ধূসর_রঙের_প্রজাপতি ৪

0
830

#ধূসর_রঙের_প্রজাপতি
#ফাতেমা_তুজ
#part_4

মেয়েটা এতো বার বার বাসা থেকে পালিয়ে যায় তাও তোমরা কিছু বলো না কেন?এই ভাবে তো মেয়ের চরিত্র খারাপ হয়ে যাবে। কোথায় কোন অঘটন ঘটায় আসবো পরে তোমাদের বংশের মুখ কালো হইবে। আর লাই দিও না তো।

আব্দুর রহমানের গা ঝাঝানো কথা গুলো শুনে হাত শক্ত হয়ে গেছে আহনাফের। বোনের নামে কঠোর কিছু কথা শুনে নিজেকে সামলাতে পারছে না ওহ।
নেহাতি ভদ্রলোক ওর গুরুজন হয় নাহলে দাঁত ভেঙে ফেলতো একদম।

আহনাফ লম্বা করে শ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করলো। ওরা খুব ভালো করেই জানে ওর বোন আবার ফিরে আসবে। তবে এবার এতো সহজে ফিরবে না সেটা ও জানে। প্রতি বারের মতো ছোট খাটো আয়োজনের বিয়ে হলে একদিনের মাঝেই ফিরে আসতো ঝিল। তবে এবার ঘটা করে লোক সমাগম করে বিয়ের আয়োজন করা হয়েছিলো। যার দরুন পালিয়ে গেছে ঝিল।আহনাফ ভদ্র লোক কে এড়িয়ে ফোন লাগালো। ওর বাবা ভাই সবাই খোঁজ লাগিয়েছে। মেয়েটা কে অনেক বেশি ভালোবাসে ওরা। তাই বার বার বিয়ের আয়োজন , যাতে তাঁদের ঘরের আলো ঘরেই থাকে।

রোহন চিপস এর প্যাকেট থেকে চিপস খাচ্ছে। আহনাফ বিরক্তি নিয়ে বলল
_ তুই এমন একটা পরিস্থিতিতে অ্যাপল চিপস খাচ্ছিস!
আর ইউ ওকে ইয়ার?

_ আম ওকে। বাট তোরা সবাই ঠিক নেই। ঝিল বিয়ে করতে চায় না তবু ও তোরা বিয়ের জন্য পাগল হয়ে যাচ্ছিস।

আহনাফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল
_ তুই ও জানিস তাহলে!

আহনাফ ভ্রু কুঁচকে বলল
_ বনু তোকে ও বলে গেছে ওহ কোথায় যাচ্ছে?

রোহন লাফিয়ে উঠলো। আহনাফের কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বলল
_ তার মানে তুই ও জানিস?

আহনাফ মাথা ঝাঁকালো। দুজনেই এক সাথে হেসে উঠলো। ঝিলের ঝাকাস মাথাতেই এমন ধরনের প্ল্যান সম্ভব। দুই ভাই কেই বলে গেছে অথচ দুজনের কেউ জানে না একে অপরের কথা।

আহনাফ রোহনের হাত থেকে চিপস এর প্যাকেট নিয়ে চিপস খেতে লাগলো। অন্য দিকে মুখ গোমড়া করে বসে আছেন ঝিলের তিন পাপা আর তিন ভাই। আশে পাশের সব জায়গায় খুঁজেছেন। কিন্তু ঝিল সেখানে নেই। তবে খুব বেশি চিন্তা নেই ওনাদের কারন ঝিল কে প্রায় সকল ধরনের সেফটি শিখানো হয়েছে। বরাবর ই মির্জা বংশের মেয়েরা প্রখর বুদ্ধি সম্পূর্ণ। তবে আশি বছর পর মির্জা বংশে ঝিল ই একমাত্র কন্যা সন্তান হয়ে জন্মেছে। আর
সকলের চোখের মনি মেয়েটা। ছোট থেকে প্রানখোলা রেখেছে সবাই। রীতিমতো এক জন ছেলের মতো করে বড় করেছেন। তবে মেয়েরা মায়ের জাত , তাদের নারী সত্তা কখনো বিলীন হবার নয়।আমাদের সমাজের নিকৃষ্ট চোখ গুলো নারী দের খুবলে খায়। তাই নারীদের এক পা ও সাবধানে ফেলতে হয়।

