#দৃষ্টিনন্দনে_তুমি
কলমে:লাবণ্য ইয়াসমিন
পর্ব:২২
আবিরের কথা শুনে হৈমন্তী নিশ্চুপ হয়ে গেলো। সত্যি কাজটা ভালো হয়নি। অরিনকে এরকম একটা খারাপ বুদ্ধি কিভাবে দিতে পারলো কে জানে। শয়তানের প্ররোচনায় করেছে নিশ্চয়ই। হৈমন্তীকে ভাবতে দেখে আবির ওর কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো। ওর হঠাৎ এমন কাজে হৈমন্তী চমকে উঠলো। পা দুটো থরথর করে কাঁপছে। আবির সেদিনের পাত্তা দিলো না। চোখ বন্ধ করে বলল,
> মাথায় যন্ত্রণা হচ্ছে হাত বুলিয়ে দাও। বদ বুদ্ধি বহুত করেছো এখন বরের সেবাযত্ন করো। পাপ না করে পূর্ণ করো আল্লাহ্ তোমার মঙ্গল করবেন।
আবিরের কথার খোঁচা শুনে হৈমন্তী ওর চুলের মুঠি ধরে শক্ত করে ধরে নাড়িয়ে দিলো। আবির চোখমুখ খিচে মৃদু ধমক দিয়ে বলল,
> মারছো কেনো? কোথায় আদর যত্ন করবে, চুমু টুমু দিবে তানা করে আমাকে মারছো?এটা ঠিক হচ্ছে বলো?
হৈমন্তী মুখটা ভার করে বলল,
> আপনি ভয়ানক খারাপ মানুষ। মুখের সঙ্গে কাজকর্মের কোনো লাগাম নেই। আচ্ছা আপনি কার মতো হয়েছেন বলুন তো? শাশুড়ি আম্মা বেশ ভদ্রমেয়ে কিন্তু আপনি তো তেমন না। আপনি কি শশুর আব্বার মতো?
আবির হৈমন্তীর হাত টেনে নিয়ে নিজের মাথার উপরে রেখে বলল,
> আমাকে নিয়ে গবেষণা অনেক হয়েছে আপাতত ক্ষমা দাও। প্লিজ বকবক বন্ধ করে ঠিকঠাক কাজটা করো নয়তো আমি কিন্তু তোমাকে ভয়ানক লজ্জায় ফেলে দিব তখন আমার সামনে আসতে পারবে না।মুখ আর চলবে না। বসে বসে কাঁদতে হবে।।
আবিরের কথা শুনে হৈমন্তী দ্রুত ওর কপাল টিপতে শুরু করলো। বলা যায় না, যা বলেছে করে ফেলতে সময় নিবে না। এভাবে বেশ কিছুক্ষণ পার হলো। আবির ঘুমিয়ে পড়েছে। সারাদিন হাসপাতাল আর ক্লিনিকে সময় পার করতে হচ্ছে। আজ অপারেশন নেই তাই রাতটা চুপচাপ ঘুমিয়ে কাটাতে পারছে নয়তো দৌড়াতে হতো। আবিরকে ঘুমিয়ে যেতে দেখে হৈমন্তী পেছনের বালিশে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করলো। আবির ওর কোলে মাথা রাখার জন্য নড়াচড়া করতে পারলো না।কিছুক্ষণর মধ্যেই হৈমন্তী ঘুমিয়ে পড়লো।
_____________
ছেলেকে ঘুম পাড়িয়ে চুপচাপ নিচে নেমে আসলো চয়নিকা। রাজীব ডাইনিং রুমের সোফায় বসে আছে। সামনের ল্যাপটপে ভিডিও কলে মিটিং চলছে। সামনে নির্বাচন ঘনিয়ে আসছে। প্রচারণার কাজকর্ম করতে হলে আগে থেকেই ময়দানে নামতে হবে। রাজীবের রাজনৈতিক ফিল্ড ভালো আছে। এবারেও অনায়াসে পাশ করতে পারবে তবুও বিরোধী দলের ঝামেলা আছে। যেকোনো সময় অবস্থা পরিবর্তন হতে পারে। লোকজন মুখে বলে এক কাজের বেলায় আরেক করে বসে। এবারের নির্বাচনে কাজীদেরকে পাশে পাবে এটা ভেবেই প্রশান্তি লাগছে। বিয়েটা দিয়ে ভূল কিছু করেনি। আবির যথেষ্ট ভালো ছেলে বোনকে সুখে রাখবে তাঁতে সন্দেহ নেই। চারদিকটা সাজানো গোছানো। কোথাও কোনো এলোমেলো নেই। পাঁচ ভাইবোন সকলেই ভালো আছে। প্রতিষ্ঠিত বলা যায়। আরাফাত একটু এলোমেলো রাজীব ওর জন্য ব্যবসার দাঁড় করিয়ে ফেলেছে। আর কি চাই জীবনে? চোখ বন্ধ করে মন দিয়ে জনগণের সেবা করবে। রাজনীতি করবে প্রাণভরে। কথাগুলো ভেবে রাজীব কল কেটে দিয়ে সোফায় হেলান দিলো। চয়নিকা রাজীবকে টপকে শাশুড়ির রুমে উঁকি দিয়ে দেখলো উনি বিড়বিড় করে বকছে। বাড়িতে তমালকে নিয়ে এতবড় একটা কান্ড ঘটে গেছে সেটা নিয়ে বকবক করছেন। তারপর কিছু একটা মনে হতেই পানের জন্য হাই হুতাশ করছেন। চয়নিকা শাশুড়ির সামনে গিয়ে বসতে বসতে বলল,
> মা আপনি কি রেগে আছেন?
