তোর নামের রোদ্দুর২ পর্ব 4

0
1721

#তোর_নামের_রোদ্দুর-২
পর্বঃ ৪

লেখনিতে:মিথিলা মাশরেকা

-বউ!

টুপ করে বন্ধ চোখ থেকে দুফোটা নোনাজল বেরিয়ে এলো।মাথার উপরে দেয়ালে আটকে রাখা হাতদুটো আরেকবার ঝাড়া মারলাম।কানে গোজা চুলগুলো এসে একদম চোখেমুখে পরলো।শুদ্ধ ভাইয়া আমার কানের কাছে থাকা মুখ উঠিয়ে আলতোভাবে ফু দিয়ে চুলগুলোকে সরিয়ে দিলেন চোখের সামনে থেকে।ফুপিয়ে কাদছি আমি।উনি একহাতে আমার দুহাতের কবজি একসাথে করে মাথার উপরে দেওয়ালে আটকে দিয়েছেন,আরেকহাতে গালে লেগে থাকা পানি মুছিয়ে দিয়ে বললেন,

-এতোটা অভিমান?

চোখ মেলে তাকালাম আমি।উনি বাকা হাসছেন।সে হাসিতে বিন্দুমাত্র সহমর্মিতা নেই আমার চোখের পানির জন্য।আমি তো শুধু বিদ্রুপই দেখতে পাচ্ছি।ঠাট্টা?এসবই ঠাট্টা মনে হয় তার?মজার বিষয় এটা আমি কাদছি?অতি সাহস জুগিয়ে ওড়না কিসে আটকেছে তা দেখতে ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকিয়েছিলাম আমি।যা দেখলাম তাতে শিউরে উঠলাম।শুদ্ধ ভাইয়া রুমের ভেতরের দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দরজা খুলে ওড়না ধরে রেখেছেন আমার।ওড়নাটা হাতে আরেকপ্যাচ ঘুরিয়ে ঘরের ভেতরে তাকিয়েই বললেন,

-ইমরোজ?তোর কল অফ গফ!তাইনা?কন্টিনিউ!কন্টিনিউ!আর তামিম?তোর কল অফ ন্যাচার!বড্ড সময় লাগাস তুই।নিউলি ম্যারেড কাপলের ওয়াশরুমটা বুঝি গেলো!রিফাত?ব্যালকনির দরজার পর্দাটা পাল্টে দিয়ে আয় তো!

কথাগুলো বলে আমার দিক ফিরে একটা ইনোসেন্ট হাসি দিলেন উনি।গলা শুকিয়ে গেলো আমার সে হাসিতে।একটা শুকনো ঢোক গিলে ওড়না টানতে টানতে বললাম,

-এ্ এটা ছাড়ুন।

কোনো হেলদোল নাই তার।আমি আরো জোরে দুহাতে টানতে টানতে বললাম,

-ছ্ ছাড়ুন ওড়নাটা শুদ্ধ ভ্….

উনি একটান দিলেন ওড়নায়।টাল সামলাতে না পেরে কয়েকপা এগিয়ে গিয়ে দরজা ধরে দাড়ালাম।অল্পের জন্য গায়ে পরিনি তার।মাথা তুলেও আর তাকাতে পারবো না।দুবার তার উষ্ণ নিশ্বাস চোখে লাগলো আমার।আচমকাই ওড়নাটা আমার গলায় পেচিয়ে বাইরে বেরিয়ে দরজাটা লাগিয়ে দিলেন শুদ্ধ ভাইয়া।শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।দু হাতে গলার ওড়নাটা ধরে প্যাচ আলগা করার চেষ্টা করতে যেতেই শুদ্ধ ভাইয়া একহাতে আমার দুহাত ধরে আমার মাথার উপরে দেওয়ালে আটকে দিলেন।

-তোকে বলেছিলাম আংটি না খুলতে!

….

-সাহস কি করে হলো তোর আংটি খোলার?

….

-আন্সার মি ড্যামিট!

প্রতিটা ধমকে কেপে কেপে উঠছি শুধু।হাত ছাড়ানোরও চেষ্টা করেছি।লাভ হয়নি।উপায়ন্তর না দেখে জবাব দেওয়াটাই শেষ ভরসা মনে করলাম।কাপাকাপা গলায় বললাম,

-চ্ চাইনা ওটা পরতে।

উনি আরো ফুসে উঠে বললেন,

-হাউ ডেয়ার ইউ?শুদ্ধকে দেখাচ্ছিস?কি চাস তুই আর কি চাস না?ওয়েল!আজ আমিও দেখাবো তোকে,কি চাই,আর কি চাই না!

ভরকে গেলাম আমি।একপলক তার দিকে তাকালাম।বাকা হেসে মুখ এগোচ্ছেন আমার দিকে।ঠোট কামড়ে ধরে,পা উচু করে,দেওয়ালে গাল ঠেকিয়ে আরো মিশে যেতে লাগলাম দেওয়ালে।গায়ের জোর কোনোদিনই কাজে লাগলো না ভেবে তীব্র রাগ হলো নিজের উপর।কিছুটা সময় পর সেই সম্বোধন।বউ!

