দেবী শেষ পর্ব

0
812

#দেবী
লেখিকাঃ #Srotoswini_স্রোতস্বীনি (ছদ্মনাম)
কপি করা সম্পুর্ণ নিষেধ।
৫২ঃ(শেষ পর্ব)

বর্তমান~

‘বিবিজান’ ঘুমের মধ্যে এমন চিৎকার করে ঘুমভেঙে উঠে বসলো রুহুল। গলা শুকিয়ে যেন কাঠ হয়ে গেছে। রুহুল তড়িঘড়ি করে বিছানা থেকে নেমে দাড়ালো। টেবিলে রাখা গ্লাস থেকে পানি পান করলো। বাম হাত দিয়ে কপালের ঘাম মুছলো।তারপর আবারো বিছানায় বসলো। স্বপ্নের কথা ভাবতে লাগলো। আবারো দেবীর রক্তাক্ত সেই মুখ আজও স্বপ্নে দেখেছে। বহুদিন পর আবারো একই স্বপ্ন দেখলো। এই ভয়াবহ স্বপ্নকে রুহুল না দুঃস্বপ্ন বলে আর না সুস্বপ্ন।
রুহুল ডিম লাইটের আলোয় ঘড়ির দিকে তাকালো রাত তিনটের অধিক। তবে রুহুল জানে আজ সারা রাত প্রয়াস চালালেও আর ঘুম হবে না।
রুহুল বাড়ান্দায় চলে গেলো। খোলা বাড়ান্দায় দাড়িয়ে রইলো। এক অদ্ভুত ঠান্ডা বাতাস নিমিষেই রুহুলের হৃদয়ে প্রশান্তি দিয়ে গেলো।রুহুল আকাশের চাদের দিকে তাকিয়ে রইলো।বললো,”এই পৃথিবীতে চাঁদ আর আমি দুজনেই এক। আজীবন একাই থেকে যাবো। হাজারো তারা, শুকতারা আছে কিন্তু আমাদের সঙ্গী কেউ কোনোদিন ছিল না আর না হবে। ”

রুহুল দুহাত মেলে দিয়ে চোখ বুজে ফেললো।জোরে শ্বাস নিয়ে বললো, “চাদের মায়াভরা রাতে স্নিগ্ধ ছায়ায় আমি আজীবন খুজে যাবো আপনাকে। আজীবন মনে রাখবো আপনাকে, আজীবন ভালোবেসে যাবো আপনাকে। কেন চলে গেলেন আমায় একা ফেলে রেখে। এ দেহে শুধু শ্বাস নেওয়ার জন্য প্রাণ আছে, কিন্তু বেঁচে থাকার রুহ তো আপনি নিয়ে গিয়েছেন সেদিনই। আমায় বড্ড একা করে গেছেন।
বৈশাখের সেই খড়ায় এক পশলা বৃষ্টি না হয়েও আসলে পারতেন। অন্তত সেই খড়ায় নিজেকে অভ্যস্ত করে নিতাম। কিন্তু পুনরায় সেই খড়ার ভয়াবহতার মুখোমুখি কেন করলেন। এই খড়া যে রোজ রোজ আমার হৃদয় হতে রক্ত শুষে নিচ্ছে।তবুও খড়া শেষ হচ্ছে না।আমাকে ও নিয়ে যান আপনার কাছে।আপনাকে ছুই না বহুদিন, আপনাকে দেখিনা যেন হাজার যুগ, হাজার বছর।”

রুহুল বাড়ান্দা থেকে কক্ষে চলে এলো। আলমারী খুলে পেন্সিলে আকা দেবীর সেই ছবি দেখলো। বহুবছর আগে এই অঙ্কিত চিত্রটি বিন্তি দিয়েছিল রুহুল কে। দেবী বেচে থাকতে শেষ যখন বকুলের বাড়িতে মাহফিলের দাওয়াত দিতে গিয়েছিল বিন্তি রুহুলকে উপহার স্বরুপ দিয়েছিল। কিন্তু আফসোস তার দেবীকে সে একটা বার ও দেখাতে পারে নি। প্রকৃতি সুযোগ দেয় নি। সুযোগ দেয় নি পাথর নিয়তি।

