#নির্মোচন . ❤
#পর্বসংখ্যা_০৫ .
#ফাবিয়াহ্_মমো .
লজ্জা, ধিক্কার, অপমান পেয়ে বিষিয়ে উঠল ফিহা। থরথর করে পাতলা ঠোঁটদুটো কাঁপছে। চোখের চাহনি স্থির হয়ে এক ডলা কান্না ছোবল মারল। এতটা অপমান পেয়ে আর শান্ত রইল না ফিহা, দু’চোখ ভর্তি পানি নিয়ে হনহন করে ছাদ থেকে বেরিয়ে গেল। আর জীবনেও এই লোকের সামনে আসবে না। জীবনেও না! রুমের দরজা দিয়ে খাটের নীচ থেকে লাগেজটা টেনে আনল। আলমারি খুলে কাপড়গুলো বের করতেই ডুকরে কেঁদে উঠল। কী কারণে অতগুলো কথা বলল? কেন? কী অপরাধ করেছে? আজ কথাগুলো শুনে মনে হয়েছে ওরা এই বাড়ির দয়া ভিক্ষা করতে এসেছে। ছিঃ, কী ধিlক্কার! কাপড়গুলো লাগেজে ফেলে ঝাপসা চোখেই কলটা ডায়াল করল ফিহা। কানে ফোন চেপে বার বার চোখ ডলছে সে। ওপাশ থেকে কলটা কেটে দিয়ে ব্যাক করল ওকে। ফিহা কলটা কানে চাপতেই আর ‘ হ্যালো ‘ বলতে পারল না। দু’পাটি দাঁত শক্ত করে কান্নামাখা সুরটা প্রাণপণে আবদ্ধ করতে চাইছে।
– কী রে মা, কথা বলবি না? ফিহা? হ্যালো?
কানে ফোন চেপে খিঁচে রয়েছে সে। নিচের ঠোঁটে শক্ত করে দাঁত বসিয়ে চোখের পাতায় তর্জনী ও বৃদ্ধাঙুল চেপে আছে। আরো কয়েকবার ‘ হ্যালো, হ্যালো ‘ করতেই গলাটা শান্ত করল ও, চোখ মুছে ঢোক গিলে আস্তে করে বলল,
– হ্যাঁ, বাবা শুনতে পাচ্ছি। তুমি কেমন আছ বাবা? দুপুরে খেয়েছ?
মেয়ের আদুরে কণ্ঠ শুনে মলিন হাসলেন নিয়াজ। চোখের চশমা খুলে টেবিলের উপর রাখতেই হাতের ফাইলটা রেখে বললেন,
– তোদের ছাড়া কীভাবে ভালো থাকি? বাড়িটা শূন্য শূন্য লাগে রে মা। দুপুরে খেয়েছি। তুই খেয়েছিস? খালামনির বাসায় কেমন কাটছে? সব ঠিকঠাক?
