#নক্ষত্র_বন্দনা
#পর্ব_১৮
#লেখায়_জারিন
১০০.
‘কি সমস্যা মি. রাফিদ? এভাবে কি দেখছেন?’
ভার ভার গলার আওয়াজে করা ইরিনের প্রশ্নটা রাফিদের অন্যমনস্কতার সুতো কাটলো। ইরিনের মুখের দিকে তাকিয়ে খানিক উত্তেজিত স্বরে রাফিদ বললো, ‘ তার মানে ছয় বছর আগের হোটেল এক্সটোরিয়ার কেসটার ভিকটিম…
‘আমিই ছিলাম। আই ওয়াজ রেপড বাই হিম।’
রাফিদের কথা সম্পূর্ণ করে দিয়ে বেশ সাবলিল কন্ঠেই বললো ইরিন। যেন এটা মানব জীবনের খুব স্বাভাবিক একটা ঘটনা। এটা বলতে গিয়েও তাই কোন প্রকার লজ্জা, সংকোচ অস্বস্তি কিছুই হচ্ছে না তার। এমনকি একটুখানি কষ্টও না।
রাফিদ অবাক হলো ইরিনের এমন সাবলিল আচরণে। সে খেয়াল করলো, ইরিনের কন্ঠ সাবলিল হলেও ঠোঁটের কোণে এক চিলতে বিষন্ন হাসি আর চোখের তারায় চিকচিক করা নোনাজল ঠিকই জানান দিচ্ছে তার ভেতরের কষ্টটা।
রাফিদ ভাবে….একটা মানুষ ঠিক কতটা কষ্ট পেলে এভাবে কষ্টের সাথে নিজেকে নিবিড়ভাবে মিশিয়ে নেয় যে কষ্ট আর মানুষটার অস্তিস্ত্ব আলাদা করা যায় না। তারা একসাথেই স্বাভাবিক জীবনযাপন করে। এই যে ইরিন নিজের জীবনের এত ভয়ংক একটা সত্যকে কি অবলীলায় রাফিদের সামনে স্বীকার করছে…যেন ধর্ষণ হওয়া খুব স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। এতে কোন খারাপ লাগা নেই, কোন প্রকার সংকোচেরও কিছুই নেই। অথচ, ধর্ষণ মানে নিজের অনিচ্ছায় কারও কাছে নিজের সম্ভ্রম বিসর্জন দেওয়া। একজন বিপরীত লিঙ্গের মানুষটার পুরুষত্বে নামে পশুত্বের শিকার হওয়া। কারও বিকৃত মস্তিষ্কের দরুন হিংস্রতার শিকার হওয়া।
অনেক মানুষ হয় তো ভাবে ধর্ষণ মানে কেবলই জোরপূর্বক দৈহিকভাবে মিলিত হওয়া। মেয়েরা যেটা স্বেচ্ছায় স্বামীর সাথে করে সেটাই অন্যকেউ জোর করে মেয়েটার সাথে করে। দুটোই দৈহিক মিলন । শুধু একটা সম্পর্কের জোরে বৈধ আরেকটা সমাজের নিয়মে এবং বাস্তবিক অর্থেই অবৈধ।
কিন্তু, তারা এটা বুঝে না শারীরিক সম্পর্ক শুধুমাত্র দৈহিক মিলন নয়। এটা দৈহিক তৃপ্তির ব্যাপার যা কেবল মনের সম্মতি থাকলেই সম্ভব। যারা বলে কেউ জোরপূর্বক নারীর দেহের গভীরে গিয়েছে বলেই তার ধর্ষণ হয়েছে, তারা তো জানেই না দেহের গভীরে প্রবেশ করে কিংবা কিছু বিকৃত চিন্তার হিংস্র প্রোয়গ করে মনের গভীরে যে রক্তপাত আর ক্ষত তৈরী করে দেয় ধর্ষণমূলত সেটাই। নইলে তো নিষিদ্ধ পল্লিতেও এক শরীর কতজনে গভীরভাবে ছুঁয়ে দেয়, প্রেমিকার শরীর হয় ভালোবাসার প্রমাণ…তাদের কি কখনো ধর্ষণ হয়?
আর ইরিনের তো গর্ভাবস্থায়ই….আর ভাবতে পারে না রাফিদ। ইরিনের অবস্থাটুকু কল্পনায় আসতেই ভেতরটা পুরোনো অস্থিরতায় উত্তাল হয়ে উঠে। দমবন্ধ লাগা এক যন্ত্রণায় বিষিয়ে উঠে মন। পুরুষ তো সে নিজেও…নারীর প্রতি আকর্ষণ তারও তো আছে। কিন্তু, পথে ঘাটে কিংবা নির্জনে নারীর দেখা পেলে তার তো হামলে পড়তে ইচ্ছে করে না। একলা ডেকে কামসাধনায় মেতে উঠতে চায় না মন। শরীর যতই জ্বালা করুক মন তো কখনো এতটা হিংস্র হয় না। তাহলে ওরা কেন হয়? পুরুষত্ব কেন পশুত্বে রুপ নেয়? আজ পর্যন্ত অনেক ভেবেও এর সঠিক জবাব পায়নি রাফিদের মন।
‘কি হলো! আজ সমস্যা কি আপনার? কি ভাবছেন এত?’
‘আপনি এত স্বাভাবিকভাবে কি করে বলছেন সেটাই ভাবছি।’
‘অবাক লাগছে?’
