নক্ষত্র বন্দনা পর্ব ১৯

0
413

#নক্ষত্র_বন্দনা

#পর্ব_১৯

#লেখায়_জারিন

১০৭.

চোখ মুখে একটু পর পর পানির ছিটা এবং শরীরে অনবরত ঘর্ষণের অনুভব হতেই পিটপিট করে চোখ খুললো ইরিন।পূর্ণ দৃষ্টি মেলে তাকাতেও ভীষণ কষ্ট হচ্ছে তার। নিভু নিভু দৃষ্টিতেই কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে মস্তিষ্কের নার্ভগুলোকে পুরোপুরি সজাগ হওয়ার সময় দিল। মস্তিষ্ক সজাগ হতে শুরু করলে নিজেকে সে বিশাল বাথটবে পানির মধ্যে আবিষ্কার করলো। একই সাথে ঘর্ষণ অনুভূতির উৎস হিসেবে আবিষ্কার করলো ওয়াসিফের হাতে থাকা নিজের হাতটা। ওয়াসিফ বাথটবে তার মুখোমুখি বসে সোবায় সাবান নিয়ে তার হাতে ঘষছে। ময়লা লাগলে যেভাবে মানুষ সাবান পানি দিয়ে পরিষ্কার করে ঠিক সেভাবেই। ইরিন সেকেন্ড কয়েক তাকিয়ে থেকে ওয়াসিফের কান্ড দেখলো। ওয়াসিফ পূর্ণ মনোযোগের সাথে ওর হাতের কোণায় কোণায় পরিষ্কার করছে। এছাড়াও নিজের দিকে যথাসম্ভব তাকিয়ে ইরিন বুঝলো…তার ঘাড়, গলা কাঁধে এখনো সাবানের ফ্যানা লেগে আছে।

নিজের অবস্থান এবং পরিস্থিতি অনুধাবন করতেই দূর্বল শরীরেই ঝট করে হাত সরিয়ে নিল ইরিন। ভয় পাওয়া স্বরে নিস্তেজ কন্ঠে চেঁচিয়ে বললো, ‘কি করছেন আপনি?’

ওয়াসিফ এতক্ষণ খেয়াল করেনি ইরিনের জ্ঞান ফেরার ব্যাপারটা। সে তার কাজে ব্যস্ত ছিল। ইরিনের আচমকা এমন রিয়্যাক্ট করা দেখে প্রথমে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলেও তা কাটতে সময় নিল না একেবারেই। ইরিনের সরিয়ে নেয়া হাতটা আবারও টেনে নিয়ে ঘষা শুরু করলো। ইরিন বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করততেই বললো, ‘এভাবে টানাটানি করছো কেন?পরিষ্কার করছি তো। এত ভালোবাসাবাসির পর ফ্রেশ না হলে চলে, সুইটহার্ট? তুমি যেভাবে সেন্সলেস হয়ে পড়ে ছিলে, তাই ভাবলাম আমিই না হয় দ্রুত এ কাজটা করে দেই তোমাকে। ওভাবে আর কতক্ষণ থাকতে বলো! এমনিতেও ভালোবাসাবাসির বোধয় কিঞ্চিৎ ওভারডোজ হয়ে গেছে তোমার জন্য। ব্লিডিং পুরোপুরি থামছেই না। তাই এই সেবাটুকুও আমিই করে দিচ্ছি আমার সুইটহার্টকে। ‘

কথাগুলো বলতে বলতেই একপলক ইরিনের দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিল ওয়াসিফ। ইরিন অবাক হয়ে শুনলো ওয়াসিফের কথা। ওর মনে পড়লো পর পর কয়েকদফায় ভোগ হওয়ার পর ওর চোখে সব আবছা আবছা ঠেকতে শুরু করে। তারপর আর কিছু মনে নেই। এখন ওয়াসিফের কথায় বুঝলো, সে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল।

হঠাৎ ইরিনের মনে হলো, ‘আচ্ছা, কয়টা বাজে এখন? নক্ষত্র কি আসেনি তাকে নিতে? তাকে না হোক অন্তত নিজের রাজকন্যার জন্য হলেও তো আসার কথা। কেন আসেনি? নাকি এসেছিল? এসব ভাবতে ভাবতেই ইরিন চট করে প্রশ্ন করলো, ‘উনি আমাকে খুঁজতে আসেননি? ‘

ইরিনের কথা শুনে অবাক নয়নে ওর মুখের দিকে তাকালো ওয়াসিফ। ইরিন উত্তরের অপেক্ষা করছে ওয়াসিফের মুখপানে চেয়ে। কিন্তু, তাকে নিরাশ হতে হলো। ইরিনের থেকে চোখ সরিয়ে ওয়াসিফ জবাব দিল, ‘তোমার খোঁজে পুলিশ স্টেশনে গিয়েও হাজির হয়েছিল তোমার উনি। কিন্তু, ডিভোর্স পেপার পাওয়ার পর মনে হয় এতক্ষণে কেস ক্লোজও হয়ে গেছে। কারণ, আদৃতসহ বাকিরা জানে তুমি গতকাল রাতেই দেশ ছেড়েছো। কোথায় গেছো কেউ জানে না। তো, খুঁজে কি করবে আর!’

ইরিন বাকরুদ্ধ! ওয়াসিফ এত নিখুঁতভাবে পরিকল্পনা সাজিয়েছে যে ইরিন গলা ফাটিয়ে চিৎকার করলেও কেউ বিশ্বাসই করবে না যে ওর সাথে অন্যায় হয়েছে। প্রতারণার শিকার সে। আর নক্ষত্র?! এত কিছুর পরেও সে কি গ্রহণ করবে তাকে? হুহ! প্রশ্নই আসে না। তাই হয় তো ম্যাসেজ দেখেও বিশ্বাস করেনি ইরিন এখনো এই দেশেই রয়েছে। একই শহরে! তবে কি সত্যিই সব শেষ হয়ে গেছে? আর তাদের বাচ্চাটা? তার কি হলো?

