাখানেক ঘুমিয়ে নাও।
ভাবনা অফিসের সামনে এসে আর যেন সামনে এগুতে পারছেনা। পা চলছেনা তার। কী হবে কি জানে! কি বলার জন্য ডেকেছে তাকে? অফিসের বাকিদের সামনে মুখ দেখাবে কি করে সে? কলিজা শুকিয়ে আসছে যেন!
ভাবনা সরাসরি সাত তলাতে ম্যানেজার সাহেবের রুমে চলে গেলো। কারো চোখে পড়তে সাহস হচ্ছেনা তার। ম্যানেজার সাহেবের রুমে যেতেই বললেন , “কিছুক্ষণ ওয়েট করতে।“
ভাবনা আধঘণ্টা যাবত অপেক্ষা করছে। খুব ভয়ে আছে মাসুদ সাহেবের নজরে আবার না পড়ে। পাশের কেবিনেই মাসুদ সাহেব বসেন।
আধাঘন্টা পরে ম্যানেজার সাহেব এসে বললেন, চলুন!
– কোথায়?
– নবম তলায়। রায়হান সাহেবের রুমে। উনি অপেক্ষা করছেন আপনার জন্য।
ভাবনার বুকের মধ্যে কেঁপে উঠলো । কি করবে তার সাথে? তাকে কি থেকে ফায়ার করা হবে? রায়হান সাহেবের সাথে এর আগে কখনো সরাসরি কথাবার্তা বলা হয়নি তার। উনি খুব মেপে মেপে কথা বলেন যে কারো সাথে। এতবড় মানুষের সাথে কি বলবে সে?
মিনিট দশেক অপেক্ষা করতেই ভেতরে যাবার অনুমতি মিললো ভাবনার। ম্যানেজার সাহেব ভেতরেই আছেন।
বুক দুরুদুরু করে কাঁপছে শুধু। মনে মনে বারবার আল্লাহর নাম জপছে সে।
– মে আই গেট ইন ,স্যার?
– ইয়েস !
ভাবনা ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলো।
– সিট ডাউন ,প্লিজ।
– থ্যাংক ইউ!
– আপনার সম্পর্কে সবকিছুই শুনলাম । এখন আপনার দিক থেকে বলার কিছু আছে?
– স্যার , আমি নির্দোষ। আমি শুধু সত্যিটাকে সামনে এনেছি। সত্যি কথা বলা যদি অন্যায় হয়ে থাকে তাহলে সত্যিই খুবই দুঃখিত ।
– আপনি কি জেনে বুঝে মাসুদ সাহেবের নামে কথাগুলি তুলেছেন? উনার পরিচয় সম্পর্কে জানা আছে তো আপনার?
– জী স্যার। উনি আমাদের এমডি স্যারের ভালো বন্ধু সে আমি জানি। কিন্তু তাই বলে তার অন্যায়গুলিকে তো আমি দেখেও না দেখার ভাণ করতে পারিনা। বাকী সবাই পারলেও আমার পক্ষে সম্ভব নাহ! আমি সত্যকে সত্য বলতে ভয় পাইনা। উনার কারণে কোম্পানীর এত বড় ক্ষতি আমি কিভাবে দেখেও চুপ করে থাকব, বলুন?
ভাবনা অবাক হচ্ছে নিজের কথা নিজের কানে যেতেই । কিছুক্ষণ আগেও তার বুকের মধ্যের ধুকধুক শব্দে নিজেই বিরক্ত হয়ে গিয়েছিলো। অথচ এখন সব গায়েব। ভয় ডর সব কিছুই নেই।
খানিকক্ষণ ভাবনার মুখের দিকে তাকিয়ে রায়হান সাহেব বললেন,
– ব্রাভো, আপনার সাহস আছে। আপনার মত সাহসী ইমপ্লয়ীই আমার প্রয়োজন। মাসুদ সাহেব আমাদের অনেক পুরানো ইমপ্লয়ী। ইমপ্লয়ী বললেও ভুল হবে। উনি আমাদের ফ্যামিলি মেম্বারের মতই। উনার বিরুদ্ধে আঙ্গুল তুলেছেন আপনি।
– স্যার, আমি কি ভুল করেছি?
