নক্ষত্র বন্দনা পর্ব ১

0
1773

আমার যার সাথে বিয়ে হয়েছে স্বামী হিসেবে তাকে আমি মেনে নিতে পারিনি। সবাই বলে তিন কবুলের জোর নাকি অনেক বেশি। কারণ, তাতে আল্লাহর বরকত থাকে। এটাই মূলত দুটো অচেনা অজানা , আলাদা প্রকৃতির মানুষকে মন থেকে এক করে দেয়। কিন্তু,আমার ক্ষেত্রে সেটা হয়নি। আমি তাকে কিছুতেই মেনে নিতে পারিনি। বিয়েটাও করতে চাইনি, আবার মানাও করতে পারিনি। এই নিয়ে আমার মনভার দেখে বিয়ের আগে মা, বড় আপারা অনেক বুঝিয়েছে। কিন্তু,কাজ হয়নি। মুখে কবুল বললেও মন থেকে তাকে নিজের স্বামী হিসেবে কবুল করতে পারিনি।

বিয়ে নিয়ে প্রতিটি মেয়েরই অনেক জল্পনা কল্পনা থাকে। আমারও ছিল। তবে, আমি কখনোই চাইনি যে আমার অনেক ধনী কোন পরিবারে বিয়ে হোক। কারণ ,আমি নিজেই একটা মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। উচ্চ মধ্যবিত্ত-ও নই কিন্তু।সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবার আমাদের। একটা ছোটখাটো কোম্পানিতে একজন সাধারণ ক্যাশিয়ার ছিলো আমার বাবা। বড় দুই ছেলে, বড় বউ, আর চার মেয়ে এবং স্বামী স্ত্রী মিলেই আমার বাবা মায়ের মধ্যবিত্তের বিশাল সংসার । বড় ভাই চাকরিতে আসার আগে সামান্য ক্যাশিয়ারের চাকরি করে বেশ কষ্ট করেই আমাদের ছয় ভাইবোনকে মানুষ করেছে আমাদের বাবা। এখন হয় তো তাদের কষ্ট অনেকটাই লাঘব হয়েছে। অনেকটা কী বলছি! পুরোই মিটেছে হয় তো। তবে লোভী মানুষদের কি কখনো পুরোপুরি সন্তুষ্টি হয়? তারা তো যত পায়, ততই আরও চায়। পাওয়ার আশা করে যায়। এদের কি হবে কে জানে!

২.

যাই হোক, আমার কথা বলি। আমি চাইনি কোন রাজপুত্র আমার স্বামী হোক। আমি নিজে খুব সুন্দরী না হলেও অসুন্দরও নই। পরিপাটি হয়ে থাকলে যে কেউ একবাক্যে সুন্দর বলতে বাধ্য। তাই বামন না হলেও হাত বাঁড়িয়ে চাঁদ ছোঁয়ার আশাও আমি কখনো করিনি। তবে,চাঁদ ছুঁতে না পারার ভাগ্যও যে আমার একেবারেই হওয়ার সম্ভাবনা নেই…মনে মনে সেই ধারণাও আমি পুষিনি কখনো। আমি শুধু চেয়েছিলাম যেন সাধারণ মধ্যবিত্ত কোন পরিবারে বিয়ে হলেও আমার স্বামী যেন দেখতে খুব সুন্দর হয়।

সুন্দর বলতে সিনেমার নায়কদের মত না হলেও চোখের মুগ্ধতা হওয়ার কারণ হবে সে। আমি খুব একটা লম্বা নই আবার একেবারে যে খাটো তাও নই। ৫:৪”উচ্চতা আমার। সুন্দর দৈহিক গড়ন আমার নিজ ইচ্ছেতেই গড়।যত যাই হোক, এ দেশে মেয়েদের শারীরিক সৌন্দর্যটাই মুখ্য কিনা! আর মধ্যবিত্তর আর কিছু না থাকলেও সৌন্দর্যের জোরে কত কিছুই তো হয়। আমিও সেই ধারণার বাইরে নই।

নিজের জীবনসঙ্গী ক্ষেত্রে আমার চাওয়া ছিল সুঠাম দেহ, লম্বা চওড়া, ফর্সা গায়ের রঙ নিয়ে একজন সুদর্শন পুরুষের সাথেই আমার বিয়ে হোক। লোকে দেখলেই বলবে, ইস….কি সুন্দর দেখতে আমার বর! একেবারে রাজপুত্রের মত। অথচ, এখন কি বলে….!!

