নির্মোচন পর্ব ১৪

0
804

#নির্মোচন . ❤
#পর্বসংখ্যা_১৪ .
#ফাবিয়াহ্_মমো .

গগনচুম্বী চিৎকারে ভ্রম ভাঙতেই শক্ত বাহুবন্ধনের ভেতর আঁতকে উঠল ফিহা। কণ্ঠ, ডাক, গলা সবটাই চেনা চেনা ঠেকছে ওর কাছে! পরিচিত কণ্ঠের ওরকম চিৎকার শুনে সাঈদের পেছনে থাকা দরজার দিকে তৎক্ষণাৎ বিস্ময় চোখে তাকাল ও। দুটো মায়াবী চোখে একমুঠো বিষ্ময় লেপে ফের সাঈদের দিকে অস্থির চোখে ঢোক গিলে থামল। সাঈদ ওর ভয়কাতুরে অবস্থা দেখে তৎক্ষণাৎ ওকে বাহুবন্ধন থেকে মুক্ত করে নিজেই আগত ব্যক্তিটির পানে তাকায়। সাথে সাথে এক খাবলা বিরক্তি তার প্রখর চোখে, গম্ভীর মুখে লেপ্টে যায়। আগন্তক ব্যক্তিটি আর কেউ নয়, ওর বাবার ঠিক করে দেওয়া সেই তথাকথিত ইয়াসিন মাহমুদ। বৃষ্টিবাদলের এমন বৈরি দিনে কেন এই লোক অদ্ভুতভাবে হাজির হয়েছে স্বয়ং বুঝতে পারছে না ফিহাও। স্যারের এভাবে হঠাৎ আসা তো দূরেরই ব্যাপার, উলটো এই বাড়ির ঠিকানা পর্যন্ত ফিহা কারো কাছে উচ্চারণ করেনি। মনে মনে শত শত প্রশ্ন জমা হলেও হঠাৎ ফিহার মনে পড়ল ওর জামাটা বোধহয় শুকনো নেই। বুকের সাথে জাপটে থাকার ফলে কামিজের সামনের দিকটা বেশ ভালোই ভিজে গেছে। স্যারও কেমন জুলজুল চোখে ফিহার মাথা থেকে পা পর্যন্ত অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে নিচ্ছে। সাথে সাথে ব্যাপারটা লক্ষ করতেই দু’হাতের সাহায্যে বুকের সামনের অংশটা ঢেকে ফেলল ফিহা। স্যারকে অপ্রতিভ কণ্ঠে প্রশ্নসূচকে বলে উঠল,

– আপনি এখানে কী করছেন? আমি তো আপনাকে আসার জন্য বলিনি স্যার। আমার যখন একটু আগে বাবার সাথে কথা হলো, তখনও তো বাবা বলেনি আপনি আজ আসবেন।

বৃষ্টি ভেজা লম্বা কালো রেইনকোট পড়ে দরজার মুখে দাঁড়িয়ে আছে ইয়াসিন। তার ডানহাতে ধরা কাক ভেজা ছাতাটা ভীষণ ক্ষোভের সাথে ঠাস করে ফ্লোরের উপর ফেলল। দুই চোখে কোপদৃষ্টি বর্ষণ করে সাঈদের দিকে একপলক তাকিয়ে প্রশ্নটা সরাসরি ফিহার দিকে নিক্ষেপ করল,

– তুমি একটু আগে কী করছিলে?