শেষের প্রশ্নটা শুনে আবারও গলাটা ধেয়ে আসে ওর। কান থেকে ফোনটা নামিয়ে ওড়নায় চোখ চাপল। কণ্ঠটা আবারও স্বাভাবিক করে মিথ্যা হাসি দিয়ে বলল,
– খালামনির বাসায় খারাপ কাটে? আমার এখানে ভালো লাগছে না বাবা। আমি বাসায় যাব। তুমি আমাকে কাল এসে নিয়ে যেয়ো
বলতে বলতেই কণ্ঠরোধ হয়ে এলো। দাঁত খিঁচে জোরালো কান্নার সাথে যুঝতে থাকলে ওপাশ থেকে স্নেহাতুর কণ্ঠে বাবা বলল,
– ধুর ধোকা, এভাবে কেউ বলে? তোর খালা একমাসের জন্য বলে রেখেছে। এখন কালই তোদের নিয়ে আসব? বড়ো আপাকে কী বলে কষ্ট দেব? পারব না তো। আরো দু’দিন থাক। অফিসে কিছু একটা বাহানা দিয়ে ছুটি নিয়ে আসব।
ফিহা জেদি গলায় নাছোড়বান্দা হয়ে গেল। কোনো কথাই শুনল না ও। কণ্ঠে আক্রোশ ফুটিয়ে অস্থিরভাবে বলল,
– না, বাবা। কাল মানে কালই। কালই সন্ধ্যায় এসে আমাকে নিয়ে যাবে। আমি এখানে একটা মূহুর্তের জন্যও থাকতে চাচ্ছি না। তুমি যে করেই হোক অফিস থেকে ছুটি নিয়ে আসবে, আর খালামনিকে বলবে —
হঠাৎ ঘরের দরজা যেন আপনাআপনি খুলে গেল। ফিহা তৎক্ষণাৎ দরজার দিকে দৃষ্টি দিলে আফসানার জীর্ণ মুখটা দেখতে পেল। হাতে ভাজা-পোড়া খাবারের ঠোঙা নিয়ে ফ্যাকাশে মুখে চেয়ে আছেন আফসানা। ফিহা খালার দিকে দৃষ্টি রেখে ‘ বাবা, রাখি। পরে ফোন দিচ্ছি ‘ বলে কলটা কেটে দিলো। আফসানা এই সুযোগে ধীর পদক্ষেপে ভেতরে ঢুকলে ফিহার সামনে এসে বলল,
– আমি কী তোকে কোনোভাবে কষ্ট দিয়েছি?
খালার বিব্রতকর প্রশ্নের কাছে চটজলদি ‘ না ‘ জানাল ফিহা। আফসানার হাতদুটো ধরে তীব প্রতিবাদ করে বলল,
– অসম্ভব! কষ্ট কেন পাব? কী আবোলতাবোল বলছ তুমি? তোমার এখানে কষ্টের কী আছে? বাবাকে ফোন দিয়েছি এখান থেকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। সবসময় কী খালার বাসায় পড়ে থাকব বলো? আমার তো মন বসছে না এখানে। এখানে এসে একদিনও হয়নি, অথচ আমার ফাঁপর লেগে গেছে। এ অবস্থায় কী থাকা সম্ভব বলো? তুমি কী আমার অবস্থা বুঝতে পারছ না?
কথা ও জ্ঞানের জরিপ দিয়ে কিছু একটা ধরতে পেরেছে আফসানা। মুখের উৎকট অবস্থা দেখে তিনি পুরোপুরি নিশ্চিত আজ তার অনুপস্থিতিতে বিরাট কিছু হয়েছে। আফসানা ওর হাতে ঠোঙা গুঁজে রুমের আশেপাশে তাকালেন। বিছানায় বসার ইশারা দিয়ে খোলা আলমারি, বিছানায় লাগেজ, লাগেজের ভেতর কাপড় দেখে ওর দিকে বিমর্ষ মুখে বললেন,
– এখানে কী হয়েছে? তাড়াতাড়ি খুলে বল। লাগেজ খোলা কেন? ওতে কাপড় রেখেছিস কী জন্যে? তুই আমার সামনে মিথ্যা বলার চেষ্টা করবি না ফিহা। ওই শয়তানটা কিছু বলেছে?
বলেই রাগত মুখে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেল আফসানা। ঘোর বিপদের আশঙ্কা করতেই ফিহা ওখানেই ঠোঙার প্যাকেট রেখে তাড়াহুড়ো ভঙ্গিতে পিছু পিছু ছুটল, কিন্তু ততক্ষণে বেশ দেরি হয়ে গেছে। আফসানা ওই ডানদিকের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে পরেছে। ফিহা থামানোর জন্য দৌড় লাগাল ঠিকই, কিন্তু শেষ মূহুর্ত্তে গতি সামলে বাইরেই রইল সে। এখন কী করবে? কী হবে এখন? খালামনি যেই ধাতের মানুষ, তাতে ওই লোকের সাথে তর্কবিতর্ক করে তুমুল ঝlগlড়া বাঁlধিlয়ে দিবে। এটা ঠিক হচ্ছে না। ইতিমধ্যে আফসানা বেশ চড়া মেজাজে চিৎকার করে গলা তুলছে,
– কী বলেছিস ওকে? আমার দিকে তাকা! আমার দিকে তাকিয়ে কথা বল! আমি তোর সাথে কথা বলছি। আমার দিকে তাকা সাঈদ!
