দেয়ালের_ওপাশে_কে? পর্ব-৪

0
517

#দেয়ালের_ওপাশে_কে?
পর্ব-৪
লেখা: Zannatul Eva

কফিশপ থেকে ফিরে এসে সাবা আরও বেশি চুপচাপ হয়ে গেল। নিজের রুমের দরজা বন্ধ করে বসে আছে আর ভাবছে, কে হতে পারে এই মহিলা? রেবা হাসান দরজায় নক করতেই সাবা এসে দরজা খুলে দিলো। ভেতরে ঢুকে রাগান্বিত স্বরে সে মেয়েকে বলল, তোমার সাহস দিনদিন অনেক বেড়েছে সাবা৷ তুমি এত দেরি করে বাসায় ফিরলে যে? কোথায় গিয়েছিলে তুমি? বিয়ের আগে মেয়েদের এত বাড়ি থেকে বেরোতে নেই জানোনা তুমি! এখন থেকে তুমি কয়েকদিন বাড়িতেই থাকবে। আমি তো মা, তাই আমার চিন্তা একটু বেশিই হয়। তোমার বাবা, চাচারা তো অন্য সব কাজ নিয়েই সারাদিন ব্যস্ত থাকে। আর চাচিরা তো যার যার ছেলে-মেয়েদের নিয়ে ব্যস্ত৷ তারা বিয়ের সময় হলে আসবে আবার চলেও যাবে। আর কোনো কিছু দেখার সময় তাদের নেই।

মায়ের কথা গুলো শোনার পর সাবা আর ওই মহিলা সম্পর্কে তাকে কিছুই বলল না। শুধু শুধু মায়ের দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে কী লাভ! কপালে যা আছে তাই হবে। আদনানকেও মনে হয় না আর বলে লাভ হবে। ও এই বিয়েটা করার জন্য নিজেকে সবরকম ভাবে প্রস্তুত করে ফেলেছে। তাহলে আমি কেন শুধু শুধু ভয় পাচ্ছি!

খাটের পাশে রাখা শাড়ির ব্যাগটা নজরে পড়তেই রেবা হাসান সাবাকে প্রশ্ন করলো, এটা কী? শপিং করতে গিয়েছিলি?

সাবা শান্ত গলায় জবাব দিলো, আদনান গিফট করেছে।

ও তাহলে তুই আদনানের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলি। সেটা আমাকে বললেই হতো। আচ্ছা আদনানকে তোর কেমন লাগে? মানে ছেলে হিসেবে কেমন বুঝছিস?

সাবা বলল, অনেক বেশি ভালো মা। আমি এর আগে এমন কাউকে দেখিনি৷ ওর সাথে দেখা করার পর আমার মনে হয়েছে এরকম কাউকেই আমি আমার জীবনে চেয়েছিলাম।
তাছাড়াও ও অনেক বেশি সাহসী।

রেবা হাসান হেসে বলল, ডাক্তার তো তাই। ডাক্তাররা সাধারণত সাহসীই হয়। আচ্ছা শোন, কাল তোকে নিয়ে শপিং এ যাব। আমাকে না বলে আবার হুট করে একা একা কোথাও চলে যাস না। ঠিক আছে? ঘুমোতে গেলাম আমি। আলোটা নিভিয়ে দিবো?

তুমি যাও।

একথা বলে সাবা নিজেই লাইট নিভিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়লো। তার মনে অনেক প্রশ্ন ঘুরপাক খেলেও সেসবকে আর পাত্তা দিলো না।