ইরিনকে ভালোভাবে ঘঁষে পরিষ্কার করা শেষ। ওয়াসিফ একনজরে ভালোভাবে দেখে নিল ইরিনকে। উষ্ণ পানিতে চোখ বন্ধ করে পাথরের মূর্তির মত স্থির হয়ে বসে আছে ইরিন। দু চোখের কোণ বেয়ে বইছে অশ্রুধারা। তবে, তার কাজটা ঠিকঠাকভাবেই হয়েছে বলে নিশ্চিত হলো ওয়াসিফ । এবারে আর কোন রিক্স নেই। সন্তুষ্টচিত্তে নিরবেই হাসলো সে।

তারপর, কিছু মূহুর্তের ব্যাবধান।ইরিনের নিস্তেজ গলা ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাওয়ার মৃদু আত্মচিৎকার। বাথটবের লাল লাল পানিগুলোও মৃদু তরঙ্গে কাঁপছে। কিছু মূহুর্তের ছটফটানি। তারপরেই সব নিরব। নিস্তব্ধতায় গূঢ়।

১০৮.

হোটেলে পুলিশ টিম এসেছে এ খবর জানাজানি হতেই ৭ম তলায় মানুষে গিজগিজ করছে একেবারে। ঘটনাস্থল হিসেবে রুমটাকে ইতোমধ্যে সিল করে দেওয়া হয়েছে। কাউকেই রুমের ধারে কাছে ঘেঁষতে দেওয়া হচ্ছে না। এস. আই খালিদ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পুরো রুমটাকে দেখলেন। একদম নীট এন্ড ক্লিন। হবারই কথা! স্টাফ বয় এসে আগে রুমটাকেই পরিষ্কার করেছে। তারপর ওয়াশরুমে গিয়েছিল ক্লিন করতে। আর সেখানেই ইরিনকে দেখে সে। খবর দেয় ম্যানেজারকে।আত্মহত্যার মামলা মনে করে পুলিশকে খবর দেওয়া হয়। সাথে আসা ফরেন্সিক টিম জানায় ভিকটিম মলেস্ট হয়েছে। পথে যেতে যেতে পাওয়া এই। আপডেটই তিনি নক্ষত্রকেও বললেছিলেন। শরীরে বেশ কিছু ক্ষত চিহ্ন তাই জানান দিচ্ছে।

এস. আই খালিদ একবার নিজের হাত ঘড়িটার দিকে তাকালেন। নক্ষত্রকে ফোন করেছিলেন অনেক্ষণ আগে। কিন্তু সে এখনো এসে পৌঁছায়নি। তার সাথে দেখা হলে ভালো হতো। কিন্তু, ভিক্টিমের অবস্থা চিন্তা করে তাকে আগে হাসপাতালে নেওয়াটাই উচিৎ মনে করলেন তিনি। তাই সাথে আসা সদস্যদের হোটেলে প্রাথমিক তদন্তের নির্দেশ দিয়ে তিনি ভিকটিমকে নিয়ে রাওনা হলেন হসপিটালে।

লিফটের দরজা খুলতে বড়সড় ধাক্কা খেল নক্ষত্র। সাদা চাদর রক্তে লাল করে নিস্তেজ হয়ে স্ট্রেচারে শুয়ে আছে ইরিন। চোখ বন্ধ। হাতে ব্যান্ডেজ করা। পায়ের কাছটায় রক্তের ছাপ বেশি। সাদা চাদর দিয়েই বুক পর্যন্ত ঢাকা। বোঝাই যাচ্ছে চাদরের নীচে গায়ে সুতোটি নেই তার। ঠোঁট কালচে হয়ে ফুলে আছে। গলায় কাঁধে অসংখ্য আঙুলের কালসেটে দাগ। আঁচড়ের লাল দাগ। ভিজা চুল থেকে পানি পড়ছে এখনো। কিছু কিছু চুল লেপ্টে আছে মুখের দুপাশেই…গলায়।

বিভৎস কোন দুঃস্বপ্নের মত একটা দৃশ্য চোখের সামনে স্থির হয়ে আছে যেন। নক্ষত্র অবিশ্বাসের চোখে তাকিয়ে আছে ইরিনের দিকে। তাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে এস. আই খালিদ ওয়ার্ডবয়দের ইশারা করলেন ইরিনকে এম্বুলেন্সে তুলতে। তারা যেতে নিলেই নক্ষত্র দূর্বল গলায় কোন রকমে উচ্চারণ করলো, ‘ও এখানে কেন? কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন ওকে?’

নক্ষত্রের এমন অবস্থা দেখে খারাপই লাগলো এস.আই খালিদের। তিনি তো জানেন গত দুই দিন কি পরিমাণ খোঁজ করেছে নক্ষত্র ইরিনের। কেস ফাইল করার জন্য পুলিশ স্টেশনেই অপেক্ষা করেছে ঘন্টার পর ঘন্টা। প্রচন্ড ভালো না বাসলে কেউ কাউকে এভাবে পাগলের মত হন্যি হয়ে খুঁজে না।

তিনি নক্ষত্রের কাঁধে হাত রেখলেন আলতো করে। হালকা চাপড়ে দিয়ে বললেন , ‘বি স্ট্রং মি. আদৃত। ইটস আ সুইসাইড কেস। বাট ফার্স্ট শী ওয়াজ রেপড। ব্লিডিং অনেক হয়ে গেছে অলরেডি। এখনো হচ্ছে। হসপিটালে নেওয়া জরুরি। ‘

