এ পর্যন্ত আমার জন্য দশ থেকে পনেরোটা বিয়ের সম্বোন্ধ এসেছে। তবে এর মধ্যে একটা সম্বোন্ধও টেকেনি। এর কারণ অবশ্য আমাদের পরিবারের কারোই জানা নেই। আমাকে দেখে পাত্রপক্ষের পছন্দ হয় ঠিকই কিন্তু পরের দিনই খবর আসে ওনারা আমাদের সাথে সম্বোন্ধ করতে চান না। এমনও নয় যে পাত্ররা আমাকে অপছন্দ করে। সবারই বিয়েতে মত থাকে কিন্তু তারপরেই হুট করে কী হয় জানিনা। এখন পর্যন্ত আসা সব সম্বোন্ধই ক্যান্সেল হয়ে গেছে। এর মধ্যে কয়েকটা সম্বোন্ধর দিন তারিখ ঠিক হতে হতেও আবার পাত্রপক্ষরা ফোন করে না করে দিয়েছে।
বান্ধবীকে কথা গুলো বলেই সাবা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
সাবার বান্ধবী ফাতিহা ওর জন্য দুঃখ প্রকাশ করে বলল, তোদের এমন কোনো শত্রু আছে যারা আড়াল থেকে তোর বিয়েতে ভাংচি দিচ্ছে। এরকম শত্রু কম বেশি আমাদের সবারই থাকে। তবে এখনি ভেঙ্গে পড়িস না৷ বিয়ের সময় হলে এমনিতেই হবে।
সাবা বলল, তোর মনে হয় আমার বিয়ে হচ্ছে না বলে আমি হাপিত্যেশ করছি! আমার তো নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে অনেক স্বপ্ন। কিন্তু বাবা, চাচারাই তো আমার বিয়ের জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। কিন্তু বারবারই এমন হচ্ছে দেখে ব্যাপারটা আমার বেশ অদ্ভুত লাগছে।
ফাতিহা বলল, এত ভাবিস না। দেখবি যেদিন বিয়ে হওয়ার সেদিন পুরো পৃথিবী এসেও যদি তোর বিয়েতে ভাংচি দেয়, তবুও কোনোভাবে আর বিয়েটা ভাঙ্গতে পারবে না। আমি গেলাম রে। আজ একটু তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে আমাকে।
সাবা বলল, আমিও যাই। কাল দেখা হবে টাটা।
ফাতিহাকে বিদায় দিয়ে ভার্সিটি থেকে বাড়ির উদ্দেশ্যে রাস্তার পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সাবা ভাবলো, সমস্যাটা যে শুধু বিয়ের সম্বোন্ধ নিয়ে তা কিন্তু নয়। আমার প্রথম বয়ফ্রেন্ড সাইমনও কোনো কারণ না দেখিয়ে আমার সাথে ব্রেকআপ করে দিয়েছিলো। এরপর অনেক ছেলেই আমার জীবনে আসতে চেয়েছে কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে তারাও পিছু হটে গেছে। প্রথম কিংবা দ্বিতীয় দেখায় আমার প্রতি তাদের যেই ভালো লাগা ছিল তারপরের দেখাতে তারা আমাকে দেখলে রীতিমতো না দেখার ভান ধরে থাকতো। এই ব্যাপার গুলো আমার কাছে নেহাতই স্বাভাবিক কোনো ব্যাপার বলে মনে হয়নি। এখনো যখন বিয়ের সম্বোন্ধ আসার পর এরকম ঘটনা গুলো ঘটছে তখন আমার মনের মধ্যে আরও বেশি করে প্রশ্ন জেঁকে বসছে।
এসব ভাবতে ভাবতেই সাবা বাড়ি চলে এলো। ভেতরে ঢুকে কাঁধ ব্যাগটা টেবিলের উপরে রেখে বেসিনে গিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে নিলো। এরমধ্যেই সাবার মা রেবা হাসান এসে বলল, আজ বিকেলে টিউশনে যাস না।
সাবা তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বলল, কেন মা? কোথাও যাবে আমাকে নিয়ে?
রেবা হাসান বলল, বিকেলে তোকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে। সম্বোন্ধটা ভালো। যাস না আজ আর কোথাও।
সাবা এবার রেগে গিয়ে বলল, কেন মা? কী দরকার এসবের? বারবার একই ঘটনা ঘটছে তবুও তোমরা ক্ষান্ত হচ্ছো না। সবাই খুব ভালো করেই জানো যে, এবারের সম্বোন্ধটাও ভেঙ্গে যাবে তারপরেও কী করে আবার পাত্রপক্ষদের আসতে বলেছো?
