দৃষ্টিনন্দনে তুমি পর্ব ১০

0
435

#দৃষ্টিনন্দনে_তুমি
কলমে: লাবণ্য ইয়াসমিন
পর্ব:১০

অমোঘ এক সত্য হৈমন্তীর সামনে এসে উপস্থিত হয়েছে। হাতদুটো থরথর করে কাঁপছে। মাথায় নানারকম চিন্তা ভাবনা ঘুরপাক খাচ্ছে। বেশি ভড়কে গেছে অরুণির ছবি দেখে।মেয়েটা দেখতে একদম অরিনের ফটোকপি। মনে হয় ওরা জমজ। হৈমন্তী শুধু মেয়েটার নাম শুনেছিল কখনও স্বচক্ষে দেখা হয়নি। ফাইলের মধ্যে থাকা তৈলচিত্রে প্রাণবন্ত কিশোরীর ওষ্ঠে অমায়িক হাসি। যেই মেয়েটার অস্তিত্ব আজ পৃথিবী থেকে বিলুপ্তপ্রায়। নিঃশব্দে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে নাকি কেউ ষড়যন্ত্র করে ওকে সরিয়ে দিয়েছে ভাবার বিষয়। আচার্যের বিষয় মৃত্যু কালে মেয়েটা প্রেগনেন্ট ছিল কিন্তু কিভাবে সম্ভব?। আরাফাতের সঙ্গে মেয়েটার গভীর সম্পর্ক ছিল। অরিন একবার বললে আরাফাত ওকে নিয়ে চোখের পলকে উধাও হয়ে যেতো।সেখানে মেয়েটা কি এমন দরকারে কিটনাশক খেয়ে মারা যেতে পারে?মেয়েটার এই অবস্থা জন্য কি কোনো রকমে আরাফাত দোষী? ওদের মধ্যে যেহেতু সম্পর্ক ছিল যেহেতু এরকম কিছু হওয়া অসাভাবিক কিছু না। রক্তে মাংসে গড়া মানুষের মধ্যে ভুলত্রুটি থাকতেই পারে কিন্তু কাজীরা কেমন করে বিষয়টাকে ধামাচাপা দিয়ে দিলো? ময়নাতদন্তের রিপোর্ট পযর্ন্ত ঘুষ দিয়ে আটকে দিয়েছে। তিল থেকে তাল বানানো কাজীরা এতবড় একটা সুযোগ পেয়েও মির্জাদের বাড়িতে কোনো হামলা করেনি। বরং চুপচাপ মেয়েকে দাফন করেছে। লোকজনকে বলেছে বিয়ে করবে না বল‍ে সুইসাইড করেছে। হৈমন্তীর মাথা ঘুরছে। কাকে বিশ্বাস করবে বুঝতে পারছে না। আরাফাতকে অবিশ্বাস করলে নিজেকে অবিশ্বাস করা হবে। ওকে বিশ্বাস করলে তাহলে আবার আরেক ঝামেলা হবে তা হচ্ছে সামনে থাকা প্রমাণ পত্রটাকে অবিশ্বাস করা হবে। অরুনির মৃত্যু রহস্যের জটিলতায় হৈমন্তী আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে পড়েছে। আবির হাসপাতালে যাওয়ার পরে হৈমন্তী কৌশলে ড্রয়ার খুলে রিপোর্ট বের করেছে। চোখের সামনে মেয়েটার মৃত্যুর কারণগুলো জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। হৈমন্তী গভীরভাবে ধ‍্যান মগ্ন। নিজের ভাইয়ের নামে বাজে কথা হৈমন্তী কিছুতেই ভাবতে পারছে না। এর পেছনে অন‍্য কোনো রহস্য আছে। কি রহস্য থাকতে পারে বুঝলো না। তবে আবির হয়তো কিছুটা জানতে পারে। হৈমন্তী মনে হাজারো প্রশ্ন। শাশুড়ির কাছে জিঞ্জাসা করা ঠিক হবে কি না চিন্তা করে হৈমন্তী দ্রুত ফাইলটা ড্রয়ারে রেখে বেরিয়ে আসলো। আসমা বেগম যত্ন নিয়ে অরিনের চুলে তেল দিয়ে দিতেছিলেন হঠাৎ হৈমন্তীকে দেখে উনি হেসে বললেন,

> পাশে বস, চুলে আজ সব গুলোরে তেল দিয়ে বেধে দিব। উল্লুখ হয়ে সামনে সামনে ঘুরছিস।

আসমা বেগমের কথা শুনে হৈমন্তী বিনিময়ে হেসে সোফায় বসতে বসতে বলল,

> তেল দিতে হবে না। তুমি আগে বলোতো অরিন আপুর মতো দেখতে কেনো অরুনি আপুকে?