বলার ধরণটা দেখে ভেতরে ভেতরে একটু ঘাবড়ে যায় ফিহা। যদি কথাটা বাবার কাছে কুৎসিতভাবে উপস্থাপন করা হয় তখন ব্যাপারটা ভালো হবে না। নিজেকে ঠান্ডা রেখে নির্ভয়চিত্তে প্রত্যুত্তর করল ফিহা,

– আপনি যা ভাবছেন, যা দেখছেন এবং যা ভাবার চেষ্টায় প্রশ্নটা করলেন ব্যাপারটা আসলে ওরকম না। আমি ফ্লোরের পানিতে পা পিছলে পরে যাচ্ছিলাম। উনি আমাকে বাঁচানোর জন্য ওভাবে ধরতে বাধ্য হয়েছেন। ব্যস্, এটুকুই। যেটা একটা ছোটোখাটো দুর্ঘটনা ছাড়া কিছুই নয় এবং আমি মনে করি ব্যাপারটা যে কারোর সাথে যেকোনো সময় ঘটতে পারতো।

ফিহার কাটকাট জবাব দেবার ভঙ্গি দেখে সাঈদ আড়চোখে ওর দিকে তাকাল। গায়ের ল্যাভেন্ডার কামিজটা ভিজে যাওয়ার দরুন দু’হাতে নিজেকে ঢেকে রাখার অক্ষুণ্ণ চেষ্টা চালাচ্ছে ফিহা, কিন্তু বুকের ডানদিকে কাঁধের একটু নীচে রক্তাভ জন্মদাগটা ওর বাঁশের মতো সরু হাতদুটো ঢাকতে পারেনি একটুও। লজ্জাজনিত ব্যাপারটা এই স্যারের সামনে না-ঘটুক সেজন্য নিজেই ডানহাত বাড়িয়ে এক কদম এগিয়ে ফিহাকে নিজের পেছনে ঢেকে দিলো সাঈদ। কণ্ঠে বেশ তাৎপর্য ফুটিয়ে স্যারের মনোযোগ টেনে বলল,

– আসসালামুয়ালাইকুম। জ্বী এদিকে তাকান। আপনি এমন ঝড়বৃষ্টির দিনে কেন এসেছেন সেটা আমার জানা নেই। এই মূহুর্তে কোনো কোয়েশ্চ্যান না করে ওকে যেতে দিলে ভালো হয়। প্লিজ ডিসমিস হার।

দম্ভের মতো স্বরটা শুনে ইয়াসিনের আত্ম অহংয়ে শূলের মতো কী একটা বাজল। নাকের ডগায় কৃত্রিম রাগ ফুটিয়ে বেশ দাবড়ের সাথে বলল,

– ওয়াআলাইকুমসসালাম, জ্বী স্যরি। হুট করে আপনাদের মাঝে ইন্টারাপ করার জন্য আমি ভীষণভাবে দুঃখিত। আমি এখানে ওর বাবার কথা মেনে লম্বা ছুটির জন্য আজকের দিনটা পড়াতে এসেছিলাম। পারিবারিক একটা বিয়ের জন্য দুই সপ্তাহের মতো পড়তে পারবে না দেখে আমার এখানে কষ্ট করে আসা, কিন্তু এখানে এসে যে ধরণের সিনারি –। আচ্ছা থাক চলি, কথা না বাড়াই। আই অ্যাম স্যরি ফর দ্যা ইনকনভিনিয়েন্স।

ইয়াসিন ফ্লোরে ঝুঁকে ছাতাটা তুলে যে-ই প্রস্থানের জন্য পা চালাতে নিবে, ঠিক তখনই কর্কশ কণ্ঠটা তীব্র আদেশের স্বরে গমগমিয়ে উঠল,

– আপনাকে তো আমি যেতে বলিনি ইয়াসিন সাহেব। ছাত্রীকে কষ্ট করে যেহেতু পড়াতে এসেছেন, সেটাও ঝড়বৃষ্টির মধ্যে এমন শোচনীয় অবস্থা উপেক্ষা করে, সেক্ষেত্রে খালিমুখে আপনাকে বিদায় করাটা আমার জন্য ভেরিটেব্যাল নয়। কাম ইনসাইড। হোপ ইয়্যু ডোন্ট মাইন্ড ফর দ্যা আনসার্টেন ইস্যু।