‘হু’
‘তাহলে আপনাকে আরেকটু অবাক করে দেই।’ ঠোঁট টিপে হেসে বললো ইরিন।
‘কিভাবে?’ কৌতুহলী স্বরে জানতে চায় রাফিদ।
‘আই ওয়াজ রেপড সেভেরাল টাইমস বাই হিম ইন জাস্ট থ্রি আওয়ারস।’ একদম ঝরঝরে গলায় বললো ইরিন। কিন্তু, রাফিদ অবাক হলো না এ কথায়। বরং, মুখ ভার করে শান্ত গলায় বললো,
‘আমি জানি।
‘আপনি জানেন! কিভাবে?’ অবাক গলায় প্রশ্ন করে ইরিন।।তখনই তার খেয়াল হলো রাফিদ একটু আগে ছয় বছর আগের হোটেল এক্সটোরিয়ার ঘটনার কথা বলেছে। কিন্তু, এটা তো তার জানার কথা নয়। তাহলে রাফিদ জানে কিভাবে? ইরিন জিজ্ঞাসু চোখে রাফিদের দিকে তাকাতেই রাফিদ জবাব দেয়।
‘হু…আপনার এই কেসটা কনফিডেনশিয়াল কেস হিসেবে প্রোফাইল করা হয়। আপনার হয়ে যে সরকারি উকিল কেসটা লড়েছিলেন..এডভোকেট আতাউর জামান তার বন্ধু এডভোকেট সাদিক রহমান…আমার সিনিয়র ছিলেন। আমি তখন সবেমাত্র পাস করে উনার আন্ডারেই প্র্যাকটিস
করছিলাম। তো, উনিই একদিন কথায় কথায় কেসটা নিয়ে বলেছিলেন। আপনার নাম পরিচয় সব গোপন রাখা হয়েছিল বিশেষভাবে। তাই কেসটার ডিটেইলস মোটামুটি জানলেও আপনার নাম পরিচয় জানা ছিল না। ‘
‘ওহ…এতো দেখছি সারপ্রাইজ দিতে গিয়ে আমি নিজেই সারপ্রাইজড হয়ে গেলাম ।’মশকরা করে হেসে বললো ইরিন।
কিন্তু, রাফিদ মনে মনে ঠিকই অবাক হয়েছে। এই ভেবেই যে জীবনের এত তিক্ত অতীত কি স্বাভাবিকভাবেই না বলছে ইরিন। যেন এটা কেবলই একটা কল্পকাহিনী। এর সাথে বাস্তবিক কোন অনুভূতি জড়িত নেই। কিন্তু ইরিনের সামনে সেটা প্রকাশ করলো না। কথা এগিয়ে নিতে প্রশ্ন করলো সে।
‘আচ্ছা, পরের গল্পটুকু শুনি এবার। ওয়াসিফের কি হয়েছিল পরে? আর মি. নক্ষত্রই বা কিভাবে রিয়্যাক্ট করেছিলেন।ব্যাপারটা নিয়ে?’
‘কেন কেস ডিটেইলস না আপনার জানা?
‘কেসটা নিয়ে জানি। স্যার আপনার মানে ভিকটিমের সাথে কি হয়েছিল সেটুকুই বলেছিলেন শুধু। পরে কেসটার কি হয়েছিল আমি জানি না সেটা। যেহেতু প্রেস মিডিয়া এর সাথে ইনভলভড হয়নি তাই নিউজ দেখেও কিছু জানার উপায় ছিল না। ভিকটিমের অবস্থা শুনে প্রচন্ড খারাপ লেগেছিল। কয়েকরাত ঘুম হয়নি ঠিকঠাক। শুধু এই ভেবেই যে একটা মানুষ ভেরত ভেতর ঠিক কতটা জানোয়ার হলে এমন একটা কাজ করতে পারে।’
‘হুম। কেসটা মিডিয়া পর্যন্ত নিতে দেওয়া হয়নি। তার দুটো কারণ ছিল। প্রথমত হোটেলের রেপুটেশন নিয়ে সমস্যা হতো আর দ্বিতীয়ত হোটেলের মালিক এবং উনার হস্তক্ষেপ। মূলত হোটেল মালিক চায়নি কেসটা জানাজানি হয়ে হোটেলের নাম এতে জড়াক, আর উনি চাননি আমাকে নিয়ে প্রেস মিডিয়ায় কথা হোক। তাই হোটেল মালিক কোন এক মন্ত্রীকে ধরে কেসটা নিরবেই সলভ করার ব্যবস্থা করেন। তাই পুলিশও এটাকে কনফিডেনশিয়াল বলে কেস ফাইল করেন। এমনকি আমাকে এডমিটও করা হয় একটা প্রাইভেট হসপিটালে। ‘
‘ভীষণ ভালোবাসেন মি. নক্ষত্র আপনাকে।’
‘হ্যাঁএএএ…..তাই জন্যই বোধয় বিপরীতে ঘৃণাটাও ছিল প্রচুর। ‘
‘উনি কি আপনাকে এই কারণেই ডিভোর্স…
‘না। ডিভোর্সটা আমার পক্ষ থেকে ফাইল হয়েছে। উনিই বরং এটাকে ঝুলিয়ে রেখেছেন। উনার একটাই কথা আমাকে উনি এত সহজে ছাড়বেন না।’
‘ধরেও তো রাখছেন না ঠিক করে। ‘ বিড়বিড় করে বললো রাফিদ। ইরিন সেটা শুনতে পেলো না। ইরিন নিজের মতই বলতে লাগলো।
১০১.
আমাকে উদ্ধার করা হয় ওয়াসিফের প্ল্যান মতই।তবে, রেপটা সে আমাকে উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে করেনি। প্রথমটা ছিল নিছক ঝোঁকের বশে। আক্রোশ থেকে। দ্বিতীয় ও পরবর্তী দফায় ছিল ইচ্ছাকৃত। কারণ..তার নাকি ঠিকঠাকভাবে তৃপ্তি হচ্ছিল না!