রুহুল সেই চিত্রের মুখে হাত রেখে বললো, “সবাই বলে আপনি নেই,,কোথাও আপনার ছায়া নেই ,,কোন ঘ্রাণ নেই। কিন্তু আমি জানি আপনি আছেন, খুব কাছে আছেন একেবারে আমার হৃদজগৎ জুড়ে আছেন। এই জগতে একটা দিন বা একটা যুগ নয় পুরো একটা জীবনে কাটাতে চেয়েছিলাম আপনার সাথে। আমার চাওয়া টা রাখলেন না, রাখলেন না আপনি।”
_______________

আজ ও বাগান জুড়ে ফুটে থাকে রক্তজবা ফুল। বাগানের চম্পা,গোলাপ,বেলি,,গন্ধরাজ,টগর, হাসনাহেনা ফুলের মাঝেও রক্তজবার সৌন্দর্য্য বেশি দেখতে পায় রুহুল। বাগানের পাশ দিয়ে যখন যায় তখন রক্তজবা দেখলেই মনে পড়ে তার বিবিজানের কথা। তার গন্ধ নাকে আসলেই মনে হয় হ্যাঁ তার বিবিজানের সুভাস পাচ্ছে সে।

বাগানে আগাছা গুলো পরিষ্কার করছে রুহুল। আজ শুক্রবার। শুক্রবারে তার প্রধান কাজ হলো ফজর নামাজের পর তার পরিবারের সদস্যদের কবর জিয়ারত করা।দুলাল,বিলাল,জামাল,মহীবুল, হেলাল, তার দাদিমা সকলের কবর জিয়ারত করতে যায় রুহুল। তারপর সকালের খাওয়া শেষে বাগানের আগাছা পরিষ্কার করে। লাল রক্তজবা গুলো পড়ে অপরিষ্কার হয়ে আছে মাটি।সেই সাথে ঘাসও অনেক হয়েছে।

বকুল বাগানের পাশে দিয়ে যাচ্ছিল। রুহুল কে দেখেই পুরণো ক্ষতের কথা মনে পড়লো।কি ছিল আর কি হয়ে গেছে। পুরো পৃথিবী রুহুলের মিথ্যে খোলস দেখে ভাবে রুহুল কত ভালো আছে যেন জীবনে কিছুই ঘটে নি।অথচ বকুল জানে রুহুলের তার হৃদয়ে কতটুকু বেদনা নিয়ে বেঁচে আছে। রুহুল বকুল কে দেখে বকুলের দিকে তাকিয়েই মৃদু হাসলো। বকুল এগিয়ে যেয়ে বললো, “খাইরুল কে বললেই তো পরিষ্কার করে দিতে পারতো।তুই নিজে কেন করতে গেলি। এমনি তেই তো হার্ট প্রবলেম বাধিয়ে নিয়েছিস।”
–“আমার নিজের কাজ গুলো নিজে করতে পছন্দ করি । আর বাগান পরিচর্যা করতে আমার ভালোই লাগে।”

