#তোমার_তুমিতেই_আমার_প্রাপ্তি
লেখক-এ রহমান
পর্ব ৫
ইভানের কাজিন সুমি তার মেয়ে সৃষ্টি আর তার জামাই আমান বেড়াতে এসেছে তাদের বাড়িতে। ঈশার সাথে সবার খুব ভাব। তার ছোট মেয়ে সৃষ্টি ঈশাকে চোখে হারায়। ঈশাও তাকে খুব ভালোবাসে। সবাই মিলে বসে আড্ডা দিচ্ছে। খুনসুটিতে মেতে আছেন তারা। ইভানের মা আফসানা রহমান একটু দূর থেকেই ডাকলেন
–ঈশা!
ঈশা তার দিকে তাকিয়ে বলল
–জি মামনি।
–আমি তোর মায়ের সাথে একটু বাইরে যাচ্ছি। বিকেলের নাস্তা আর চা বানানোর দায়িত্ব কিন্তু তোর উপরে থাকল।
ইভানের মায়ের সাথে ঈশার সম্পর্ক বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ। তার মেয়ে নেই বলে তিনি ঈশাকে সেই ছোট থেকেই অনেক পছন্দ করেন। ঈশা একটু হেসে বলল
–তুমি একদম ভেবনা। আমি সবটা সামলে নিবো।
ইভানের মা নিশ্চিন্ত মনে ঈশার উপরে সব দায়িত্ব দিয়ে বের হয়ে চলে গেলেন। কিছুক্ষন কথা বলার পর ঈশা বলল
–বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। মুড়ি মাখা চায়ের সাথে ভীষণ জমবে। কি বল?
সবাই তার কথায় সায় দিতেই সে উঠে চলে গেলো রান্না ঘরে। ঈশার খুব একটা রান্না ঘরে আসা হয়না। আসলে সময় হয়না। কিন্তু মায়ের কাছ থেকে রান্নাটা ভালই রপ্ত করেছে। পেয়াজ কাটতে শুরু করলো সে। নাক টেনে টেনে পেয়াজ কাটছে। এমন সময় ইফতি এসে পিছন থেকে বলল
–মাই ডিয়ার ভাবি। তুমি তো আবার ঝাল বেশী খাও। এটা একদম করবে না। আমি নাদান একটা বাচ্চা। ঝাল খেতে পারিনা। অসুস্থ হয়ে পড়ি।
ইফতির কথা শুনে ঈশা পিছনে তাকায়। ঈশার চোখে পানি দেখে ইফতি এগিয়ে গিয়ে বলে
–কি হয়েছে? তুই কাদছিস কেন? বুঝেছি তোকে কাজ করতে বলেছে বলে কাদছিস তাই না। প্লিজ কাদিস না। আনটি আঙ্কেল জানতে পারলে ভাববে বিয়ের আগেই আমার মেয়েটাকে এভাবে অত্যাচার করছে। বিয়ে হলে না জানি কি করবে?
ঈশা ছুরিটা ইফতির দিকে তাক করে বলল
–গাধা একটা। আর একটা কথাও বলেছিস তো একদম মেরে দিবো। দেখছিস না পেয়াজ কাটছি।
–ওহ! আমি তো ভাবলাম কি না কি হয়ে গেলো এখন কেস খেতে হবে।
ঈশা বিরক্ত হল। রাগি চোখে তাকিয়ে বলল
–তুই এখান থেকে যা তো। বিরক্ত করিস না।
–এই যে ঝাল বেশী খাস তাই কথার মাঝে সব সময় ঝাঁঝ থাকে। আমার মতো মিষ্টি খাবি বুঝলি। তাহলেই কথা মিষ্টি হবে।
ঈশা ছুরিটা একটু এগিয়ে এনে বলল
–তুই যাবি?