হৈমন্তীর কথা শুনে আসমা বেগম ছলছল চোখে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন,

> ওরা জমজ ছিল। অরুনি ছোট থেকে মামার বাড়িতে থেকে মানুষ। পড়াশোনাও সেখানে করতো আর অরুনির বাড়িতে। মেয়েটা বেশ নরম মনের ছিল। সামান্য বকলেও মেয়ের সেকি কান্না। হাতের পুতুলের মতো ছিল। আমি ওকে যত্ন নিয়ে কতরকম রান্না শিখিয়েছিলাম। কি থেকে কি হয়ে গেলো।

হৈমন্তী বিস্মিত হয়ে বলল,

> কি হয়েছিল বলবে? বলো না আম্মা।

আসমা বেগম কিছু একটা ভেবে বললেন,

> মেয়েটা তোমার ভাইয়াকে ভালোবাসতো। তোমাদের বাড়ির অবস্থা খারাপ ছিল না কিন্তু আরাফাত তো বেকার ছিল। অরুনির বাবা চাচার এক কথা মেয়ে কোনো বেকার ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিবে না। ওরা দ্রুত ওর বিয়ে ঠিক করে ফেলেছিল। কিন্তু মেয়েটা হয়তো সেটা মেনে নিতে পারেনি। তবে তুমি বিশ্বাস করবে না আমরা কিন্তু এটা নিয়ে ওকে কখনও বকাবকি করিনি। ওকে বোঝানো হয়েছে। কি একটা ভয় ওকে জড়িয়ে রেখেছিল। সারাক্ষণ রুমে থাকতো। আরও একটা কথা আমরা জানার আগেই কিন্তু ও তোমার ভাইয়ার সঙ্গে শুনেছি যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিল। ওর সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পেরে ছেলেটা পাগলামী করছিল। আমরা ওর পাগলামীর জন‍্যই জেনেছিলাম সবটা।

আসমা বেগম এই পযর্ন্ত এসে থামলো। হৈমন্তী কাছে বিষয়টা গুলিয়ে গেলো। ও ভ্রু কুচকে বলল,

> তোমার কথা ঠিক বুঝতে পারলাম না। তুমি বলতে চাইছো যে,অরুনী আপু ভাইয়ার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিল তাই ভাইয়া তোমাদেরকে বিরক্ত করছিল। আর ভাইয়া ভাবছিল তোমাদের চাপে আপু ভাইয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করছে না তাই তো?

> হ‍্যাঁ এটাই। আমরা প্রথমে অবাক হয়েছিলাম। অরুনীর মতো মেয়ে প্রেম করবে বিশ্বাস ছিল না। কথাটা জেনে তখন থেকেই পাত্র দেখা শুরু। অরুনি তোমার ভাইয়ার সামনে আর কখনও যায়নি। ওকে নিয়ে কিছু জিঞ্জাসা করলে চুপচাপ শুনতো। চোখের পানি ফেলতো। আমরা বুঝলাম হয়তো মেয়েটা তোমার ভাইয়ার উপরে রেগে আছে এই সুযোগে বিয়ে দিতে সুবিধা হবে। এখন বুঝি সিদ্ধান্তটা ভুল ছিল।

হৈমন্তী চুপচাপ গোলমেলে কথাগুলো শুনলো। ওর মনে প্রশ্ন জাগলো, আরাফাত ভাইয়া যদি অরুনীর জন্য এতোটা উথলা ছিল তাহলে নিজের বাচ্চার কথা জানলে ওকে কি ওকে ফিরিয়ে দিতো?নাকি ওদের মাঝে কোনো তৃতীয় পক্ষ চলে এসেছিল। হৈমন্তী নিজের মতো করে ঘটনাটা সাজিয়ে ফেলল।। তবুও মন মতো হলো না। রহস্যের অন্তরালের থাকা ঘটনাটা সবার সম্মুখীন হওয়াটা খুব জরুরি। হৈমন্তী সিদ্ধান্ত নিলো রহস্যের সমাধান করবে। অরিনের মন ভয়ানক খারাপ। নিজের বোনের জন্য সেই সঙ্গে আরাফাতের জন্য। ও জানতো না বোন যাকে পছন্দ করতো সেই ছেলেটা আরাফাত ছিল। আগে জানলে হয়তো এতোটা এগিয়ে যেতো না। এখন ফিরে আসা সম্ভব না। লোকটার মনে শুধু ওর বোনের জন্য ভালোবাসা বিরাজ করছে। যদিও ওরা দুবোনের আবয়বের হুবুহু মিল আছে তবুও হৃদয় তো আলাদা। ভালোবাসা চেহারা না মন দিয়ে হয়। অরিনের চোখ থেকে দুফোটা পানি গড়িয়ে পড়লো।