-এতো অভিমান কেনো তোর বউ?

আবারো!আবারো একইকথা বললেন উনি।আমি কেনো শুনবো তা?শুনবো না।শুনতে চাইই না।ওনারও তো বলার কথা না।কেনো বলছেন উনি তবে?আমাকে আঘাত করতে?কিন্তু আমি তো আর নিজেকে ছোট করতে পারবো না।কোনোভাবেই না।

-ক্ কোনো বউ টউ নই আমি আপনার!আপনি তো….

শুদ্ধ ভাইয়া দেয়ালে আটকানো দুহাত পিছনে নিয়ে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলেন আমাকে।একহাতে ঘাড়ের সবগুলো চুল মুঠো করে চেচিয়ে বললেন,

-এনাফ অফ ইউর ননসেন্স!যেটা করলি আর যেটা বললি,কোনোটাই ঠিক করলি না তুই সিয়া।এবার শুদ্ধর অন্যরুপ দেখবি তুই।গুনে গুনে সবটার জন্য শাস্তি দেবো তোকে আমি।আর যা বললি,তার সত্যতা সময় বলে দেবে।টাইম উইল সে!জাস্ট ওয়েট,এন্ড ওয়াচ!

ঝাড়া মেরে আমাকে ছেড়ে দিয়ে দুরে দাড়ালেন উনি।দুহাতে মুখ চেপে ধরে হুহু করে কাদতে লাগলাম।কিছুই কানে যায়নি আমার।শুধু এটুকো বুঝেছি উনি কষ্ট দিয়েছেন আমাকে,বরাবরের মতো আজও ধমকেছেন আমাকে,নিজেই যেটাকে ভোলার চেষ্টারত,সেই অতীত দিয়ে আঘাত করেছেন আমাকে।ছুটে চলে আসতেই উনি হাত আটকে দিলেন আমার।কিছুটা কাছে টেনে দুগাল ধরে অস্থিরভাবে বললেন,

-কাদিস না সিয়া!প্লিজ কাদিস না!কোথায় লেগেছে তোর?বলনা!এই গলায়?হাতে?গালে?কোথায় লেগেছে তোর সিয়া?বলনা সিয়া!বলনা!

-ইনসু!

সেজোমার গলা শুনে দু পা পিছিয়ে দাড়ালাম।তাড়াতাড়ি চোখমুখ হাতের পিঠে মুছে একনজর জলভরা চোখে দুজনের দিকেই তাকিয়ে দৌড়ে রুমে চলে আসলাম আমি।রুমে দু তিনটা বাচ্চা ড্রেসিংটেবিলের কাছে বসে এটা ওটা ধরছে মনে হলো।ওয়াশরুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিলাম।কান্না পাচ্ছে।প্রচন্ড কান্না পাচ্ছে।
একটুপরই নক পরলো দরজায়।চোখ মুছে চেহারায় পানি ছিটিয়ে দরজা খুললাম।সেজোমা!বেরিয়ে জোরপুর্বক হাসি টেনে বললাম,

-ত্ তুমি সেজোমা?ক্ কিছু লাগবে তোমার?

সে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে মলি খালাকে ডাক লাগালো।খালা আসতেই বললো,

-মলি?বাচ্চাগুলোকে একটু কিছু খাইয়ে দে।ঘুমিয়ে যাবে ওরা।ওদের আম্মু ব্যস্ত।

মলি খালা মাথা নেড়ে সবগুলোকে নিয়ে চলে গেলো।নজর চুরি করে এদিক ওদিক তাকিয়ে কিছুক্ষন আগের ঘটনা ভোলার চেষ্টায় আছি আমি।সেজোমা বললো,

-তুই আগের মতো আমাকে আর ভালোবাসিস না,তাইনা ইনসু?

-এসব কি বলছো তুমি?

-ঠিকই তো বলছি।সেজোমা খুব বাজে তাইনা রে মা?এজন্য ভালোবাসাটা কমে গেছে তাইনা?

-তা কেনো সেজোমা?যাদের ভালোবাসা যায়,তাদের প্রতি ভালোবাসা কখনোই কম পরে না।

-বলছিস?

-সত্যিই তাই।

-আয়।এদিকে আয়।আমার কোলে মাথা রাখ।আমি বিলি কেটে দিচ্ছি।

একটু হেসে তাই করলাম।সেজোমার হুইলচেয়ারটা জানালার দিকে এগিয়ে মেঝেতে বসে মাথা রাখলাম তার কোলে।সে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললো,

-জানিস তো!আগে যখন তুই ছোট ছিলি,দুষ্টু ছিলিস তো,তোর আম্মু খুব মার লাগাতো তোকে।আর আমি থাকলে তোকে নিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে থাকতাম বলে তোর আম্মু আমার আসাকে পছন্দ করতো না।তোর দাদুভাই,দীদুন,যীনাত আপুর মতো আমিও নাকি আদরে আদরে বিগড়িয়ে ফেলেছি তোকে!

