নির্মোচন পর্ব ১৩

0
719

#নির্মোচন . ❤
#পর্বসংখ্যা_১৩ .
#ফাবিয়াহ্_মমো .

বাড়ি ফেরার পর একদণ্ড স্বস্তি পাচ্ছে না ফিহা। কেন মনের ভেতর অজস্র প্রশ্ন ঘুরে বেড়াচ্ছে তা সে নিজেও জানে না। গোসল সেরে দুপুরের খাবার খেয়ে ছাদে এসেছে একটু। বিকেলের কমলাভ সূর্যটা নিস্তেজ হয়ে হেলে পরেছে পশ্চিমদিকে। বাতাসের থেমে থেমে চলা শোঁ শোঁ ধ্বনিতে ফিহার মনটা অদূর কোনো ভাবনার রাজ্যে হাবুডুবু খাচ্ছে। ডানহাতে থাকা স্মার্টফোনটা মৃদু শব্দ করে ছোট্ট একটা কাঁপুনি দিয়ে থামল। অবসন্ন বিকেলের আকাশ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে মাথা নীচু করে ফোনটার স্ক্রিনে তাকাল। স্ক্রিনে ভেসে উঠা নাম ও ম্যাসেজ দেখে চট করে ভ্রুঁ’জোড়া কুঁচকে ফেলে আগ্রহের সাথে ম্যাসেজটা পড়তে থাকে ফিহা। ম্যাসেজটা সাফার এবং সেখানে লেখা, ‘ কল ব্যাক করিস। তোর ফোন বন্ধ। শাড়ি কিনেছিস? ‘। বতর্মানে বিক্ষিপ্ত মনটা এলোমেলো হয়ে আর ইচ্ছে করল না কলব্যাক করে কথা বলতে। সুফিয়া খালার কাছ থেকে জেনেছে স্যারও ওকে কল করেছিল; কিন্তু কলটা কাটতে গিয়ে রিসিভ করে ফেললে সেই যে সুফিয়া খালা ফোনটা সুইচড্ অফ করে দেয়, তারপর সেটা চালু হয় সাড়ে তিনঘণ্টা পর। ছাদের বুকে পড়ন্ত বিকেলের শেষ রোদ মাড়িয়ে ছোটো ছোটো পায়ে চিলেকোঠার দিকে এগোল ফিহা। মসৃণ কাঠের বন্ধ দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলে তাপহীন সূর্যের কমলা রোদে অন্ধকার ঘরটা একফালি আলোতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। টান টান করে চাদর বিছানো ছোটো একটা চৌকি, শূন্য চেয়ারটার পাশে অবহেলার মতো পরে আছে আয়তাকার টেবিলটা, টেবিলের উপর গুছিয়ে রাখা দুটো এ-ফোর সাইজের নোটবুক ও কিছু কলম-পেন্সিল। টেবিলের সামনে এসে একটা নোটবুক ও পেন্সিল তুলে চৌকিতে গিয়ে আরাম করে বসল ফিহা। একবারও ভাবল না এই ঘরের আনাচে-কানাচে যেই মানুষটার স্পর্শ লেগে আছে সে যদি হুট করে এখন এসে পরে তখন? চিলেকোঠার একমাত্র জানালাটি খুলে দিয়ে নিবিষ্ট মনে নোটবুকটির পাতায় ভীষণ যত্ন করে পেন্সিল চালাল ফিহা। খোলা জানালা ও হাঁট করে খোলা দরজা দিয়ে হুঁ হুঁ বাতাস এসে সপাটে ফিহার এলোচুলগুলো মুখের উপর, গালের পাশে, পিঠের উপর উড়িয়ে দিতে ব্যস্ত। পশ্চিমের সূর্যটা যখন আরো একটু ডুবে গিয়ে মৃদু সন্ধ্যার আহ্বান জানিয়ে বেড়াচ্ছে, ঠিক তখনই ডানহাতের পেন্সিলটা থেমে গিয়ে পরিপূর্ণ একটি সাদা-কালো মনুষ্য ছবি নোটবুকটার পাতায় হুবহু একটি বাস্তবিক ছবির মতো ফুটে উঠল। এভাবে যত্ন করে আঁকাটা বিগত সেই একটি ঘটনার পর আর কখনোই হয়নি ফিহার। অষ্টম শ্রেণিতে থাকাকালীন স্কুলের অঙ্কন প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েও যখন বাসায় এসে শুধু আঁকাআঁকির জন্য ডানগালে সপাটে চড় খেয়েছিল, সেই অপমান ও লজ্জার ধিক্কারে আর কখনোই অঙ্কন প্রতিযোগিতা, চারুকলা একাডেমির দূর্দান্ত চিত্রশিল্পী রেশমি আপুর প্রশংসা, বিদেশি প্রতিযোগিদের সাথে মোক্ষম লড়াইয়ের সুযোগ, সেইসব কিছু এক ঝটকায় আজীবনের ছেড়ে দেয় ও। পুরোনো দিনের ফেলে আসা স্মৃতিগুলো রোমন্থন করতেই বুকভরা নিশ্বাসটা ছেড়ে দিয়ে নোটবুকটা সেখানেই ফেলে চিলেকোঠা থেকে বেরিয়ে যায়। নীচে গিয়ে দেখে আফসানা বাড়ি ফিরে হাতমুখ ধুয়ে চা-নাস্তা করছে। সিঁড়ি দিয়ে ফিহাকে নামতে দেখে চায়ে চুমুক দিয়ে হাস্যমুখে ডেকে উঠলেন আফসানা,