সাঈদ ডিভানে বসে কোলে ল্যাপটপে নিয়ে কিছু একটা মনোযোগের সহিত করছিল। মাকে দেখে কিবোর্ড চালানো হাতটা মন্থর করে ছোট্ট পরিসরে জবাব দিলো,
– কান দিয়ে শুনি, চোখ দিয়ে না। যা বলার স্ট্রেট কাট বলো। শোনার দায়িত্ব আমার। কোথায় কী হয়েছে?
আফসানা চরম রাগ দেখিয়ে ছেলের সামনে এসে দাঁড়ালেন। গলার স্বর তুঙ্গে চড়িয়ে গর্জে উঠলেন তিনি,
– তুই ফিহাকে কী বলেছিস? খবরদার সাঈদ, মিথ্যে বলবি না। তুই নিশ্চিত কিছু বলেছিস বলেই ও এখন ব্যাগ গুছিয়ে বাপকে ফোন দিলো। আমাকে তুই শান্তি দিবি না? আমাকে ওর বাপের সামনে অপমান করতে চাস? কী মুখ নিয়ে আমি বোনজামাইকে কথাগুলো বোঝাব?
চোখ ছোটো করে ল্যাপটপটা বন্ধ করল সাঈদ। নির্বিকার ভাব প্রদর্শন করে ভীতিহীন ভঙ্গিতে জবাব দিলো,
– কে কী করল তার জন্য আমি জবাবদিহি করব না মা। কেউ আমার সামনে লিমিট ছাড়িয়ে আচরণ করুক তা আমি বসে বসে দেখব না। সামান্য হিউম্যার সেন্স যদি না থাকে তাহলে অপরিচিত একদল ছেলের সামনে অত ফ্র্যাঙ্কলি আচরণ করাটা লেইম দেখায়। সেটা ওই গর্দভাকে কড়ায়-গণ্ডায় বুঝিয়ে দিয়ো। আর আমাকে একতরফা কথা শোনানোর আগে ব্ল্যাক কফি উইদাউট সুগারের এক মগ কফি দিয়ে যাও। কাল রাত থেকে মাথা ধরে আছে। বর্তমানে আমি ক্লায়েন্টের মেইল চেক করছি। আশা করব কোনো গর্দভজনিত ইস্যু নিয়ে আমার কাছে তলব করবে না। নিড প্রাইভেসি মা। এই মূহুর্ত্তের জন্য স্যরি।
ছেলের কাট কাট ভঙ্গির খাপে খাপ কথা শুনে হতবুদ্ধির মতো তাকিয়ে আছেন আফসানা। এই ছেলেকে তিনি যতবারই কথা শোনাতে আসেন, উলটো যেন যুক্তির ফুলঝুরিতে আঁটকা পড়েন। সাঈদ আবারও ল্যাপটপ খুলে স্ক্রিনের প্রতি সন্ধানী দৃষ্টি মেলে কাজ শুরু করেছে। সেই অবস্থা অবলোকন করে রুম থেকে চুপচাপ বেরিয়ে গেলেন আফসানা। বেরুতেই তিনি ফিহার মুখোমুখি হলে ওর ভয়ে চুপসে যাওয়া ফ্যাকাশে মুখটা দেখে আফসোসের শ্বাস ছাড়লেন। যার অর্থ হলো, ‘ শয়তানটাকে আজও কথার তর্জনে হারাতে পারলাম না। আমাকেই চুপ বানিয়ে ছাড়ল। ‘ ফিহা কীভাবে যেন আফসানার সুপ্ত কথাটা বুঝতে পেরে ঠোঁট প্রসার করে হেসে দিলো। স্মিত স্বরে বলল,
– কাল বাবা আসুক না আসুক, আমি কালই এখান থেকে চলে যাব। আত্মসম্মান খুইয়ে ছ্যাঁচড়ার মতো পড়ে থাকব তা হতে পারে না খালামনি। ফিমা আপু থাকলে থাকুক, কিন্তু আমি এখানে একমূর্হুতও থাকতে চাচ্ছি না। আমার কথায় কষ্ট পেলে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। যাও কফি বানিয়ে উনার খায়েশ মেটাও। এসব নিয়ে জোরাজুরি কোরো না।
কথাগুলো হাসি দিয়ে বলল ঠিকই, কিন্তু তরলত্বের ভেতর শান্ত তেজের রূপ দেখে আফসানাও কিছুটা অবাক হলেন। ফিমা নিশ্চয়ই অহংকারী এবং সকলের সাথে উlগ্র আচরণ করে, কিন্তু ফিমার বোন হিসেবে ফিহার মধ্যে ওরকম কিছু না থাকলেও আত্মসম্মানের জন্য একচুল ছাড় দেবে না ফিহা।
.