ঝরঝরে মুক্ত ঝরানো হাসিতে হেসে ফেলল ইয়াসিন মাহমুদ। কাষ্ঠমুখে বলল,

– না না ইটস ওকে। আমার কোনো প্রবলেম নেই। আপনাদের মতো উচ্চ ইনফ্লুয়েনশিয়াল মানুষ আমার মতো নগন্য এক টিচারকে সম্মান করেছে তাতেই আমি সন্তুষ্ট। জ্বী ধন্যবাদ।

সাঈদ কথাটা শোনার পর একসেকেন্ডও দেরি করল না শক্ত উত্তর দিতে। গম্ভীর গলায় চাপা হাসি ফুটিয়ে পালটা জবাবে বলল,

– আপনাকে তো ধন্যটাই করতে চাইছি ইয়াসিন সাহেব। সুযোগটা যদি না দেন, তাহলে তো আমার মতো নন-ইনফ্লুয়েলশিয়াল মানুষের গরিবী সার্ভিসটা মিস করবেন। ভেতরে আসুন। ছাত্রীর গার্ডিয়ানের হাতে এককাপ হ্যাজেল-নাট কফি খেয়ে ধন্য হোন।

‘ছাত্রীর গার্ডিয়ান ‘ শব্দটা শুনে ধক্ করে ফিহার ছোট্ট বুকে এফোঁড় ওফোঁড় করে ছুড়ির মতো লাগল কিছু। এই লোকটা ক্ষণেক্ষণে ওকে নিজের সাথে জড়িয়ে যেটুকু অধিকার ফলিয়ে যাচ্ছে, ঠিক যোজন-বিয়োজন করে পরিমিত দায়িত্বগুলো পালন করছে সেসব কিছু দেখে ফিহার বুকে খরস্রোতার নদীর মতো কলকল স্বরে বান ভাসিয়ে যাচ্ছে। ইয়াসিনকে কথাগুলো বলেই সম্পূর্ণ পেছনে ঘুরে ফিহার আনা তোয়ালেটা দিয়ে সুন্দর করে গা ঢেকে দিলো সাঈদ। যেন নিজের মহামূল্যবান সম্পদকে কুদৃষ্টির আড়াল থেকে সন্তপর্ণে বাঁচিয়ে রাখল সে। হিমজড়ানো ঠান্ডা হাওয়ার দল ফিহার সমস্ত শরীরে শৈত্য কাঁপুনি ছড়ালেও বড়ো বিস্ময় নিয়ে মুখ তুলে সাঈদের শান্ত মুখশ্রীর পানে তাকাতে বাধ্য হল। ওই গভীর দুটো চোখে সমুদ্রের মতো গভীরতা, নেশার মতো মাদকতা, বুকের বাঁদিকে ছোট্ট মোচড় তুলে দেওয়ার মতো অদ্ভুত চাহনি লুকিয়ে আছে। হাসিহীন অকাট্য চিত্তের মুখটা তখনো গম্ভীরতা বজায় রেখে কাঠিন্যস্বরে বলে উঠল ফিহাকে,

– রুমে গিয়ে ড্রেসটা চেন্ঞ্জ কর। বড়ো গলার জামা, ফিনফিনে ওড়না, খাটো কামিজ, ফিটিং পোশাক এসব যেন পরতে না-দেখি। আমার বাড়িতে ভদ্র লক্ষ্মীমেয়ের মতো সবটা দেখে শুনে মেনে চলবি। মনে থাকবে? পালটে আয়।

ফিহা এখনো বুঝতে পারছে না এই শান্ত, অবিচল কণ্ঠের ভেতর কীসের কঠোরতা লুকানো থাকে। মানুষকে আদেশ করার মতো দাম্ভিকতার স্বর, আর সেটা হাড়ে হাড়ে পালন করিয়ে ছাড়ার মতো বজ্রকঠিন চেতনা, এ দুটো বৈশিষ্ট্য ফিহার কাছে সাধারণ বলে মনে হয় না। একটা অদ্ভুত কৌতুহল থেকে প্রশ্ন করে উঠল ফিহা,

– আপনি কী স্বাভাবিক ভাবে কথা বলতে পারেন না?