ইফতি সরে গিয়ে বলল
–যাচ্ছি যাচ্ছি।
বলেই বাইরের দিকে পা বাড়াতে বাড়াতে বিড়বিড় করে বলল
–ইয়া খোদা কি দজ্জাল ভাবি কপালে দিলা।
ঈশার কানে কথাটা আসতেই আবার রাগি চোখে তাকাল। ঈশা শুনতে পেয়েছে বুঝেই ইফতি দাত কেলিয়ে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেলো। ঈশা আবার নিজের কাজে মনোযোগ দিলো। বেশ কিছুক্ষন পর মনে হল কেউ তাকে মনোযোগ দিয়ে দেখছে। ভ্রু কুচকে তাকাতেই দেখল ইভান দেয়ালে হেলানি দিয়ে তাকে মনোযোগ দিয়ে দেখছে। ঈশা তার দিকে ফিরে তাকাতেই মুখে প্রশস্ত হাসি টেনে বলল
–আমার উপস্থিতি বুঝতে পারিস দেখছি। তার মানে আমার অস্তিত্ব অনুভব করা শিখে গেছিস। মেনে নে তোর জিবনে আমি অভ্যাসে পরিণত হচ্ছি।
ইভানের কথা শুনে ঈশা কোন কথা বলল না। নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে গেলো। ইভান ধির পায়ে এসে ঈশার পিছনে দাড়িয়ে দুই পাশে হাত রাখল। ঈশার খুব অসস্তি হচ্ছে। ইভান চোখ বন্ধ করে ঈশার চুলের ঘ্রাণ নিয়ে বলল
–তোর চুলের এই মাতাল করা ঘ্রাণে আমার মাথা ঝিম ঝিম করে।
ঈশা চোখ বন্ধ করে একটা শ্বাস ছেড়ে ঘুরতেই ইভানের অনেকটা কাছে চলে এলো। ইভান ঘাবড়ে গেলো। একটু সরে দাড়াতেই ঈশা হাতে থাকা ছুরিটা তাক করে বলল
–আমি বিরক্ত হচ্ছি তোমার উপরে। বেশী বিরক্ত করলে এই ছুরিটা গলায় বসিয়ে দেব।
ইভান নিশব্দে হাসল। ঈশার একটু কাছে চলে এলো। খুব স্বাভাবিক ভাবেই বলল
–মেরে ফেল। সেটাই ভালো। আমার এই ভালবাসার অধিকার নামক যন্ত্রণা থেকে তোকে মুক্তি দিতে পারব। তোকে এই যন্ত্রণাময় জীবন উপহার দেয়ার চেয়ে তোর হাতে মরতেই বেশী পছন্দ করবো আমি।
ঈশা ছুরিটা মুহূর্তেই সরিয়ে নিলো। ইভান পাশের দেয়ালে হেলানি দিয়ে গুন গুন করে গান গাইছে
–বেঁচে থেকে লাভ কি বল তোকে ছাড়া আর!
সুপ্ত রাগটা আচমকাই চাড়া দিয়ে উঠলো ঈশার। চোখ মুখ রাগে লাল হয়ে গেলো। ইভান সেটা বুঝতে পেরে মহনীয় কণ্ঠে বলল
–তোর এই রক্তিম চেহারা আমাকে দূরে ঠেলে দেয়ার থেকে আরও কাছে টানে। এতটা কাছে মাঝে মাঝে নিজেকে হারিয়ে ফেলি আমি।
এবার ঈশা আর ঠিক থাকতে পারল না। উলটা দিকে ঘুরে দাঁড়ালো। চোখ বন্ধ করে বড় বড় শ্বাস ফেলছে।
–মামনি!
সৃষ্টির ডাক শুনে নিজেকে শান্ত করে ঘুরে দাঁড়ালো। ইভান ততক্ষনে সৃষ্টিকে কোলে নিয়েছে। ঈশা হাসি মুখে বলল
–জি মামনি?
সৃষ্টি ইভান কে ইশারা করে দেখাল ঈশার কাছে নিয়ে যেতে। ইভান তাকে কোলে নিয়ে ঈশার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। সৃষ্টি ইভানের কোল থেকেই ঈশার গলা জড়িয়ে ধরল। এতে ইভান আর ঈশা অনেকটা কাছাকাছি চলে এসেছে। ইভান ঈশার দিকে তাকাল। ঈশা চোখ নামিয়ে নিয়েছে। তার অসস্তি হচ্ছে। ইভান ঈশাকে বলল
–কোলে নে।
ঈশা ছুরিটা রেখে সৃষ্টি কে কোলে নিলো। ইভান ছুরি তুলে নিয়ে পেয়াজ কাটতে লাগলো। ঈশা শান্ত ভাবে বলল
–তুমি পারবে?