– কী রে, তুই ছিলি কই? তোকে নীচে থেকে এতো করে ডাকলাম কোনো সাড়াই দিলি না।

খালামনিকে দেখে মন বেজার ভাবটা ধূলিসাৎ করে হাসি হাসি মুখ নিয়ে কাছে বসল ফিহা। প্রসন্ন হাসিতে স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল,

– ছাদে ছিলাম খালামনি। এজন্য তোমার ডাকগুলো শুনতে পাইনি। আচ্ছা একটা কথা বলো তো, তুমি আজ এতো তাড়াতাড়ি কীভাবে আসলে? সবসময় তো দেখলাম সাতটার পর বাড়ি আসো, আজ সেখানে সাতটা না বাজতেই হাজির?

– ওমা! তাড়াতাড়ি না আসলে তোর শাড়ি কেনার সুযোগ পেতাম? তুই যখন আমাকে দুপুরের দিকে ফোন দিলি, তখন কী জানিস আমি কতোটা ব্যস্ত ছিলাম? ওই ম্যানেজার ব্যাটাকে সাইড এনে সব কাজ বুঝিয়ে তাড়াতাড়ি তোর লাল শাড়ি কিনতে চলে গেছি। দ্যাখ তো এটা পছন্দ হয় নাকি। আমার যা বুড়া বুড়া পছন্দ, তা দেখে তোর ভালো লাগবে নাকি সেটা নিয়ে এখন চিন্তায় মরছি। ও সুফিয়া? চা খেয়ে তো গলা ভিজল না। কী চা খাওয়ালে তুমি?

শেষের কথাটা উচ্চস্বরে সুফিয়ার উদ্দেশ্যে বলতেই তড়িৎ গতিতে রান্নাঘর থেকে জবাব দিলো প্রৌঢ়া,

– আপনে এমনে গ্যাদগ্যাদায়া চা খাইলে তো ডায়বেটিসে ধরব আপা। আপনে তো চায়েরে মিডা পানি বানায়া খান। এতো মিডা দেওন যাইত না। ভাত দিতাছি। ভাত খান।

– ভালোই তো! জুতা মেরে গরু দান করতে চাইছ? আমি ভাত খাব না। পারলে আরেক এক কাপ চা দাও, নাহলে আমিই তোমার রান্নাঘরে গিয়ে মিডা পানি বানিয়ে খাব।

দু’পক্ষের এমন মিষ্টিমধুর তর্ক দেখে ফিহা হাসতে হাসতে শপিংব্যাগ খুলে লাল শাড়ির প্যাকেটটা বের করে দেখল। শাড়িটা তাঁতের, তবে রঙটাকে লাল না বলে মেরুন বললে যুৎসই হবে। এমন সময় সারাদিন পর কিছুক্ষণ আগে গোসল সেরে চোখের, মুখের লালচে ফোলা ভাব একটু কমিয়ে নীচে নামল ফিমা। পড়ণে হাঁটু সমান ঢিলেঢালা অতিমাত্রায় বড়ো গলার গেন্ঞ্জি, নীচে লেডিস ট্রাউজার পরে ভেজা চুল সেরে দিয়ে গম্ভীর মুখে সোফায় বসল। ফিহা মুখ তুলে সামনের সোফায় তাকাতেই বড়োদের সামনে এমন ফালতু ধরণের পোশাক পরা দেখে নিজেই আপামর লজ্জায় নিশপিশ করতে লাগল। আফসানা তর্ক করা বাদ দিয়ে ফিমার দিকে তাকাতেই দ্বিতীয় শপিংব্যাগটা ওর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন,