নক্ষত্র বজ্রাহতের মত করে এস. আই খালিদের মুখের দিকে চাইলো। তিনি আবাও শান্ত্বনা দিয়ে বললেন, ‘ধৈর্য্য ধরুন। আপনাকেও যেতে হবে এ আমাদের সাথে। হসপিটালের ফর্মালিটিজ ফিলাপ করতে লাগবে আপনাকে। চলুন।’

নক্ষত্র আর এক সেকেন্ডও দেরি করলো না। ছুটে গেল ইরিনের এম্বুলেন্সের কাছে। নিজেও এম্বুলেন্সের ভেতরে উঠে গেল ইরিনের সাথে। ওয়ার্ডবয়রা প্রথমে বাঁধা দিলেও নক্ষত্র শোনেনি। জেদ করে বসে ছিল। তা দেখে এস. আই ওয়ার্ডবয়দের বললেন তারা যেন নক্ষত্রকে থাকতে দেয় সাথে।

হসপিটালে পৌঁছানোর আগেই ইরিনের জ্ঞান ফিরে। নক্ষত্রকে দেখে স্বপ্নবিলাসের মত মৃদু হাসে সে। ভ্রম বলে ধরে নেয়। নক্ষত্র ইরিনের চোখে চোখ রাখে না। রাগে দুঃখে ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নেয়। ইরিনের এই অবস্থার জন্য তাকেই দায়ী করে ঘৃণায় বিষিয়ে উঠে নক্ষত্রের মন।তার ভালোবাসার মানুষটা অন্যের লালসায় পিষে গেছে ভেবেই রাগে জ্বলে উঠে সমস্ত শরীর। দুঃখ হয় ইরিনও তাকে ঠকিয়েছে বলে।

ইরিন তা দেখেও হাসে। এই তো হওয়ার ছিল। তার আকাশের একটামাত্র নক্ষত্রই আজ খসে গেল খুব অসময়ে। চিরতরে হারিয়ে গেল তার জীবনে অন্ধকার টেনে। এই তো প্রাপ্য ছিল তার। এখন শুধু বাকি আছে মাটির অতল অন্ধকারে নিজেকে মিশিয়ে নেওয়ার অপেক্ষা।

১০৯.

রাত ৯ টা। অনেকক্ষণ হলো ডাক্তারের কেবিনে বসে আছে নক্ষত্র। অপেক্ষা করছে ডাক্তারের জন্য। নক্ষত্র ব্লাডের ব্যাগ দুটো নার্সকে দিয়ে আসার সময় তাকে জানানো হয়েছে যেন সিনিয়র ডাক্তারের সাথে দেখা করে একবার সে।

কেবিনে এসে শুনে যে উনি ইরিনকে চেক আপ করছেন। শেষ করে কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবেন। নক্ষত্র যেন ততোক্ষণ একটু অপেক্ষা করে।

সুসজ্জিত টেবিলের উপর রাখা নেইম প্লেটটা একনজর দেখলো নক্ষত্র। কালোর মাঝে রূপালী অক্ষরে লেখা ড. সুব্রত মুখোপাধ্যায়। স্ত্রী ও প্রসূতি রোগ বিশেষজ্ঞ। নীচে তার হরেক রকমের ডিগ্রীর ছোটখাটো একটা বর্ণনা দেওয়া। নক্ষত্র সেসব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ছিল। এরই মাঝে ডাক্তার এসে বসলেন নিজ চেয়ারে।

নক্ষত্র তাকে খেয়াল করতেই তিনি মুচকি হাসলেন। জানা থাকারও প্রশ্ন করলেন, পেশেন্ট মিসেস.ইরিনের হাজবেন্ড, রাইট?

‘জ্বী। আদৃত রাওনাফ নক্ষত্র।’

‘ওয়েল…মি. আদৃত, আপনাকে কিছু জরুরী কথা বলার জন্য ডেকেছি। মূলত আপনার ওয়াইফের কন্ডিশন নিয়ে আপনার সাথে পার্সোনালি আমার কিছু ডিসকাস করার আছে। তারপরেই আমি পুলিশের কাছে পেশেন্টের ফরেন্সিক রিপোর্ট দিতে চাই।

‘জ্বী.. বলুন।’

‘আপনাদের বিয়ের কতদিন হয়েছে?’

‘সামনের সপ্তাহে ১ বছর পূর্ণ হবে। ‘

‘বিয়েটা কি পারিবারিকভাবে ছিল নাকি..?

‘পারিবারিকভাবে।’

‘তা এত দ্রুত বাচ্চা নেওয়ার ডিসিশন নিয়েছিলেন যে?’

‘আমাদের কোন প্ল্যান ছিল না বেবি নিয়ে। বিয়ের সম্পর্কটাও স্বাভাবিক ছিল। আলহামদুলিল্লাহ, সুখী ছিলাম আমি ইরিনের সাথে। বিয়ের ৭ মাস চলাকালীন একদিন আমাকে জানানো হলো আমাদের সন্তান আসছে পৃথিবীতে। আমি খুশি ছিলাম। ইরিন কি চেয়েছিল জানি না। কখনো এটা নিয়ে ওর মন খারাপ বা অনিচ্ছা প্রকাশ করতে দেখিনি আমি। ‘

‘ছেলে চেয়েছিলেন নাকি মেয়ে?’