ইভান ঈশার দিকে না তাকিয়েই বলল
–আমি অতোটাও অযোগ্য নয় যতটা তুই ভাবিস।
ঈশা কোন কথা বলল না। সৃষ্টি আর ঈশা মনোযোগ দিয়ে ইভানের কাজ করা দেখছে।
–বাহ! ডাক্তাররাও এতো রোম্যান্টিক হয় সেটা নিজের চোখে না দেখলে জানতেই পারতাম না।
আমান দরজায় দাড়িয়ে বলল। ইভান আর ঈশা দুজনেই ঘুরে তাকাল। ইভান একটু হেসে বলল
–কেন দুলাভাই ডাক্তারদের কি ফিলিংস নেই?
–তা কেন থাকবে না শালা বাবু। কিন্তু আমি এতদিন ভাবতাম যে ডাক্তার রা অনেক স্ট্রিক্ট হয়। তাদের বিয়ে হলেও রোমান্স টা সাধারন পাব্লিকের মতো হয়না।
ইভান ঘুরে দাড়িয়ে পিছনে হেলানি দিলো। মুচকি হেসে বলল
–এই ধারনা টা এখন বদলে ফেলেন। ভালবাসার মানুষ আশে পাশে থাকলে রোমান্স এমনিতেই চলে আসে। পেশা জায়গা এসব কিছুই ম্যাটার করেনা।
–বাহ শালাবাবু! তুমি তো প্রেম বিশেষজ্ঞ।
আমানের কথা শুনে ইভান হাসল। আড় চোখে ঈশার দিকে একবার তাকিয়ে বলল
–সেটা হলে তো কথাই ছিলোনা। নিজের মতো ট্রিটমেন্ট করে অসুখ সারিয়ে ফেলতে পারতাম। কিন্তু সেটা এখনো হয়ে উঠতে পারিনি। এটাই ব্যর্থতা।
আমান হাসল। ঈশার দিকে তাকিয়ে বলল
–হবু বউকে নিয়ে রোমান্স করছ আবার বলছ এখনো হয়ে উঠতে পারনি। বিশ্বাস হলনা শালাবাবু।
আমানের কথায় ইভান ম্লান হাসল। আমান মুচকি হেসে
–ক্যারি অন!
বলেই চলে গেলো। ইভান ঈশার দিকে তাকাতেই সৃষ্টি ঈশার গালে চুমু দিলো। ঈশাও একটু হেসে সৃষ্টির গালে চুমু দিলো। ইভান দেরি না করে ঈশা সৃষ্টির গালে যেখানটায় ঠোট ছোঁয়াল সেও ঠিক সেখানটায় ঠোট ছুয়ে দিলো। ঈশা বোকা বোকা চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। ইভান হেসে হাত বাড়াতেই সৃষ্টি তার কোলে চলে এলো। ইভান তাকে কোলে নিয়ে রান্না ঘর থেকে বের হতে হতে ঈশাকে উদ্দেশ্য করে বলল
–তাড়াতাড়ি আয়।
ঈশা নিজের কাজে মন দিলো। এই বাড়ির রান্না ঘরে কোথায় কি থাকে সব ঈশার জানা। কারন প্রায় সময়ই সে এই রান্না ঘরে এসে ইভানের মায়ের সাথে রান্নায় সাহায্য করতো। তাই চুলায় চা বসিয়ে দিয়ে বাকি কাজ শেষ করে ফেলল। খুব জত্ন করে মুড়ি মাখাল। মুড়ি মাখিয়ে পাশে রাখল। চা ততক্ষনে হয়ে গেছে। কাপে ঢালতে শুরু করতেই ইফতি এসে বলল
–মাই ডিয়ার ভাবি আর কতদুর?