– নে তো ফিমু। দ্যাখ তো খালামনির পছন্দটা ভালো লাগে নাকি। তোর শাড়িটা খুঁজতে খুঁজতে প্রচুর হয়রান হয়েছি বাপ! মনে মনে তোর জন্য যেই রঙটা পছন্দ করেছিলাম সেটা কোনো দোকানেই পাচ্ছিলাম। ব্যাটারা কীসব সবুজ, বেগুনি, হলুদ দেখাচ্ছিল! শেষমেশ ভেতরের একটা দোকানে গিয়ে এই রঙটা খুবই মনে ধরল। দ্যাখ খুলে।

ফিমা প্যাকেট খুলে হালকা আকাশি রঙের চমৎকার একটি জামদানী শাড়ি আবিস্কার করল। যেটা দেখে মোটেও তার পছন্দ হলো না। ওর গম্ভীররূপী চোখদুটো সামনের সোফায় বসা ফিহার কোলে থাকা মেরুন বস্তুটার দিকে চুম্বকের মতো আকৃষ্ট হলো, কিন্তু মনের কথাটা সে ফিহার দিকে তাকিয়ে উচ্চারণ করল না। মুখে শুধু ফিকে হাসি দিয়ে বলল,

– ভালো হয়েছে খালামনি। তোমার পছন্দ খারাপ না। সামনে কোনো অকেশন পরলে শাড়িটা পরব। আমি তাহলে এটা রেখে আসি।

– আসলেই পছন্দ হয়েছে নাকি খুশি করানোর জন্য আমাকে বললি?

– না, তোমাকে খুশি করাতে যাব কেন? ভালো হয়েছে তাই সত্যটাই বলেছি।

এবার ফিহার দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল,

– যদি ব্যস্ত না থাকিস, একটু রুমে আয়। আমার একটা অ্যাসাইমেন্টে তোর আর্ট করে দিতে হবে।

ফিহা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানিয়ে ফিমার পিছু পিছু রুমে গিয়ে পৌঁছল। রুম পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন এবং স্বাভাবিকভাবে গোছানো। কোথাও অস্বাভাবিকতার চিহ্নমাত্র না পেয়ে মনে মনে ফিহাও ভাবতে লাগল কেন ফিমা আপু দরজা বন্ধ করে লম্বা ঘুম দিয়েছে। পেছন থেকে নব্ লাগানোর শব্দ পেতেই চকিতে পিছু ফিরে ফিমার ক্রুদ্ধদৃষ্টির মুখোমুখি হলো। পায়ে পায়ে ফিহার দিকে এগোতেই শান্ত, ক্ষোভিত, চাপা আক্রোশের কণ্ঠে চিড়বিড়িয়ে উঠল ফিমা,

– আফিফের ব্যাপারে কবে, কখন, কোনসময় ফাঁস করেছিস তুই? কীভাবে জুনায়েদ সাঈদের কান অবধি এই কথা পৌঁছাল? আমার সামনে অবুঝের নাটক করবি না ফিহার বাচ্চা! তোর জন্য আমি আফিফের কাছে কী পরিমাণে অপমানিত হয়েছি তুই কল্পনাও করতে পারবি না। বাংলা নাটক ছেড়ে সত্যটা উগরে বল্।

দু’চোখ আশ্চর্যভাবে বড়ো বড়ো করে ফিহা নিজেও চরম বাকশূন্যতায় স্তব্ধ হয়ে বলল,

– কী আশ্চর্য! আমার কী মাথা খারাপ? তোমার আর আফিফ ভাইয়ার খবর আমি কেন ফাঁস করতে যাব?