–“জানা আছে তাই বলে এভাবে করতে হবে।বুকের ব্যাথা বেড়ে গেলে বুঝবি কেমন লাগে!”
–“শুধু এগুলো কেন আমার সকল কাজ আল্লাহ যতদিন ভালো রেখেছে নিজেই করে যাবো।”
–“অন্যকে করার সুযোগ না দিলে নিজেই তো করতে হবে তাই না। নিজস্ব কেউ থাকলে তো নিজের কাজ তোর নিজের করতে হতো না। ”
–“আবার এক কথা বকুল।”
–“তো বলবো না তো কি। মানুষ একা বাচতে পারে না।প্রত্যেক টা মানুষের নিজস্ব একটা সঙ্গী দরকার।তোর ও একটা সঙ্গী দরকার ছিল রুহুল। ”
–“মানুষের কোনো সঙ্গী নেই। মানুষের সেরা সঙ্গী মানুষ নিজেই।নিজেকেই নিজের সঙ্গী করে নিতে হয়।”
–” তোর বন্ধু আমি। কেউ না জানুক আমি জানি তুই কতটা বিরহে বাস করছিস। আমার তোকে এভাবে দেখতে ভালো লাগে না রুহুল।”
–“আমি মোটেও বিরহে বাস করছি না।আমি তার স্মৃতি গুলো কেবল আকড়ে ধরে বেচে আছি। কেবল ভালো বাসা নয় বিরহও যে সইতে পারবে সেই প্রকৃত প্রেমিক।”

–” কিন্তু যে চলে গেছে তার স্মৃতি আকড়ে ধরে বাচার প্রশ্নই উঠে না। এত গাঢ় প্রেম না করলেও পারতি।ভালো আমিও বেসেছি। ”

–“পৃথিবীর সকলেই প্রেমিক। সকলেই প্রেমে পড়ে তবে কারো প্রেমের গাঢ়ত্ব কম কারো বেশি। সহজেই যে কেউ প্রেমের সম্পর্কে জড়াতে পারে, কিন্তু সেই প্রেমের সম্পর্ক সারাজীবন ধরে রাখতে সকলেই পারে না। ”

–“তুই সবসময় তোর এসব কথা বলে আমায় ভুলাস সা’লা। আমার দেখা তোর প্রেমের গাঢ়ত্ব সবচেয়ে বেশি ছিল। এতটা কষ্ট নিয়ে আর কত বইবি। কষ্ট গুলো কি ফিকে মনে হয় তোর? ”

রুহুল মাটি থেকে ঝরে যাওয়া একটা ফুল হাতে দিলো বকুলের। বললো,”বল তো এই ফুলের নাম কি?”
–“তোর প্রিয় রক্তজবা ফুল। ”
রুহুল বললো, “কত সুন্দর গাঢ় রঙ এই রক্তজবার তাই না।তার প্রতি আমার প্রেম এই রক্তজবার রক্তাক্ত রঙ এর চেয়েও গাঢ় ছিল। সে আমার বেরঙ জীবনের রঙিন রংধনু হয়ে এসেছিল। যার সাতরঙেই ছিল লাল রক্তের পরশ। যার রক্তাক্ত পদধুলি নিয়ে এসেছিল আমার খড়াময় জীবনের তৃষ্ণা মেটাতে।তাই সে চলে যাওয়ার পর তার স্মৃতিময় সেই রক্তাক্ত প্রেম থেকে প্রতিনিয়ত রক্তক্ষরণ হচ্ছে। হৃদয় জুড়ে তার শুন্যতার খরস্রোতা স্রোতস্বীনি বয়ে যাচ্ছে বহু বছর ধরে।”
________________

–“খাবো না আমি, নিয়ে যা আমায় একা থাকতে দে। আমি একা থাকতে চাই। ওরা কেউ ভালো না। সব পাপি। আমার দাদা,বৌদি, দেবীকে এনে দাও। বিলাল কে এনে দাও। ”

–“বড় আম্মা আপনি খেয়ে নেন। এনে দেবো দেবীকে। একবার মুখে নেন। কাল হতে কিচ্ছু খাচ্ছেন না। ”

সুভা সামিয়ার কপালে গ্লাস ঢিল মারলো।সামিয়া ‘আহ’ শব্দ করলো।সামিয়া করুণ চোখে সুভার দিকে তাকিয়ে বেরিয়ে এলো কক্ষ হতে।সুভা হাটুতে মুখ গুজে গুন গুনিয়ে কাদছে।বার বার বলছে,”দেবী, দেবী, দেবী।”