*

বিকেলের ছটফটে রোদ্দুরের মাঝে দাড়িয়ে আছে অভিনব। বিডির প্রতি একটা আলাদা মায়া এসে গেছে ওর। কেমন যেন সব কিছু কেই আপন আপন মনে হয়।
বছর খানেক পর বিডি তে আসার কথা থাকলে ও সব মিলিয়ে আসতে পারে নি ওহ। আর দেড় বছর পেরিয়ে যাওয়ার পর অভিনব আবার বিডি তে এসেছে তা ও তাঁর নানার বাসায়। মামাদের এতো এতো ভালোবাসা পেয়ে অভিনব মুগ্ধ। সপ্তাহ খানেক ধরে এসেছে ওহ,
অথচ সবাই এমন আচারন করছে যেন অভিনব আজ ই এসেছে। রোজ এতো শত আয়োজন , উল্লাস আর হৈ হুল্লর। ভাই বোনেরা ও বেশ ভালোবাসে ওকে। অভিনব কে মামিরা ও খুব ভালোবাসেন। সচরাচর মামিরা ভাগ্নে দের দেখতে পারেন না। আর এখানে সমস্ত টাই উল্টো।
অভিনব পকেটে হাত গুঁজে ভাবছে আদৌ কি কখনো মামারা সব কিছু মেনে নিবেন?
এই কয়েক দিনে কয়েক শত বার বলার চেষ্টা করে ও কিছু বলতে পারে নি অভিনব। সবাই প্রচন্ড অভিমানি , কেউ ই ওর মা বাবা কে মেনে নিচ্ছেন না। হয়তো চাঁপা অভিমান টা এতো বছরে ও কাটিয়ে উঠতে পারে নি।
কিন্তু কেন পারে নি? তাঁর পেছনে কি কোনো গুরুতর কারন লুকিয়ে আছে ? ত্রিশ বছর আগে কি আরো কিছু হয়েছিল? যার জন্য সবাই এখনো রেগে আছেন।

অভিনব ফোঁস করে দম ফেলল। মাথা কাজ করছে না ওর।একটা ট্যুর এ যেতে পারলে ভালো হতো। প্রকৃতির সান্নিধ্য পেয়ে মাথার জট গুলো হয়তো বা খুলে যেত।
অভিনব নিভু নিভু সূর্যের দিকে তাকিয়ে রইলো। ধূসর আকাশ টা কেমন লালচে বর্ন ধারন করেছে। কয়েক টা মেঘ ও দেখা যাচ্ছে। কি আশ্চর্য ফ্রেবুয়ারি মাসে ও বুঝি আজকাল আকাশে মেঘ করে? অভিনব প্রশস্ত হাসলো , প্রকৃতির নানান রূপ , নানা রঙে সজ্জিত তাঁরা।

_ ইহান ভাইয়া তুমি এই সন্ধ্যা বেলাতে কি করছো?

ফুলের কথাতে পেছন ফিরে তাকালো অভিনব। অভিনবর ছোট মামার মেয়ে ফুল। বলতে গেলে এ বাড়ির সব থেকে ছোট সদস্য। বয়স 11 ক্লাস 5 এ পড়ে। ফুলের নামের মতোই ,ফুল দেখতে ও খুব মিষ্টি।
অভিনব মৃদু হেসে বলল
_ ফুল ঝুঁটি এসেছে দেখছি। ভাইয়া তো সন্ধ্যা বিলাস করছিলাম।

_ সন্ধ্যা বিলাস! সেটা আবার কি ?

_ সন্ধ্যা বিলাস হলো সন্ধ্যা কে উপভোগ করা।

ফুল খিল খিল করে হাসলো। অভিনব খুব ঘুরিয়ে কথা বলে। যাহ ফুলের কাছে বেশ মোহনীয় লাগে।

অভিনব পকেটে হাত রেখে বলল
_ ফুল সোনার জন্য আমার কাছে একটা উপহার আছে। ফুল ঝুঁটি কি সেটা নিতে চায়?

ফুল উল্লাসের সাথে মাথা ঝাঁকালো। বাসার সবাই ফুল কে ফুল ঝুঁটি বলেই ডাকে। আর অভিনব আদর করে মাঝে মাঝে ফুল সোনা বলে। অভিনব নামটা একটু হিন্দু দের মতো লাগে বিধায় এ বাড়ির সবাই ওকে ইহান বলে ডাকে।
অভিনব পকেট থেকে একটা চকলেট বের করতেই ফুল ইয়ে বলে লাফিয়ে উঠলো। অভিনব প্রশস্ত হেসে বলল
_ নাও এটা শুধু তোমার জন্য এনেছি , রূপার জন্য আনি নি।

ফুল উজ্জল চোখে তাকালো। রূপা ওর বড় বোন , দুজনের বয়সের ফারাক 5 বছরের হলে ও রূপার সাথে ওর লেগেই থাকে।