‘মেয়ে। আমার মা আমার মেয়ে হয়ে ফিরে আসুক আমার কাছে সেটাই চেয়েছিলাম শুধু।’

এটুকু শুনে ড. সুব্রতর মন কিঞ্চিৎ খারাপ হয়ে গেল। এই তো কয়েক ঘন্টা আগে তিনি নিজ হাতেই নক্ষত্রের মেয়ে সন্তানকে মৃত অবস্থায় উদ্ধ্বার করেছেন তার মাতৃগর্ভ থেকে। দুঃখ প্রকাশ করে উনি বললে, ‘আ’ম স্যরি মি.আদৃত। বাট উই কান্ট ডু এগেইন্সট দ্যা গড’স উইশ, রাইট? । আই থিংক ইউ ক্যান আন্ডারস্যান্ড দ্যাট! ‘

‘ইয়াহ…আই ক্যান ।’

‘আপনার কখনো সন্দেহ হয়নি আপনার স্ত্রীকে নিয়ে? আই মিন, আপনার কখনো মনে হয়নি যে তার অন্য কারো সাথে এক্সট্রা ম্যাটেরিয়াল অ্যাফেয়ার আছে?’

‘না। ‘

‘তবে কি আপনি মনে করছেন এ ব্যাপারে? তাকে কি কেউ কিডন্যাপ করে এসব করেছে?’

‘আমি জানি না কিছু। আজ সকালে একজন লইয়ার ইরিনের পক্ষ থেকে ডিভোর্সের নোটিশ ও তার সাইন করা ডিভোর্স পেপার নিয়ে এসেছিল। আমাকে বলা হয়েছিল যে ইরিন গতকাল দেশ ছেড়ে চলে গেছে। বাচ্চাটা জন্মানোর পর দেশে আসবে ডিভোর্স ফাইনাল করতে। কিন্তু, আমার বিশ্বাস হয়নি ইরিন এমন কিছু করতে পারে। ডিভোর্সের কারণও যথেষ্ট অযৌক্তিক এবং মিথ্যা ছিল। ‘

‘দেখুন মি. আদৃত, আপনাকে কিছু কথা বলবো এখন। মনোযোগ দিয়ে শুনবেন এবং আশা করি আপনি বুঝবেন।’

‘জ্বী..বলুন।’

‘আমি এখানে আসার আগে এস.আই খালিদের সাথে কথা বলেছি। পুলিশ আপনার ওয়াইফের কেসটা প্রাথমিকভাবে এটেম টু সুইসাইড কেস হিসেবে ফাইল করেছে।

‘জীবন বোধয় খুব সস্তা ওর কাছে। তাই এত সহজেই মরতে চেয়েছিল। ‘ রাগ অভিমান মিশ্রিত গলায় বললো নক্ষত্র।

‘অন্যসময় হলে আমি এই নিয়ে কিছু বলতাম না। সুইসাইড করতে চাওয়া স্বাভাবিক এক্ষেত্রে।কিন্তু, একজন মা কখনো নিজের সন্তানকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয় না। আর আপনার ওয়াইফও এক অনাগতর মা ছিল।

ডাক্তারের এমন কথায় বিস্ময় ও বিভ্রান্তিমিশ্রিত চোখে তাকালো নক্ষত্র তার দিকে। ডাক্তার ঠিক কি বলছেন বোঝার চেষ্টা করছে। প্রবীণ ডাক্তার মানুষটা তার চোখের ভাষা বুঝতে পেরে নিজেই বললেন।

‘আপনার ওয়াইফ সুইসাইড এটেম করেননি। অন্যকেউ ছুরি আপনার ওয়াইফের হাতে ধরিয়ে জোরপূর্বক করেছে এটা। ‘

‘ইরিন বলেছে এ কথা?’

‘না। উনি এখনও মেন্টালি অনেকটা শকড এসব নিয়ে। আমি তাকে কিছু জিজ্ঞেসও করিনি এ ব্যাপারে। তবে,আমি একজন ডক্টর মি. আদৃত। একজন মানুষ নিজ হাতে নিজ ইচ্ছায় হাতের শিরা কাটলে সেটা কেমন হয় আর অন্য একজন দ্বারা সেটা ঘটলে কেমন হয় এটুকু বোঝার ক্ষমতা অন্তত আমি রাখি। ‘

ডাক্তার সুব্রতর কথায় নিজের বোকা প্রশ্নের জন্য মনে মনে লজ্জিত হলো নক্ষত্র। নিজের ভুল স্বীকার করে বিনম্রভাবে বললো, ‘আ’ম স্যরি ডক্টর। ‘

‘ইটস ওকে মি. আদৃত।’ আলতো হেসে বললেন ডাক্তার সুব্রত। খানিক থেমেই আবার বললেন,

‘যদিও আমি ফরেন্সিক রিপোর্ট এখনো পুলিশের হাতে দেইনি, তবে এটা সত্যি যে…শী ইজ রেপড সেভেরাল টাইমস ইন আ শর্ট টাইম। এবং এটা একজন ব্যক্তি দ্বারাই হয়েছে। তাছাড়া, হোটেলরুমে মিসেস. ইরিন এবং যার দ্বারা রেপ হয়েছে সে ছাড়া আর কারও কথা উল্লেখ নেই হোটেলের রেজিস্টারে। ‘

ইরিনের এভাবে ধর্ষণ হওয়ার কথা শুনে চোয়াল শক্ত হয়ে এলো নক্ষত্রের। রাগে চোখজোড়াও লাল হয়ে উঠলো। ডাক্তার সুব্রত আরও বললেন,

‘তার ব্লিডিং এর কারণ হিসেবে আমার ধারণা, রেপ হওয়ার আগেই তিনি কোনভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। যেটা বারেবারে রেপ হওয়ার কারণে অতিরিক্ত হারে বেড়ে যায় এবং গর্ভেই বাচ্চার মৃত্যু ঘটে। এছাড়াও, তার রিপোর্ট বলছে তাকে হাই ডোজের ঘুমের ইনজেকশন পুশ করা হয়েছিল। প্রায় দু তিনদিন যাবৎ তার স্টমাক এমটি ছিল। ইট মিনস, তাকে কিছুই খাওয়ানো হয়নি। যার কারণে তিনি অনেক দূর্বল ছিলেন। তারপরেও ধস্তাধস্তি হয়েছে এবং তিনি যে নিজেকে প্রোটেক্ট করার চেষ্টা করেছেন, তা তার আঘাতের চিহ্নই প্রমাণ করে।