জীবনে বিলাসিতার সুযোগ না হলেও সে আমাকে এতটাই ভালোবাসবে…যত্ন করবে যে আমি শত অভাব, দুঃখ কষ্টেও তার ভালোবাসায় তৃপ্ত হয়ে, তাকে ভরসা করে খুশি মনে মেনে নেব সব।তাকে ভালোবাসবো নিজের সবটা দিয়ে। একটাই তো জীবন।আর নিজের অর্ধেক জীবন পেরিয়ে যাকে নিয়ে আমার বাকি জীবনটুকু কাটাবো তাকেই তো নিজের সবটা দিয়ে ভালোবাসবো। পরিপূর্ণ করবো তাকে। নিজেকে বিলিয়ে তাকে নিজের করে রাখবো গোটা জীবন পেরিয়ে মরণের পরেও।
ব্যাস…এটুকুই ছিল আমার চাওয়া। কিন্তু, ঐ যে কথায় বলে না! কপালের লিখন না যায় খন্ডন। আমার ক্ষেত্রেও ঠিক সেটাই হলো। আমি যা চেয়েছিলাম তার চাইতে বহুগুণ বেশি পেয়েছি। তাই হয় তো মেনে নিতে আরও বেশি কষ্ট হচ্ছিল আমার। এর থেকে বোধয় আমার চাওয়াটুকুর চাইতেও কম পেলেও আমি বেশি সহজে মেনে নিতে পারতাম।

৩.

আমার স্বামী বিরাট এক ধনী পরিবারের একমাত্র ছেলে। শশুড় শাশুড়ি, আমার স্বামী ও তার তিন বোন নিয়ে আমার ভরা সংসার। আমার স্বামী পরিবারের ২য় সন্তান। আমার একমাত্র ননাস আয়শা আপুর বিয়ে হয়েছে অনেক আগেই। স্বামী ও দুই সন্তান নিয়ে সুইজারল্যান্ডে থাকেন। বিয়েতে আসেননি। ভিডিও কলে কথা হয়েছিল কয়েকবার। খুব বেশি আলাপ না হলেও যতটা হয়েছে তাতে মনে হয়েছে তিনি বেশ মিষ্টিভাষী। আর ছোট দুই ননদ..বড়জন অদ্রিজা ও ছোটজন কনক । দুজনে পিঠাপিঠিই বলতে গেলে। শুনেছি মাত্র ১৯ মাসের ছোটবড় এরা। একজন কলেজে পড়ছে আরেকজন এবার এস.এস.দিবে শুনেছি।

বিয়ের কথাবার্তার শুরু থেকেই দেখেছি এরা দুজনেই আমায় চোখে হারায়। অথচ আমাদের সমাজে সচারাচর এটা হয় না। ননদ ননাসদের সাথে ভাবীর একরকম বৈরী সম্পর্কই থাকে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যাতিক্রম হয়। আমারটাও বোধয় ব্যাতিক্রম। তবে, এর পেছনে আমি দুটো কারণ ভেবে নিয়েছি। তবে ঠিক কি কারণে সেটা এখনো আমি বুঝে উঠতে পারিনি। হয় তো একমাত্র ভাইয়ের বউ বলেই নয় তো তাদের ওমন ভাইয়ের বউ বলেই। এছাড়াও আরেকটা কারণ উহ্যভাবে ভেবে রেখেছি। তা হলো এরা দুজনই খুব ভালো মন মানসিকতার। তাই ভাবীকে তার প্রাপ্য ভালোবাসা, সম্মান ও মর্যাদা সবটাই দিতে জানে। অবশ্য এতদিনের দেখা সাক্ষাৎ আর আলাপে যা বুঝেছি এরা প্রত্যেকেই বেশ ভালো মানুষ। অর্থ ও বিনয় দুটোই সমানভাবে অর্জন করেছে এরা। তবে, এ তালিকায় আমি আমার স্বামীর নাম জুড়ছিনা। কারণ, তার সাথে বিয়ের আগে আমার দুবার দেখা হলেও তেমন কোন কথা হয়নি।

৪.