প্রথমে জোর করায় আমি বাঁধা দেওয়ার তুমুল চেষ্টা চালিয়েছিলাম নিজের সাধ্যের মধ্যে। ধস্তাধস্তি হয়। পড়ে যাওয়ার কারণে ব্লিডিং হচ্ছিল। ওমন নাড়াচাড়ার কারণে সেটা বাড়ছিলও। বেশ কসরত করতে হয়েছিল তাকে ঐ অবস্থাতেও আমাকে কাবু করতে।
আমি নিজেও জানি না তখন এতটা শরীরের জোর আমার কোথা থেকে এসেছিল। হয় তো একটা অনাগতর মা ছিলাম বলেই। কিংবা হয় তো নারী ছিলাম বলেই নিজের সম্মান বাঁচাতে এই শক্তি ছিল আমার সৃষ্টিকর্তা হতে প্রাপ্ত। তা না হলেও হয় তো নিজের গভীরে উনাকে মন থেকেই জায়গা দিয়েছিলাম বলেই অন্য কাউকে সে গভীরতায় প্রবেশ থেকে বাঁধা দিতে লড়াই করেছিলাম।
‘তারপর?’ টানটান উত্তেজনা নিয়ে জিজ্ঞেস করলো রাফিদ।
‘তারপর যখন আমি শক্তি ফুরিয়ে নিস্তেজ হয়ে পড়ি, নিজের খায়েস মেটাতে চড়াও হয় সে আমার উপর। ব্লিডিং এর জন্য সমস্যা হচ্ছিল ওর। সময় সময় অনেক গালি গালাজও করেছিল ও আমাকে এই নিয়ে। কিন্তু, খাবার দেখলে নিজের ক্ষুধা নিবারণের জন্য লোভাতুর পশুরা যেমন রাস্তার ডাস্টবিনেও মুখ দিতে ছাড়ে না সেভাবে ওয়াসিফও আমাকে….’
‘মিসেস. ইরিন, প্লিজ। ‘
‘কিইই…?ভিকটিমের অবস্থা জেনে খারাপ লাগছে নাকি লজ্জা পাচ্ছেন যে ভিকটিম স্বয়ং আপনাকে বলছে বলে! পুরুষ হয়ে শুনতে লজ্জা সংকোচ হচ্ছে?’ -বাঁকা হেসে বললো ইরিন।
‘এসব কিছুই না। ল’পড়তে গিয়ে এর চাইতেও অনেক বাজে কেস স্টাডি করতে হয়েছে আমাকে। প্র্যাক্টিস করতে গিয়ে এবং নিজের প্রোফেশনে এসেও ধর্ষণের অনেক কেস ফেইস করতে হয়েছে। নিষ্ঠুরতা, নির্মমতা যেখানে পশুত্বকেও হার মানিয়েছে। তাই এগুলো আমার কাছে নতুন কিছু না। তবে… ‘
‘তবে?’ ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করলো ইরিন।
‘তবে আপনার এই স্বাভাবিক ভাবভঙ্গি আর সাবলিল বলার ধরণ আমার মোটেও ভালো লাগছে না। সহ্য হচ্ছে না বলতে গেলে। ‘ কিছুটা মিইয়ে যাওয়া গলায় বললো রাফিদ।কারণ, নিজের এমন দূর্বল মনোভাব ইরিনের সামনে প্রকাশ করতে বেশ অস্বস্তি হচ্ছিল ওর।
‘পাগল মনে হচ্ছে আমাকে?’ হেসে প্রশ্ন করে ইরিন।
‘না। তবে অস্বাভাবিক রকম শক্তপোক্ত মানসিকতার লাগছে আপনাকে। মেয়েমানুষ এত শক্তপোক্ত মনের মানায় না!’ কিছুটা গম্ভীর গলায় বললো রাফিদ।
রাফিদের এমনভাবে বলা কথাটায় এবার সজোরে হেসে ফেললো ইরিন। রাফিদ থতমত খেয়ে গেল ইরিনের আচমকা এমন আচরণে। অবাক গলায় প্রশ্ন করলো, ‘এখানে হাসির কি হলো?’
ইরিন হাত দিয়ে মুখ চেপে হাসি থামানোর চেষ্টা করলো। নিজেকে কিছুটা ধাতস্ত করে বললো, ‘না…বিশেষ কিছু না।আপনি বরং বাকি গল্পটুকু শুনুন।’
রাফিদ বুঝলো এই নিয়ে কথা বাড়ালে পরিস্থিতি অন্যদিকে মোড় নিবে। তাই সেও চুপ থেকে সায় দিল ইরিনের কথায়। ইরিন আবার বলতে শুরু করলো।
‘ওয়াসিফ আমাকে কয়েকদফায় ভোগ করার মাঝেই আমাকে সবটা বলেছিল। ওর উদ্দেশ্য ও এতসবকিছুর কারণ সম্পর্কে জানিয়েছিল আমাকে। ওর ধারণা ছিল এত কিছুর পরে আমাকে নক্ষত্র গ্রহণ তো করবেই না..আমি কিছু বললে সেটাও বিশ্বাস করবে না। আবার যতক্ষণে আমাকে ওখান থেকে উদ্ধার করা হবে হয় তো আমি বাঁচবোও না। আর বাঁচলেও প্রমাণ দেওয়ার মত কিছুই থাকবে না আমার কাছে।
‘হুম। প্রমাণ খুব সুন্দর করে লোপাট করে দিয়েছিল। ব্যাটা এক্কেরে কোল্ড মাইন্ডের ক্রিমিনাল বলতে গেলে।’
‘হুম। রক্ত বলে কথা!’ মুচকি হেসে বললো ইরিন।
‘মানে?’ অবাক গলায় প্রশ্ন করলো রাফিদ। বিপরীতে ইরিনের ঠোঁটের কোণের মুচকি হাসিটা প্রস্থন হলো খানিক।
১০২.
