নীলাম্বরে জোছনা পর্ব ৬

0
353

#নীলাম্বরে_জোছনা
#নুসাইবা_ইভানা
#পর্ব-৬
রাত গভীর থেকে গভীর হচ্ছে, রতন সাহেব আশেপাশের খোঁজ করেছেন, কোথাও মানাহার খবর পেলেননা।তার বোনের মৃত্যুর পর নিজেই আগলে রেখেছিলেন মেয়েটাকে। বুকের ভেতর তীব্র ব্যাথা হচ্ছে।মনে কত রকম ভাবনা আসছে। ক্লান্ত শরীর নিয়ে রাত দু’টোর সময় বাসায় ফিরলেন। আদুরি নিজের বাবাকে দেকে ছুটে আসলো। বাবার চেহারা বলে দিচ্ছে মানহার খোঁজ পাওয়া যায়নি। গ্লাস পানি এনে বাবার সামনে দিল। রতন সাহেব পানির গ্লাসটি নিলেন আদুরী বাবাকে বললো তুমি এত চিন্তা করো না, বাবা সব ঠিক হয়ে যাবে। আমার মনে হচ্ছে মানহা ঠিক জায়গায় আছে। ওর কিছু হবেনা দেখে নিও রতন সাহেব মেয়ের কথায় চিন্তা মুক্ত হতে পারলেন না। তার মাথায় ঘুরছে কতশত চিন্তা! নিজের বোনকে কথা দিয়েছিলেন নিজের সবটুকু দিয়ে আগলে রাখবেন, আজ সে কথা রাখতে ব্যর্থ! ক্লান্ত শরীরটা এলিয়ে দিলো সোফায়।

তৎক্ষণাৎ সেখানে উপস্থিত হল রুনা বেগম চোখমুখে কাঠিন্য ফুটিয়ে তুলে বলে এসবকিছু তোমার আদরের ভাগ্নি ইচ্ছা করে করেছি।
আমি অতো শত বুঝি না আমার মেয়ের যদি কোনরকমে ক্ষতি হয় তাহলে আমি কাউকে ছাড়বো না।আমি এর শেষ দেখে ছাড়ব!

রতন মিয়া চোখ বন্ধ করে বললেন মেয়েটা ম’রে গেলেই তো তুমি শান্তি দেখো ইচ্ছে পূরণ হয়ে যায়নাকি! আচ্ছা রুনা তোমার কখনো মেয়েটার জন্য মায়া হয় না!
বাচ্চা মানুষ একটা ভুল করে ফেলেছে,সে ভুলের শাস্তি তুমি আর কত দিবে।এবার হয়েছে তো তোমার শান্তি।

রুনা বেগম কপট রাগ দেখিয়ে বললেন, এসব নাটক আমার সাথে করে লাভ নেই! আমি সব বুঝি তুমি নিজেই তোমার ভাগ্নীকে অন্য কোথাও সরিয়ে দিয়েছো!।এখন এসে আমার সামনে নাটক করছো! আমি কিছুতেই তুমি যা চাইছ তাই হতে দেবো না। আমার মেয়েকে আমি মিফতাজের সাথে বিয়ে দিয়ে ছাড়বো । কিছুতেই তোমার ভাগ্নিকে আমি সুখী হতে দিবোনা। রাত অনেক হয়েছে নাটক বন্ধ করে যে যার রুমে ঘুমাতে যাও। সকাল হলে আবার নাটক করতে পারবে।