উনি স্বল্পভাষী বলে বলা হয়েছিল আমায়। উনার বোনেরা বলেছিল। হয় তো তাই জন্যই বিয়ের পাকা দেখা থেকে শুরু করে বিয়ের বিদায়ের আগে পর্যন্ত উনার সাথে একবারে একটা কথাই কেবল হয়েছিল আমার। সেটাও কথা নয় ঠিক…একটা প্রশ্ন ছিল।

পাকা দেখার দিন আমাকে আর উনাকে একঘরে আলাদা বসে কথা বলার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু, উনি একা যাননি। সাথে আমার ৬ বছরের ছোট বোন রিতুকেও নিয়ে গেছিলেন ঘরে। আমার অবশ্য এতে সুবিধাই হয়েছিল।কারণ উনার সাথে একঘরে একা এক মূহুর্তেও আমার কাছে একজনমের অস্বস্তির সমতুল্য ছিল। রিতুকে বিছানায় আমার পাশে বসিয়ে উনি বসেছিলেন আমার মুখোমুখি একটা মোড়া পেতে। বেশ কিছুক্ষণ নিরবতায় কাটিয়ে, সেবারই প্রথম নিজের ভরাট ও দৃঢ়কণ্ঠে উনি জিজ্ঞেস করেছিলেন , ‘তুমি স্বেচ্ছায় আমাকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছ তো? ‘

প্রশ্নটা শুনে অবাকই হয়েছিলাম বটে। মধ্যবিত্ত পরিবারে মেয়েদের বিয়ে দিতে গেলে যেখানে পরিবারের মানুষেরাই মেয়ের মতামত নিতে চায় না সচারাচর, সেখানে উনি পাত্রপক্ষ মানে স্বয়ং বিয়ের পাত্র হয়ে আমার মতামত জানতে চাইছেন। আমার মনে একবার প্রশ্ন জেগেছিল, যদি আমি ‘ না ‘বলি, তাহলে? তাহলে কি উনি বিয়েটা করবেন না? বলে দেবো কি সত্যটা? এ বিয়েতে আমার মত নেই। পরিবারের চাওয়াতে সায় দিতেই কেবল হ্যাঁ বলতে হয়েছে। বলবো কি?! কিন্তু, তারপর কি হবে? উনি যদি বিয়েটা না করেন তাহলে আমার আর এ বাড়িতে জায়গা হবে তো? জায়গা হয় তো হবে তবে সেটা কতটা নীচে সেটার আন্দাজ ঠিকমত করতে পারিনি সেদিন। তাই মনের কথাগুলোও চেপে যেতে হয়েছিল।

প্রশ্ন করে উনিও চুপ হয়ে গিয়েছিলেন।তাকিয়ে ছিলেন আমার দিকেই, আমার উত্তরের অপেক্ষায়। আমি না দেখেও স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম তা। উনি চুপ থেকে হয় তো আমাকে ভাববার বা নিজের উত্তর গুছিয়ে নেবার সময় দিতে চেয়েছিলেন। আমিও অবশ্য খুব বেশি সময় নেইনি। যা বলতে পারবো না তা আর গুছিয়ে নেওয়ার কি দরকার। তাই পোষা পাখির মত শিখানো বুলিই আউড়েছিলাম উনার সম্মুখে।

সেদিন আমি ভুলেও একবারের জন্যও উনার মুখের দিকে তাকাইনি। উহু, লজ্জা বা অস্বস্তিতে নয়। গূঢ় অনিচ্ছায়। ছবিতে দেখেই উনাকে দেখা হয়ে গিয়েছিল আমার।আর বাকিটা বায়োডেটা দেখেই জেনেছিলাম। তাই, দ্বিতীয়বার দেখার আর ইচ্ছে জাগেনি। প্রয়োজনই বোধ করিনি আসলে।

আমি নিজের দৃষ্টি ঘরের নীলচে সাদা মিশেল টাইলস করা মেঝেতে আবদ্ধ রেখেই ছোট্ট একটা শব্দে উত্তর দিয়েছিলাম, ‘জ্বী।’ আমার জবাব শুনে ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে উনি উঠে দাঁড়িয়েছিলেন উনি। ছোট্ট হলেও সে নিঃশ্বাসের শব্দ ছিল স্পষ্ট। আমি হলফ (নিশ্চিত) করে বলতে পারি সেই ক্ষুদ্র ও স্পষ্ট সশব্দের নিঃশ্বাসে কোন সন্তুষ্টি ছিল না। ছিল অন্যকিছু। হয় তো হতাশা বা কোন খারাপ লাগার অনুভূতি। তারপর উনি হাত বাড়িয়ে রিতুকে ডেকে ওকে কোলে তুলে নিয়েছিলেন। আর ওর সাথে টুকটাক কথা বলতে বলতেই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেছিলেন। এই তো এটুকুই ছিল আমাদের তখন অবদি কথোপকথন।

৫..