দ্বিতীয় দফায় ধর্ষণের পর ইরিনকে ফেলে বিছানায় নিজের ঘর্মাক্ত শরীর এলিয়ে দিল ওয়াসিফ। এসির পাওয়ার বাড়িয়ে দিল আরও। জোরে জোরে কয়েকবার শ্বাস নিয়ে পাশ ফিরে ইরিনকে একনজর দেখে নিল সে। নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছে। এলোমেলো চুলে..ঘামে..রক্তে..আঘাতের চিহ্ন নিয়ে নির্বাক ইরিন শূন্যে দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছে। সাদা বিছানা চাদরের কয়েক জায়গায় রক্তে মাখামাখি। ওয়াসিফ বাঁকা হেসে মুখ ফিরিয়ে নিল। নিজেকেও দেখলো একবার। নিজের অবস্থা দেখে বিদঘুটে হাসলো সে। তারপর, হাত বাড়িয়ে সাইড টেবিলের উপর থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা তুলে নিল আলগোছে। প্যাকেট থেকে সিগারেট বের করে মুখে দিয়ে লাইটার জ্বালিয়ে আগুন ধরালো তাতে। আয়েশ করে লম্বা একটা সুখটান দিয়ে ধোঁয়া ছুড়লো সিলিং এর দিকে।
পর পর দু তিনটে টান দিয়ে ইরিনের দিকে ফিরে তাকালো আবারও। মেয়েটা আগের মতই অনুভূতি শূন্য হয়ে লেপ্টে আছে বিছানার সাথে। হিম শীতল এসি রুমের মাঝেও গায়ে সুতোটি না থাকায় সংকুচিত হওয়া লোমকূপ শরীরের অস্বস্তির কথা জানান দিলেও ইরিনের ভাবলেশ প্রতিক্রিয়া তা হতে সম্পূর্ণ বিমুখ। ইরিনের এমন রূপ যেন আরও বেশি আকর্ষিত করলো ওয়াসিফকে। নিজের বলিষ্ঠ শরীরের জোড়ে এক হাতেই ইরিনকে টেনে নিজের বুকের উপর এনে ফেললো সে। চাদরটা আরেকটু উপরে টেনে ঢেকে দিল ইরিনকে। নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়ে এক হাতে ইরিনের বাহুতে ঘঁষতে লাগলো উষ্ণতা দিতে। ইরিন তখনো ভাবলেশ।
ইরিনের এমন অবস্থা দেখে তাচ্ছিল্য করে হাসলো ওয়াসিফ। সিগারেটে আরেকটা টান দিয়ে বললো, ‘ ইউ নো সুইটহার্ট তুমি ভীষণ বোকা। আমি এভাবে কিছুই করতে চাইনি। তুমি এমন চালাকি করার চেষ্টা করতে গিয়ে যে বোকামোটা করলে সেটাই বাধ্য করেছে আমাকে। এখন দেখো…কষ্টটা তোমারই বেশি হলো!’
ইরিন চুপ। তার থেকে কোন সাড়া না পেয়ে ওয়াসিফই বললো আবার।
তখন একটা গল্প শোনাতে চেয়েছিলাম শুনলে না তো। এখন শোনো তাহলে। তুমি জানতে চেয়েছিলে না কিসের প্রতিশোধ? সেটাই বলি তোমাকে এখন। আচ্ছা, তুমি কি জানো ইরিন…অদ্রিজার জন্মের আগে তোমার শাশুড়ির মিসক্যারেজ হয়েছিল একবার?’
‘ইরিনের এবার টনক নড়ে। শান্ত বিভ্রান্ত চোখে মাথা উঁচিয়ে ওয়াসিফের মুখের দিকে তাকায়। এ ব্যাপারে তো তার জানা নেই। অনেক অতীত সামনে এলেও এ কথা শায়লা বলেননি তাকে। ‘
ওয়াসিফ বুঝে ইরিনের এমন চাহনীর মানে।সে কিছুই জানে না এ ব্যাপারে। আলতো হাসে ওয়াসিফ। সাইড টেবিলের উপর রাখা এ্যাশ ট্রে তে ছাই ফেলতে ফেলতে বলে, ‘আট মাসের বাচ্চাটার মিসক্যারেজ হয়। ঠিক হয় বলা যায় না, মিসক্যারেজ করানো হয়। আমার মা করে সেটা। কারণ বাচ্চাটা ছেলে ছিল। শেখ বংশের বংশধর। ‘
ইরিনের মস্তিষ্কে মূহুর্তেই যেন নিউরনগুলো নড়েচড়ে উঠলো। হতবাক মনে নিস্তেজ গলায় অস্পষ্ট শব্দে প্রশ্ন করলো ‘কিন্তু কেন?’
‘কারণ তোমার দাদী শাশুড়ি। মেয়ে বলে বড্ড অনাদর অবহেলা করেছেন উনি আমার মাকে। তার সমস্ত ধ্যানজ্ঞান ছিল তোমার শশুড় নাফিজ শেখ। ‘
‘তাই বলে ফুপু এমন একটা কাজ করতে পারলেন? উনি না একজন নারী? একজন মা?!’ অনেক কষ্টে থেমে থেমে বললো ইরিন।
‘মা তো ফরিদা শেখও ছিল। তাহলে সে কেন এত অবহেলা অনাদর করতো আমার মাকে?’