________________
বিক্ষিপ্ত মন নিয়ে রুগী দেখছে আবির। হৈমন্তীর ব‍্যবহারটা হঠাৎ পরিবর্তন হয়ে গেছে মানতে পারছে না। মেয়েটার মাথায় এসব উল্টোপাল্টা বুদ্ধি কে দিয়েছে আল্লাহ্ ভালো জানে। আবির একবার ভাবলো ওকে ঘরে বন্দ করে রাখবে কিন্তু মায়ের কথা ভেবে দমে গেলো। হঠাৎ একজনের কথা শুনে ও চমকে উঠলো। সামনে ভাঙা হাত নিয়ে বসে আছে এক যুবক। আরাফাত সৌজন্যতার খাতিরে বলল,

> কেমন আছেন?নাম কি আপনার?

লোকটা লাজুক হেসে বলল,

> লিচু মিয়া।
আবির ভ্রু কুচকে বলল,
>কে রেখেছে আপনার এমন উদ্ভুত টাইপ নাম?

লোকটা আরও একটু খানি হেসে দিয়ে বলল,

> আমরা আম্মা মোছাঃ বেদানা বেগম।

আরাফাত বিরক্তি নিয়ে বলল,

> আশাকরি আপনার বাড়িতে বাকী ফুল ফুলেরা খুব যত্ন সহকারে আছে। যাহোক আপনার অসুবিধা গুলো বলেন।

ছেলেটা বিস্তার বলছিল আর আবির শুনছিল এর মধ্যেই হঠাৎ ওর কেবিনের দরজা খুলে গেলো। আবির বিরক্তি নিয়ে তাঁকিয়ে দেখলো তমালিকা দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটা ঝড়ের গতিতে আবিরকে জড়িয়ে ধরতে চাইলো কিন্তু পারলো না। আবির ওক আটকে দিয়ে বলল,

> কি করছো তমা? আমাকে স্পর্শ করো না প্লিজ।

আবিরের এমন একটা কথা শুনে মেয়েটা হজম করতে পারলো না। এতদিনের সম্পর্ক, যেখানে আবির তমা বলতে পাগল ছিল সেই ছেলেটা কিভাবে ওকে এভাবে ইগনোর করতে পারলো। প্রচণ্ড রাগে ওর শরীর জ্বলে উঠলো। আবির লিচু মিয়াকে ইশারা করে বাইরে পাঠিয়ে দিলো। লিচু মিয়া যেতেই তমালিকা ঝাঝালো কন্ঠে বলল,

> আমি স্পর্শ করলে তোমার শরীর পচে যাবে নাকি ক্ষয় হয়ে যাবে কোনটা? তুমি এসেছিলে আমার কাছে, আমি কিন্তু না?তাহলে আজ এমন করছো কেনো? দেশে ফিরে একবারও খোঁজ নিয়েছো?

আবির ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। কি বলে এই মেয়েটাকে সান্ত্বনা দিবে ভাবতে পারছে না। তবুও কিছু বলা দরকার ভেবে বলল,

> আমি বিবাহিত তমা। আমি চাইনা তুমি মরিচীকার পেছনে ছুঁটে নিজের জীবনটা এলোমেলো করে ফেলো। ভেবে নাও আমি তোমার ভাগ্যে ছিলাম না। আমার পাজড়ের হাড় দিয়ে অন‍্য নারীকে সৃষ্টিকর্তা বহু আগেই সৃষ্টি করে ফেলেছে। আল্লাল চাইলে তুমি ভালো কাউকে পাবে

আবির কথাগুলো বলতে গিয়ে জড়িয়ে ফেলল। পালিয়ে যেতে পারলে ভালো হতো। তমালিকা চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকার পাত্রী না। হুমকি ধামকি দিয়ে ফিরে গেলো। ও যেতেই আবির হাফ ছেড়ে বাঁচলো। মেয়েটা য‍দি বাড়িতে গিয়ে হানা দেয় তাই ফোন করে হাতি বাহিনীকে বলে দিল অনুমতি ছাড়া প্রবেশ একদম নিষেধ। তমালিকাও মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছে যেভাবেই হোক আবিরের বউকে স্বচক্ষে দেখে তবে ছাড়বে। কি এমন সুন্দরীকে পেয়ে আবির ওর মতো মেয়েকে ফিরিয়ে দিল।

(চলবে)

ভুলত্রুটি মার্জনা করবেন। লেখার সময় পাচ্ছিনা তাই পর্ব একটু ছোট হচ্ছে। ঈদের পরে ইনশাআল্লাহ আগের মতো নিয়মিত গল্প পোস্ট করবো।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here