মাঝ নদীতে ডুবতে বসেছে সাবা। প্রচন্ড ঝড়তুফানের মধ্যে অসহায় ভঙ্গিতে চিৎকার করে সাহায্য চাইছে। এমন সময় দেখলো, একটা মহিলা দু’হাত বাড়িয়ে তার দিকে এগিয়ে আসছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে যেন সাবার অনেক দিনের চেনা কেউ। তার চোখে মুখে সাবার জন্য চিন্তার ছাপ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু এই চেনা চেহারাটা কার সেটা কিছুতেই মনে করতে পারছে না। মহিলাটি সাবার দিকে ক্রমাগত এগিয়ে আসতেই হঠাৎ করে তার ঘুম ভেঙ্গে গেল। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো, সকাল হয়ে গেছে। এগারোটা বেজে পনেরো মিনিট। সাবা তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে উঠে মায়ের খোঁজ করলো। আজকে তাদের শপিং এ যাওয়ার কথা ছিল। তাহলে মা তাকে এখনো ঘুম থেকে ডাকেনি কেন?

ইতোমধ্যেই রেবা হাসান বাহির থেকে ফিরলো। সাবা মাকে দেখে প্রশ্ন করলো, কোথায় গিয়েছিলে তুমি? আমাদের না বেরোনোর কথা ছিল! একা একা কি শপিং করতে চলে গিয়েছিলে নাকি?

রেবা হাসান চট জলদি মেয়েকে ব্রেকফাস্ট করতে বলল। একটু পরেই তারা বেরোবে।

সাবা বলল, কিন্তু তুমি কোথায় গিয়েছিলে?

রেবা হাসান দ্রুত হাতের কাজ গুলো সেরে নিচ্ছে। মেয়ের প্রশ্নের জবাব দিয়ে বলল, আমার একটু কাজ ছিল। তাই আর তোকে ডাকিনি। ভাবলাম কাজটা সেরে এসেই তোকে নিয়ে একবারে বেরোবো। তুই তাড়াতাড়ি খাবারটা খেয়ে রেডি হয়ে নে। তোর বাবাও যাবে আমাদের সাথে। সোনার দোকানেও যেতে হবে একবার।

সাবা খাবার খেতে খেতে বলল, আচ্ছা।
.
প্রতিদিন প্রচুর পেশেন্ট দেখতে হয় আদনানকে। ডাক্তার হওয়ার পর থেকে অন্য সব জগতের সাথে রীতিমতো বিচ্ছেদ ঘটেছে তার। পুরনো বন্ধুদের সাথেও দেখা করার তেমন সুযোগ পায় না৷ কাছের রিলেটিভদের অভিযোগ তো রয়েছেই। ডাক্তার হওয়ার অনেক জ্বালা। ডাক্তারি পড়ার আগে অবশ্য এসব ব্যাপারে কোনো আইডিয়া ছিল না তার। তখন মনে হয়েছিলো জীবনে ডাক্তার হওয়াটাই তার একমাত্র লক্ষ্য। কিন্তু এই প্রফেশনে আসার পর থেকে দেখছে, বাড়ির মানুষ থেকে শুরু করে অনেক কাছের মানুষদের সাথেই তার দূরত্ব বেড়েছে। সখ্যতা বেড়েছে কেবল হাসপাতালের রোগীদের সাথে। বাড়ির সবাইকে তো সে ঠিক ম্যানেজ করে নেয়। কিন্তু বন্ধুদের তার প্রতি অনেক অভিমান জমে আছে। ইমারজেন্সি রোগী দেখার চাপে গতবার রিইউনিয়নেও এটেন্ড করতে পারেনি। তবে এত সব ব্যস্ততার মধ্যে শুধুমাত্র একটা বন্ধুর সাথেই তার ভালো সম্পর্ক রয়ে গেছে। কারণ, তারা দুজনেই একই প্রফেশনে আছে। তাই দুজনেই দুজনের সুবিধা অসুবিধা গুলো ফিল করতে পারে। আজ একটা জরুরি কাজে হাবিব আদনানদের হাসপাতালে এসেছে। কাজ শেষে ভাবলো একবার নিজের বেস্টফ্রেন্ডের সাথে দেখা করে তবেই যাবে।