– চুপ্, নাটক করবি না। এই সি-গ্রেডের নাটক জায়গামতো দেখাবি। তোর জন্য ভরদুপুরে আমি সবার সামনে ইনসাল্ট হয়েছি। এখন যদি তুই আমার সামনে উলটাপালটা কাহিনি করিস তোর নাটকের ঝাল আমি মিটিয়ে ছাড়ব।

অকথ্য ভাষার প্রগলভ্ দেখে ফিহার মেজাজটাও ভেতরে ভেতরে ভয়ংকর রূপ নিচ্ছে। নিজেকে বাইরে থেকে শান্ত দেখিয়ে আবারও স্বাভাবিকভাবে জানতে চাইল,

– আমি যেখানে পুরো ঘটনা জানি না, সেখানে আমাকে দোষী সাব্যস্ত করা থেকে একশো হাত দূরে থাকবে। আমার এতো টাইম নেই যে তোমার ফালতু কাহিনি নিয়ে পরে থাকতে যাব। ভালোমতো জিজ্ঞেস করছি, ভদ্রভাবে জবাব দাও। তোমার কোন্ ঘটনার জন্য তুমি আমাকে এবং যার নাম ধরে ডাকার কঠিন সাহস দেখাচ্ছ তাকেও দোষী সাব্যস্ত করছ?

মধ্যবর্তী দূরত্ব সম্পূর্ণ কাটিয়ে একেবারে ফিহার মুখোমুখি হয়ে দাঁত চিবিয়ে বলতে লাগল ফিমা,

– আফিফের ব্যাপারটা আমার তিন ফ্রেন্ড আর তুই ছাড়া কেউ জানত না। সেখানে আরেকজন ব্যক্তি এটা কীভাবে জানতে পারল? আফিফকে বাবুরাইল রোডে ডেকে এনে পিটিয়ে জখম করে আমার কাছ থেকে দূরে থাকতে বলল কেন? আছে জবাব? আফিফের কাজিন এসে আমাকে যুঁথিদের সামনে ইচ্ছামতো যা-তা ব্যবহার করে কথা শোনাল! এই দায়ভার কে নিবে? তুই?

সিলিং ফ্যান ঘুরার মতো বনবন করে ফিহার মাথাটা যেন ঘুরতে লাগল। ও তো জানেই না কখন কীভাবে বীভৎস ঘটনাগুলো আড়ালে-আবডালে ঘটে গেছে। এমনকি ফিমার ঘটনায় অযৌক্তিকভাবে সাঈদের ঢোকাটা কেন জানি আরো বিভ্রান্তির মধ্যে ফেলে দিল ওকে। ফিহা কোনো উত্তর না পেয়ে নীচের শুকনো ঠোঁটটা জিভে ভিজিয়ে নিয়ে আবারও বলে উঠল,

– জ্ঞান থাকতে ওয়াদা দেওয়া কথা আমি ভাঙি না। অত বড়ো পাষাণ বা মূর্খ আমি নই। আমার মনে হচ্ছে এখানে কোনো ভুল আছে, যা দু’পক্ষের কথা না-শোনা অবধি বুঝতে পারব না।

রাগে ফুঁসতে থাকা ফিমা সামান্য এই কথাটুকু আমলে না নিয়ে উলটো তেজালো রাগে ভয়ংকরভাবে ফেটে পরল,

– তুই কী ভেবেছিস আমি কিছু বুঝি না? ভেতরে ভেতরে আমার বিরুদ্ধে হিংসা পুষে এখন ভালোমানুষি সাজার অভিনয় করছিস? বাবাকে নিজের আঙুলে নাচিয়ে তুই —

কথাটা বলতেই হঠাৎ প্রচণ্ড আগ্রাসী রূপে ফিহার চুলটা খামচে ধরতে গেল ফিমা, পারল না। ফিহা সঙ্গে সঙ্গে সরে গিয়ে ফিমার হাতদুটো ক্রস করে আঁটকে নিজের টালমাটাল ক্ষোভটা এবার ঝেড়ে দিয়ে বলল,