– না, ভুল করেন নি। অফিসে সবাই সমান। কে আত্মীয় কে আত্মীয় না এসব চিন্তা করলে ব্যবসায় সম্ভব না। উনার বিরুদ্ধে অনেক আগে থেকেই অভিযোগ এসেছে কিন্তু কেউ যথাযথ প্রমাণ দেখাতে পারেনি।
যাই হোক ,যা হয়েছে , হয়েছে। আপনি সঠিকভাবে আপনার কাজ করেন। আপনার চাকরি নেবার মাসুদ সাহেব কেউ না। দেখি উনার ব্যাপারে কি করা যায়!
– কিন্তু স্যার, মাসুদ সাহেব যদি কোনো ঝামেলা করেন? আপনি তো সবসময় থাকেন না।
– আচ্ছা, বসুন। আমি মাসুদ সাহেবকে ডেকে নিচ্ছি। আপনার সাথে কথাবার্তা বলিয়ে দেই। যাতে এরপরে আপনাদের মধ্যে আর কোনো প্রবলেম না হয়!
ভাবনা মাসুদ সাহেবের নাম শুনেই কেমন ইততস্তবোধ করছে। কালকের কথাগুলি শুধু মনে পড়ছে। এতোটা অপমান জীবনে কোনোদিন হয়েছে কারো কাছে মনে পড়ছেনা তার! আবার এই লোকের সাথে কথা বলতে হবে ভেবেই ভয় হচ্ছে তার!
– আসতে পারি ?
– হ্যা আসুন।
ভেতরে ঢুকে ভাবনাকে দেখে মাসুদ সাহেবের চোখ চড়কগাছ। এই মেয়ে আবার এসেছে? নিশ্চয়ই তার নামে ইনিয়ে বিনিয়ে নানান কথা অভিযোগ করেছে। করুক যেয়ে। এসব মেয়েদের ভয় পাওয়ার কি আছে?
– মাসুদ সাহেব, শুনলাম ভাবনার সাথে নাকি আপনার কিসব ঝামেলা হয়েছে?
– বাবা, আমি আসলে….
কথা শেষ হবার আগেই রায়হান সাহেব বলে উঠলেন , এটা অফিস। কথাবার্তা বলার আগে চিন্তাভাবনা করে বলবেন । যাই হোক, আপনার নামে আমি আগেও বেশ কয়েকবার অভিযোগ পেয়েছি । কিন্তু আমলে নেইনি। আপনি আমাদের পুরানো এবং অভিজ্ঞ ইমপ্লয়ী ।আপনার কাছে এমন কিছু আশা করিনি। আপনার জায়গায় অন্য কেউ হলে অনেক আগেই চাকরী হারাতে হতো। আশা করছি এখন থেকে সাবধান হয়ে কাজ করবেন । এমন কোনোকিছু আমি আর দেখতে বা শুনতে চাইনা।
– আপনি আমাকে ভুল বুঝছেন। ইনি সম্পূর্ণ মনগড়া কাহিনী দিয়ে আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন। নিশ্চয়ই অন্য কেউ ইনাকে উসকে দিয়েছে আমার বিরুদ্ধে। না হলে এত সাহস পায় কীভাবে? গতকাল অফিস থেকে বের করে দেবার পরেও আজ আবার কোন মুখে এসেছে?