আমেনা বেগম বিরক্তি নিয়ে বললেন,
> রাগবো না বলছো? আচ্ছা আমার পানের পাত্রটা ময়লার স্তুপে কে ফেলতে পারে বলে তোমার মনে হয়? সন্দেহভাজন কাউকে চোখে পড়েছে?
চয়নিকা মাথা নাড়িয়ে ইশারায় বুঝিয়ে দিলো জানেনা। আমেনা বেগম ভ্রু কুচকে বললেন,
> কিছুই তো জানোনা। শুধু জানো কিভাবে আমার ছেলেকে জব্দ করতে হবে। শুনো মেয়ে বরকে ওরকম করে জব্দ করতে গিয়ে হারিয়ে ফেলোনা যেনো। একটু ছাড় ছোড় দিতে হয় পুরুষ মানুষ তো?
চয়নিকা শাশুড়ির কথা শুনে বেশ বিরক্ত হলো। কিসের ছাড়? ছাড় শব্দের সঙ্গে চয়নিকার পরিচয় নেই। ভূল করলে কঠিন শাস্তি পেতে হবে। চয়নিকা যদি কোনো ভূল করতো তবে কি রাজীব ওকে ছাড় দিতো? জীবনে দিতো না। কলেজে কোন এক ছেলে ওকে প্রস্তাব দিয়েছিল সেই অপরাধে রাজীব চয়নিকার পড়াশোনা লাটে উঠিয়ে ছেড়েছিল। চয়নিকার সবটা মনে আছে। দোষ না করেই শাস্তি পেয়েছে সেখানে দোষ করলে তো শাস্তি পাবেই। চয়নিকা কথাগুলো ভেবে ভ্রু কুচকে বলল,
> মা ছাড় দিলে এতদিন ঘরে আরেকজন চলে আসতো। আপনি তো সেই ব্যবস্থা করেই ফেলেছিলেন। আমি কিন্তু ছাড় দেওয়ার মেয়ে না। জানেন তো শেখ বাড়ির মেয়ে আমি। শেখদের দাপটে বাঘে মহিষে এক ঘাটে জ্বল খাই। আপনি যথেষ্ট ভালো মা তবুও কেনো মাঝেমাঝে এমন বোকামি করে ফেলেন শুনি? ছেলেমেয়েকে কষ্ট দিতে ভালো লাগে? মাকে ছেড়ে এসেছি আপনার কাছে, কোথায় একটু কাছে টেনে নিবেন তানা করে শুধু বকাবকি করেন। খুব কষ্ট হয় মা।
বহুদিনের জমিয়ে রাখা কথাগুলো চয়নিকা উগড়ে দিলো। শেষের কথাগুলো বলতে গিয়ে ওর চোখ দিয়ে দুফোটা পানি গড়িয়ে পড়লো। ভাবলো এখানে আর থাকবে না।রুমে চলে যাবে কিন্তু পারলো না। আমেনা বেগম দ্রুত চয়নিকাকে জড়িয়ে ধরে বললেন,
> ক্ষমা করে দে মা। আমি তোর কাছে অপরাধী। দুদিন পর কবরে চলে যাবো অথচ তোর কাছে সারাজীবন অপরাধী হয়ে গেলাম যে মা। আমি রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারি নারে মা। হুটহাট কি হয় জানিনা। আমি খুব ভূল করেছি। তাছাড়া রাজীব আমার প্রথম সন্তান। ভেবেছিলাম খুব ধুমধাম করে নিজের পছন্দের মেয়ের সঙ্গে ওর বিয়ে দিবো। কিন্তু ও হুটকরে তোকে বউ করে নিয়ে আসলো। আমি মানতে পারিনি। তারপর যখন দেখলাম তোর কোলে এত বছরেও কোনো বংশধর আসছে না তখন আরও রাগ হলো। জীদ চাপলো মাথায়। কিন্তু দেখ আমার ছেলেমেয়েগুলো কতটা ভালো। ওরা কৌশলে আমার অপরাধটাকে থামিয়ে দিলো। আমি পরে ভেবেছি ওরা খারাপ কিছু করেনি। রাগে পড়ে জিদ নিয়ে আমি ভয়ানক খারাপ কাজ করতে বসেছিলাম।