কিন্তু, সমস্যা হচ্ছে যে,এত সব কিছুর পরেও তার শরীরে কোন ডিএনএ পাওয়া যায়নি যা দিয়ে রেপিষ্ট কে এটা প্রমাণ করা যায়। একদম নীট এন্ড ক্লিন করে সব ডিএনএ মুছে ফেলা হয়েছে। এর থেকে আমি এটাই বলবো ব্যাপারটা প্রোফেশনালি করা হয়েছে। রেপিষ্ট অনেক জ্ঞান রাখে এ ব্যাপারে। এবং খুব দক্ষতার সাথে ভিকটিমের শরীর থেকে যাবতীয় প্রমাণ মিটিয়ে দেওয়া হয়েছে।

‘এক্ষেত্রে আমি কি করতে পারি এখন?’ একদম ভাবলেশ আওয়াজে প্রশ্ন করলো নক্ষত্র।

ডাক্তার সুব্রত চমকালো নক্ষত্রের এমন আচরণে। কপালে দুদন্ড ভাঁজ ফেলে কিছু ভাবলেন মনে মনে। তারপরে চিন্তিত গলায় নক্ষত্রকে বললেন, ‘ আপনি কি আপনার ওয়াইফের ব্যাপারটা নিয়ে সিরিয়াস নন, মি.আদৃত?’

‘ এমন কিছু নয়, ডক্টর। আপনি বলুন…কি বলছিলেন।’

‘আপনার স্ত্রীর কেসটা কিন্তু ভীষণ সেন্সেটিভ, মি.আদৃত। পুলিশ বলেছে তিনি তার প্রেমিকের সাথে হোটেলরুমে ছিলেন। আপনি বলছেন আপনি তার এসব ব্যাপারে কিছু জানতেন না, ডিভোর্স পেপার পাওয়ার আগে। তো, আপনিও কি এটাই বিশ্বাস করেন যে তিনি এমন কিছু করেছেন?’

‘ইরিনের জ্ঞান ফিরেছে? ‘ কথা এড়িয়ে প্রশ্ন করলো নক্ষত্র।

‘হ্যাঁ। আমি তার চেকআপ করেই আপনার সাথে কথা বলছি এখন।’

‘পুলিশ বয়ান নিয়েছে?’

‘না। আমি এখনো পুলিশকে পার্মিশন দেইনি পেশেন্টের সাথে কথা বলার। পেশেন্ট খুবই দূর্বল।ব্লাড দেওয়া হয়েছে। বডি ব্লাড এক্সেপ্ট করতেও যথেষ্ট সময় নিচ্ছে। শী নিডস লটস অব রেস্ট উইথ প্রোপার ডায়েট এন্ড কেয়ার অলসো।
তার এখন আপনার সাপোর্টটাই সবথেকে বেশি প্রয়োজন মি. আদৃত। যদিও বা এ ধরণের কেসে হাজবেন্ড ও তার পরিবার মেয়েকে এক্সেপ্ট করতে চায় না। কিন্তু, আপনার ওয়াইফের ব্যাপারটা সত্যি অন্যরকম।

‘এখন আমার কি করণীয় সেটা বলুন, প্লিজ।’ খাপছাড়াভাবে বললো নক্ষত্র। ডাক্তার সুব্রত কিছুটা বিব্রত হলেন নক্ষত্রের বারেবারে এমন ভাবলেশ আচরণে। কিছুটা সময় নিয়ে তিনি বললেন,

‘আপনাকে একটা দুঃসংবাদ দেওয়ার আছে মি. আদৃত।’

‘দুঃসংবাদ ছাড়া আর কি-ই বা থাকতে পারে আমার জন্য! বলুন। ‘

‘প্লিজ ডোন্ট স্যে লাইক দ্যাট। কিপ ফেইথ অন গড। মানুষের জীবনে ভালো খারাপ দুটো সময়ই আসে পালাক্রমে। ইটস আ রুল অব ন্যাচার।ইউ হ্যাভ টু কিপ পেসেন্স।’

‘দুঃসংবাদটা কি?’

‘আঘাতজনিত কারণে আপনার ওয়াইফের কোমড় থেকে পা পর্যন্ত প্যারালাইজড হয়ে গেছে। বাট ডোন্ট প্যানিক। এটা সাময়িক সময়ের জন্য বলেই আমি ধারণা করছি এই মূহুর্তে। আমাদের হসপিটালের ফিজিওথেরাপিস্ট ড. আনিকার সাথে আমার কথা হয়েছে। সে বলেছে নিয়মিত থেরাপি আর মেডিসিন কন্টিনিউ করলে দ্রুত রিকভার করার সম্ভাবনা আছে। ‘

‘ওকে..ডক্টর, আপনাদের যেভাবে ট্রিটমেন্ট করার করুন। আমার এতে কোন আপত্তি নেই। ও বেঁচে থাকলেই যথেষ্ট।’

‘দেখুন, মি. আদৃত…আপনি আমার ছেলের বয়সী। কোন মেয়ে নেই আমার। তবুও, কোন মেয়ের সাথে এমন কিছু হলে নিজের মেয়ের মত খারাপ লাগে তার জন্য। আর আমাদের সমাজের অবস্থা তো জানেনই আপনি। আমি মনে করি, একটা মেয়ে যতই খারাপ হোক না কেন এমন কিছু সে ডিজার্ভ করে না। তাই, ড. হিসেবেই বলুন বা একজন বাবার বয়সী মানুষ হিসেবেই ধরুন একটা কথা বলি আপনাকে।

যা ঘটে গেছে তা নিয়ে এই মূহুর্ত রিয়্যাক্ট করবেন না প্লিজ। পেশেন্ট আগে স্টেবেল হোক, আপনি তার সাথে কথা বলুন। সবটা জানুন, তারপর আপনি যা ডিসিশন নেওয়ার নিবেন। বাট দিজ টাইম শী ব্যাডলি নিডস ইউ মোস্ট। সো…প্লিজ! ইউ ক্যান আন্ডারস্যান্ড মাই ওয়ার্ডস, রাইট?