– আপনি উনাকে বের করে দেবার কে? আপনি নিজেও যেমন এখানের একজন ইমপ্লয়ী তেমনি উনিও। উনাকে ফায়ার করার রাইট আপনার নেই।
– স্যার, আপনি পুরো কাহিনীটা প্লিজ, শুনুন। উনি অফিসের সবার সামনে আমাকে ছোট করেছে। তাই আমি উনার দুঃসাহস দেখে এমন পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়েছি।
– ছোট করার মত কাজ কেনো করেন? তাছাড়া গতকালের সম্পূর্ণ কথাবার্তা আমি ভিডিওতে দেখেছি। আপনি কাল যেসব কথা উনাকে বলেছেন কেউ একজন সবকিছু ভিডিও করেছে। এবং আমি সবকিছু তখনই অবগত হয়েছি। উনার সাথে যেভাবে কথা বলেছেন এমন ভাষায় কথা বলা কোন ভদ্রতার মধ্যে পড়েনা। যাই হোক, উনি আপনার বয়সে ,পদবীতে ছোট হলেও আপনার কাছ থেকে উনি একটা সরি নিশ্চয়ই পেতে পারেন। আশা করছি এমন ঘটনা আমাকে আর দেখতে হবেনা।
রায়হান সাহেবের কথা শুনে মাসুদ সাহেবের চোয়াল ঝুলে পড়লো।
– এসব কি বলছেন? তার মানে কি উনি এখানে কন্টিনিউ করছেন?
– অবশ্যই । উনি তো কোনো অন্যায় করেন নি। অন্যায়কে তুলে ধরা যদি অন্যায় হয়ে থাকে তবে সে অন্যায় করেছে । তবে এজন্য উনার চাকরি যাচ্ছেনা। বরং পুরস্কৃত করা দরকার।
মাসুদ সাহেব অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন । এমন টা হতে পারে উনি কোনোমতেই ভাবেননি। আজ পর্যন্ত কোনোদিনই এভাবে কথা বলেনি রায়হান সাহেব তার সাথে। মাসুদ সাহেব নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন ,
– উনি যদি চাকরি করেন তবে আমি চাকরী ছাড়তে বাধ্য হব। যেখানে আমার কথার কোনো সম্মান নেই সেখানে থাকা সম্ভব না।
মাসুদ সাহেব মনে মনে ভেবেছেন যদি চাকরী যায়ও রায়হান সাহেবের বাবার সাথে কথা বলে সে আবার বহাল তবিয়তে তার চাকরীতে থাকতে পারবে। রায়হান সাহেবকে ভয় দেবার জন্যই মূলত সে এমন কথা বলেছে। যাতে ভাবনাকে বের করতে পারে। কারণ তার দৃঢ় বিশ্বাস রায়হান সাহেব নিশ্চয়ই তাকে বাদ দিয়ে ভাবনাকে রাখার কথা ভাবছেনা।
মাসুদ সাহেবের কথা শুনে রায়হান সাহেব খুব বিরক্ত হলেন।
– আপনি ভেবে বলছেন তো!
– জী!
– আচ্ছা, ভাবনা! আপনি যেন কোন সাব্জেক্টে পড়াশোনা করেছেন?
– স্যার, ফিন্যান্সে।
– কোথা থেকে?
– জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটি থেকে।
– আর মাসুদ সাহেব আপনি?
মাসুদ সাহেব নিরুত্তর!
– আপনি তো বোধ হয় গ্রামের কলেজ থেকে ডিগ্রী পাশ করেছিলেন। বাবার কাছে শুনেছি স্টুডেন্ট হিসেবেও খুব ভালো ছিলেন না। আচ্ছা সেসব কথা থাক! আপনি চাকরী করবেন না ,শিওর?
মাসুদ সাহেব খুব অপমানিতবোধ করছেন রায়হান সাহেবের কথায়।
আস্তে করে বললেন, উনি থাকলে আমার পক্ষে থাকা সম্ভব হবেনা। উনি যদি কন্টিনিউ করেন তবে আমি এই মুহূর্তে রিজাইন করবো। কারণ সবার কাছে নিজেকে হাসির খোরাক করতে চাইনা এই বয়সে!
– ওকে ফাইন। ম্যানেজার সাহেব , এক কাজ করুন!