সামিয়া প্রতিবারের মতোই ব্যার্থ হলো সুভাকে খাওয়াতে। আজ ১৮ বছর যাবত সুভা এমন বিষন্নতায় ভুগছে। মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে গেছে যেন।সামিয়া দুচোখের জল মুছে দরজা আটকিয়ে দিলো। যে মানুষটা সামিয়াকে মায়ের মতো আগলে রেখেছে, ভালোবেসেছে। সে আজ নিজের অজান্তে আঘাত করলো সামিয়াকে।বোধহয় নিজ হুশে থাকলে এভাবে আঘাত করতে পারতো না। সামিয়ার সকল আবদারের কেন্দ্রবিন্দু ছিল তার প্রিয় বড় আম্মা।

সামিয়া নিজ কক্ষে এসে আয়না দেখে দেখে তুলা দিয়ে কপালের রক্ত মুছছে। বকুল সামিয়ার রক্তমাখা কপাল দেখে এগিয়ে এলো। বললো, “রক্ত, কপাল কাটলো কি করে সামিয়ারানি? ”
–“বড়াম্মা গ্লাস ঢিল দিছে। ”
–“আবার কি পাগলামি বেড়ে গেছে নাকি। ”
–“হুম ইদানীং বেশি বেশি করে। কেউ কক্ষে ঢুকলেই যা পায় ঢিল ছুড়ে। দাদাভাই কে বলতে হবে। ”

বকুল আফসোস এর সহিত বললো, “আর বলেই বা কি। বেচারা জীবনে আর কত কিছু সইবে। দেখবে হুট করেই একদিন রুহুল ও শেষ হয়ে যাবে। ”

সামিয়া বকুলের মুখে হাত রেখে বললো, “না ওমন কথা বলবেন না। আমার দাদাভাই এর কিছু হয়ে গেলে খুব কষ্ট হবে আমার,খুব। ”

–“বেচে থেকেও মৃত সে। নতুন করে মরলে খুব বেশি কষ্ট হবে না সামিয়ারানি। ভেতরটা পুড়ে যায় ওর এই বিরহের রুপ দেখে।”

–“সব কিছুর জন্য ওই দেবী দায়ী। ওর জন্যই এরকম হয়েছে। আমাদের সুখের সংসারটা ধ্বংস করে দিছে। ওরে কোনোদিনো ক্ষমা করবো না আমি।ও আমাদের সকলের বিশ্বাস ভেঙেছে। বেই’মান একটা। ”

–“আর তোমার পরিবার যে তার পরিবার ধ্বংস করেছিল তার বেলা। সে ভালো ছিল বলেই তোমার দাদাভাই জীবিত আছে। শুধু শুধু তাকে ঘৃণা করা বন্ধ করো। সে রুহুল কে ভালোবেসেছে। ”

–“ভালোবাসলে চলে যেতো না। ফেলে যেতো না আমার দাদাভাইকে এভাবে দুঃখের সাগরে।”
–“সব ভালোবাসা পুর্ণতা পেতে নেই। থাক না কিছু ভালোবাসা অপুর্ণ।অপুর্ণ প্রেম মানুষকে আজীবন ভালোবাসার কথা স্মরণ করিয়ে রাখে। ”
__________________