দ্বিতীয় সাক্ষাতের কথা বলি এবার। বিয়ে ঠিক হবার পর একদিন বিয়ের শাড়ি, জুতো, কসমেটিক্স আর বিয়ের গায়নাগাটি কিনতে নিয়ে গিয়েছিল তারা আমায়। আমার বিয়ে তাই বিয়ের সাজ সজ্জার জিনিসগুলোও নাকি আমার পছন্দ মতই হওয়া চাই।এই বলেই আমার শাশুড়ি হলুদ থেকে বৌভাত সব অনুষ্ঠানের শাড়ি গহনা ও যা যা লাগে সব আমার ইচ্ছেমত কিনে দিয়েছিলেন। আমার ননদরা অবশ্য নিজেরা পছন্দ করেও কয়েকটা শাড়ি, সালোয়ারকামিজ কিনিয়েছে আমার জন্য। সেগুলোও খুব ভালো ছিল। আমার পছন্দের চাইতেও ভালো ছিল। হবেই নাই বা কেন…উন্নত রুচি ও চিন্তা বলে কথা!

সেদিন আমাদের কেনাকাটা শেষে বিল পরিশোধ করার সময় জানলাম উনি নাকি উনার ক্রেডিট কার্ড আমার শাশুড়ির হাতে তুলে দিয়েছিলেন। উনি আগেই বলে দিয়েছিলেন আমার ও আমাদের দুই পরিবারের যত কেনাকাটা এসব জামাকাপড়, গয়নাগাটি ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় যা লাগে সব নাকি উনার টাকা দিয়েই কেনা হবে। বিয়ে যখন উনি করছেন খরচটা উনিই বহন করতে চান। বাকিটা বাবা মা হিসেবে আমার শশুড় শাশুড়ির যেভাবে ইচ্ছা উনাদের একমাত্র ছেলের বিয়ের আয়োজন করতে পারে। উনি বাঁধা দিবেন না। সেদিন বেশ ভালোই লেগেছিল ব্যাপারটা। উনি নিজের দায় ভার নিজে বহন করতে জানেন বলে। আবার এও মনে হয়েছিল…বেশি ধনাঢ্য ব্যক্তিরা বুঝি এমনই হয়। এদের পকেট সবসময়ই গরম থাকে।তাই নিজ থেকে যেচে খরচ করতে এরা কখনো কার্পণ্য করে না।

অফিস শেষে উনিই এসেছিলেন সেদিন, আমাদের সবাইকে নিয়ে যেতে। কারণ, এত এত শাড়ি গয়না ও জিনিসপত্র নিয়ে আমাদের সবার এক গাড়িতে করে যাওয়া সম্ভব ছিল না। তাই সমস্ত জামা কাপড়ের ব্যাগগুলো নিয়ে আমার শাশুড়ি ড্রাইভার সমেত নিজের আনা গাড়ি করেই বাড়ি ফিরে গেলেন। বাকি গয়নাগাটি, তার দুই কন্যা আর একমাত্র হবু ছেলের বউকে উনি তুলে দিলেন ছেলের গাড়িতে। বলেছিলেন আমায় যেন বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসেন উনি। আমাকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব উনি নিলেও আমার সাথে বাকি দুই বোনকেও ওই গাড়িতে করে নেওয়ার কথাটা উনিই নিজের মাকে বলেছিলেন আগ বাড়িয়ে। আমার দুই ননদ প্রথমে আপত্তি করলেও ভাইয়ের চোখ রাঙানোতে আর কথা বাড়ায়নি। ওরা হয় তো চেয়েছিল যেন আমরা একটা সুযোগ পাই একসাথে আলাদা করে কিছুটা সময় কাটানোর জন্য। কিন্তু, তাদের সেই আশায় গুড়ে বালি আর আমার শাপেবর করে দিয়ে উনি বোনেদের সাথে নিয়ে নিলেন।

সেদিন প্রথমবারের মত আমি খেয়াল করলাম উনি আমার সাথে একা কখনো থাকতে চান না। প্রথম দিনও রিতুকে সাথে নিয়ে ঘরে এসেছিলেন আর সেদিন শপিংমলে আসার পর থেকেই আমার সাথে দূরত্ব রেখে চলছিলেন বারেবারে। এমন কি আমাকে দেখে সৌজন্যসরূপ জিজ্ঞেসও করেননি কেমন আছি। ভাব এমন ছিল যেন আমার কোন অস্তিত্বই ছিল না সেখানে। কিংবা কেবল উনার দৃষ্টিতে। আবার আমায় বাড়ি পৌঁছে দিতেও দুই বোনকে নিজের সাথে নিয়ে ছিলেন।