খালামনির বাড়িতে আসার পর চাপ বেড়েছে ফিমার। যাতায়াতের জন্য যদিও খালামনি ইডেনের সামনে নামিয়ে দেয়, কিন্তু ছুটির পর বাস ধরেই ফিরতে হয় ওর। এই মূহুর্তে লোকাল বাসের জানালার পাশে বসে আছে। সঙ্গে বান্ধুবী সামান্তা বাড়ি ফেরার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছে। কানে সাদা অ্যায়ার-পডদুটো গুঁজে জানালার বাইরে দৃষ্টি দিয়ে অনেক কিছুই ভাবছে ফিমা। হঠাৎ পাশ থেকে কনুই গুঁতা খেয়ে বামে তাকাতে নিলে সামান্তা ওকে অ্যায়ারপড খোলার জন্য ছোট্টা ইশারা দিলো। ফিমা কৌতুহলী চোখে বাঁ-কানের অ্যায়ার-পড খুলে সরাসরি জানতে চাইল,
– গুঁতাচ্ছিস কেন?
সামান্তা রয়েসয়ে নীচের ঠোঁট কামড়ে বলল,
– এখন কী করবি? ভেবেছিস কিছু? আমার মনে হচ্ছে কনফেস করাটাই বেটার। আর তো রিস্ক নেওয়া যায় না।
ফিমা এ কথা শুনে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠল। দ্রুত অন্য কানের অ্যায়ার পডটাও এক চান্সে খুলে নিয়ে ওর দিকে ঝাঁজালো সুরে বলল,
– তুই জানিস কত বড়ো রিস্কের কথা বলছিস? তার সামনে আজ পযর্ন্ত এসব নিয়ে বলিনি সামু। তার সামনে দাঁড়ানো তো দূর, এখন পযর্ন্ত চোখ তুলে তাকাতে পারি না। আমি জানি না সে সামনে আসলে কেন আমার হার্টবিট বেড়ে যায়। আমি একদম স্বাভাবিক থাকতে পারি না। এটা সত্য যে, তার সামনে আজ অবধি কোনো মেয়েকে লটরপটর করতে দেখিনি। ইভেন তার নামে কোনো মেয়েলি স্ক্যানডেলও নেই। গার্লফ্রেন্ড একটা ছিল তাও সেটা দু’মাসের রিলেশন। ব্রেকআপ কেন হয়েছে এ তথ্য কেউ জানে না। শুধু উড়ো উড়ো কথা শুনেছি সে ফিহা শেখের সাথে নরম্যাল বিহেভ করতো না। তার অ্যারোগেন্ট স্বভাবটার জন্য ওই মেয়েও সহ্য করতে পারেনি। কিন্তু ফুল হিস্টোরি আমি জানি না। তুই বুঝতে পারছিস আমার ভয়টা কোথায়?
সামান্তা চটান করে কথার ছন্দ টেনে বলল,
– কেন? সে কী তোর বোনের সাথেও একই আচরণ করে?