সেই হেমন্তে সিরাজী মঞ্জিল থেকে চারটি লাশ বের হয়। দেবীর মৃত্যুর পর সুভা সম্পুর্ণ ভেঙে পড়ে। তার ধারণা সকল কিছুর জন্য সে নিজে দায়ী।সে যদি বিলাল কে ভালো না বাসতো এত কিছু হতোই না। আবার মা হিসেবেও রুহুল কে ভালোবাসেনি। দেবীর মৃত্যুর পর রুহুল পাগলের মতো কেদেছিল। রুহুলের সেই কান্না দেখে সুভা আরো বেশি নিজেকে দায়ী করেছে। অন্যদিকে বিলাল সিরাজী ও কিছুদিন পর পৃথিবীর বুক হতে বিদায় নেয়। সুভা সকল কষ্ট একসাথে পেয়ে বিষন্নতায় ভোগে। ধীরে ধীরে মানসিক ভাবে ভেঙে পড়ে। অন্ধকার একা ঘরে থাকতে পছন্দ করে। কারো সাথে কথা বলা তো দূর আলো অব্দি পছন্দ করে না। রুহুল মায়ের প্রতি ক্ষোভে প্রথম প্রথম খেয়াল করেনি। কিন্তু পারে যখন খেয়াল করে তখন অনেক ডাক্তার দেখিয়েছে কিন্তু সুভা মানসিক ভাবে এতটাই বিষন্ন হয়েছিল যে স্বাভাবিক হওয়া অসম্ভব। অতিরিক্ত বিষন্নতা কেড়ে নিয়েছে সুস্থ সুভাষিণীকে।সে এখন একা থাকতেই পছন্দ করে। কেউ গেলেই চিৎকার করে।

অন্যদিকে সামিয়া সিরাজী মঞ্জিলে আছে ১৬ বছরের অধিক।এক ভয়াবহ দুর্ঘটনায় বকুল তার এক হাত হারায়। চাকরি ছেড়ে অবস্থা করুণ হয় বকুলের। এই নিয়ে সামিয়ার শাশুড়ির সাথেও কথায় পড়তো না,সামিয়ার সাথে অনেক বাজে আচরণ করতো। বিধায় সবকিছু ছেড়ে সিরাজী মঞ্জিলে চলে এসেছিল সামিয়া।আর সামিয়ার ভালোবাসার টানে বকুল ও চলে এসেছিল।এখন রুহুলের সাথেই থাকে বকুল।তালে তাল মিলিয়ে সকল কাজে সহায়তা করে। সামিয়াও নিজের সংসার মনে করে সকল কাজ নিপুণ ভাবে সামলায়।সামিয়ার দুই মেয়ে এক ছেলে এই মঞ্জিলেই থাকে।রুহুলের দাদিমা ও গত হয়েছে বহুবছর। সিরাজী মঞ্জিলে এখন মানুষ বলতে কেবল মালেকা,সামিয়া, সুভা, আর মহীবুলের মা ই আছে। হয়তো তারাও খুব শীঘ্রই গত হবে। কাজের লোক, প্রহরীরা এখনো আছে তবে নেই কেবল এই পরিবারের কেন্দ্রবিন্দু গুলো।

আসমাও মাঝে মাঝে আসে। কিছুদিন থেকে চলে যায়। পারুলের ও বিয়ে হয়েছে। তবে পারুলের মনে প্রথম প্রেমের ফুল ফুটেছিল হেলালের জন্য। হয়তো সব প্রথম প্রেমটা ভুল মানুষের সাথে হয়। আলেয়া,রোকেয়া ও আসে। বয়স্কের ছাপ ও পড়েছে। রুহুল বড় ভাই হিসেবে সকল দায়িত্ব পালন করে।এই মঞ্জিল, মঞ্জিলে থাকা মানুষের স্মৃতি গুলো আজীবন আছে এবং থেকে যাবে। তবে সিরাজী মঞ্জিল একদিকে যেমন হত্যা,প্রতিশোধ এর চিহ্ন অন্যদিকে রুহুল-দেবীর পবিত্র প্রনয়বন্ধনের প্রতীক হয়ে আছে। আবার সেই সাথে কিছু মানুষের বুকভরা হাহাকার আর বিরহের সাক্ষীও বটে।