– খবরদার! চুল টাচ করার সাহস দেখাবা না! বাবা, মা সবসময় তোমার ব্যাপারগুলো নিয়ে প্রায়োরিটি দিয়ে দেখেছে, আমারটা না। সেখানে আমার উচিত ছিল তোমার ব্যাপারগুলো নিয়ে হিংসা করা। অথচ, ওই ধরণের থার্ডক্লাস হিংসা আমি করিও না, করব না। বড়ো বলে যতটুকু সম্মান তোমাকে দেখানো প্রয়োজন ততখানিই দেখাব, কিন্তু বাড়াবাড়ি রকমের বাজে আচরণ দেখাতে এলে তোমাকে আমি ছেড়ে কথা বলব না। তোমার সো-কল্ড বন্ধু নিয়ে সাজেক ঘুরো, জাফলং যাও, যেটা খুশি সেটা করো। আমার কোনো ইন্টারেস্ট নেই তোমার ঘটনা দেখার জন্য। যাকে তুমি অভদ্রের মতো নাম ধরে ডাকছ, এই কাজটা তুমি তাঁর সামনে করে দেখো, তোমাকে ভালোমতো শিক্ষা দিয়ে ছেড়ে দিবে। বাবা-মার মতো তোমার ফালতু ভুলগুলো ইগনোর করতে যাবে না ফিমা আপু। আর হ্যাঁ, আমাকে তুমি দয়াকরে রাগাতে এসো না। আমি শান্তিপূর্ণ মানুষ, আমাকে শান্তিমতো থাকতে দিয়ো। অশান্তির মধ্যে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলে তোমাকে সম্মান দিতে আসব না।

রাগারুণ মুখে তেজস্বী ব্যক্তিত্বের মতো প্রত্যেকটা কথা শুনিয়ে দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল ফিহা। বেরোনের শেষমূহুর্তে পা থামিয়ে সরাসরি ফিমার দিকে জোরাল স্বরে বলল,

– পড়ণের ওসব গেন্ঞ্জি-ট্রাউজার পালটে এসো, এটা আমাদের বাড়ি না। মা এই ধরণের জামাকাপড় আমাদের বাড়ি ছাড়া অন্য কোথাও পরার অনুমতি দেয়নি। বড়োদের সামনে কেমন জামাকাপড় পরা উচিত আমার চেয়ে তুমি ভালো জানো।

মুখ ঘুরিয়ে নিজের রুমের দিকে ত্রস্তভাবে পা চালাল ফিহা। এদিকে হতভম্বের মতো কেউ যে ওর মুখের উপর এইভাবে কট্টর ভঙ্গিতে কথাগুলো শুনিয়ে দিয়েছে এটা কল্পনাও করতে পারছে না ফিমা। যেখানে নিজে বড়োজন হবার দরুন ছোটোবোনের গালে কষিয়ে দুটো চড় লাগানোর কথা, সেখানে বলদের মতো চুপ মেরে একটা কথাও বলতে পারল না ফিমা।

.

রাত বারোটার পর থেকে আবহাওয়ার হঠাৎ পরিবর্তনে দেশের আনাচে-কানাচে ঠান্ডা ভর করল। গরমের তীব্র তাপদাহে অতিষ্ঠ হওয়া জনগণ এবার স্বস্তির নিঃশ্বাসে গা ছেড়ে বাঁচল একটু। টিভির পর্দায় দেখাতে শুরু করল আজ বৃষ্টি হবে এবং আগামী কিছুদিন দেশের বিভিন্ন জেলায় মাঝারি থেকে তুমুল বৃষ্টিপাত হবার সম্ভাবনা রয়েছে। সকালে নাস্তার জন্য ব্যস্ত আফসানা টিভির খবরটা শুনতে শুনতে সুফিয়ার দিকে বললেন,

– ও সুফিয়া? কী বলে এগুলো? দীপের বিয়ে কী বৃষ্টির মধ্যে পরবে নাকি? বৃষ্টি হলে তো বিপদ! প্যান্ডেল, আয়োজন সবকিছুই বৃষ্টির পানিতে তছনছ হয়ে যাবে।

সুফিয়া পাশে দাঁড়িয়ে নিজেও টিভির সংবাদটা শুনতে শুনতে তীব্র আফসোস করে বলল,

– হ, আপা সময় তো নাই কা। শুক্কুরবারে বিয়া, আর আইজকা মঙ্গলবার যাইতাছে। কী হইল এডি? এহনো তো আপনে মার্কেট-মুর্কেট কিচ্চু করলেন না। মাইয়াগুলিরে ভাইয়ের বিয়াত কিচ্চু দিবেন না কিন্না? কী করবেন এহন? ভাবছেন কিছু?