ছোটো বোনের কথা শুনে মুখটা বিকৃত করে ফিমা। কথায় কথায় ওর নাম শুনলে গা জ্বালা ধরে। দুই চোখে এটাকে দেখতে পারে না ফিমা। সামান্তার দিকে গলার স্বর ভৎসর্নার মতো করে বিরক্তভাবে বলল,
– ওই বেহাlয়াlর টপিক তুলিস না। বতর্মানে মুডটা ভালো নেই। ওর নাম শুনলেই মাথাটা ঝিমঝিম করে।
ফিমার কথায় কিয়ৎক্ষণ চুপ থাকে সামান্তা। সেও কিছুটা জানে ফিমা ওর ছোটোবোনকে সহ্য করতে পারে না। ফিমার সবসময় একটাই চাওয়া, একটাই ইচ্ছা, সবাই ওকে সম্পূর্ণ মনোযোগ দেক। সোজা ভাষায় ‘ অ্যাটেনশন সীকার ‘ বিশেষণটার জন্য ফিমার চরিত্রগুণ বিশেষায়িত। নিজেকে সবার চাইতে মর্যাদাপূর্ণ দেখানোর জন্য যা ইচ্ছা করতে সক্ষম। সেটা ভালোই হোক অথবা খারাপ সেদিকে লক্ষ করে না ও। পাশ থেকে ফিমা নিজেই স্বগোতক্তির মতো বলল,
– আমরা আজ পযর্ন্ত ভাইবোনের মতো বিহেভ করিনি। না আমরা তাকে কাজিন হিসেবে দেখেছি। কেন জানি না তার সাথে সবসময় একটা সুক্ষ্ম দূরত্ব আমাদের দূরে রাখতো। ওই লাইনের বাইরে আমরা কখনোই যেতে পারিনি। সে শুধুমাত্র খালুজান, খালামনি আর সুফি খালার সাথে কথাবার্তা বলে। বাইরে থেকে আগত মানুষদের সাথে কথাই বলে না একদম। মাঝে মাঝে চিন্তা করি সে কী আমাদের অহংকার দেখায়? পরে আবার মনে পড়ে সুফিয়া তো একটা কাজের বুয়া। ওই মহিলার প্রতি যদি স্বাভাবিক আচরণ করে তাহলে আমরা তো সে হিসেবে আত্মীয়, সে কেন আমাদের সাথে ওরকম আচরণ করে না? আমার ইচ্ছা করছে ফিহাকে বাসায় থেকে পাঠিয়ে দেই। এখান থেকে দূরে চলে গেলে আমি শান্তি মতো ধ্যান দিতে পারব। ও যতদিন থাকবে আমি কোনোভাবে মনোযোগ দিতে পারব না।
সামান্তা ডানে মুখ ফিরিয়ে ফিমার নিরুত্তেজ মুখটা দেখতে পেল। আবারও প্রশ্ন শুধিয়ে বলল,
– নামটা কী? এখনো তো নামধাম কিছু জানালি না। কী করে সে? তোর থেকে কত বড়ো?