সকলেই সকলের জীবন নিয়ে ব্যস্ত শুধু থেকে গেছে একা রুহুল। রুহুল নিজের সবকিছু দিয়ে যে দুজন কে ভালোবেসে ছিল তারা দুজন ই রুহুল কে একাকিত্ব উপহার দিয়েছে। তার মা জীবিত থেকেও একা করেছে অন্যদিকে দেবী নিজে মরে রুহুল কে খুন করেছে।মরলেই হয় না মরা, আর মারলেই হয়না মারা। রুহুল এখন মনে প্রাণে এখন তাই বিশ্বাস করে। দেবী না মেরেই রুহুল কে খু’ন করেছে। নিজের বুকে সৌরজগৎ সমান বিরহ নিয়ে প্রাণহীন হয়ে বেঁচে আছে দেবীর সেই মাতোয়ারা প্রেমিক রুহুল সিরাজী।
___________________

আসর নামাজ পড়ে রুহুল নিজের সবচেয়ে প্রিয় জায়গায় যাওয়ার জন্য হাটা ধরলো। শিমুল ফুল গাছে কোকিল কু কু করে তার সুমধুর কণ্ঠে ডাকছে। সেই সাথে সুন্দর প্রকৃতির ফুলের গন্ধ নাকে আসছে।রুহুল নিজের মতো করে যাচ্ছিলো কিন্তু রুহুল কে দেখেই সাজু সালাম দিলো,”সালাম সিরাজী আব্বা। ”

রুহুল তাকিয়ে দেখলো সাজু তার ছোট মেয়েকে কোলে নিয়ে আছে।রুহুল মৃদু হেসে উত্তর নিলো,”ওয়ালাইকুম সালাম। কোথায় যাচ্ছো মেয়েকে নিয়ে?”

–“আর কইয়েন না রিতা তো এহুনো আগের মতোই আছে। একটু কিছু হইলেই অফ ফুইলা মহিলাশালায় যায় আর না হইলে সই এর বাড়ি চইলা যায়। মাইয়াডা ওর আম্মার জন্য কানতাছে।আমার হইছে যত জ্বালা।”

–“ভালোবাসায় মান-অভিমান অতি জরুরী। এগুলো সম্পর্কের মর্ম বুঝায়।যাও ওকে বুঝিয়ে বাড়ি নিয়ে এসো। ১৭ বছর ধরে সংসার করছো অথচ এখনো এগুলো ছেলেমানুষী করো দুজনে। ছেলে বড় হয়েছে। এগুলো আর করবে না। নিজেদের শুধরে নাও। ”

সাজু মাথা নিচু করে বললো, ” আমার কি দোষ কন। ও ই তো হুদা কথা নিয়া ঝগড়া করে। রাজু বড় হইয়া গেছে,রানি হইছে তাও ওর স্বভাব বড় হইলো না। ”

–“বুঝাও ওকে। লোকে মন্দ বলবে এগুলো শুনলে। যাও এখনি গিয়ে ওকে বুঝিয়ে বাড়ি নিয়ে এসো।”

–“আইচ্ছা, আমি আইসি তাইলে। সালাম। ”

সাজু চলে গেলো রুহুল হাসলো। কি সুন্দর খুনসুটি ভড়া সংসার করছে সাজু আর রিতা। এই তো রুহুল ই তো সাজুর সাথে রিতার বিয়ে দিয়ে দিলো। কত সুন্দর সুখী ওরা। অথচ রুহুল নিজে তার ভালোবাসার মানুষটার সাথে শেষ অব্দি সংসার করতে পারলো না। পুতুল খেলার মতোই মাত্র কয়েকদিন সেই সংসার ছিল। কত সহজে শেষ করে দিয়েছিল দেবী তাদের সংসার।