আমেনা বেগম একদমে কথাগুলো বলে থামলো। অনেক দিন পরে নিজেকে হালকা লাগছে। মেয়েটাকে কমতো কষ্ট দেননি। এখন ক্ষমা না চাইলে কখনও আর ক্ষমা চাওয়া হবে না। সন্তান দেওয়া নেওয়ার ক্ষমতা কি মানুষের আছে? সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছে ছাড়া যেখানে গাছের পাতাও নড়ে না। সেখানে জোরজবরদস্তির করে এসব আশা করা বোকামি ছাড়া কিছুই না। চয়নিকা শাশুড়ির হাতটা নিজের মুঠোয় নিয়ে বলল,
> ক্ষমা চেয়ে লজ্জা দিবেন না। আপনি অনুতপ্ত এতেই আমি খুশী। মা খুব ভালোবাসি এই সংসারটাকে। আমি নিজের দুহাতে সবটা গুছিয়ে নিয়েছি হঠাৎ ছাড়তে বললে মরে যাবো আমি। আপনি তো জানেন কতটা কষ্ট হয়।
> এই অধম মেয়েটাকে ক্ষমা করে দে মা। আমি কখনও আর তোকে কষ্ট দিবো না। আমার ছেলেটাকে নিয়ে সুখে থাক। সন্তান হোক বা না হোক তোরা সুখে আছিস এতেই আমি খুশী।
চয়নিকা চোখের পানি মুছে বলল,
> সন্তান নেই কে বলল? আপনি নিজে আমাকে মা হতে সাহায্য করেছেন। আমার ছেলেটা যখন আমাকে মা বলে ডাকে আমার বারবার আপনার কথা মনে পড়ে। সারাজীবন মনে থাকবে আপনার কথা। আপনি সত্যি সত্যি আমার মা।
চয়নিকা শাশুড়িকে জড়িয়ে ধরলো। বেশ কিছুক্ষণ চলল বউ শাশুড়ির সুখ দুঃখের গল্প। বেশ রাত হয়েছে। সবাই নিজ নিজ ঘরে ঘুমিয়ে আছে। চয়নিকা শাশুড়ির থেকে বিদায় নিয়ে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালো। আমেনা বেগম পানের চিন্তা একদম ভূলে গেলো। বউমাকে নিজের কথাগুলো বলতে পেরে শান্তি শান্তি লাগছে।
☆☆☆
তোড়জোড় করে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান শেষ হয়েছে কিন্তু ঝামেলা একটা বেঁধে গেছে। হৈমন্তীর ভয়ানক জ্বর এসেছে। বিয়ের দিন সকালবেলায় মেয়েটা বিছানা থেকে উঠতেই পারছে না। আবির গতকাল রাতে বাসাই ফিরে আসেনি। অপারেশন ছিল কয়েকটা। সেসব ঝামেলায় পড়ে বাড়িতে ফিরতে পারলো না। দিনের কাজকর্ম সব শেষ করে নিয়েছে। বরযাত্রী যেতে হবে। ছোট জামাইকে সকলে খোঁজ করবে। হৈমন্তীর জ্বর দেখে মাসুদ বিয়ে দুদিন পিছিয়ে দিতে চাইলো কিন্তু ওর ছুটির দিন কমে আসছে। এখন বিয়ে না হলে পরের অনুষ্ঠানগুলো বউকে একা একাই পালন করতে হবে। হৈমন্তী সেসব ভেবে দিন পিছাতে মানা করলো। ও না গেলে বিশেষ কোনো অসুবিধা হবে না। ভাইয়ের সঙ্গে যেতেই হবে এমন কোনো নিয়ম নেই। মাসুদের মন খারাপ লাগছে। আরাফাত ঝিম ধরে বসে আছে। মাসুদ হৈমন্তীর রুমে গিয়ে বোনের কপালে হাত রেখে বলল,