ফুল চকলেট টা খুলে একটা বাইট দিয়ে বলল
_ মামুনি তোমাকে ডাকছে।

অভিনব আলতো হেসে বলল
_ তুমি যাও আমি একটু পর ই আসছি।

ফুল চলে গেল। অভিনব লম্বা করে শ্বাস ফেললো। মায়ের সাথে মামাদের সম্পর্ক ঠিক করতে ওকে খুব বেগ পেতে হচ্ছে। এবার যে করেই হোক সম্পর্ক ঠিক করেই যাবে ওহ।

*

_ম্যাম আপনার ক্যাশ, আর কার্ড ।

ঝিল স্মিত হেসে টাকা গুলো নিলো। আগে থেকেই ক্যাশ কলেক্ট করে রাখলো। নাহলে ওর পাপা আর ভাইয়েরা কার্ড এর মাধ্যমে ওর লোকেশন পেয়ে যাবে।
এবার পনেরো দিনের আগে বাড়ি ফিরবে না কোনো ভাবেই। সবাই কে আচ্ছা করে টাইট দিবে। কার্ড টা ব্যাগে পুরে নিয়ে ভালো করে মুখ টা ঢেকে নিলো ঝিল।
কে জানে কাকে কাকে ওর খোঁজে পাঠিয়েছেন । ধরা খেলে সব প্ল্যান ভেস্তে যাবে।

ঝিল কাঁধের ব্যাগ টা ভালো করে ঝুলিয়ে হাঁটা লাগালো।
যদি কার্ড এর মাধ্যমে ওর লোকেশন ট্র্যাক করে তাহলে ওহ কোন লোকেশন থেকে টাকা তুলেছে তা জেনে যাবে ওরা। তাই দ্রুত এখান থেকে চলে যাচ্ছে ওহ। মির্জাপুর থেকে গুলশানে এসে টাকা তুলেছে আপাতত গন্তব্য মিরপুর। মিরপুরে ওর বেস্ট ফ্রেন্ড এর বাসাতে দুদিন থাকবে। আর তারপর অন্য কোথাও যাবে।শীতের কারনে শরীর যেন থেমে যাচ্ছে। সন্ধ্যা সাত টা বাজতেই কুয়াশা তে ছেয়ে গেছে সব। সি এন জি করে যেতে পারবে না ওহ। রিক্স আছে , তাই লোকাল বাসে করেই যাবে।

গুলশান ১ বাস স্ট্যান্ড এ দাঁড়িয়ে আছে ঝিল। কাঁধে স্টাইলিশ কলেজ ব্যাগ আর বা হাতে ছোট্ট একটা লেডিস হ্যান্ড পার্স। বার বার ঘড়ি দেখে যাচ্ছে। বাস হয়তো জ্যামে পরে আছে।

মিনিট পনের পর মিরপুর ১০ নং গোলচত্বর এর বাস এসে থামলো। ঝিল আসে পাশে তাকিয়ে দ্রুত বাসে উঠে গেল।মাঝের একটা সিটে গিয়ে বসলো। তারপর ফোনের লক খুলে মৌনতা কে ফোন লাগালো। ফোন রিসিভ করেই ঝিল কে কিছু বলতে না দিয়ে মৌনতা বলল
_ এই ঝিল কোথায় তুই? এতো লেট হচ্ছে কেন? ফোন দিতে ও বারন করেছিস। এতো এতো টেনশনে মাথা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। দেখ সাড়ে সাত টা বাজে, আর ও আগে আসার কথা ছিলো তোর ।

_ একটু তো কথার বলার সুযোগ দে মৌন।

_ হুম হুম বল।

_ আমি গুলশান ১ বাস স্ট্যান্ড থেকে বাসে উঠে পরেছি।
মিরপুর১০ নং গোলচত্বর যেতে গুগল ম্যাপের লোকেশন অনুযায়ী মিনিট 35 লাগলে ও আমার আসতে জ্যামের কারনে হয়তো ১ ঘন্টা লেগে যাবে।তাই আমি তোকে বাস থেকে নেমে ফোন দিবো। তুই আমাকে পিক করে নিবি ওকে?

_ ওকে। সাবধানে আছিস ঝিল, তোকে নিয়ে চিন্তা হচ্ছে খুব।

_ আরে এতো ভাবিস না তো। সেফটির জন্য সব ই আছে আমার কাছে। ডোন্ট ওরি , আর শোন

_ হুমম বল।

_ আমার জন্য মগজ চপ আর খাসির চাপ অর্ডার করে রাখ এসে খাবো। আর শোন নান খাবো না , আটার রুটি অর্ডার করবি।

মৌনতা হো হো করে হেসে বলল
_ ওকে ওকে ডোন্ট ওরি। এবার তাড়াতাড়ি আয় তুই।
বাই

_ বাই।

ঝিল ফোন টা রেখে দিলো। মিরপুর ১০ এর বিখ্যাত খাবারের মধ্যে শওকতের কাবাব একটি। ঝিল যেখানে যায় সেখানের কিছু স্পেশাল ফুড অবশ্যই খাবে।না হলে জার্নির মাহাত্ম্য কি হবে?