আমার মনে সেদিন প্রশ্ন জেগেছিল, উনি কি আমায় পছন্দ করেননি? নাকি এই বিয়েতেই উনার মত নেই। নাকি অন্য কোন কারণ! আমায় অপছন্দ করার প্রশ্নই আসে না উনার। কারণ, উনার মত ছেলের জন্য বাহ্যিক দৃষ্টিতে বউ হিসেবে আমি ছিলাম বাঁদরের গলায় মুক্তোর মালার মত। অমত থাকলেও সেটার কারণ অন্য কিছু হতে পারে। হতে পারে উনি অন্য কারও সাথে কমিটেড। আবার এও হতে পারে উনি আমার মত মধ্যবিত্ত ঘরের কোন মেয়েকে বিয়ে করতে চাননি। হয় তো উনার আমার চাইতেও আরও বেশি সুন্দরী মেয়ের আশা ছিল বিয়ের জন্য।

আমাদের সমাজে ছেলে যেমনই হোক বউ তার একদম সেরাটা চাই। আর সেটার প্রথম তালিকায় থাকে বউয়ের সুন্দরী হওয়ার বিষয়টা। তারপর, এক এক করে বংশ পরিচয়, ঘরকন্নার কাজ, সাংসারিক হওয়ার ব্যাপার আর সবশেষে শিক্ষাগত যোগ্যতাটাও খঁতিয়ে দেখা হয়। সেদিক থেকে আমার তেমন কোন যোগ্যতাই ছিল না উনার বউ হবার। না একেবারে হুরপরীর মত রূপ ছিল আর না ছিল উচ্চ বংশ মর্যাদা। পড়াশোনাও করেছি সাধারণ স্কুল কলেজ থেকে। অনার্স করেছি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতির মত একটা সাবজেক্ট নিয়ে। তাই এসব দিক থেকে সব মিলিয়ে উনার জন্য আমি ততোটাও যোগ্য মনে করিনি নিজেকে। তবুও, তারা নিজ হতেই আমায় তাদের বাড়ির বউ করতে চেয়েছেন। কারণ, হিসেবে ঘটক বলেছিল তারা নাকি সাধারণ মধ্যবিত্ত ঘরের সংসারি একটা মেয়ে চায়। তাদের এত এত অর্থ সম্পদ এসব আগলে রেখে সংসার করার মত মেয়ে হিসেবে তারা এই সাধারণ ছাপোষা গোছের মেয়েটাকেই শেষে বেছে নিয়েছিলেন নিজ বাড়ির বউ করার জন্য। আমার অবশ্য সেটা মনে হয়নি। তাদের ওমন ধারার ছেলেকে কোন বড় ঘরের অর্থসম্পদশালী মেয়ে বিয়ে করবে নাকি? যার টাকার অভাব নেই তার কাছে মুখ্য বিষয় তো সোশ্যাল স্ট্যাটাস আর রেপুটেশনই হয় তাই না? সেক্ষেত্রে এ ছেলেকে বিয়ে করলে তাদের রেপুটেশন নিয়ে সমস্যা হতে পারে বলেই তাকে বিয়ে করার জন্য মানা করে দেওয়াটা তেমন অবিশ্বাস্য কিছু নয়।
ফলস্বরূপ, এত ধনী হয়ে নিম্ন বিত্ত পরিবারের সম্বন্ধ করতে বোধয় তাদেরও বাঁধছিল। তাই উপযুক্ত অপশন হিসেবে সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েকেই তারা বেঁছে নিয়েছিলেন। আর, ওদিকে এত ধনী পরিবার পেয়ে আমার পরিবারও আর দ্বিমত করেনি। আমার মতামতের তোয়াক্কা না করেই একবাক্যে হ্যাঁ বলে দিয়েছিল। আমার আর কি! মুখে মুখেই রাজি হলাম বিয়েতে। মনের খবর জেনেও তো কেউ আর কিছু করবে না আমার জন্য। তাই সবটাই ভাগ্যের পরিহাস বলে ছেড়ে দিলাম সৃষ্টিকর্তার হাতেই।

সেদিন উনার সাথে দ্বিতীয়বারের মত দেখা হলেও যতক্ষণ একসাথে ছিলাম, পুরো সময়টা উনি একটা কথাও বলেননি আমার সাথে। তবে পেছনের সিটে বসে আমার দুই ননদ ঠিকই বকবক করে মাতিয়ে রেখেছিল আমায়। নইলে পুরো পথ অস্বস্তিতে কাঁটা হয়ে থাকতে হতো আমায়।

চলবে…

#নক্ষত্র_বন্দনা

#সূচনা_পর্ব

#লেখায়_জারিন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here