‘তা..আই বলে একটা বাচ্চাকে খুন করে ফেলবেন উনি?’ মনের উত্তেজনায় আর শরীরের ক্লান্তি মিলে শ্বাস টেনে বললো ইরিন।
‘বাচ্চাটার দোষ ছিল তো! সে ছেলে বাচ্চা ছিল। শেখ বংশের বংশধর। তাই মরে গেছে। এটা ওর ভাগ্য ছিল। ওই যে তুমি সেদিন তোমার বাচ্চাটাকে নিয়ে বললে না যে, ভাগ্যে ছিল…হয়ে গেছে! ঠিক তেমনি। ‘
‘এইইই বাচ্চাটা তো ছেলে না মেয়ে কিছুই জানা যায়নি এখনো। তা..আ..হলে ওকে এবোর্ট করতে চাইছেন কেন?’ কাঁপা কাঁপা গলায় প্রশ্ন করলো ইরিন। ‘
‘কারণ দুটো। প্রথমত এটা আদৃতর সন্তান। বা বলতে পারো শেখ বংশের রক্ত। হোক সেটা ছেলে বা মেয়ে..এই বংশের কোন সন্তান আর আসবে না পৃথিবীতে এটাই কারণ এই বাচ্চাটাকে জন্ম নিতে না দেওয়ার। ‘
‘আর অন্যটা?’
‘আদৃতকে তোমার থাকে আলাদা করা। আদৃত তো প্রথমে বিয়েই করতে চায়নি। আমার হবু শাশুড়ি মা অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে রাজি করিয়েছিলেন বিয়ের জন্য। বিয়ে হলো তোমার সাথে। কিন্তু, আমরা চাইনি আদৃতর কোন সন্তান এ পৃথিবীতে জন্মাক। তাই আগুন থেকে ঘি আলাদা করার ব্যবস্থা করতে হয়েছে।
তবে এখানেও একটা সমস্যা ছিল । আদৃত যেন দ্বিতীয়বার বিয়ে না করে সেজন্য তোমার দ্বারা বাজেভাবে হার্ট হওয়া জরুরি ছিল ওর। প্রতারণার শিকার আর কি! অনেকটা যেমন ওর মা হয়েছিল নাফিজ শেখের দ্বারা। তাই জন্যই তোমাকে আমার কাছে নিয়ে যেতে চাওয়া। ‘
‘আর আমি যদি যেতে না চাইতাম? ‘ নিজেকে যথাসম্ভব স্থির রেখে বললো ইরিন। ভয়, শংকা, উত্তেজনা সব মিলিয়ে ভেতর ভেতর উত্তাল ঝড় বইছে ইরিনের।
‘তুমি আমাকে পছন্দ করো এটা বুঝতে পেরেছি বলেই প্ল্যানটা এভাবে সাজানো হয়েছে। তোমার দূর্বলতাকে হাতিয়ার করে কাজটা করা সহজ হয়েছে। তবে যদি এটা না করা যেত তবে অন্য প্ল্যান করতে হতো আমাকে। ‘
‘অদ্রিজাকে কেন বিয়ে করছেন?’
‘এটার কাহিনীটাই বলি তাহলে এবার। ‘
ইরিন কৌতুহল নিয়ে তাকায়। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে সবটা শোনার। ওয়াসিফ একটু নড়েচড়ে উঠে এবারে। বালিশে হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে বসে। ইরিনের এলোমেলো চুলগুলো আঙুলে পেঁচিয়ে খেলতে খেলতেই তার সামনে উন্মোচন করে একটা আরও একটা রহস্যকথা।
১০৩.
‘ফরিদা শেখ আমার মাকে বরাবরই অবহেলা করতো। বিয়েও দেয় খুব সাধারণ একটা পরিবারে। এই যে যাকে তুমি আমার বাবা হিসেবে চিনো সে আমার মায়ের দ্বিতীয় স্বামী। আমার জন্মদাতা উনার প্রথম স্বামী। আমার ৫ বছর বয়সে সে মারা যায়।
শ্লা নেশাখোর মাতাল ছিল একটা। নেশা করে এসে মারধোর করতো আমার মাকে। ব্যাটা নেশা করতে করতে একদিন সটকে গেল উপরে। আমার মা বিধবা হলো। স্বামী ছাড়া শশুড়বাড়িতে তখন আমার মা উচ্ছিষ্ট ছাড়া আর কিছুই রইলো না। তাকে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। কিন্তু, আমাকে তারা দিতে চায়নি। কারণ আমি ঐ বাড়ির বংশধর ছিলাম। মা অনেক কান্নাকাটি করেও তাদের মন গলাতে পারলো না। বাপের বাড়িতে বাবা নেই, মায়ের কাছে কদর নেই। সে যদি আমাকে নিয়ে কোথাও চলেও যায় তো যাবে কোথায়!