দেবীকে দেওয়া সকল কথা রুহুল রেখেছে। সিরাজপুর আজ উন্নত হয়েছে। মহিলাশালা এখন আরো উন্নত হয়েছে। মেয়েরাও লেখাপড়া করে চাকরি করার সুযোগ পাচ্ছে।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সহ বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেলে-মেয়েরা উভয়ই লেখাপড়া করছে।দেবীর কথামতো ফাতিমাকেও চিকিৎসা করিয়েছিল। কিন্তু ফাতিমা মরেছে আজ প্রায় ১৫ বছর ।বক্ষব্যাধি ফাতিমাকে গিলে খেয়েছিল।সেদিন যদি দেবী বেঁচে থাকতো হয়তো খুব কাদতো ফাতিমার জন্য।

দেবীর মৃত্যুর পর রুহুল তিনতলার সেই গুপ্তকক্ষের সকল কংকাল বের করে কবর দেয় নিজ উদ্দেগে। দেবীর মা-বাবার লাশ ও হিন্দুধর্মের পুরোহিত দের সাথে কথা বলে পুরিয়ে দেওয়া হয়। সকল ভুল ভ্রান্তিকর নীতি মুছে ফেলে সঠিক ইসলাম ধর্ম মতে সকল কিছু পরিচালনা করা হয় সিরাজপুরে।

দেবীর মৃত্যুর পর কেউ দেবীকে শেষ গোসল করিয়ে দেবে না রুহুল জানতো। আর সেই সাথে দেবীর লাশ কেও আস্ত রাখতো না সিরাজপুরবাসি। ইসলাম ধর্মে স্ত্রী মারা গেলে স্বামীর তাকে শেষ গোসল করানো জায়েজ। তাই রুহুল নিজে তার বিবিজান কে সেই রাতেই গোসল করিয়ে সাদা কাফনে মুড়িয়ে দেয়। সাজুর সাহায্য নিয়ে সেদিন ফজরের পর রুহুল নিজে দাফন করে।

সিরাজপুরের শেষ মাথায় বিরাট ফাকা জমি ছিল। সেখানে মানুষের যাতায়াত খুব একটা বেশি নেই।দেবীকে মৃত্যুর পর সেখানে খোলা আকাশের নিচে কবর দেওয়া হয়েছে। যেখানে সুন্দর খোলা আসমান দেখা যায়। তবে রুহুল চারপাশে ঘেরাও করে দিয়েছে।

কবরের চারিদিকে রক্তজবা ফুল গাছ। মাথার কাছে বড় একটা কৃষ্ণচূড়া গাছ। যার লাল রঙ এর ফুল ফুটে থাকে। আর সেই সাথে আশে পাশে ও খেজুর গাছ লাগানো। শরৎকালে যখন এই জমিতে কাশফুল ফোটে রুহুলের সেই কাশফুল ফুল গুলো দেখলে মনে হয় বহু বছর আগের সেই শুভ্রপরীকে পুনরায় দেখছে। যখনি মনে পড়ে তখনি রুহুল ছুটে আসে এই জায়গায়। প্রকৃতির বুকে কোথাও শান্তি না পেলেই চলে আসে এই কবর জিয়ারত করতে। কখনো বা দেখতে আসে প্রিয় অর্ধাঙ্গিনীকে। সে যে সিরাজী মঞ্জিলের বিলাশবহুল বিছানা ছেড়ে সুয়ে আছে এই মাটির বিছানায়।