‘ইয়াহ…শিওর, ডক্টর। ‘ নির্লিপ্ত ভংগিতে বললো নক্ষত্র।

‘গুড।’ মুচকি হেসে বললেন ডাক্তার সুব্রত।

১১০.

আজ দুদিন হলো ইরিন হাসপাতালে ভর্তি। আগের তুলনায় কিছুটা ভালো ইরিনের অবস্থা। তবে সুস্থ হতে অনেকটা সময় লাগবে বলে জানিয়েছে ডাক্তার। কথা বলার মত অবস্থায় থাকায় আজ পুলিশকে বয়ান নেওয়ার অনুমতি দিয়েছে ডাক্তার। এস. আই খালিদ এসেছেন বয়ান নিতে।

বিছানায় শুয়ে আছে ইরিন। তার সামনের চেয়ারে বসে আছে এস. আই খালিদ। তার পাশেই ইরিনের মাথার কাছে টেপ রেকর্ডার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একজন কন্সটেবল। কেবিনের একদম কোনায় বুকের কাছে দুই হাত ভাজ করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে নক্ষত্র। এই দুদিন সে ইরিনের ধারে কাছেও ঘেঁষেনি। ইরিনকে দেখলেই রাগ, ঘৃণা, কষ্টে জর্জরিত হয়ে ওঠে নক্ষত্রের মন। তাই তার থেকে যথা সম্ভব দূরে থেকেছে। কিন্তু, আজ বয়ান নেওয়ায় সবটা জানার জন্য পুলিশের সাথে নক্ষত্রও এসেছে। শায়লা, অদ্রিজা, আম্বিয়া অবশ্য দেখা করতে এলেও কথা বলার সুযোগ হয়নি তাদের। দূর থেকে দেখেই ফিরে গেছেন তারা। এছাড়া পরিবারের কেউ এ মুখো হয়নি ইরিনের এমন খবর পাওয়ার পর।

এস. আই খালিদ একনজর ইরিনকে দেখে প্রশ্ন করলেন।

‘কেমন আছেন মিসেস. ইরিন?’

‘আলহামদুলিল্লাহ। ‘ ধীমি স্বরে বললো ইরিন।

‘আপনাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য এসেছি আমি। আপনার সাথে ঠিক কি কি হয়েছে এবং কে করেছে সেসব আমার সামনে বলবেন আপনি। আপনার বয়ান পাওয়ার পরই আমরা আরও ভালোভাবে তদন্ত করা শুরু করবো।

‘হু’। আস্তে করে জবাব দেয় ইরিন।

‘আপনাদের বিয়েটা কিভাবে হয়েছিল মিসেস. ইরিন?

‘পারিবারিকভাবে। ‘

‘আপনার মত ছিল এই বিয়েতে? ‘

‘না। ‘ কথাটা বলেই আড়চোখে একবার নক্ষত্রকে দেখে সে। নক্ষত্র গম্ভীর মুখেই দাঁড়িয়ে আছে আগের মতই।

‘তাহলে বিয়েটা কেন করেছেন? ‘

‘পরিবারের চাপে বাধ্য হয়ে করতে হয়েছিল।’

‘বিয়েতে রাজি না হওয়ার কারণ? আপনার হাজবেন্ড তো সব দিক থেকেই একজন মেয়ের হাজবেন্ড হওয়ার উপযুক্ত। ‘

‘ উনি আমাকে পছন্দ করলেও আমার উনাকে পছন্দ ছিল না।

‘কারণ?’

‘উনার গায়ের রঙ কালো। আমার এক্সপেকটেশানস থেকে সম্পূর্ণ বিপরীত ছিলেন উনি।’ ইরিনের কথা শুনে বেশ অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন এস. আই খালিদ। কোন মেয়ে নিজের বিয়ের এতদিন পর অন্যের সামনে স্বামীকে অপছন্দ হওয়ার এমন কারণ বলতে পারে তা উনার ধারণাতেই ছিল না। পেছন ফিরে একবার নক্ষত্রকে দেখলেন তিনি। তার কোন ভাবান্তর নেই। তা দেখে আরও অবাক হলেন এস.আই খালিদ। অথচ, নক্ষত্রের মতে ইরিন তাকে ভালোবাসে!

এই জন্যই কি তাহলে বলে নারী ছলনাময়ী? তিনি এই নিয়ে আর বেশি ভাবলেন না এই মূহুর্তে। প্রশ্নপর্ব এগিয়ে নিলেন।

‘শুধু এটাই কারণ ছিল যার জন্য আপনি পরকীয়ায় জড়িয়েছিলেন?’

‘জ্বী।’

‘আপনার প্রেমিক মানে যার সাথে আপনি পরকীয়ায় জড়িত ছিলেন উনার পরিচয়টা বলুন এবার।’

‘ আমাদের বিয়ের দু’মাস পরে কনকের জন্মদিন ছিল। ‘

‘কনক কে?’

‘আমার ছোট ননদ।’

‘আচ্ছা। তারপর?’