ফিমা সিটের সাথে পিঠ লাগিয়ে মাথাটা পেছনে ঠেকিয়ে দেয়। জিহবা দিয়ে ঠোঁটদুটো ভিজিয়ে নিতেই জানালার বাইরে গতিময় দৃশ্য দেখে বলে,
– সাঈদ, জুনায়েদ সাঈদ। বতর্মানে প্রাইভেট সেক্টরে জব করে। কী সেক্টর, কী জব এসব কিছু জানি না। এসএসসিতে বোর্ড করা মানুষ। থার্টি হওয়ার আগেই অ্যাচিভমেন্টের খাতাটা ভরে গেছে। প্রচণ্ড ইন্ট্রোভার্ট, মানুষের সাথে মিশে কম।
সামান্তা প্রতিটি বাক্য শুনে সেই অদেখা অচেনা মানুষটির প্রতি ভীষণ আগ্রহী হলো। তার ব্যাপারে আরো শোনার জন্য উৎসুক ভঙ্গিতে বলল,
– তার মানে সে সেটেল্ড পার্সোন। শর্ট টাইমে এতকিছু পাওয়ার রহস্য কী? ছেলেদের সবকিছু গোছগাছ করতেই তো থার্টি আপ হয়ে যায়। ভালো একটা পজিশনে যেতে যেতেই বিয়ের অ্যাজ প্রায় শেষ।
কথাটা উড়িয়ে দেওয়ার মতো ফিমা তখন তাচ্ছিল্যের হাসি দিলো। তেমনি অবজ্ঞাপূর্ণ কথায় বলল,
– বোর্ড স্ট্যান্ড কী এমনি এমনি করেছে? প্রচুর মাথা খাটিয়েছে। জীবনে সাকসেস অ্যাটাম্পট্ করার মূল ট্রিক্সই হল মাথা খাটানো। সে তার জীবনে এমন সব অপোরচুনেটি গ্র্যাব করেছে যেটা মানুষ অবহেলা করে ছেড়ে দেয়। সে ছেড়ে দেয়নি। ছোটো ছোটো সুযোগগুলোকে কাজে লাগিয়ে সে দক্ষতা বাড়িয়েছে, নিজেকে সামনের জন্য রেডি করেছে। পরিস্থিতির কাছে সবকিছু সামাল দিতে শিখেছে। এত সহজে সাকসেস তার দরজায় নক করেনি। আমি তার বিষয়ে সম্পূর্ণ ঘটনা মায়ের কাছ থেকে জেনেছি। এই লোক আমার মাকে একটু বেশি শ্রদ্ধা করে। মায়ের কাছে গেলে যদি একবার তার বিষয়ে মুখ খুলিস তাহলেই শেষ। সবদিক দিয়ে ভালো আছে, শুধু একটাই সমস্যা সে প্রচুর হাইপার মানুষ।
– আমাদের তাহমিদের মতো?
– একেবারেই না। তার বন্ধু সংখ্যাও কম। মাত্র চারজন। তার মধ্যে একমাত্র লাবিব ভাইয়ার সাথে তার সখ্যতা বেশি। তাহমিদ আমাদের চেয়ে দুই ইয়ার সিনিয়র। তবু দ্যাখ, আমরা ওকে দেদারসে তুই তোকারি করে বলছি। এদিক দিয়ে তাকে নাম ধরে ডাকার মতো দুঃসাহস আমার একেবারেই নেই।
সবটুকু শোনার পর সামান্তা ভেতরে ভেতরে উচাটন অবস্থা টের পাচ্ছে। তার কল্পনায় যে চিত্রটা ভেসে উঠছে সে এক জাঁদরেল পুরুষ। ঠিক জল্লাদদের মতো চেহারা এবং কসাইদের মতো আচরণ। নিজের ইচ্ছার কথা ফিমার কাছে জানালে ফিমা ফোনের গ্যালারি ঘেঁটে সবচেয়ে সেইফে রাখা ফোল্ডারটা থেকে ছবি বের করে দেয়। ফোনটা হাতে নিয়ে স্কিনের দিকে তাকায় সামান্তা। মূহুর্ত্তের ভেতর কালবৈশাখি ঝড়ের মতো তীব্র এক ঝাপটায় সমস্ত কল্পনা লন্ডভন্ড হয়ে গেল। ধূলোর বাতাসে হারিয়ে যাওয়ার মতো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দুটো বিস্ফোরণ দৃষ্টি ফিমার দিকে আস্তে করে বলল,