একরাতে মা আমাকে নিয়ে পালিয়ে এলো। আর কোন রাস্তা না পেয়ে বাপের বাড়িতে গিয়ে উঠলেও তাকে গ্রহণ করা হলো না সেখানে। বিধবা মেয়ে শশুড়বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছে ফরিদা শেখ মানলেন না।তার উপর আবার আমাকে ঐ বাড়িতে ফিরিয়ে দিয়ে আসতে বললেন। মা রাজি হলো না। যতই হোক প্রথম সন্তান আমি তার। আমাকে কি করে ছাড়তো। আর শুনেছি ঐ বাড়িতেও নাকি পরিবেশ ভালো ছিল না। তাই মা আমাকে দিতে চায়নি কিছুতেই। ফরিদা শেখ তখন মাকে বাড়ি থেকে বের করে দিতে চাইলো।
সেই সময় সহায় হলো তোমার শশুড়। নিজের আশ্রয়ে রাখলেন বোনকে। কিন্তু, ফরিদা শেখ রাত দিন কথা শোনাতো মাকে। আমাকে তো সহ্যই করতে পারতেন না যেন। কিন্তু, যতদিন ও বাড়িতে ছিলাম মামা মামী কখনো অনাদর করেননি।
মামী যখন দ্বিতীয়বারের মত প্রেগন্যান্ট। ফরিদা শেখ আল্ট্রাসোনোগ্রাফি করিয়ে জানলেন ছেলে সন্তান আসছে। তার খুশি দেখে কে! মামীর কদর বেড়ে গেল। বিধবা মেয়েকে যতটা না তুচ্ছ তাচ্ছিল্য আর অবহেলা করতেন বিপরীতে ছেলে বউকে তার থেকেও বেশি আদর যত্ন করতেন। মা কাঁদতো কিন্তু চুপচাপ সয়ে নিত সব। আমি শুধু অবুঝ নয়নে তাকিয়ে দেখতাম সবটা।
এটুকু বলে থামলো ওয়াসিফ। হাত বাড়িয়ে সিগারেটের প্যাকেটটা নিয়ে তা থেকে আরেকটা সিগারেট বের করে মুখে দিল। আগুন জ্বালাতে জ্বালতেই অধৈর্য্য হয়ে ইরিন প্রশ্ন করলো, ‘তারপর?’
১০৪.
সিগারেটে লম্বা করে একটা টান দিয়ে ইরিনের মুখ বরাবর ধোঁয়া ছাড়লো ওয়াসিফ। সাথে সাথে কাশি উঠে গেল ইরিনের। নিস্তেজ শরীরে কাশিও যেন আরেক মরণ যন্ত্রণা। তা দেখে মুচকি হাসলো ওয়াসিফ। বলতে শুরু করলো গল্প নামক তিক্ত অতীতের বাকি অংশ।
‘একদিন আমি ছাদে খেলতে গিয়ে মামীর জন্য করা আচারের বোয়ম ভেঙে ফেলেছিলাম। এই রাগে ফরিদা শেখ আমার গায়ে হাত তুলেন। মা ঠেকাতে গেলে তাকেও আজেবাজে কথা শুনায়। অন্যের বাড়ির বংশধর চুরি করে আরেকজনের অন্ন ধ্বংস করছে বলেও অপমান করেন। আমার তখন ৯/১০ বছর বয়স হবে হয় তো।
মা যখন আমাকেও শেখ বংশের রক্ত বলেও দাবি করেন সেদিন তিনি সাফ সাফ জানিয়ে দেন, মেয়েরা কখনো বাড়ির বংশধর হয় না। তার ছেলেমেয়েরাও নিছক বাড়ির অতিথি। বাড়ির ছেলেরাই বংশের প্রদীপ। আর আমি অন্য একটা বংশের। এমন কি আয়শা আপাও এই বাড়ির পরগাছা। আমার মা যেমন ছিল। এই পরিবারের প্রকৃত রক্ত ও বংশধর মামীর গর্ভের ছেলে সন্তান।
এতকালের অনাদর আর সেসময়ের অবহেলা অপমান সব মিলিয়ে মা আর মানতে পারলো না। ছেলে সন্তান চাই ফরিদা শেখের। কিন্তু মা সিদ্ধান্ত নিল ফরিদা শেখের বংশে আর কোন বংশধর আসবে না। তাই, খাবারের সাথে কোন একটা মেডিসিন মিশিয়ে মামীর মিসক্যারেজ করিয়ে ফেলে। এতেও দোষ হয় আমার মায়ের। তবে অন্যভাবে। তার কু নজরে নাকি এমন হয়েছে। ননসেন্স শোনালেও একদিক থেকে সত্যিই ছিল এটা।
ফরিদা শেখ এটা মানতে পারলোনা।বংশধর হারানোর শোকে কাতর হলেও তিনি দমলেন না। মামীর উপর চাপ বাড়লো। তারপর বছর তিন পরেই অদ্রিজার জন্ম। এর মাঝেই আমার মায়ের দ্বিতীয় বিয়ে দিলেন মামা। আমাদের জীবন বদলে দিয়ে…ফেরেশতা বলো তোমরা যাকে তার মতই রাশেদ রায়হান চৌধুরী এলেন আমার মায়ের দ্বিতীয় স্বামী এবং সম্পর্কের দিক থেকে আমার প্রকৃত বাবা হয়ে।
আমার মায়ের এবার সুখের সংসার হলো। কোট কাচারি করে মামা ও বাবা মিলে আমাকে মায়ের কাস্টাডিতে এনে দিলেন। সব মিলিয়ে মা এবং আমি নতুন জীবনে ভালো থাকলেও ফরিদা শেখের অবহেলা কমেনি। আমাদের বিদায় করতে পেরে বরং উনি আপদ বিদায় করতে পেরেছেন, এমন মনোভাব ছিল উনার।
অদ্রিজার জন্মের পরে যখন কনকের জন্ম হলো , মা আর চান্স নিতে চায়নি। ডাক্তারকে টাকা খাইয়ে ভুল রিপোর্ট দেখিয়ে মামীর জরায়ুটাও বাদ দিয়ে দেয়। যাতে মামী আর কখনো মা হতে না পারে।
ইরিনের নিস্তেজ চোখে আবারও পানি পড়ছে। তবে কারণটা এবারে ভিন্ন। ইরিন বুঝলো কষ্ট কেবল নক্ষত্রর একার জীবনে ছিল না। ফরিদা শেখ নামক মহিলাটির নিম্নধারার ও অমানুষিক কিছু চিন্তা চেতনার কারণে এই পরিবারের সাথে যুক্ত সকলেই কোন না কোনভাবে কষ্ট পেয়েছে। অনেকগুলো জীবন বিষাদে জড়িয়ে বেঁচে ছিল। মহিলাটি বেঁচে না থাকলেও তার কৃতকর্মের বিরূপ ফল এখনো ভোগ করছে তারা। ওয়াসিফ এবং ওর মা নুপুর সেই বিরূপ ফলাফলের একটা রূপ মাত্র! যার প্রভাবে পিষছে আজ সে নিজেও।
ইরিনের এসব চিন্তাভাবনার মাঝেই ওয়াসিফের কথা কানে আসে ওর। আবার মনোযোগ দেয় ওয়াসিফের কথায়।
১০৫.