‘কনকের জন্মদিনের পার্টিতে আমার সাথে পরিচয় হয় উনার ফুপাতো ভাই ওয়াসিফের। ‘

‘ওয়াসিফের সাথেই তাহলে আপনার সম্পর্ক ছিল?’

‘জ্বী।’

‘হু, তারপর?’

এরপর ইরিন ধীরে ধীরে সময় নিয়ে ওয়াসিফের সাথে তার পরিচয় থেকে শুরু করে সম্পর্কে জড়ানো এবং দুদিন আগে হোটেলে যা যা ঘটেছিল সেসব খুলে বলে। এস.আই খালিদ মনোযোগ দিয়ে সবটা শুনেন। ইরিনের কথা শেষ হওয়া মাত্রই উনি বলেন,

‘মিসেস. ইরিন, আপনি কি জানতেন যে হোটেলে যে রুম থেকে আপনাকে উদ্ধার করা হয়েছে সে রুমে ওয়াসিফ নামের কেউ ছিলই না। রুমটা আশরাফ মেহতাজ নামের একজন লোকের নামে বুকিং দেওয়া হয়েছিল। এবং আপনি হোটেল রেজিস্টারে উনার রুমের গেস্ট হিসেবেই সাইন করেছেন প্রতিবার।’

ইরিন এবারে নতুন করে আরও একটা ধাক্কা খেল মনে মনে। উত্তেজিত হয়ে চেঁচিয়ে বললো, ‘অসম্ভব।’

‘কিন্তু এটাই সত্যি মিসেস. ইরিন।’

‘আমি প্রতিবার ওয়াসিফ রায়হান বলেই দেখা করতে চেয়েছি। আর মেয়েটিও আমাকে এই নামেই ঐ রুমের ঠিকনা দিয়েছিল। তাহলে আমি অন্য কারও রুমে কিভাবে যাবো?’ জোর গলায় বললো ইরিন।

‘কোন মেয়েটি?’ ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করলেন এস.আই খালিদ।

‘ওই যে রিসিপসনিস্ট মেয়েটি। নাম মনিরা সম্ভবত। দুজন লোক থাকতো ডিউটিতে। আমি দুবার গিয়েছিলাম ওয়াসিফের সাথে দেখা করতে। দুবারই আমি তার এগিয়ে দেওয়া রেজিস্টারে সাইন করেছি। ‘

‘আচ্ছা, ঠিক আছে। আমরা দেখছি ব্যাপারটা। আপনি রেস্ট করুন। আসছি আজ। দরকার পড়লে আবার আসবো। ‘

‘জ্বী।’

এস. আই খালিদ কেবিন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় নক্ষত্রকেও সাথে আসতে বললেন। নক্ষত্র এবং এস.আই খালিদ পাশাপাশি হাঁটছে করিডোর ধরে। হাঁটতে হাঁটতেই এস. আই খালিদ বললেন,

‘সবই তো শুনলেন মি. আদৃত। এ ব্যাপারে আপনার কি বলার আছে ?’

‘আমার এসব কিছুই জানা ছিল না অফিসার।’

‘আপনার কাজিন বর্তমানে কোথায় আছে জানেন?’

‘লন্ডনে থাকার কথা। ওখানেই তার বিজনেস আছে এক্সপোর্ট ইমপোর্টের। ‘

‘আপনি কি বিশ্বাস করেছেন আপনার স্ত্রীর কথা?’

‘আমি এ ব্যাপারে এখনই কিছু বলতে চাইছিনা অফিসার। আপনারা ইনভেস্টিগেশন করুন আপনাদের মতো। সত্য মিথ্যা যা সামনে আসার তা এমনিতেই আসবে তখন।’

‘কেসটাকে আমি এক্সট্রা ম্যাটেরিয়াল অ্যাফেয়ার, রেপ এন্ড এটেম টু সুইসাইড….এই তিনটা ইস্যুর উপর ভিত্তি করে সাজাবো। আপনি কাল একবার থানায় এসে কেস ফাইল করে যাবেন।’

‘জ্বী অফিসার।’

‘আজ তাহলে আসি। কোন কিছু জানার হলে আপনাকে থানায় ডাকা হবে, আসবেন প্লিজ।’

‘ইয়াহ…শিওর অফিসার। ‘

নক্ষত্রের জবাবে মুচকি হাসলেন এস. আই খালিদ। হ্যান্ডশেক করে নক্ষত্রের থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন তিনি। নক্ষত্র কেবিনে ফিরে গেল না। করিডোরের পাতা সারিবদ্ধ চেয়ার গুলোর একটাতে বসে গেল। মাথা নীচু করে দু হাতে চুল মুঠো করে টেনে ধরলো সে। রাগে লাল হওয়া চোখগুলোকে বন্ধ করে নিল সে। বসে রইলো ওভাবেই। ভাবতে লাগলো ইরিনের বলা প্রতিটা কথা।

করিডোরের সাদা ঝকঝকে মেঝেতে টুপটুপ করে ঝরে পড়ছে কিছু নোনাজল। জীবনে প্রতারণা আর বিশ্বাসঘাতকতা নামক যে দুটো জিনিসকে সে সব থেকে বেশি ভয় পায় সেটাই বারেবারে ঘটে তার সাথে। কেড়ে নেয় ভরসা, বিশ্বাস আর ভালোবাসাটুকুও। ইরিন যতই বিভ্রান্ত থাকুক, সে ফিরে তাকায়নি। চলে যেতে চেয়েছিল তার রাজকন্যাকে নিয়ে। চুপিসারে হারিয়ে যেতে চেয়েছিল তার জীবন থেকে। অথচ, নক্ষত্র তাকে সম্মুখে ছেড়ে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছিল। তবুও, সে চোরের মত পালিয়ে যেতে চেয়েছিল। এতটাই কি তুচ্ছ তার ভালোবাসা ইরিনের কাছে? নাকি ইরিন তাকে ভালোবাসে এই অনুভূতিটাই তার মিথ্যা?