আদনানের রোগী দেখা শেষে হাবিব তার চেম্বারে এসে একদম চকমে দিলো। বন্ধুকে দেখে প্রাণোচ্ছল হাসি দিয়ে আদনান বলল, কী রে তুই! হঠাৎ কিভাবে এলি? না মানে তোরও তো আমার মতোই সারাক্ষণ চাপের উপরে থাকতে হয়।

হাবিব আদনানকে জড়িয়ে ধরে বলল, চাপের কথা আর বলিস না দোস্ত। এখানে একটা কাজে এসেছিলাম। তাই ভাবলাম এসেছি যখন তোর সাথে একবার দেখা করে তবেই যাব। কিন্তু এসে দেখি রোগীদের লাইন লেগে আছে। ভালোই তো নামডাক করেছিস। পেশেন্টরা ভালো জ্বালাচ্ছে তাই না! আমাদের ডাক্তারদের মতে যেই ডাক্তারকে পেশেন্ট যত বেশি জ্বালাবে সেই ডাক্তার তত বেশি বিখ্যাত হাহাহা।

আদনান হাবিবের জন্য কফি মগে কফি ঢালতে ঢালতে বলল, আর বলিস না। মাঝে মাঝে তো মনে হয় কবে জানি নিজেই সাইকো হয়ে যাই। এত অদ্ভুত অদ্ভুত পেশেন্ট দেখতে হয় রোজ।

হাবিব কফির কাপে চুমুক দিয়ে বলল, তাজা বলেছিস। আজ সকালে আমিও একটা অদ্ভুত পেশেন্ট দেখেছি। তোকে সবটা খুলে বলি শোন। ব্যাপারটা যতটা ইন্টারেস্টিং আবার ততটাই ঝামেলার।

আদনান ভ্রু কুঁচলে বলল, কী রকম!

একজন মহিলা এসেছিলেন আজ আমার চেম্বারে। ওনাকে দেখলে কিন্তু মনে হবে না যে ওনার সাইকোলজিক্যাল প্রবলেম আছে। আর প্রবলেমটা ওনার নিজের মেয়েকে নিয়েই। মানে ওনার মুখ থেকে সবটা শোনার পর আমার মনে হলো উনি একজন ওভার পজেসিভ মাদার। মহিলা বহু বছর ধরে এই ট্রমার মধ্যে আটকে আছেন। আর ওনার এই অদ্ভুত প্রবলেমটার কারণে ওনার মেয়ের জীবনটাও দিনদিন বিষিয়ে উঠছে।

আদনান বেশ আগ্রহ নিয়ে বলল, খোলাসা করে বলতো। সমস্যাটা কী?

সমস্যাটা হচ্ছে উনি ওনার নিজের মেয়ের বিয়ে নিজেই ভেঙ্গে দেন। মানে যখনোই কেউ ওনার মেয়ের সংস্পর্শে আসার চেষ্টা করেছে তখনই তিনি কোনো না কোনো ভাবে তাদেরকে মেয়ের জীবন থেকে সরিয়ে দিয়েছেন৷ মহিলা বেশ কান্নাকাটি করছিলেন জানিস৷ সামনেই ওনার মেয়ের বিয়ে। তাই উনি খুব করে চান এই ট্রমা থেকে নিজেকে মুক্ত করতে আর নিজের মেয়েকে একটা সুন্দর জীবন দিতে।

কথা গুলো শুনে আদনান নড়েচড়ে বসলো। বেশ কৌতূহল হয়ে হাবিবকে বলল, তোর পেশেন্টের ডিটেইলস লাগবে আমার৷ দিতে পারবি?

হাবিব অবাক হয়ে বলল, তুই ওনার ডিটেইলস জেনে কী করবি?

আদনান গম্ভীর স্বরে বলল, অনেক বড় একটা রহস্য উদঘাটন করতে হবে। আমি যাকে সন্দেহ করছি এ সে নয় তো!

চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here