ভীষণ চিন্তিত হয়ে মুখটা সুফিয়ার দিকে ফেরালেন তিনি,

– আজ ছাড়া তো উপায় দেখছি না সুফিয়া। কী করি এখন? এদিকে ফিহার কালকে কলৈজে অনুষ্ঠান, আবার রোকসানা সেদিক থেকে মেয়েদুটোকে পাঠিয়ে দিতে কালই চাপ দিচ্ছে। ওই বাড়িতে দীপের চাচাতো, ফুপাতো ভাইবোনগুলো সব একত্র হয়েছে দেখে দীপও চাইছে ফিমা-ফিহা হাজির হোক। আমার এখানকার কাজ শেষ করতে করতে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা। আবার সাঈদের ছুটি হচ্ছে কিনা তাও জানি না। কী একটা ফ্যাসাদে পরে গেলাম বলো এখন!

– আমি কী নাবিলারে বুঝায়া কমু কালকা অনুষ্ঠানে না গিয়া দীপের ওইদিকে যাইতে? নাইলে এক কাম করি আপা, লাবিবরা তো দীপের বিয়াত যাইতেছেই। ওগোর লগে ফিমা আর ফিহারে ব্যবস্থা কইরা দেই, কি কন?

– না, বুড়ির সাথে এই কাজ কোরো না। বান্ধবীদের সাথে এই বয়সে আনন্দ না-করলে আর কবে করবে? যেতে দাও। আমি নাজু আর রোকসানাকে ফোন করে বলে দিচ্ছি, তুমি আর ফিমু কাল দুপুরের দিকে লাবিবদের গাড়িতে রওনা দিচ্ছ। আমি মেজর সাহেবের সাথে বৃহস্পতিবার রাতের মধ্যে সব পাট চুকিয়ে রওনা দেওয়ার চেষ্টা করব। মেজর সাহেব ফোন করে বারবার বলে দিয়েছেন খালিহাতে ওদের বাড়িতে না যেতে। তাহলে কেনাকাটার জন্য আজকে বের হওয়া ছাড়া উপায় দেখছি না। তুমি বিকেলের মধ্যে সব কাজ করে আমার জন্য অপেক্ষা করবে। আমি এক ফাঁকে তোমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য গাড়ি পাঠিয়ে দিব।

চুপ করে সমস্ত কথা শ্রবণ করতেই সুফিয়ার হুঁশিয়ার মাথাটায় দারুণ একটা বুদ্ধি চলে এল। তিনি মনে মনে কথাটা সাজিয়ে নিয়ে আফসানার দিকে বলে উঠলেন,

– তাইলে আপা, আরেক কাম করন যায় কিন্তু। আপনে তো এইদিকে নতুন বউয়ের লিগাও কেনাকাটা করতে যাইতাছেন। আমি একখান বুড়া ফুড়া বেডি, অন্যদিকে আপনেও কইলাম যুগের লগে তাল মিলায়া জিনিস কিনতে পারতেন না। আমগোর ফিমায় কিন্তু এই কামের লিগা এক্কেবারে ফিট হইব আপা। কচি মাইয়া-পুতের সাজুন গুজুনের জিনিস ওর চাইতে ভালা কেউ বুঝত না। ওরেও লগে লই কি কন?

– ওমা! ফিহা কী বাড়িতে একা থাকবে নাকি?

– হুরো আপা, খালি চিন্তা করেন ক্যান? সাঈদে তো আজকা পাঁচটার সময় আইয়া পরব কইছে। আমি এইদিকে কাম-কাজ সব গুছায়া ফিমারে লইয়া রেডি থাকমু।

সুফিয়ার কথাটা মন দিয়ে শোনার পর আপন ভাবনায় নিজে নিজেও কিছুক্ষণ ছক কষলেন আফসানা। ফিহার সাথে প্রথমেই যেই ধুরন্ধর সমস্যাটা সাঈদের সাথে হয়ে গেছে, ওটার জন্য কী এখনো তাঁর ছেলে ফিহার সাথে তর্কবিতর্ক করবে কিনা। যদিও ফিহার সাথে গতকাল সাড়ে তিনঘণ্টা ঘুরেফিরে তেমন রাগ, ক্ষোভ, বিরক্তি প্রকাশ করেনি ও, তাহলে এটা ধরেই নেওয়া যায় ওদের মধ্যে সাপে নেউলে ব্যাপারটা এখন আসবে না। নিশ্চিত মনে সবকিছু ঠিকঠাক দেখে এবার অফিসের জন্যে বেরিয়ে গেলেন আফসানা।

.