– টোটালি আনএক্সপেক্টেড! চুল, চোখ, মুখ সবকিছু অ্যাট্রাক্টিভ। আমি বিশ্বাসই করতে পারছি না তুই এর জন্য দিন-রাত চিন্তায় মরছিস! আমি কোথায় ভেবেছি গুণ্ডাদের মতো ফেস হবে, অথচ এ তো দেখছি পুরোই হ্যান্ডসাম।
ফিমা এ প্রসঙ্গে লজ্জার জন্যই হোক বা ভালোলাগার জন্য সামান্তাকে সে কিছুই বলল না। সামান্তা আবারও ফোনের দিকে হতবিহ্বল দৃষ্টি দিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল, কোনো এক বিলাসবহুল চাইনিজ রেস্টুরেন্টে দাম্ভিক মানুষটার ঠোঁটের কাছে ধোঁয়া উঠা কফি খাওয়ার দৃশ্যটুকু ক্যামেরাবন্দি করা হয়েছে। তার দৃষ্টি টেবিলের মেন্যু কার্ডের দিকে এবং কপালের সামনে ছোট্ট বাচ্চাদের মতো সারি-সারি সিল্কি চুলগুলো এসে আছে। পোশাক-আশাক ঠিক ফর্মাল গেটআপ, তবে ছবিতে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে গায়ের পোশাকগুলো ভেজা। একটু ভালোভাবে পরোখ করতেই বুঝল সময়টা বোধহয় বর্ষণমুখর দিন। তাকে দেখে মনে হচ্ছে না ছবিটার জন্য পোজ দিয়েছে সে। মনে হচ্ছে কেউ অজান্তেই সুন্দর সুদর্শন মানুষটাকে ছবিতে আবদ্ধ করেছে। সামান্তার মনে উক্ত প্রশ্নটা উঁকি দিতেই ফিমার দিকে বলল,
– ছবিটা কে তুলেছে রে? তুই?
কৌতুক শোনার মতো হো হো করে হেসে দিলো ফিমা। সামান্তার মাথায় অবজ্ঞাসূচক চাট্টি মেরে হাসতে হাসতেই বলল,
– সেই সৌভাগ্য হলে তো হইছিলই। ছবিটা লাবিব ভাইয়া তুলেছে। আমি আবার ভাইয়ার সাথে ইন্সটায় অ্যাড আছি। সেখানে এই ছবিটা সে কী যেন ক্যাপশন লিখে স্টোরি দিয়েছিল, তারপর আমি সেটা টুপ করে স্ক্রিনশট নিয়েছি।
আরো আশ্চর্য হলো সামান্তা। মানুষটাকে নিয়ে জানার জন্য ব্যাকুলিত হয়ে এ সুযোগে শুধাল,
– সোশ্যাল মিডিয়ায় নেই?
সামান্তার চোখদুটো প্রশ্নসূচকে ধক ধক করে জ্বলছে। এ চাহনি ফিমার চেনা। এ পযর্ন্ত যতজনকে এই ছবিটা দেখিয়েছে সবাই কোনো-না-কোনোভাবে তার বিষয়ে আরো জানার জন্য অদ্ভুত টান দেখিয়েছে। ফিমা সত্যটাই বলে দিলো,
– জানি না। এ বিষয়ে কিছুই জানতে পারিনি। অনেক চেষ্টা করেছি কিন্তু ফলাফল শূন্য।
হতাশ দেখাল সামান্তাকে। ফোনটা হাতের মুঠোয় নিয়ে অনিশ্চিত ভাবনায় মগ্ন দেখাল। পাশ থেকে ফিমা পরিস্থিতির ব্যগ্র স্ফুরণ দেখে ওর হাত থেকে ছোঁ মেরে ফোনটা নিয়ে নিলো। চমকে উঠে সামান্তা ফিমার দিকে তাকালে ফিমা মেকি হাসি দিয়ে বলল,
– স্টপেজ এসে গেছে সামু। আমি তাহলে যাই? নেক্সট ক্লাসে দেখা হবে।
.