– জী স্যার , বলুন।
– মিস ভাবনাকে এসিস্ট্যান্ট ম্যানেজারের পোস্টে প্রমোশন দিলাম। আপনি সব ব্যবস্থা করে ফেলেন।
–
ম্যানেজার সাহেব, ভাবনা, মাসুদ সাহেব সবাই হা হয়ে তাকিয়ে আছে রায়হান সাহেবের দিকে। কি বলছে উনি? মজা করছেনা তো! এসিসট্যান্ট একাউন্ট্যান্ট থেকে এক লাফে এসিসট্যান্ট ম্যানেজার! সেটা কি করে সম্ভব? উনি নিশ্চয়ই মজা করছেন।
– কি ব্যাপার , শুনতে পাচ্ছেন না? যেভাবে বলেছি সেভাবে ব্যবস্থা করুন। মিস ভাবনা, আপনি পারবেন তো ?
– স্যার আ’ম এক্সট্রিমলি সরি! আমি আসলে বুঝতে পারছিনা। এসব কি বলছেন?
– যা শুনেছেন তাই বলেছি। আপনি পারবেন তো ?
– স্যার, না মানে?
– আপনি বেশ দক্ষ। কাজের প্রতি খুব ডিভোটেড। অনেক কিছুই খুব ভালো বোঝেন যা আমার অনেক অভিজ্ঞ ইমপ্লয়ীরাও বোঝেনা। এমন কর্মীই আমার দরকার। যারা কোম্পানীর স্বার্থে কাজ করবে নিজের স্বার্থে না। আশা করছি আপনি পারবেন ম্যানেজ করতে সবকিছু। আমি আপনার সম্পর্কে ভালো করে খোঁজখবর নিয়েই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আপনি কোম্পানীর যেসব খুঁটিনাটি বিষয় খুঁজে খুঁজে নানান ধরণের অসঙ্গতিগুলিকে টেনে বের করেছেন এটা আমার অন্য অভিজ্ঞ কর্মীদের পক্ষেও সম্ভব হয়নি এতদিনে। অথবা হয়তো সম্ভব ছিলো কারো ভয়ে বা হুমকিতে মুখ খোলেনি। আপনার মধ্যে সৎ সাহস আছে। আমি এমন কাউকে দিয়েই আমার কোম্পানী চালাতে চাই।
কিছুক্ষণ থেমে মাসুদ সাহেবের দিকে তাকিয়ে বলল,
মাসুদ সাহেব, আপনি আমার বাবার বন্ধু। এতবছর আমাদের সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। কখনো আপনার বিরুদ্ধে কেউ প্রশ্ন তুললেও পাত্তা দেইনি। কিন্তু দিন দিন আপনি সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছেন। লাগাম টানার সময় এসেছে। এতকিছুর পরেও আপনাকে আরেকটা সুযোগ দিতে চেয়েছিলাম । কিন্তু আপনি তা হেলায় হারালেন। আমি এই কোম্পানীর ডিরেক্টর হিসেবে কোথায় কাকে নিয়োগ দিতে হবে সেই ক্ষমতা রাখি। ভয় নেই আপনাকে অসম্মান করবোনা। যথাপূর্বক সম্মানের সাথে আপনার ফেয়ার ওয়েল হবে। আর তার দায়িত্ব রইলো মিস ভাবনা আর ম্যানেজার সাহেব আপনাদের উপর।
একদিকে মাসুদ সাহেব রাগে থরথর করে কাঁপছে আরেকদিকে ভাবনা ভয়ে থরথর করে কাঁপছে । কি বলছে এসব রায়হান সাহেব?
ভাবনার চিন্তার বাইরে ঘটছে সবকিছু। সে ভেবেছিল চাকরীই থাকবে কি না থাকবে! সেখানে সহকারী ব্যবস্থাপক? তাও এতবড় কোম্পানীর ? তার কিছুই বিশ্বাস হচ্ছেনা। সে ভাবছে সে মনে হয় স্বপ্ন দেখছে। নিজেকেই নিজে চিমটি কেটে দেখলো না ,সে বাস্তবেই আছে। খুশি হবে না অখুশি হবে কিছুই মাথায় আসছেনা তার।
সবকিছু কেমন নিমিষেই হয়ে যাচ্ছে ।
– মিস ভাবনা ! কথা বলছেন না যে?