রুহুল বহুদিন পর আবার এখানে এলো। কবরের পাশে বসলো। ডান হাত দিয়ে পুরোটা কবর স্পর্শ করলো। ঠান্ডা শীতল বাতাস মুহুর্তেই সব কিছু উড়িয়ে দিলো। বাতাসে সকল লাল রঙের কৃষ্ণচূড়া ফুল গুলো পড়লো রুহুলের ওপর। বসন্তের দক্ষিণা হাওয়া রুহুলের সকল ক্লান্তি দূর করে হৃদয় সতেজ করে তুললো। কবরের ওপর আবারো ছড়িয়ে পড়লো রক্তজবা আর কৃষ্ণচূড়া ফুলে। সেই সাথে রুহুল এর গায়েও পড়লো। রুহুল চেয়ে রইলো উপরের কৃষ্ণচূড়া গাছের দিকে। মুহুর্তেই একটি প্রজাপতি উড়ে এসে রুহুল কে স্পর্শ করে গেলো। আকাশে ঝাকে ঝাকে পাখি উড়তে শুরু করলো। রুহুল তার বাদামি ঠোঁট প্রশস্ত করে সুখের হাসি হাসলো। তার বিবিজান জীবনের শেষ মুহুর্তে মনের সকল ভাবাবেগ প্রকাশ করে গিয়েছিল। যা তার বিবিজান সত্যিই করে থাকে। আজ ও সে পবিত্র ফুল হয়েই আছে যা রুহুলের দিকে ঝরে পড়ে রুহুলের মনের বিষন্নতা নিমিষেই গায়েব করে দেয়।যাদের গন্ধে লেগে আছে তার বিবিজানের সেই পবিত্র ঘ্রাণ।

রুহুল কবরের পাশে শুয়ে পড়লো। করব জড়িয়ে ধরে বললো,”জগতের সকল ফুলের সেরা ফুল ছিল আমার বিবি।তার সুভাস, তার সৌন্দর্য্য,তার ছোয়া আমার খুব নিকটে এসে জানিয়েছিল সে ই সৃষ্টির সেরা দেবী।
সাত সমুদ্র তেরো নদী আমি চিনি না, সারা জাহান আমি চিনি না। তবে আমি যাকে চিনতে চেয়েছিলাম সে কেবল আমার দেবী।পুরো পৃথিবী যতদিন টিকে থাকবে ততদিন আপনি বেঁচে থাকবেন বিবি। ভালোবাসার স্রোতস্বীনির ধারায় আজীবন মনে রাখবো, ‘দেবী।”

~সমাপ্ত~

#দেবী
#Srotoswini_স্রোতস্বীনি

বিদ্রঃ দয়া করে কেউ কপি করবেন না। এটা আমার লেখা প্রথম গল্প। আমি জানি অনেক ভুল, অনেকটা অগোছালো হয়েছে। তবে বলবো ভুলত্রুটিগুলো ক্ষমা করবেন। যারা এতদিন পাশে ছিলেন তাদের জন্য হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা এবং ধন্যবাদ। যারা ভুল গুলো ধরিয়ে দিয়েছিলেন তাদের কেও ধন্যবাদ। এটা সম্পুর্ণ আমার কল্পনায় গড়া একটি গল্প। বাস্তবতার সাথে তুলনা করবেন না। এটা হ্যাপি এন্ডিং দেওয়া আমার জন্য অসম্ভব ছিল। তাই এবার আপনাদের বিরহ দিয়ে বিদায় নিলাম। ইন শাহ আল্লাহ আগামী গল্পে এক বুক ভালোবাসা দিতে ফিরে আসবো। সকলেই ভালো থাকবেন। আমার জন্য দুয়া করবেন।সামনে আমার বোর্ড পরীক্ষা এখন পড়াশোনা করতে হবে। আপনারাও পড়াশোনা করুন। বেশি বেশি বই পড়ুন।ইন শাহ আল্লাহ আমার পরীক্ষা শেষ হলে নতুন ভিন্নধর্মী একটা গল্প নিয়ে ফিরে আসবো। আর #দেবী গল্পটা আপনাদের কেমন লাগলো অবশ্যই জানাবেন। ভালো মন্দ দুটো মন্তব্যই জানতেই আগ্রহী আমি। আর গল্পটা আপনাদের গল্পপ্রেমী বন্ধুদের সাথেও শেয়ার করবেন আশা করি।আমার পেজটি ফলো করে রাখবেন যেন নতুন গল্প দিলে খুব সহজে পেয়ে যান। সকলকে ধন্যবাদ। আসসালামু আলাইকুম এবং আল্লাহ হাফিজ। ❤️?

®️ Srotoswini-স্রোতস্বীনি ✍️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here