দৃষ্টিনন্দনে তুমি পর্ব ১১

0
442

#দৃষ্টিনন্দনে_তুমি
কলমে: লাবণ্য ইয়াসমিন
পর্ব:১১

গেটের বাইরে চিৎকার চেচামেচি শুনে হৈমন্তী আর অরিন দৌঁড়ে আসলো। আসমা বেগম ওদেরকে আটকে দিতে চেয়েছিলেন কিন্তু উনার মনেও কৌতূহল কাজ করছে। শেষমেশ উনিও ছুটলেন ওদের পিছু পিছু। মহিত দোতলা দেকে উঁকি দিচ্ছে। হৈমন্তী ভেবেছিল ওর বাসার কেউ হয়তো এসেছে কিন্তু কাজের মেয়েটা বলল একটা মেয়ে ভেতরে আসার জন্য চেচামেচি করছে তাই ও দাঁড়িয়ে পড়লো। আসমা বেগম কিছু একটা ভেবে নিয়ে কাজের মেয়েকে বলে দিলেন মেয়েটাকে ভেতরে নিয়ে আসতে। হৈমন্তী শাশুড়ির পাশে দাঁড়িয়ে আছে। অরিন ফিসফিস করে বলল,

> ঘটনা কি? ভাইয়ার বাড়িতে মেয়ে মানুষ কি হচ্ছে এসব?

কথাটা শুনে হৈমন্তীর ভ্রু কুচকে গেলো। আসমা বেগম ওদের চুপ থাকতে বলে ভেতরে গেলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই সবুজ গাউন পরা বেশ সুন্দরী একটা মেয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো। হৈমন্তী মেয়েটার আপাদমস্তক বেশ ভালো করে দেখে নিলো। মেয়েটার ফর্সা মুখটা রোদে লাল হয়ে গেছে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। আসমা বেগম গম্ভীর কন্ঠে মেয়েটাকে পাশে বসতে বলে কাজের মেয়েকে শরবত করতে বললেন। অরিন আর হৈমন্তী বাকশৃন‍্য। নিরবে দেখে চলছে। মেয়েটা বসতে বসতে সালাম দিয়ে বলল,

> আন্টি ব‍্যস্ত হবেন না আমি আবিরের বন্ধু তমালিকা। আপনি আমাকে তমা বলে ডাকতে পারেন। আপনার কথা বহুবার শুনেছি আবিরের থেকে।

তমলাকি একদমে কথাগুলো বলে থামলো। গেটের কাছে প্রায় এক ঘন্টা দাঁড়িয়ে থেকে পা ব‍্যাথা হয়ে গেছে। পানি পিপাসা পেয়েছে। কিন্তু বলতে পারছে না। কি উপলক্ষে এসেছে জিঞ্জাসা করলে ঘেটে ফেলবে নিশ্চিত। গলা শুকিয়ে আসছে। আসমা বেগম মেয়েটার মুখের দিকে তাঁকিয়ে আছেন। উনি হয়তো কিছুটা আচ পেয়েছেন তাই একটু ভয় পাচ্ছেন হৈমন্তীকে নিয়ে। মেয়েটা আবার উল্টোপাল্টা কিছু বুঝবে কিনা কে জানে। কথাগুলো ভেবে উনি বললেন,

> আবির বাসাতে নেই। হাসপাতালে আছে। তুমি কি ওর কাছে এসেছিলে?

তমালিকা ঢোক গিলে বলল,

> না না আমি তো আপনার কাছেই এসেছি। আপনার সঙ্গে দেখা করার অনেক ইচ্ছা ছিল। আপনার কথা কতবার শুনেছি। তাই ভাবলাম দেখা করে আসি।

আসমা বেগমের বিশ্বাস হলো না। তবুও মলিন হেসে বললেন,

> তা বেশ ভালো করেছো। এসেছো যখন থাকো আবির আসলে দেখা করে ফিরবে।

আসমা বেগমের কথা শেষ হলো না শরবত চলে আসলো। তমালিকা শরবত হাতে নিয়ে ঢাকঢক করে গলাই ঢেলে নিয়ে গ্লাস টা ঠক করে সামনে রেখে বলল,

> আন্টি আপনার পাশের মেয়ে দুটো কে ঠিক চিনতে পারলাম না।

আসমা বেগমের হঠাৎ খেয়াল হলো আলাপচারিতার দরকার তাই উনি হৈমন্তীকে দেখিয়ে বললেন,

> আবিরে স্ত্রী হৈমন্তী আর পাশে আমার মেয়ে অরিন।

তমালিকা অবাক হয়ে বলল,

> আপনার মেয়ে? আবির বলেছিল ওর তো বোন নেই। বড় ভাই ভাবি আছে উনারা দেশের বাইরে। তাহলে মেয়ে কিভাবে?