‘মামীকে দিয়ে ফরিদা শেখের বংশধরের আশায় যখন গুড়ে বালি হলো ফরিদা শেখ মামার দ্বিতীয় বিয়ে নিয়ে পড়লেন। আর তখনই ভোজ বাজির মত কোথা থেকে যেন উদয় হলো আদৃত। আমি সেবারই প্রথম জানলাম, এই মামী মামার সেকেন্ড ওয়াইফ। কিন্তু, মামার প্রথম বিয়ের কথা জানলেও সবার অগোচরে তাদের সংসার যে টিকে ছিল এবং সেই সংসারে একজন সন্তান ছিল, তাও আবার ছেলে সন্তান এটা আমার মা জনতো না। আদৃতর তখন ১২/১৩ বছর। আর আদৃতর যা অবস্থা ছিল তখন বলার মত না। বেচারা বেঁচে থেকেও মরার মত হয়ে গেছিল। মামার মানসিক অবস্থাও ভালো ছিল না।
তাই, মা ভাবলো, মরাকে আর কি মারবে! তারচে বরং হাতের পুতুল বানিয়ে নেওয়া যাক।ইচ্ছা মত কনট্রোল করে যা ইচ্ছা করা যাবে। তাছাড়া, ভাইয়ের প্রতি বেশ কৃতজ্ঞ ছিল আমার মা। বিপদের সময় সেই তো সহায় ছিল। আবার বাবাকে পাওয়ার পেছনে কৃতিত্বও ছিল মামারই। শুনেছি বাবা মামার কলেজ জীবনের বন্ধু। মায়ের অবস্থা জেনে তার মায়া হয়। তাই বিয়ে করে নেয়। কিন্তু, আমি বুঝি বাবা আমার মাকে প্রচন্ড ভালোবাসে। আর আমিও এই পরিবারটাকে অনেক ভালোবাসি। তবে, আমার মায়ের থেকে বেশি নয়।
মা সিদ্ধান্ত নিল আদৃতর সরাসরি কোন ক্ষতি না করার। আদৃত শুরুর দিকে কাউকে সহ্য করতে পারতো না। কেবল শায়লা মামীকে ছাড়া। যখন ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হলো আমার মায়ের আদর যোগ হলো তাতে। বড় ভাই হিসেবে আমিও ছিলাম সাথে। এই জন্যই আদৃত আমাকে এত পছন্দ করে। বড় ভাইয়ের মত বিশ্বাস করে…ভরসা করে। কিন্তু আদৃত আমার কাছে আমার মায়ের ইচ্ছা পূরণে পথের কাটা ছাড়া আর কিছুই না।
ফরিদা শেখের বাড়ি ছাড়ার পরই মা আমাকে তার ইচ্ছের কথা জানিয়েছিল।আমিও মায়ের এই ইচ্ছে পূরণ করবো বলে তাকে প্রমিস করি। তাই জন্যই এত সব।
আর রইলো অদ্রিজাকে বিয়ে করার কথা! অদ্রিজার জন্মের পর ফরিদা শেখ যখন ওকেও তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করলেন আমার মায়ের খারাপ লাগে। তাই সে মামার কাছে অদ্রিজাকে চায় মেয়ে হিসেবে। মামী নিজের সন্তান দিতে চায়নি। মায়ের মন খারাপ দেখে মামা কথা দেয়, মা যদি আপত্তি না করে তাহলে অদ্রিজার ১৮ বছর হলেই আমার সাথে তার বিয়ে দিয়ে মায়ের মেয়ে করে পাঠাবে। মা সানন্দে রাজি হয়। ছোট থেকেই সে অদ্রিকে অনেক আদর করে। ভালোবাসে।তাই মায়ের ইচ্ছে পূরণ করতেই আমার অদ্রিকে বিয়ে করা। মেয়েটাও তো সুন্দর। ভদ্র। ছোট থেকেই ও জানে আমার সাথে ওর বিয়ে হবে। অন্য কারো সাথে জড়ায়নি নিজেকে। পিওর ভার্জিন। নিজেকে আমার বউ হওয়ার জন্যই গড়ে তুলেছে। তাই যত যাই হোক, বিয়ে আমি অদ্রিকেই করবো।
এন্ড ইউ নো সুইটহার্ট , আজ পর্যন্ত আমি কোন ভার্জিন মেয়েকে রুম ডেটে নিয়ে যাইনি। অদ্রি ছাড়া অন্য কোন ভার্জিন মেয়েকে আমি টাচ করতে চাইনা। ভার্জিন হিসেবে আমার একমাত্র বউকেই আমি একাই টাচ করবো। ইজেন্ট ইট কুল?! বাঁকা হেসে প্রশ্ন করে ওয়াসিফ।
‘এতকিছুর পরেও অদ্রি আপনাকে বিয়ে করবে?’ নিস্তেজ শরীর ও বিদ্ধস্ত মন নিয়েও বিদ্রুপ করে হেসে বললো ইরিন।
‘জানলে তো কিছু! জানাবে কে? তুমি? পারবেই না। আর বললেও কেউ বিশ্বাস করবে না। ওয়াসিফ রায়হান চৌধুরী এত কাঁচা কাজ করে না। প্রচন্ড আত্মবিশ্বাসের সাথে বললো ওয়াসিফ।