বিকেলের আকাশ জুড়ে ঘন কালো পৈশাচিক মেঘ এসে পুরো চারধার অন্ধকার করে রেখেছে। জানালা দিয়ে বাইরে তাকালে ঝুম বৃষ্টির আগ্রাসী অবস্থা দেখা যায়। একটু আগে বাবার সাথে কথোপকথন সেরে রান্নাঘরে ঢুকেছে ফিহা। বতর্মানে বাড়িতে কেউ নেই। সুফিয়া ও ফিমা আফসানার পাঠানো গাড়িতে ঘণ্টাখানেক হলো শপিংয়ের জন্য বেরিয়ে গেছে। শূন্য খাঁ খাঁ করা বাড়িতে একা থাকলেও পাহারাদার দারোয়ানদুটো যে ধরণের নিরাপত্তা দিয়ে থাকে, তাতে এক সপ্তাহ যদি এভাবে থাকার প্রয়োজন হয় তাতেও ফিহার ভয় নেই। এমন সময় বাড়ির কলিং বেলটা সশব্দে বেজে উঠলে দরজার বাইরে আগন্তকের নির্দেশ পাঠিয়ে দিল। তড়িঘড়ি করে দরজা খুলে দিলে সামনে দাঁড়ানো লম্বা, ঋজু ও বৃষ্টির পানিতে জবুথবু ভেজা মানুষটাকে দেখে তৎক্ষণাৎ চোখ নামিয়ে সরে গেল ফিহা। বৃষ্টির ছোবলে সমস্ত শরীর ভিজে গিয়ে গা চুয়েচুয়ে এখন পানি ঝরছে সাঈদের, তবু ডানহাতে ধরা প্যাকেটটা সন্তপর্ণে হাত উলটো করে পিঠের আড়ালে দক্ষভাবে লুকিয়ে নিয়েছে। সামনে থেকে ফিহা চটপট সরে গেলে ফ্লোরে হাঁটু ঠেকিয়ে জুতার ফিতাগুলো খুলতে থাকলে এক ফাঁকে জুতার ছোটো আলমারিটার পেছনে প্যাকেটটা লুকিয়ে রাখল সে। ঠিক তখনই সামনে থেকে আবারও ফিহা হাজির হয়ে তোয়াল বাড়িয়ে বলল,

– মাথা মুছে নিন।

তোয়ালে ধরা হাতটায় চোখ বুলিয়ে আবারও জুতা খোলার দিকে মনোযোগ দিল সাঈদ।

– লাগবে না।

বড়ো অদ্ভুত কারণে এমন নৈব্যর্ক্তিক উত্তর শুনে মেজাজটা একটু খারাপ হলো ফিহার। সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যুত্তর জবাবটা বড্ড তেজ দেখিয়ে বলল,

– আপনার জবাবটা আমার কাছে ভালো লাগেনি। আপনি যে বৃষ্টির মধ্যে কাক ভেজা হয়ে বাড়ি এসেছেন সেই হুঁশ কী আপনার আছে? জনাব, আপনার মা বা খালা কেউই এই মূহুর্ত্তে বাড়ি নেই। আপনাদের কোনোকিছু সম্বন্ধে আমি একদণ্ড জানি না। এমতাবস্থায় ১০৪ ডিগ্রি জ্বরে কাঁদা হয়ে পড়লে বাড়িতে ডাক্তার ডাকতে পারব না। দয়াকরে, ভদ্র মানুষের মতো হাত থেকে তোয়ালেটা নিন এবং সেটা মাথায় প্রয়োগ করুন।

মধ্যবর্তী দূরত্বটুকু ফিহা দর্পের সাথে নিজেই ঘুচিয়ে সদ্য জুতা খুলে দাঁড়ানো সাঈদের হাতে তোয়ালে ধরিয়ে দিচ্ছিল, কিন্তু পা ঘুরিয়ে যেতে নিলে খেয়ালই করল না, নীচের ফ্লোরটা পানির জন্য বেকায়দায় পিচ্ছিল হয়ে গেছে। দ্রুতপায়ে এগোতে নিলে বেমক্কা পা ফসকাতেই তীব্র ভয়ের আক্রোশে চিৎকার দিয়ে উঠল ফিহা, কয়েক মূহুর্ত্তের জন্য মাথার ভেতরটা ‘ ভোঁ-ও ‘ শব্দে তব্দা মেরে থাকলে সারামুখ ঘামিয়ে চোখ খুলে তাকাল। সম্মুখে একজোড়া স্থিরচক্ষু দেখে ফিহাও কেমন বেকুবের মতো আমতা আমতা করে বলে উঠল,

– আ-আমি কী পরে যাইনি?