ঈশা ঘুরে কঠিন গলায় বলল
–হয়ে গেছে।
বলেই আবার কাপে চা ঢেলে সেগুলো ট্রেতে রেখে দিলো। ইফতি মুড়ির বাটিটা নিয়ে এক আজলা মুখে দিয়ে বলল
–বাহ! বেশ মজা তো।
বলেই বাটি হাতে বের হয়ে এলো। সেই সময় ওর ফোন বেজে উঠলো। ফোনে কথা বলতে বলতে মুড়ির বাটি নিয়ে যাচ্ছে সে। ঈশা চা নিয়ে তার আগেই চলে এলো। ইভান সামনের সোফায় বালিশে ভর দিয়ে আধ শোয়া হয়ে আছে। ঈশা নিচে হাঁটু মুড়ে বসে টেবিলে চায়ের ট্রেটা রাখল। ঠিক সেই সময় ইফতি ফোনে কথা বলতে বলতে আনমনে হাঁটছিল। টেবিলের সাথে পা লেগে পড়ে যেতে গেলে সে টেবিল ধরে নিজেকে সামলে নেয়। কিন্তু মুড়ির বাটিটা পড়ে গিয়ে সম্পূর্ণ মুড়ি ঈশার গায়ে পড়ে যায়। কিছুক্ষনের জন্য সবাই থমকে যায়। কিন্তু কিছুক্ষন পরেই অট্ট হাসির আওয়াজ কানে আসতেই ঈশা চোখ ঘুরিয়ে সবার দিকে তাকায়। সবাই হাসছে। ইভান ঠোট টিপে হাসছে। ঈশা রেগে ইফতির দিকে ঘুরতেই সে ভয়ে ভয়ে দাত কেলিয়ে বলে
–সরি!
ঈশা রাগে ফুসছে। মনে হচ্ছে ইফতিকে এখনি তার অগ্নি দৃষ্টি দিয়ে জালিয়ে দিবে। ইফতি ভয়ে ঢোক গিলে সামনে থেকে চায়ের কাপটা সাবধানে তুলে নিয়ে বলে
–ফোন এসেছে।
বলেই উঠে চলে যায়। সুমি আর আমান হাসি থামিয়ে ঈশার দিকে এখন তাকিয়ে আছে। ঈশার অবস্থা দেখার মতো। পেয়াজ কাঁচা মরিচ টমেটো সব তার গায়ে মাথায়। সুমি উঠে দাড়িয়ে বলল
–আমি তোমাকে হেল্প করছি ঈশা।
ইভান তাকে থামিয়ে দিয়ে ঈশার সামনে এসে হাঁটুতে ভর দিয়ে বসলো। শান্ত সরে বলল
–এটা আমার সাবজেক্ট। আমাকেই দেখতে দাও আপু।
আমান সৃষ্টিকে কোলে নিয়ে সুমিকে বলল
–শালা বাবুকে তার সাবজেক্ট ভালো করে পড়তে দাও। নাহলে ফেল করতে পারে। তখন আবার…
সে তার কথা শেষ করলো না। সুমি হেসে উঠে গেল আমানের সাথে। ইভান ঈশার কোলে পড়ে থাকা কয়েকটা মুড়ি তুলে মুখে দিয়ে বলল
–একদম অন্য রকম টেস্ট! তোর শরীরের মিষ্টি ঘ্রাণটা টেস্ট টা একদম বদলে দিয়েছে।
ঈশা বিরক্তিকর চাহুনি নিয়ে তার দিকে তাকাল। এক রাশ বিরক্ত নিয়ে বলল
–তোমার এমন আচরনে আমি বিরক্ত হই। বোঝনা?
ইভান ঈশার চুল থেকে সব কিছু ঝেড়ে ফেলতে ফেলতে বলল
–বুঝি। আর এই জন্যই তোকে বিরক্ত করি। তুই যখন সবটা জানতে পারবি তখন আমার এই বিরক্তই তোর বাঁচার অবলম্বন হবে।
বলেই ইভান উঠে গেলো। ঈশা বসে ইভানের কথা ভাবতে লাগলো। কি জানার বাকি এখনো তার? বরাবরের মতো আজও ইভানের কথা সে বুঝতে পারল না।
চলবে………