এখনো ইয়াসিন দরজার কাছে হাঁটু মুড়ে জুতা খুলতে ব্যস্ত, এবং তা যে আর মাত্র কিছু সেকেন্ডের ভেতর শেষ হয়ে আবারও ওদের দু’জনকে ফিসফিস আলাপে কথা বলতে দেখবে, সেটা চিন্তা করে সাঈদ প্রসঙ্গ পালটে বলল,

– জানি না। রুমে যেতে বলেছি। এই মূহুর্তে কোনো প্রশ্ন না।

এবারের কণ্ঠটা নীচু হলেও চোখের ক্ষিপ্ত চাহনি, মুখের শক্ত অবস্থা দুটোই ফিহাকে চোখ নামিয়ে দোতলার পথে হাঁটা দিতে বাধ্য করল। অন্যদিকে জুতা খোলা শেষ হলে ড্রয়িংরুমের বড়ো সোফাটার দিকে তর্জনী উঁচিয়ে ভদ্রভাবে বলল সাঈদ,

– ওখানে বসুন। আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি। আশাকরি আপনার অপেক্ষা করতে অসুবিধে হবে না।

– অসুবিধে কীসের? কোনো অসুবিধে নেই। আপনি যেতে পারেন। আমি ঠিক আছি।

নিজের ভেজা অবস্থা পালটানোর জন্য রুমে চলে গেলে এদিকে ইয়াসিন চারিদিকে চোখ বুলাতে বুলাতে ড্রয়িংরুমের নরম সোফাটায় ধপ করে বসে পরল। ভেজা রেইনকোটটা দরজার আংটার কাছে ঝুলিয়ে এসেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই অফিসের ফর্মাল বেশভূষা পালটে সাধারণ পোশাকে উপস্থিত হয় সাঈদ। হাতে রান্নাঘর থেকে আনা ট্রে’র উপর চিনির পট, দুধের কৌটা, কফি মিক্সার, মাঝারি সাইজের কফি-মগ এবং দুটো হ্যাজাল-নাট কফির প্যাকেট সাজিয়ে সামনের সেন্টার টেবিলে ট্রে-সমেত রাখল। ইয়াসিন জুলজুল চোখে তার প্রতিটি কর্ম দেখতে থাকলে হঠাৎ কপালের বাঁ-দিকে কী যেন একটা দেখতে পেয়ে প্রায় আঁতকে উঠতে যাচ্ছিল, কিন্তু চূড়ান্ত মূহুর্ত্তে নিজেকে আঁটকে নিয়ে আবারও নিজের মুখটা স্বাভাবিক করে ফেলল। একদণ্ড বুঝতে দিলো না সাঈদকে। ইয়াসিনের ছোঁক ছোঁক করা ভাবটা সাঈদের কাছে ধরা পরলেও কফির প্যাকেটদুটো ছিঁড়তে ছিঁড়তে স্বাভাবিক স্বরে বলল,

– আমাকে নিয়ে আপনার অযথা কৌতুহল কেন তৈরি হয়েছে আমি জানি না মাষ্টার মশাই। আপনি প্রথম দিন থেকে আমার ব্যাপারে কিছু জানার জন্য প্রবল আগ্রহ দেখিয়ে আসছেন। এটার পেছনে কারণটা কী জানতে পারি ইয়াসিন সাহেব?