এই মূহুর্তে কোন জবাব নেই নক্ষত্রের কাছে। ছোট থেকে কেবল ভালোবাসার মানুষগুলোই ওকে একলা করে চলে গেছে। প্রথমে মা আর তারপর আজ নওরিন গেল। লোকে সত্যিই বলে, পৃথিবীতে কিছু কিছু মানুষের জন্মই হয় শুধু প্রিয় কিছু হারানো জন্য, বারেবারে কষ্ট পাওয়ার জন্য। সুখ তাদের জন্য সোনার হরিন। কখনো ভাগ্যক্রমে ধরা গেলেও পোষ মানে না। ফাঁক পেলেই ছুট্টে পালায়। দূর….বহু দূর!

১১১.

‘তো…মি. নক্ষত্র কি করেছিলেন? বিশ্বাস করেছিলেন আপনার কথা?’

‘জানি না।’

‘কেন?’

‘আমি ঠিক জানি না উনি কি ভেবে কি করেছিলেন। তবে পুরো কেসটা সাজানো হয়েছিল উল্টোভাবে।

‘হোয়াট? ‘

‘হ্যাঁ। উনি সরাসরি ওয়াসিফকে আসামী করে রেপ এন্ড এটেম টু মার্ডার ইস্যুতে কেস ফাইল করেন। ‘

‘হোয়াট দ্যা….এটুকু বলে ইরিনের মুখের দিকে তাকিয়ে বাকি কথাটুকু নিজের মাঝেই গিলে নিল। ইরিনের কঠিন চোখ মুখের ভাব দেখে বুঝেছে ইরিন রাগ হবে এমন কথায়। তাই ক্যাবলা হেসে পরিস্থিতি সামলে নেওয়ার জন্য বললো,

‘ওয়াও….সো নাইস। না…মানে তারপর? ওয়াসিফের কি হয়েছিল শেষে?’

‘কিছুই না। কেস এখনো চলছে। ওয়াসিফের নামে যে প্রমাণ পাওয়া গেছে সেটা যথেষ্ট ছিল না এটা প্রমাণ করার জন্য যে আমি যা বলেছি সেসব সত্যি ছিল।জামিনে আছে এখন উনি। ‘

‘কি…কি প্রমাণ পেয়েছিলেন ?’ উত্তেজনা ও কৌতুহল উপচে পড়ে রাফিদের কন্ঠে।

রাফিদের এমন উত্তেজিত কন্ঠ শুনে রহস্যময়ভাবে হাসে ইরিন। রাফিদ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে ইরিনে মুখপানে।চোখে মুখে কৌতুল আরও বাড়ে তার। ইরিন রহস্য ভঙ্গ করে।

‘রিসিপসনিস্ট মেয়েটা, মনিরা….ওকে তুলে নিয়ে গিয়ে সব সত্যি বের করেছিলেন নক্ষত্র। কিন্তু, ওয়াসিফের উকিল কোর্টে অভিযোগ তুলে এটা টাকার লোভ দেখিয়ে করা হয়েছে। নক্ষত্র অদ্রিজার সাথে ওয়াসিফের বিয়ে দিতে নারাজ তাই সুযোগের সৎ ব্যবহার হিসেবে আমাকে এবং মনিরাকে বাধ্য করা হয়েছিল ওয়াসিফকে ফাঁসানোর জন্য এমন বলতে। বেশ কাঁদা ছুড়াছুড়ি হয় এই নিয়ে দু পক্ষে। পরিবারে কহল বাড়ে। সম্পর্ক নষ্ট হয়। তবুও উনি আজ পর্যন্ত আমার হয়েই লড়ছেন। এই তো সামনের মাসে আরেকটা হেয়ারিং আছে কেসের। ‘

‘তাহলে এতসব কিছুর পরেও কেন ডিভোর্স দিচ্ছেন মি. নক্ষত্রকে?’ হতাশ গলায় প্রশ্ন করে রাফিদ। নক্ষত্রকে যত জানছে ততো মুগ্ধ হচ্ছে সে এই মানুষটার প্রতি। শুধু তার একটাই অভিযোগ নক্ষত্রকে নিয়ে। এতসব কিছু করছে, তাহলে জোর করে ইরিনকে কেন ধরে রাখছে না সে? ইরিন তো ভালোবাসে তাকে তাহলে জোর করলেই তো থেকে যেতো ইরিন। কেন করে না সে এমন? অদ্ভুত!’

‘আচ্ছা, এই যুগে এমন একটা মানুষ পেয়েও আপনি তাকে ছাড়তে চাইছেন। কেন বলুন তো? সমস্যা কি আপনার?’ বেশ বিরক্তি নিয়ে ইরিনকে প্রশ্ন করলো রাফিদ।

রাফিদের এই প্রশ্ন আজ নতুন নয়। ইরিনের জবাবটাও পুরোনো। তবে আজ সেটা মোড় ঘুরিয়ে অন্যরূপে সামনে এলো রাফিদের। তার প্রশ্নের জবাবে ঠোঁটের কোণে বিষন্ন হাসি নিয়ে কন্ঠে অভিমান জড়িয়ে জীবনানন্দে বুলি আউড়ে দিল ইরিন।

‘আমারে সে ভালোবাসিয়াছে,
আসিয়াছে কাছে,
উপেক্ষা সে করেছে আমারে,
ঘৃণা ক’রে চ’লে গেছে – যখন ডেকেছি বারে বারে,
ভালোবেসে তারে।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here