আমেনা বেগম মলিন হেসে বলেন

> মেয়ে নেই কে বলেছ? পাশাপাশি দুটোই আমার মেয়ে। যাইহোক তুমি বসো ওদের সঙ্গে গল্প করো আমি আসছি।

আসমা বেগম অতিথির খাবারের আয়োজন করতে চলে গেলেন। উনি চলে যেতেই তমালিকা হৈমন্তীর দিকে ভ্রু কুচকে বলল,

> তুমি জানো আমি কে?

হৈমন্তী মাথা নাড়িয়ে ইশারা করলো জানে না। তমালাকে ক্ষুব্ধ হয়ে বলল,

> এক সময় আবির আমার জন্য পাগল ছিল। আমি ওর গার্লফ্রেন্ড ছিলাম। আমার গায়ে আচড় লাগলেও আবির পাগল হয়ে যেতো।

তমালিকার কথা শুনে হৈমন্তী চোখ বড়বড় করে বলল,

> ডাক্তার মানুষের এই একটা স্বভাব। কিছু হলেই চিকিৎসা করতে মন চাই। আমার সঙ্গেও এমন করে।

হৈমন্তী শেষের কথাটা লাজুক হেসে বলে দিলো। মেয়েটাকে দেখে ওর কেনো জানি রাগ হচ্ছে। তবুও মনে মধ্যে পৈশাচিক একটা বুদ্ধি উঁকিঝুকি দিচ্ছে। তাই এভাবে উত্তরটা দিয়ে দিলো। বিনিময়ে তমালিকা আরও কিছুটা জ্বলে উঠে ফিসফিস করে বলল,

> আবির তোমাকে বাধ্য হয়ে বিয়ে করেছে। আমি সব জানি। তুমি কি ভাবছো আমাকে বোকা বানাবে?

অরিন ভ্রু কুচকে শুনছে। ও ইচ্ছে করছে মেয়েটাকে এখুনি তাড়িয়ে দিতে। ও কিছু বলতে চাইলো কিন্তু পারলো না। তার আগেই হৈমন্তী বলল,

> কি যে বলো না আপু। উনি কি বাচ্চা যে জোরজবরদস্তি করে বিয়ে দিবেন। তাছাড়া যদি জোর করেই দিতো তাহলে কি আর আমার সঙ্গে এমন করতেন? জানেন উনি কতটা রোমান্টিক? কি ভালো বর আমার। আমাকে কতটা কেয়ার করে। হৈমী বলতে পাগল। আগে যায় হয়েছে হয়েছে এখন উনি শুধু আমার।

হৈমন্তী কথাগুলো বলে দাঁত বের করে হাসি দিয়ে আরিনের দিকে চোখ টিপ দিলো। অরিন বুঝতে পারলো না মেয়েটার মাথায় কি চলছে। তমালিকা ওর এমন উত্তর শুনে একেবারে দমে গেলো। ভেবেছিল আবির হয়তো মেয়েটাকে মন থেকে স্ত্রী হিসেবে মানে না। কিন্তু এখন তো সব গোলমাল হয়েগেলো। মহিত ওকে খবর দিয়ে এনেছে। বদ ছেলেটা বলেছে আবির এখনো ওকেই ভালোবাসে সেই খবর শুনে ও এমন করে ছুটোছুটি করছে। তবুও মেয়েটা হেরে যাওয়ার ভয়ে বলল,

> আবির দায়িত্ববান ছেলে। বিয়ে করেছে তার দায়িত্ব নিবে না এমন তো হয়না। শুনো মেয়ে দায়িত্ব পালন আর ভালোবাসার মধ্যে পার্থক্য আছে। ওর মনে শুধু আমি।

হৈমন্তী কুটিল হেসে বলল,

> সে উনি হতেই পারেন দায়িত্ববান, তাতে আমার কি? উনি আমার সঙ্গে থাকেন,আমার সকল আবদার পূরণ করেন। সেবাযত্ন করেন। আরও কতকিছু সব তো বলা যাবে না। একজন স্ত্রীর এর চাইতে আর কি লাগে? উনি সুখী না হলেও আমি কিন্তু দারুন সুখী। উনার মনে যেই থাকুক সঙ্গে কিন্তু আমি থাকি।