বাইরের নিকষ কালো অন্ধকারের মতো ইয়াসিনের মুখটাও যেন তৎক্ষণাৎ চুপসে গেল। একপলক কফি বানানো মগটার দিকে দৃষ্টি বুলিয়ে সামনে বসা চতুর প্রশ্নকর্তার দিকে বলল,

– কোনো কারণ নেই মিস্টার। আপনি ভুল ভাবছেন। আমি শুধু ফিহার কাছে জানতে চেয়েছিলাম ওর কী আরো ভাই আছে কিনা। ওদের বাসায় অনেকবছর ধরে পড়াচ্ছি। এতোগুলো বছরে আপনাকে কখনো দেখতে পাইনি এটা নিয়েই মূলত প্রশ্ন ছিল। তাই একটা চাপা কৌতুহল থেকে দু-একটা প্রশ্ন করেছিলাম, এছাড়া আর কিছুই না।

ছোটো কফি-মিক্সারটা চালু করে মগের ভেতরে ঘূর্ণিঝড়ের মতো কফি বেসটা বানাতে থাকলে একটু হাসল সাঈদ। মগের দিকে শান্ত দৃষ্টি রেখে চাপা ইঙ্গিতে বলল,

– অফিসে আমার নামে একটা গুন্ঞ্জন আছে ইয়াসিন সাহেব। একটা সাজানো গোছানো নির্ভেজাল মিথ্যাকে আমি চট করে ধরতে পারি। আই হোপ বাকিটা আমার ব্যাখ্যা দিয়ে বোঝাতে হবে না।

সুক্ষ্ম কথার ইঙ্গিত, চোখের চাহনি দুটোই এবার ইয়াসিনের কাছে স্বচ্ছ পানির মতো পরিস্কার হয়ে গেল। এই চতুর লোক শুধু শুধু তাকে বসিয়ে-বসিয়ে কফি খাওয়াতে আসেনি, এসেছে চালাকির সাথে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে পেটের তলদেশ থেকে সমস্ত কথা বের করে নিতে। চরম ধূর্ততার পরিচয় পেয়ে ইয়াসিন ভণিতা ছেড়ে ইতস্তত করে বলল,

– আ-আসলে আপনি আমাকে চিনবেন না মিস্টার, কিন্তু আমি আপনাকে চিনি। বলতে পারেন টিউশনিরও আগে থেকে চেনা আছে। যখন আপনি… বি.এ. …মানে —

গলায় একটু হেঁয়ালি হেঁয়ালি ভাব টেনে কথাটা ওখানেই থামিয়ে দিল ইয়াসিন, কিন্তু সে তখনও জানে না কার সামনে বসে কথা থামানোর মতো কুটিল আস্পর্ধা দেখাচ্ছে। সাঈদ সংযতস্বরে আবারও তাগাদা দিয়ে বলল,

– বলতে থাকুন ইয়াসিন সাহেব। আমি শুনছি। পুরো কথা না বলে থেমে যাবেন না। আধা কথা, আধা সত্য এগুলো আমার অপছন্দ।

কথাগুলো শুনে ভেতরে ভেতরে খুব ঘাবড়ে গিয়ে ঢোক গিলল ইয়াসিন। এদিকে ফিহা দোতলা থেকে কালো রঙের ফ্লোর ছুঁই ছুঁই জামা পরে গলায় ওড়না জড়িয়ে নীচে নেমে এল। মানুষটার কড়া নির্দেশে ছোটো গলার জামা, লম্বা হাতা এবং ঢিলেঢালা পোশাকে ঢেকে রেখেছে একটু আগের লজ্জাপ্রবণ দেহ। অন্যমনষ্ক ফিহাকে ড্রয়িংরুমে আসতে দেখে ডানহাতে দু’বার টাস-টাস তুড়ি বাজিয়ে ওর অন্যমনষ্ক দৃষ্টি আকর্ষণ করল সাঈদ। ফিহা মুখ তুলে অভ্রান্তচোখে তাঁর পানে তাকালে ভারী কণ্ঠটা কেমন অধিকার ফলিয়ে বলল,

– আমার রুমে গেলে আলমারির সেকেন্ড সেকশনে কফিম্যাট জারটা দেখতে পাবি। আর রান্নাঘর থেকে দুটো কফি মগ এই মূহুর্তে প্রয়োজন।

শক্ত অধিকার মাখানো কণ্ঠস্বর শুনে বুকে র ভেতরটা কেমন দুরুদুরু করে কেঁপে উঠল ফিহার। টি-টেবিলে কফির পসরা দেখে মৃদুস্বরে বলল,

– ঠিক আছে আনছি। আর কিছু লাগবে আপনার?