*

অভিনবর পাশে বসে আছেন অভিনবর বড় মামা ইববান শিকদার। ওনার নামের অর্থ হলো সময়। আর ওনার চরিত্রে ও রয়েছে সময়ের প্রতি দারুন খেয়াল। সময়ের অপচয় তিনি একদম ই পছন্দ করেন না।

অভিনব প্রশস্ত হেসে বলল
_ মামা কিছু বলবে ?

_ হুমম ইহান শোন আমি কয়েক দিনের জন্য সিলেট যাবো। ব্যবসায়িক কাজে আর কি তাই আমি না ফেরা অব্দি আমেরিকা তে ফিরে যাবি না বুঝেছিস?

অভিনব সরস হাসলো। শান্ত স্বরে বলল
_ সমস্যা নেই মামা আমার পাসপোর্ট এর মেয়াদ বাড়ানো আছে। তাছাড়া তেমন কোনো সমস্যা ও হবে না। আর আমি তো বেশ কিছুদিন থাকবো বলেই এসেছি।

অভিনবর কথাতে ইববান শিকদার তুষ্ট হলেন।ছেলেটার মুখের দিকে তাকালেই ওনার সব কঠোরতা কেমন করে যেন উবে যায়।ছেলেটার মুখে যেন আলাদা কোনো শক্তি আছে।

অভিনব আশে আশে তাকিয়ে বলল
_ মেঝো মামুনি মোঝো মামা আর ছোট মামা কোথায় ?

_ বাইরে গেছে হয়তো। এসে পরবে , দিন রাত এটা সেটা নিয়ে পরে থাকে। কি জানে আবার কি হয়।

_ আহহ থাক না বাদ দাও ঐ সব।ছেলেটার যত্ন তে যেন কোনো ত্রুটি না থাকে সেটা দেখো।

অভিনব হাত গুঁজে বসে রইলো। ওনারা কিছু লুকাতে চাইছেন। মাথা ব্যথা করছে , প্রকৃতির সাথে থাকলে ভালো লাগতো হয়তো। ভ্রমন প্রেমি দের এই হচ্ছে এক সমস্যা। প্রকৃতির সান্নিধ্য ছাড়া এক মুহুর্ত চলে না।অভিনব বেশ কিছুক্ষণ ভেবে বলল
_ বড় মামা তুমি তো সিলেট যাচ্ছো। আসতে আসতে বেশ কিছুদিন লাগবে। তোমার সাথে নিশ্চয়ই আরফান ভাইয়া , তামির , সাদাদ ও যাবে।

_ হ্যাঁ ওরা ও যাবে।

_ তাহলে বাসাতে দানেশ , রূপা আর ফুল ঝুঁটি থাকবে।
বাচ্চা গুলোর সাথে আমি তো খেলতে পারবো না আর।
তো যদি কোথাও একটা ট্যুর দিয়ে আসি আমি।

ইববান শিকদার কিছু একটা ভেবে বললেন
_ তুই তো আমাদের সাথেই যেতে পারিস।

_ মামা তোমাদের সাথে গেলে ও ঘুরতে পারবো না।
আর আমি ট্রাভেল করতে খুব পছন্দ করি।

_ আচ্ছা ঠিক আছে যাস না হয়। তবে কোথায় যাবি?

_ সুন্দরবন যেতে চাচ্ছি। যান্ত্রিক জগত থেকে একটু বাইরে আর কি।

ইববান শিকদার প্রসন্ন হাসলেন। তিনি নিজে ও ট্রাভেল করতে খুব ভালোবাসেন। তবে পরিবার সামলিয়ে যেতে পারেন না। যদি ও কয়েক মাস পর পর ফ্যামিলি ট্রিপ এ যান ওনারা। অভিনবর দিকে প্রখর দৃষ্টি দিয়ে তাকালেন। ছেলেটার মুখের দিকে তাকাতেই বোনের কথা মনে পরে গেল। বুকের ভেতর চাঁপা কষ্ট টা যেন উতলিয়ে পরছে।
অভিমান ছাপিয়ে ভালোবাসা গুলো বেরিয়ে আসতে চাইছে। ইববান শিকদার দ্রুত স্থান ত্যাগ করলেন।

বি : দ্র : ভুল ত্রুটি মাফ করবেন ।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here