রুনা বেগম নিজের রুমে চলে গেলো।
আদুরি তার বাবার পাশে এসে বলে বাবা যাও যেয়ে শুয়ে পরো। আমি মিফতাজকে একটা কল করে বলি।
‘রতন সাহেব বললেন বলে দেখ।
আদুরী কল করছে কিন্তু রিসিভ হচ্ছে না।
মূলত মিফতাজ ইচ্ছে করেই রিসিভ করছে না।
আদুরী উপায় না পেয়ে টেক্সট করলো।
কিন্তু কোন রেসপন্স নেই। হতাশ হলো আদুরী। বৃত্তস্থ এত তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে যাওয়ার মানুষ না। সব সময় কমপক্ষে রাত তিনটা পর্যন্ত জাগে। তবে আজ এখন লাইনে নেই কেন! মানহার সাথে তাজে কিছু করেনি তো!আদুরীর সন্দেহ হতে লাগলো। আদুরী ঠিক করল সকাল হলেই একবার তাজের সাথে দেখা করবে।

মিফতাজ একটা চেয়ার টেনে বসে আছে মানহার মুখোমুখি। মানহা তখন গভীর ঘুমে। ঘুমে তো থাকারই কথা,এই ঘুম পারানোর জন্যই তো এতো আয়োজন। মিফতাজ এক ধ্যানে মানহার দিকে তাকিয়ে আছে। বেশ কিছু সময় তাকিয়ে থাকার পর উঠে এসে মানহার কপালে চুমু দিলো। মানহাকে নিজের বাহুতে আগলে নিয়ে নিজেও ঘুমের রাজ্যে পারি জমালো।

সবাই ঘুমে থাকলেও একটা মানুষের চোখে ঘুম নেও তার চোখে মুখে প্রতিশোধের নেশা। রুনা বেগমের এখনো মনে আছে সেই দিনটির কথা। চোখ বন্ধ করলেও যেনো, ভেসে উঠে সেই গাঁ শিউরে উঠা দৃশ্য!
তার মনে একটাই প্রশ্ন বারবার ঘুর পাক খায় আর সেটা হল, মানহা আয়াতকে কেন ধ্বাক্কা দিয়েছিলো
কেন তার মেয়ের সাথে এতো নিষ্টুরতা করলো?


রাত তো চলেই যায় নতুন দিন শুরু হয়ে।তবে আমাদের হৃদয়ের ক্ষত গুলো প্রতি রাতে বাড়তে থাকে। সকালে গাড়ির হর্ন আর ব্যস্ত মানুষের সমাগম বাড়তেই থাকে এই এড়িয়ায়। পুরান ঢাকার বংশালে নিয়ে এসে রেখেছে মানহাকে। মিফতাজ উঠে ফ্রেশ হলেও মানহার এখনো কোন হুস নেই। পুরান ঢাকার মানুষ এক আজব জনগোষ্ঠী। এখানে এখনো সকাল হলে পুরো পরিবার মিলে বাখরখানি আর চায়ের আড্ডা মেলাতে ব্যস্ত হয়ে পরে। অলি গলির এই শহরে একে অপরের সাথে মিশে আছে সকলে। এখনো এখানের মানুষ নিজেদের ঐতিহ্য বহন করে। বাপ দাদার আমলের। তাদের মধ্যে এখনো রয়েছে কথার ফাঁকে হিন্দি বলার রেওয়াজ। বাড়ি গুলো যেনে একেকটার সাথে আরেকটা লেপ্টে আছে। এখনো প্রায় বাড়ির ছাদে বারান্দায় ঝুলে থাকতে দেখা যায় বানর।এই বানরের কাহিনির শেষ নেই, কলা খেয়ে মানুষের টাকে ছুড়ে মারা। আরেক ছাদ থেকে এটা সেটা নিয়ে আসা চলতে থাকতে বানর বাহিনির। অদ্ভুত ভালো লাগে এসব দেখতে। মাগার তাহারা পরোয়াভি করে না কিছু। পুরান ঢাকার মানুষের কলিজা মেলা বড়। অতিথি আপ্যায়নে তাদের জুড়ি মেলা ভার। তেমন আবার খু’ন করতেও দোবারা ভাবেনা।
মিফতাজ চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে সবার ব্যস্ততা দেখছে। এরমধ্যেই ঘরের মধ্য থেকে কিছু ভাঙ্গার শব্দ পেয়ে ছুটে আসে তাজ। চায়ের কাপ টেবিলে রেখে মানহার উদ্দেশ্যে বলে,রিলাক্স জান এতো হাইপার হচ্ছো কেন?