‘তাছাড়া, আজ পর্যন্ত এই কথাগুলো কেবল মা আর আমার মাঝেই ছিল। কাউকে বলিনি আমি। আজ তোমাকে বলে বেশ শান্তি লাগছে কেন জানি। তবে, এক্সপোজ হওয়ার ভয় হচ্ছে না একটুও। ‘ শেষ কথাটা বেশ রসিকতার স্বরে হেসে বললো ওয়াসিফ।
ইরিন ওয়াসিফের কথা কিছু বুঝলো না। বিভ্রান্ত নয়নে ওয়াসিফের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো কেবল।
ওয়াসিফ ইরিনের এমন দৃষ্টির অর্থ বুঝে নিল খুব সহজেই। তার সশব্দের হাসি জানান দিল তার ভেতকার পৈশাচিক সুখানুভূতির। । ইরিন তখনো ওয়াসিফের বুকের উপর পড়ে আছে নেতানো লতার মত। ওয়াসিফের কর্মকান্ড ও কথায় সে এতটাই বিস্মিত এবং হতবাক হয়েছে যে তার খেয়ালই নেই..ওয়াসিফ নামক মানুষার সাথে সে বাঁধা দেওয়ার সুযোগ থাকার পরেও এভাবে জড়িয়ে আছে।
ইরিনকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে মুচকি হাসলো ওয়াসিফ। হাতে থাকা সিগারেটে শেষ একটা টান দিয়ে তা এ্যাশ ট্রেতে ফেলে দিল।ইরিনক নিজের থেকে সরিয়ে বিছানায় রেখে আরও একবার চড়াও হলো তার উপর। ইরিন কিছু বুঝে উঠার আগেই সিগারেটের ধোঁয়াটুকু ইরিনের মুখে পুরে দিল সে। আচমকা এমন কাজে প্রবল কাশি উঠলেও ওয়াসিফের জোরের কাছে সেটুকুও গিলে নিতে হলো ইরিনকে। তবুও, চোখের কোণ বেয়ে তা নেমে এলো অভ্যন্তরীণ যন্ত্রণার সাক্ষ্য হয়ে।
১০৬.
ইরিন ওয়াসিফকে বাঁধা দিল না আর। সর্বনাশ যা হওয়ার হয়ে গেছে। এরপর ওয়াসিফ তাকে বাঁচিয়ে রাখবে কিনা জানা নেই তার। ওয়াসিফ ছেড়ে দিলেও সে নিজেকে বহন করতে পারবে বলে ওর মনে হলো না। তবে মনে একটা ইচ্ছা তার রয়েই গেল। যদি বাচ্চাটা অন্তত বেঁচে যায়। যত কষ্টই হোক ওকে জন্ম দেওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করবে ও। নক্ষত্রের এক আকাশ সমান অসীম ভালোবাসার কৃতজ্ঞায় এটুকু সময় নিজেকে বহন করে নিবে সে।
নিজ শরীর হতে ক্রমাগত নির্গত রক্তের ধারা এবং অযাচিত এক পুরুষের ঘর্মাক্ত সিক্ত শরীর ও কামনার রসে মাখামাখি শরীরের অস্বস্তির সাথে অনুভূতিটা যোগ হতেই ঘেন্নায় সমস্ত শরীর গুলিয়ে উঠলো ইরিনের। নিজের শরীরকে পঁচা নর্দমায় ভেসে থাকা পঁচে গলে যাওয়া মৃতের শরীর মনে হলো তার। ওয়াসিফকে মনে হলো নর্দমার সেই কীট যা মৃতদেহ খুবলে খুবলে খায়।
কোমড় থেকে পা ক্রমশ ভার হয়ে আসছে ইরিনের। ব্যাথা তীব্র থেকে তীব্রতর মাত্রায় ছড়িয়ে পড়ছে কোমড় থেকে পায়ের পর্যন্ত। সহ্যের মাত্রা ছাড়িয়ে গেলে ইরিনের কন্ঠে উঠে এলো ছোট্ট একটা আকুতি, ‘আর সহ্য হচ্ছে না ওয়াসিফ।রেহায় দিন প্লিজ। ‘
ওয়াসিফ তখন ইরিনের গভীরে নিজের পৌরষত্ব নামক পশুত্ব ফলাতে মত্ত। ইরিনের কথায় সেকেন্ড কয়েক ওর করুন মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে হেসে বললো, ‘সহ্য করে নাও সুইটহার্ট। লাইফে সব ধরণের এক্সপেরিয়েন্স থাকা লাগে। নইলে লাইফের মজা কই! সো….জাস্ট রিলাক্স..ইঞ্জয় এন্ড লেট মি গেইন সাম নিউ এক্সপিরিয়েন্স! ‘
এরপর ইরিনের আর কিছুই বলার থাকে না। নিজের পাপের ফল ভোগ করার মত করে নিজের নিস্তেজ শরীরটা সঁপে দেয় ওয়াসিফের আয়ত্ত্বে। মনে মনে আউড়ায় সে, খাক…নর্দমার কীট আস্ত একটা পঁচে যাওয়া নর্দমাকেই খুবলে খাক। যতক্ষণ পারুক খাক।
চলবে….