হৈমন্তীর খাপছাড়া কথা শুনে তমালিকা চোখ কপালে উঠিয়ে ফেলল। মেয়েটা যে দুষ্টু বুদ্ধির খনি সেটা বুঝতে ওর বাকি নেই। এই মেয়ে আর যাইহোক আবিরকে ছাড়বে না। ওর ইচ্ছে করছে মহিকে কাচা চাবিয়ে খেতে। মনে মনে মহিতকে আচ্ছা করে জঘন্য করে গালি দিয়ে দিলো। হৈমন্তী মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে কয়েকবার চোখের পলক ফেলে বলল

> একটা কাজ করুন বিবাহিত ছেলের পেছনে না ঘুরে ভালো ছেলে দেখে বিয়ে করে ফেলুন। ভালো হবে। যাইহোক আসছি আমি শাশুড়ি আম্মা একা আছেন।

হৈমন্তী উঠে দাঁড়িয়ে হঠাৎ দোতলার দিকে নজর দিয়ে বলল,

> উপরে আপনার কূটনীতিক মন্ত্রী দাঁড়িয়ে আছেন। আপনি বরং উনার সঙ্গে পরামর্শ করুক হয়তো কোনো ভালো সমাধান দিতে পারবেন। একার বুদ্ধিতে ফকির হয়ে কাজ নেই।

হৈমন্তী কথা শেষ করে অপেক্ষা করলো না। টান পায়ে চলে আসলো। অরিন ভদ্রতার খাতিরে বসে আছে কিন্তু বিশেষ কোনো কথা বলছে না। অনেক কিছুই বলতে চেয়েছিল কিন্তু হৈমন্তীর যা বলেছে তার উপরে আর কোনো কথা হয়না। তমালিকা মিনমিনে কন্ঠে বলল,

> একটু মহিতকে ডেকে দিবেন? কথা ছিল।

অরিন মাথা নাড়িয়ে উঠে আসলো। এই মেয়ের সঙ্গে মহিতের যোগাযোগ আছে আবিরকে বলবে ভেবে নিয়েছে। মহিতকে ওর একটুও পছন্দ না। মহিত ওর একমাত্র ফুপির ছেলে। ওরা দুই ভাই দুই বোন। ছেলে দুটোই মহা শয়তান। মামা বাড়িতে জীবনের অর্ধেকের বেশি টাইম পার করে ফেলেছে। ওদের বাড়িতে ফুপির বেশ দাপট আছে। ভদ্রমহিলা ভীষণ অহংকারী। উনি উচিৎ কথা বলতে আপন পর বাচ বিচার করেন না। বড় ছেলেটা কয়েক বছর দেশের বাইরে আছে। শিঘ্রই ফিরবে তখন আরও একটা ঝামেলা এসে জুটবে। অরিন কথাগুলো ভাবতে ভাবতে মহিতকে বলে আসলো নিচে যেতে।
☆☆☆☆
বাথরুমে ভেজা কাপড়ে দাঁড়িয়ে আছে আবির। দুপুরের পরে হন্তদন্ত হয়ে বাড়িতে ফিরে এসে তমালিকাকে দেখে চোখ ওর উল্টে যাবার উপক্রম হয়েছে। অরিন ওকে প্রথম থেকে শেষ পযর্ন্ত সবটা বলে তবে ক্ষান্ত হয়েছে। আবির তমালিকা কে নিয়ে ভাবছে না। চিন্তা হচ্ছে হৈমন্তীকে নিয়ে।মেয়েটার মাথায় কি চলছে ধরতে পারছে না। তমালিকাকে দেখে এমন ঠান্ডা ঠান্ডা অনুভূতির পেছনে ঠিক কোন কাহিনী লুকিয়ে আছে জানতে হবে। বাথরুম থেকে বের হতে আজকে আর ইচ্ছে করছে না। কোন শয়তানের প্ররোচনায় যে প্রেম করেছিল এখন ভারি আফসোস হচ্ছে। এক বাড়িতে বউ আর প্রেমিকা সেখানে আবার মা বোন ভাই আছে। সবাইকে হম্বিতম্বি করে নাহয় ভয় দেখিয়ে দমিয়ে রাখতে পারবে তবুও লজ্জা বলতে একটা অদৃশ্য বস্তু আছে। হৈমন্তী দরজার ওপাশ থেকে অনবরত ধাক্কা দিচ্ছে। আবির বিরক্ত হলো মেয়েটার উপরে। হৈমন্তী সাড়াশব্দ না পেয়ে ফিসফিস করে বলল,