– না, মানে … স্যার ! আমি কীভাবে এতবড় দায়িত্ব পালন করবো ?
– সাহস করলেই পারবেন। আপনার জ্ঞানবুদ্ধি আমার অফিসের অনেকের চেয়েই শার্প। আপনার একাডেমিক ব্যকগ্রাউন্ডও বেশ ভালো। আর আপনার কর্মদক্ষতা সে তো প্রমাণ করেছেন এই দেড় বছরে। আমি আপনার ব্যাপারে খুব পজিটিভ। আশা করছি আপনিও পজিটিভভাবে নিবেন। আগামীকাল থেকে দায়িত্ব শুরু করেন। আজ সন্ধ্যায় একটা মিটিং ডাকেন ম্যানেজার সাহেব। আমি এই নতুন ঘোষণা নিজেই দিতে চাই। ভালো কাজের রিওয়ার্ড কীভাবে দেওয়া হয় সেটা সবাই দেখুক।
– কিন্তু স্যার আরেকবার ভেবে দেখলে ভালো হত, প্লিজ! আমি নগণ্য মানুষ ! এই পোস্টের কি যোগ্য?
– আমি যেখানে নিশ্চিত সেখানে আপনি এত ভয় পাচ্ছেন কেনো? তবে হ্যা , এই মাস আপনি আগের স্যালারিই পাবেন, একমাস ট্রেইনিং হওয়ার পরে আপনি পার্মানেন্টলি সিলেক্ট হবেন। তবে আমার বিশ্বাস আপনি পারবেন। সো ,নো ওয়ারি, প্লিজ!
– স্যার , আপনি যখন সাহস দিয়েছেন আমি আমার বেস্ট দিয়ে যথাসাধ্য চেষ্টা করবো আপনার বিশ্বাসকে অক্ষুণ্ণ রাখার।
মাসুদ সাহেবের মাথায় কিছুই ঢুকছেনা। এসব কি হচ্ছে? এমন তো সে স্বপ্নেও ভাবেনি। এতবার সে দুর্নীতি করেও পার পেয়েছে রায়হান সাহেবের বাবার সাথে ঘনিষ্ঠ হবার কারণে। কিন্তু এবার এসব কি হচ্ছে। সে খেয়াল করেছে রায়হান সাহেব দায়িত্ব নেবার শুরু থেকেই তাকে অপছন্দ করে। কিন্তু তাই বলে এভাবে তাকে অপমান করে বের করে দিবে এটা সে কিছুতেই মেনে নিতে পারছেনা। আর মিটিং ডেকে তার রিজাইনের ব্যাপারটাও পাকাপাকি করে ফেলছে এত দ্রুত। সবকিছু এত দ্রুত হচ্ছে সে নিজেই বুঝতে পারছেনা কী করবে এই মুহূর্তে? এই মুহূর্তে কোম্পানীর এমডি রায়হান সাহেবের বাবা সিঙ্গাপুরে । চাইলেও কিছু করা সম্ভব না মাসুদ সাহেবের পক্ষে। খুব অসহায় লাগছে নিজেকে তার।
ভাবনা বাসায় ফিরে আবিরকে আর কিছু জানালোনা। আগে পার্মানেন্ট হোক তারপরে না হয় জানানো যাবে। চাকরী হারাবার কথা বলতে হবে এমনটাই ভেবেছিল সে। কিন্তু এখন? মহান আল্লাহই জানেন কখন কী হবে? কার ভাগ্যে কী আছে কেউই জানেনা। তার নিজেরই এখন পর্যন্ত কিছুই বিশ্বাস হচ্ছেনা। আবির কি করে বিশ্বাস করবে?
চলবে….
(আন্তরিকভাবে দুঃখিত দেরীতে দেবার জন্য)