– না তো।

– আমি কী বেঁচে গেছি?

– তাই তো মনে হয়।

বোকা বোকা প্রশ্নের এমন সরল জবাবে প্রথমবার মানুষটার চোখে হাসি হাসি ভাবটা দেখতে পেল ফিহা। বড্ড সুন্দর, বড্ড আদুরে সেই ভাব। অন্যদিকে সবল দৃঢ় হাতদুটো ভারী ভারী বস্তু ধরার জায়গায় আজ ভাগ্যলীলায় নরম তুলতুলে দেহটা নিজের প্রস্তরকঠিন বুকটার সাথে মিশিয়ে রেখেছে। আকস্মিকভাবে পরতে যাওয়া ফিহার সদ্যস্নাত দেহ থেকে মেয়েলি গায়ের মিষ্টি সুভাস গন্ধটুকু আচ্ছন্ন করছে ঘোর লাগা মাদকের মতো। পেছনে হাঁট করে খোলা দরজা দিয়ে হুঁ হুঁ করে ঢুকছে ঠান্ডা ভিজভিজে পাগলা হাওয়া, সেই হাওয়াতে উচ্ছ্বসিত হয়ে চোখে মুখে ছুঁয়ে যাচ্ছে মিষ্টি গন্ধ মাখানো আধা-শুকনো এলোচুল। পাথরের মতো শক্ত কঠিন থাবাটা তুলতুলে পিঠের মধ্যে আস্তে আস্তে মোমের মতো ডেবে যাচ্ছে। ভীষণ ঘন হয়ে আসছে থরথর করে কাঁপতে থাকা দুটো লোভাতুর কোমল ঠোঁট। একটুখানি ছুঁয়ে দিলে কী থরথর করে কাঁপতে থাকা ঠোঁটদুটো শান্ত হয়ে যাবে? ভুলবশত আজ ওড়না না থাকায় গায়ের ল্যাভেন্ডার কামিজের একটুখানি বড়ো হয়ে থাকা গলাটা দিয়ে ছোট্ট একটা জিনিস দেখতে পেল সাঈদ। ডানকাঁধের বিউটি-বোন্ হাড্ডিটার একটু নীচে ছোপ ছোপ রক্তের মতো লালচে একটা জন্মদাগ সন্তপর্ণে ফুটে আছে। বুকের মসৃণ ফুটফুটে চামড়ায় চুম্বকের মতো দৃষ্টি আকর্ষণ করছে লাল টুকটুকে ওই জন্মদাগটা। যদি মাথাটা নামিয়ে একটু নীচু করে একবার ওই জায়গাটুকু ছুঁয়ে দেওয়া যেতো, শুধু একটাবার অধিকারস্বরূপ রাখা যেতো তপ্ত ছোঁয়ার পরশ তাহলে বাহুবন্ধনে আঁটকে থাকা এই তুলতুলে নরম দেহটা কেমন করে কেঁপে উঠতো তখন? হঠাৎ ঘোরলাগা সন্ধিক্ষণে নির্জন বাড়িটার শূন্য দেয়ালে গমগম করে উঠল পুরুষালী কণ্ঠের তীব্র চিৎকার,

– ফিহা! কী হচ্ছে এসব!

#নোটবার্তা — গতকাল রাতে লোডশেডিং এবং ঘুম দুটোই তীব্ররূপে হানা দিয়েছিল। তাই আজকের এই পার্টটা বিশাল বড়ো করে লিখেছি। ভুল ও ত্রুটি ক্ষমাপূর্ণ চোখে দেখার অনুরোধ। কমেন্ট সেকশনে আবারও আপনাদের ছোটো-বড়ো সব মন্তব্য শোনার জন্য অপেক্ষা করছি। ❤

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here