> প্রেমিকাকে দেখে বুঝি আপনি বাথরুমে লুকালেন? এই আপনি সাহসি ডাকাত ডাক্তার? আরে আসুন কিছু হবে না আমি আছি সামলে নিব।

আবির দ্রুত কাপড় চেঞ্জ করে বাইরে এসে কোমরে হাত রেখে ধমক দিয়ে বলল,

> তোমাকে পাগলের ডাক্তার দেখানো দরকার। ফাজিল মেয়ে তোমাকে এসব আজেবাজে বুদ্ধি কে দিচ্ছে? তমালিকাকে ওসব কেনো বলেছো? বেচারি মেয়েটা এমনিতেই কষ্ট পাচ্ছে।

হৈমন্তী ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বলল,

> আহারে কি কষ্ট কষ্ট। আসুন কষ্ট সারিতে দিব।

আবির চোখ বড়বড় করে বলল,

> আমাকে নকল করছো?

> আসল নকল বুঝি না। আপনি আমার একমাত্র বর আমি আপনার কষ্টে দুঃখ পাচ্ছি। এতগুলো…

হৈমন্তী দুহাত দিয়ে দেখিয়ে দিল কতটা কষ্ট পাচ্ছে। আবির বুঝলো মেয়েটা ওর সঙ্গে মজা করছে। ও আর কথা বাড়ালো না। চুপচাপ বেরিয়ে আসলো। ও বাইরে আসতেই হৈমন্তী বিছানায় ধপাস করে বসে পড়লো। ভেতরে ভেতরে কেনো জানি খারাপ লাগছে। কান্না পাচ্ছে। শাশুড়ি মায়ের বুদ্ধিতে আবিরকে বিরক্ত করে বেশ ভালো লাগছিল কিন্তু মাঝখানে এই মেয়েটা এসে সব ঝামেলা করে দিল। আসমা বেগম হৈমন্তীকে আচ্ছা করে বুঝিয়েছে। ঝগড়া ঝামেলা কোনো সমাধান না। প্রতিশোধ নিয়ে চাইলে শান্ত ভাবেও নেওয়া যায়। বুদ্ধিটা হৈমন্তীর কাছে দারুণ লেগেছে। হঠাৎ বাইরে থেকে অরিনের ডাকে ওর ধ‍্যান ভাঙলো। টেবিলে খাবার দেওয়া হয়েছে। হৈমন্তী দ্রুত বাইরে চলে আসলো। আবিরের সামনের চেয়ারে তমালিকা বসে আছে। আবির একবারও তাকিয়ে দেখেনি। ওর রাগ হচ্ছে মেয়েটার উপরে। মেয়েটাও ভয় পাচ্ছে তবুও নিজেকে শান্ত রেখেছে। আসমা বেগম গম্ভীর কন্ঠে বললেন,

> খাওয়া শেষ হলে ওকে বাড়িতে রেখে আসো।

আবির খাবার মুখে দিতে দিতে উত্তর দিলো,
>পারবো না।
আসমা বেগম বিরক্তি নিয়ে বললেন,
> কেনো পারবে না?
> যে আসতে পারে সে যেতেও পারে। আমার সময় নেই। সারাদিন প্রচুর কাজকর্ম করেছি এখন ঘুমাবো।
মহিতকে বলো পৌঁছে দিবে। এসব ও ভালো পারে।

তমালিকা খাবার নাড়াচাড়া করছে। আবিরের উপরে ওর রাগ হচ্ছে। মানুষ কিভাবে এমন বদলে যায় কে জানে। ওর ইচ্ছে হলো আবিরকে খুন করতে। ফাজিল বেটা। এর জন্য ফরহাদের সঙ্গে সম্পর্কটা নষ্ট করেছিল। এখন আফসোস হচ্ছে।

(চলবে)

ভুলত্রুটি মার্জনা করবেন। সবাইকে ঈদের শুভেচ্ছা, ঈদ মোবারক।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here