> গাধা ডাক্তারটা থাকতেও তুই অসুস্থ। কারণ টা কি? সে কি পশু ডাক্তার? মানুষের সেবাযত্ন করতে পারেনা। সে থাকতে আমি বোনকে ছাড়া বিয়ে করতে যাচ্ছি। ডাক্তার পাত্র দেখে বোন বিয়ে দিয়ে লাভের লাভ কিছুই তো হচ্ছে না। বোন আমার তুই আগে সুস্থ হয়ে উঠ বিয়ে নাহয় পরে হবে।
ভাইয়ের কথা শুনে হৈমন্তী মৃদু হাসলো। ও জানে বিয়ে নিয়ে ভাইয়ের কতগুলো স্বপ্ন রয়েছে। ভাবিকে ঘনঘন ফোন করে এটা ওটার প্লান করছে। আবার বোনের জন্য এতো স্বাদের বিয়েটা পিছিয়ে দিয়ে দুবার ভাবছে না। হৈমন্তী ভাইয়ের হাতটা মুঠোয় নিয়ে বলল,
> একদম না। তুমি ভাবিকে আজকের মধ্যেই নিয়ে আসবে। আমি অপেক্ষা করবো। তাছাড়া ভিডিও কলে দেখবো সবাইকে। আজকের মধ্যে কিন্তু বিয়ে হওয়া চাই।
হৈমন্তী চোখ বন্ধ করে কথাগুলো বলে উঠলো। মাথায় প্রচণ্ড যন্ত্রণা হচ্ছে। চোখ লাল হয়ে উঠছে। আবির কয়েকবার ফোন করেছিল হৈমন্তী ধরতে পারেনি। মাসুদের সঙ্গে কথা বলে ও গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে পড়ল। শেষমেশ হৈমন্তীকে ছাড়াই বিয়েতে যাওয়ার পরিকল্পনা হলো। আবির এগারোটার পরে শশুর বাড়িতে এসে হৈমন্তীকে অসুস্থ দেখে ঘাবড়ে গেলো। সুস্থ মানুষ রেখে গিয়েছিল এসে এভাবে অসুস্থ দেখবে ভাবেনি। ও পোশাক চেঞ্জ না করেই হৈমন্তীকে চেকআপ করতে শুরু করলো। বাড়ির পুরুষ মানুষেরা সকলেই যাচ্ছে তাই আবির হৈমন্তীর কাছে থেকে গেলো। হৈমন্তী জ্বরের ঘোরে প্রলাপ। আবির ওকে ওষুধ দিয়ে মাথায় পানি ঢালছে। মেয়েটা চোখ বন্ধ করেই বিড়বিড় করছে। আবির কানটা ওর মুখের কানে নিয়ে গিয়ে শুনলো,
> মাথায় এতো শরবত ঢালে ক্যান? আমি শরবত খাই না। আমি পানি খাই। গাধা ডাক্তার বোকা ক্যান?
হৈমন্তীর ভুলভাল কথাবার্তা শুনে আবিরে চোখ বড়বড় হয়ে উঠলো। মেয়েটার মাথা পুরোপুরি গেছে। কি ভয়ানক অবস্থা। আবির দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে আবারও হৈমন্তীর মাথায় পানি দিতে ব্যস্ত হয়ে উঠলো। হৈমন্তী প্রচুর নড়াচড়া করছে। আবির হাপিয়ে উঠলো হৈমন্তীর সেবাযত্ন করতে গিয়ে।মেয়েটা ঘুমের মধ্যে মাঝেমাঝে দাঁড়িয়ে পড়ছে। চোখ বন্ধ করে সাপ সাপ বলে চিৎকার করে উঠছে। আবির মাথায় হাত রেখে হৈমন্তীর পাশে বসে আছে। শাশুড়ি লজ্জায় এদিকে পা রাখছে না।
চলবে