-একদম আমার সাথে কথা বলবে না। এসব করে তুমি আমাকে পেয়ে যাবে, ভেবে থাকলে তুমি ভুল!
-জান তোমাকে পেয়ে গেছি।আর নতুন করে কি পাবো।
-জোড় করে শরীর পাওয়া যায় মন না।
-এসব কি ধরনের কথা বলছো। মানছি তোমাকে এখানে এনে রেখেছি কিন্তু জোড় করে তোমার সাথে কিছু করিনি।
-আজ করোনি কাল করবে না তার কি গ্যারান্টি আছে!
-কি সব উদ্ভট কথা বলছো মানহা। তোমার আমাকে সেরকম মনে হয়!
-আমাদের কত কিছু মনে হয় না কিন্তু সে রকম অনেক কিছুই আমাদের সাথে হয়। দূর্ভাগা আমরা মানুষ চিনতে ভুল করি।
-তুমি রেগে আছো তাই ভুল বকছো। রিলাক্স হও আমার কথাটা শোন।
-এই পুরান ঢাকায় তোমার বাবার এপার্টমেন্ট কবে হলো?
-এটা রিন্তি ফুপির বাসা। ফুপি তো পরিবার নিয়ে বাহিরে থাকে তুমি জানোই।
-তাই আমাকে এখানে নিয়ে আসবে? বউ করতে না পারলে রক্ষিতা করে রাখবে বুঝি।
-মানহার কথা শুনে তাজ মানহার দিকে তেড়ে এসে বলে এনাফ ইজ এনাফ। অনেক বলেছো তুমি আর না। ভালোবাসি বলে মাথায় চড়ে বসেছো!
-ভালেবাসার দোহাই দিয়ে একটা মেয়েকে ঘুমের মে’ডি’সি’ন দিয়ে নিজের কাছে পুরো রাত রেখে দিয়ো তার মান সম্মান সব ধুলোয় মিশিয়ে দেবে!
-আমি অতো-শতো বুঝিনা যে পর্যন্ত তুমি তোমার আর আয়াতের সাথে ঘটে যাওয়া সত্য না বলছো তোমাকে ছাড়বো না।
-সে সব শুনে হজম করতে পারবেন তো! মিস্টার মিফতাজ আয়মান!
-মানে তুমি কি বলতে চাইছো।
-সত্য কঠিন সত্য। যা শোনার আর মানার ক্ষমতা আপনার নেই।
-এতো হেয়ালি না করে বলো।
– আমি এখন বাসায় যাবোে। আমি আপনাকে বলতে বাধ্য নই।
– সামনের টেবিলে পা দিয়ে জোড়ে আঘাত করে মিফতাজ বলে,আমিও তোমাকে এখান থেকে বের হদকরতে বাধ্য নই। বলেই দরজা বন্ধ করে চলে যায়।
– এই অতীত মানহা কারো সামনে আনতে চায় না। কিন্তু ঘুরে ফিরে সেটাই বারবার তার জীবনে চলে আসে।

আরহাম আজ এসেছে এক বুকশপে। এখান থেকে মাহিবা বই ক্রয় করতো।
আরহাম এসে দোকানের কর্মচারীদের জিজ্ঞেস করতে থাকে কিন্তু সবাই বলে এমন কাউকে তারা চেনেনা। হাতাশ হয়ে একটা চেয়ারে বসে পরে, ঠিক তখন মনে পরে, মাহিবার বলা একটা কথা।

“ক্লান্ত হয়ে ফিরবে যখন নীড়ে আমায় খুঁজে পাবে তোমার তীরে”!
আরহামের মনে পরলো চিঠির কথা এতো কিছুর মধ্যে সেটা সে ভুলেই বসে ছিলো। এখন মনে হয় প্রাণে পানি এসেছে।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here