দুটো আচ্ছন্ন করা চাহনি যেন কয়েক সেকেন্ডের জন্য কিছু বলার জন্য চাইল, কিন্তু আসল কথাটা অনুচ্চ রেখে শীতল কণ্ঠে বলল,

– বর্তমানে কিছু লাগবে না।

কনকনে শীতের মতো ঠান্ডা কণ্ঠটায় আরো কিছু কথা সংগোপনে লুকায়িত ছিল। যেন বলতে চাইছিল, এখন কিছু লাগবে না। তবে বিশেষ সময়ে বিশেষ কিছু চেয়ে নিব। ফিহা যেন নীরব প্রজার মতো আজ্ঞা পালনে সচেষ্ট হয়ে সেই কাঙ্ক্ষিত রুমের বদ্ধ দরজা খুলে ঢুকল। সঙ্গে সঙ্গে মন মাতানো পুরুষালী ঘ্রাণ, কড়া পারফিউমের মিঠে সুভাস, বৃষ্টিস্নাত প্রকৃতির মাটি সোঁদা গন্ধ যেন রুমের প্রতিটি কোণা থেকে ফিহাকে আচ্ছন্ন করতে ব্যস্ত ছিল। পায়ের তলায় থাকা সাদা টাইলসের ঠান্ডা ফ্লোরটা মৃদু শিরশিরানি তুলে দিয়ে বুকের ভেতরে কেমন কামড় বসিয়ে দিচ্ছে। ফিহা প্রাণপণে নিজের সমস্ত উৎকণ্ঠা চেপে নিয়ে ডার্ক চকলেটরঙা আলমারির দ্বারদুটো খটাশ করে টান মেরে খুলল। আলমারির ডানদিকে সারি সারি হ্যাঙারে ঝুলছে পরিষ্কার ধোপদুরস্ত শার্ট, বাঁদিকের তাকগুলোতে ভাঁজ করা ইস্ত্রিযুক্ত প্যান্ট, প্যান্টের পাশে গোল গোল চাকতির মতো অসংখ্য বেল্ট রাখা, সেই বেল্টের পাশেই মাঝারি সাইজের কফিম্যাট বয়ামটা দৃষ্টিগোচর হতেই ভেতরে হাত ঢুকিয়ে বের করে আনল ফিহা। ঠিক তখনই বয়ামটার ঢাকনার উপর ছোট্ট একটা কাগজের টুকরো দেখে ভ্রুঁদুটো কুন্ঞ্চন করে তাকাল। দু’আঙুলে ছোট্ট হলুদ চিরকুটটা তুলে নিতেই সেখানে জেল কালিতে প্রতিটি শব্দ পড়ল ফিহা —

‘ আমি জানি না স্বাভাবিক কথাবার্তা কাকে বলে। আমাকে শিখায়নি, শিখিনি। রুম থেকে বেরোনোর প্রয়োজন নেই। মগদুটো আমি আনতে পারব। ডোন্ট শো ইউর রেডিশ বার্থমার্ক টু অ্যানিওয়ান। আমি চাই না ওটা কেউ দেখুক। ‘

.

#নোটবার্তা : পর্বে কোনো ভুল-ত্রুটি পেলে ক্ষমার নজরে দেখবেন। আমি মানুষ। একটি যন্ত্রচালিত রোবট হলে আপনাদের শতভাগ নিশ্চয়তাটুকু দিতে পারতাম। তাই আন্তরিকভাবে দুঃখিত। অপেক্ষারত প্রিয়তুল্য মানুষগুলোকে শ্রদ্ধা ও স্নেহ। ❤

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here