…..

-মনে আছে তোর ইনসু?তাপসীর বিয়ের আগেরদিন তোরা ছাদে রঙ খেলেছিলি বলে তোর আম্মু তোকে মারতে গিয়েছিলো,আমিই কিন্তু সেদিন তোকে নিয়ে রুমে দরজা লক করে ছিলাম।বলেছিলাম এখন উঠতে পারবো না।তোর আম্মু তো বুঝেই গিয়েছিলো,আমি তোকে নিয়েই আছি।কি রাগ তার!বাপরে!

…..

-তোর এব্রোডে পড়ার ইচ্ছাটা এখনো আছে ইনসু?

এতোক্ষনে মাথা তুলে তাকালাম আমি।বললাম,

-হঠাৎ এ কথা সেজোমা?

-এমনি।জানতে ইচ্ছে করলো।

-যেটা ইচ্ছে,সেটা হয়তো অন্যকিছুর প্রক্সিতে ভোলা যায় সেজোমা।কিন্তু যেটা স্বপ্ন,সেটাকে ভোলা যায় না।আমার এই স্বপ্নটাকে ভুলিনি আমি সেজোমা।ভুলিনি।তুমি দেখো,আমি পারবো ইনশাল্লাহ!

-হুম।তা তো তুমি পারবেই।ইনসিয়া সারাহ্!শেরনি অফ শেহনাজ মন্জিল বলে কথা!

মৃদ্যু হেসে আবারো কোলে মাথা রাখলাম তার।কিছুটা চুপ থেকে সেজোমা বললো,

-জানিস ইনসু?আমার এইরকম প্যারালাইজড্ হওয়ার জন্য শুদ্ধ বরাবরই নিজেকে দায়ী করে।পেটে থাকতে ওর পজিশনটা বেশ অনেকটাই ক্রিটিক্যাল ছিলো।তাই সিজারিয়ান অপারেশন করাতে হয়েছিলো আমার।বেশ তাড়াহুড়োর মধ্যেই।কিন্তু অপারেশন হয়ে যাওয়ার পরও পা দুটো নাড়াতে পারছিলাম না আমি।সবাই বলে এটা ডাক্তারদেরই অবহেলার জন্য ছিলো,আমি বলি দূর্ভাগ্যবশত,আর শুদ্ধ বলে শুধুমাত্র ওর কারনেই নাকি আজও হইলচেয়ার আমার সঙ্গী।

…..

-এতোটুকো দুরে থাকতে পারে না আমাকে ছেড়ে।একটা রাতও কোনোদিন বাসা ছেড়ে অন্য কোথাও থাকেনি।আমিও না।বাসায় আসলেই,আম্মু কোথায় তুমি?খেয়েছো তুমি?আব্বু,ওষুধ দাওনি আম্মুকে এখনো?

বলতে বলতেই হেসে দিলো সেজোমা।কাদেছেও সাথে।আমি শুধু চুপচাপ শুনছি।

-ছেলেটা খুব মিশুক জানিসতো।আমার ছেলে বলে বলছি না।ও আপন পর,চেনা অচেনা,ধনী গরীব সবাইকে এতোটা ভালোবাসে যে আমার হিংসে হয়,আমাকে এতোটা ভালোবাসে তো?পরপরই মনে হয়,আমার ছেলে ও!পাগলের মতো ভালোবাসে আমাকে।

……

-একটাই বাজে স্বভাব।রেগে গেলে হুশ থাকেনা ওর।উলোটপালোট করে দেয় সবটা।ওহ!আরেকটা আছে,কোনো কথা লুকোলে যদি তা কোনোভাবে পরে জানতে পারে,তখন ওর রাগ হয় গগনচুম্বী।বলদাতে পারিনি দুটোর কোনোটাই এই পঁচিশ বছরেও।

-সেজোমা,এসব আমাকে….

-যদি রেগে গিয়ে রাগ দেখাতে আসে,একদম ভয় পাবি না।চোখে চোখ রেখে কথা বলবি।দেখবি,এতোটুকো রাগ দেখাতে পারবে না ও।ও আসলে যারা ভয় পায়,তাদেরই আরো বেশি বেশি ভয় দেখায়।তুই ভয় পাবি,তো তোকে ভয় দেখিয়েই জড়োসড়ো করে দেবে একদম!

-সেজোমা,তুমি এসব….

-এই মেয়ে!চল চল!বউ নিয়ে এসে গেছে তো!পরে আরাম করবি।চল বাইরে!যীনাতকে ছাড়েনি সীমা।আমিই আসলাম ডাকতে তাই নবাবজাদীকে।চল!

দরজায় দাড়ানো তাপসী আপুর দিকে তাকিয়ে আবারো সেজোমার দিকে তাকালাম।সে ইশারায় বুঝালো ওর সাথেই যেতে।উঠে দাড়িয়ে একটু ঠিকঠাক হয়ে বেরিয়ে এলাম রুম থেকে।

#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here