রেবা হাসান নিচু স্বরে বলল, বেশি কথা বাড়িও না। তোমার বাবা ঘরে আছে। এসব কথা তার কানে গেলে কী হবে ভাবতে পারছো! আমি খাবার বাড়ছি টেবিলে খেতে এসো।
আমি খাবো না।
রেবা হাসান মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, তোকে বিয়ে করতে হবে না। শুধু ওরা এলে ওদের সামনে যাস। নয়তো তোর বাবার অসম্মান হবে।
সাবা অবাক হয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, তার মানে তোমরা সিউর যে এবারও একই ঘটনা ঘটবে। তবুও নিজেদের সম্মান বাঁচানোর জন্য উঠে পড়ে লেগেছো। আর প্রত্যেকবার আমার সাথে যেটা হয় তারপর আমার মনের যেই অবস্থাটা হয় সেটা নিয়ে তো তোমাদের কারো কোনো মাথা ব্যথা নেই।
রেবা হাসান মেয়ের কথার কোনো জবাব না দিয়ে চলে গেল। বিকেলে পাত্রপক্ষরা এলে সাবাকে সুন্দর করে সাজিয়ে তাদের সামনে নিয়ে আসা হলো। সাবার বাবা কামাল হাসান অনেকটা ভয়ে ভয়েই এই সম্বোন্ধটা নিয়ে সামনে এগিয়েছেন। পাত্র একজন নামকরা সাইকিয়াট্রিস্ট। ডক্টর আদনান আহমেদ। যাকে একডাকে সবাই চেনে। এখানে আসার আগে আদনান অবশ্য সাবার ছবি দেখেছে। কিন্তু সামনাসামনি সাবাকে দেখে এই মুহুর্তে তার মনে হচ্ছে সময়টা এখানেই থেমে যাক। আর সে এক নজরে সাবার দিকে তাকিয়ে থাকুক। বয়জৈষ্ঠ্যরা সামনে থাকাতে আদনান অগত্যাই সাবার দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিলো। সাবাও আদনানকে একজনর দেখে নিয়েছে। মনে মনে ভাবছে, ছেলেটা দেখতে শুনতে বেশ ভালো। তার উপর এত বড় ডাক্তার। কিন্তু এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পরেই হয়তো কোনোদিন আর এমুখো হবেনা বেচারা।
দেখা সাক্ষাতের পর্ব শেষে আদনানের বাবা-মা জানালেন সাবাকে তাদের বেশ পছন্দ হয়েছে এবং তারা আজই দিন তারিখ ঠিক করে যাবেন। খুব বেশি দেরি করতে চাইছেন না। সাবার পুরো পরিবারই প্রচন্ড অবাক হলো। কামাল হাসান খুশিতে আত্মহারা হয়ে সবাইকে মিষ্টিমুখ করালো। এরপর দুই পক্ষ মিলে দিন তারিখও ধার্য করে ফেললো।
সাবার কাছে ব্যাপারটা ভীষণ অদ্ভুত লাগছে। কারণ এ পর্যন্ত আসা সব ক’টা সম্বোন্ধই হতে হতে ভেঙ্গে গিয়েছে। সেখানে আদনানের পরিবার এত সহজেই বিয়ের জন্য রাজি হয়ে গেল! স্ট্রেঞ্জ!
এরপর সাবা আর আদনানকে আলাদা করে নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলার জন্য সময় দেয়া হলো। সাবা প্রথমেই আদনানকে জিজ্ঞেস করলো, আমাকে আপনার পছন্দ হওয়ার কারণ কী?
আদনান মৃদু হেসে বলল, আপনি সুন্দরী, স্মার্ট, শিক্ষিতা, ভালো পরিবারের মেয়ে। তবে আপনাকে পছন্দ করার আরো একটি বিশেষ কারণও রয়েছে।
সাবা কপাল কুঁচকে বলল, কী কারণ?
আদনান বলল, আপনাদের বাড়িতে আসার আগে আমার কাছে একটা ফোন আসে। যেখানে আমাকে রীতিমতো থ্রেট করা হয়। যেন আমি আপনাকে বিয়ে না করি।
সাবা বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, মানে কী? থ্রেট! তাহলে এলেন কেন? আর কেনই বা আমাকে বিয়ে করতে রাজি হলেন?
আদনান বলল, যেই মেয়ের জন্য আমাকে মা*রার হুমকি দেয়া হলো আমাকে তো সেই মেয়েকে একবার দেখতেই হতো। আর দেখার পর মনে হলো বিয়ে করলে আমি আপনাকেই করবো। দেখি কী হয়। ব্যাপারটা বেশ থ্রিলিং না?
সাবা অস্থির গলায় বলল, আপনি মজা করছেন? আমার তো ভেবেই হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। আপনার এই বিয়েতে রাজি হওয়া একদম ঠিক হয়নি।
আদনান সাবার কথা শুনে অট্টহাসি দিয়ে বলল, এত ভীতু কেন আপনি? বিয়ে শাদির মামলায় এরকম ঘটনা ঘটেই থাকে। কত মানুষই তো বিয়েতে বেগড়া দেয়ার জন্য ফাঁদ পেতে বসে থাকে। তবে আমার মামলাটা একটু ভিন্ন। ডিরেক্ট খু*নের হুমকি দিলো!
সাবা কাঁপা স্বরে বলল, কিন্তু কে সে? যে আড়াল থেকে এভাবে আমার ক্ষতি করার চেষ্টা করছে।
চলবে……..
#দেয়ালের_ওপাশে_কে?
পর্ব-১
লেখা: Zannatul Eva