ভোর আলো না ফুটতেই শোয়া থেকে উঠে পড়ল সাঈদ। আকাশে এখনো শেষ রাতের কালিমা লেগে আছে। সমস্ত চরাচর এখন ঘুমের রাজ্যে গভীর নিদ্রায় ডুবে আছে। জানালার পর্দা সরিয়ে বারান্দায় চলে গেল সে। গ্রিলহীন বারান্দা, বারান্দাটাও বেশ বড়ো। রেলিংয়ের উপর দু’হাত রেখে বুকভরা দম নিল সে। মাথাটা এখন শান্ত ও ঠান্ডা হয়েছে। বহু কিছু ভাবতে পারছে সে। গতকাল ঠিক এ সময়ই বাসা থেকে বেরোনের তোড়জোড় শুরু করেছিল। আর আজ এখন স্থবির চিত্তে প্রসন্ন মনে স্বস্তি অনুভব করছে। ফাহিমের অবস্থা এখন ছ’মাসের জন্য হাসপাতালের বাসিন্দা হয়ে গেছে। এদিক থেকে পুরোপুরি নিশ্চিন্ত হয়েছে সে। গতকাল মাথাটা একেবারেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিল। কোনোকিছু মনমতো এবং নিখুঁতভাবে না হলে তার মেজাজটা ধীরে ধীরে খারাপের দিকে চলে যেতে থাকে। এ অবস্থায় কেউ উলটাপালটা আচরণ বা উদ্ভট কথাবার্তা বললে সে ছেড়ে দেয় না। এমন অপ্রতিকূল আচরণের জন্য আজ বাবার সাথে যোজন যোজন দূরত্ব বেড়ে গেছে। যেই দূরত্ব আদৌ কমবে কিনা জানা নেই। তার চারিত্রিক কিছু গুণাবলীর জন্যই বোধহয় মানুষ তার সাথে অকপটে কথা বলতে ভয় পায়। বিশেষ করে ছোটো আন্টির মেয়েদুটো। ওদের কাছ থেকে সবসময় নিজেকে দূরে রেখেছে সে। নিজের কাজ ও পড়াশোনা নিয়ে অত্যধিক ব্যস্ত হলেও তার জীবনে মেয়ে হিসেবে শুধু ফিহা শেখের ছায়া পড়েছিল, তবু সে ছায়া রাবারের মতো ঘষে ঘষে মুছে ফেলে। আজ আবারও ‘ ফিহা ‘ নামটা তার কানের কাছে শোনার মতো অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু কথা হলো গতকাল সে কী জন্যে ওর উপর চ্যাঁচাল? কোন অধিকারে অমন আচরণ করে কাঁদিয়ে দিলো ওকে? কাজটা একদম ঠিক করেনি। মাথাটাও বিভিন্ন চিন্তায় বিভোর ছিল, আবার রাগটা ছিল তুঙ্গস্পর্শী। এই ভুলটার জন্য অবশ্যই দুঃখ প্রকাশ করা দরকার, কিন্তু সমস্যা হলো সে কখনোই নিজের ভুলত্রুটির জন্য কারো কাছে দ্বারস্থ হতে পারে না। কারো সাথে মন খুলে কথা বলার মতো সহজ সাধারণ অবস্থা একেবারেই তার আয়ত্তাধীনে নেই। কেউ তাকে বুঝলে বুঝুক, না বুঝলে নেই, সে অনেকটা এমন ধাতের মানুষ। অদ্ভুতভাবে আজ মন চাইছে ওর কাছে একটাবার নিজের ভুলটা স্বীকার করা দরকার। কিন্তু কেন মন চাইছে? কেন মনে হচ্ছে এই কাজটা না করলে বিরাট কোনো ক্ষতি হবে? আকাশের দিকে উদ্বেলিত চোখদুটো স্থিরভাবে রাখল। মনের একদম গভীর থেকে গভীরতম স্থান থেকে উত্তর খুঁজল সে। সেখান থেকে একটাই জবাব বহু প্রয়াসের হাতড়াতে হাতড়াতে পেল। ‘ কাজটা একদম ঠিক করছিস না সাঈদ। কোথাও একটা ভুল হচ্ছে। বড়ো ধরণের ভুল। এখনই সময় থাকতে সেটা ঠিক কর। ‘
#FABIYAH_MOMO .
#নোটবার্তা : রি-চেক দেইনি। দুঃখ প্রকাশ করছি।