তোমার_তুমিতেই_আমার_প্রাপ্তি লেখক-এ রহমান পর্ব ৪

0
1237

তোমার_তুমিতেই_আমার_প্রাপ্তি
লেখক-এ রহমান
পর্ব ৪

সোফায় বসে ঈশার বাবা আশরাফ আহমেদ টিভি দেখছিলেন। ঈশা এসে বাবার পাশে বসে পড়লো। তিনি ঈশাকে দেখে একটু হাসলেন। ঈশা কোনদিকে খেয়াল না করে টিভি দেখায় ব্যস্ত হয়ে পড়লো। তিনি টিভিতে নিউজ দেখছিলেন। ঈশা অন্য কিছু দেখবে ভেবে রিমোট তার দিকে এগিয়ে দিলেন। কিন্তু ঈশার কোন হেলদোল না দেখে ভ্রু কুচকে তার দিকে তাকালেন। ভালো করে মেয়েকে দেখছেন তিনি। টিভির দিকে চোখ থাকলেও মেয়ের মন যে অন্য কোথাও সেটা বুঝতে আশরাফ আহমেদের অসুবিধা হল না। তিনি বুঝতে চেষ্টা করছেন মেয়ের মনে কি চলছে। কিন্তু কোন ভাবেই সেটা বোঝার উপায় নেই। মেয়েটা তার ছোট বেলা থেকেই এমন। নিজের মনের কথা কাউকে জানতে দেয়না। কারও সাথে কিছুই শেয়ার করেনা। বাবা মা যা বলে সব মেনে নেয়। কিন্তু নিজের জিবনের এতো বড় সিদ্ধান্ত নিয়ে সে কিছুই আগে থেকে জানাবে না সেটা আশরাফ আহমেদের মোটেই ভালো লাগেনি। যখন নিরবের সাথে তার বিয়ের কথা চলছিল তখনই তার মেয়ে তাকে বলতে পারত যে সে ইভান কে ভালোবাসে। তাহলেই তো তিনি আর সেই ছেলের সাথে বিয়ের কথা বলতেন না। মেয়ের কথাটাই মেনে নিতেন। ইভানের মতো অমন একটা ছেলেকে জামাই হিসেবে মেনে না নেয়ার তো কিছুই নেই। ইভান নিঃসন্দেহে খুব ভালো ছেলে। আর তিনিও যদি কোন ভাবে বুঝতে পারতেন যে ছেলে মেয়ে দুইটা দুজনকে ভালোবাসে তাহলে নিজে থেকেই বন্ধুর সাথে কথা বলে বিয়ে ঠিক করতেন। যাই হোক যা হবার হয়ে গেছে। ভালই হয়েছে। তবে তার মেয়ে তাকে আগে থেকে কিছু বলেনি সেটা নিয়েই তার আফসোসের শেষ নেই। কিন্তু একটা বিষয় তার চোখে লাগছে বেশ। মেয়েটা সেদিনের পর থেকে একদম চুপচাপ হয়ে গেছে। আগে সারা বাড়ি মাতিয়ে রাখত। সবার সাথে হাসাহাসি করতো। কিন্তু এখন সেসব চোখেই পড়েনা। একা একা ঘরের মাঝে থাকে। কারণটা মেয়ে নিজে থেকে কখনই বলবে না। তিনি টিভির চ্যানেল বদলে দিলেন। সেদিকেও মেয়ের কোন খেয়াল নেই। এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে সেদিকে। আশরাফ আহমেদ গলা পরিস্কার করলেন মেয়ের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য। কিন্তু এতেও মেয়েটার কোন হেলদোল প্রকাশ পেলো না। তিনি আর অপেক্ষা করতে পারলেন না। মেয়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন
–ঈশা মা!

গভির ভাবনায় ডুবে থাকার পর হঠাৎ আওয়াজ কানে আসলে মানুষ যেমন চমকায় তেমন চমকাল সে। আশারফ সাহেব মেয়ের এই চমকানিতে মোটেই অবাক হলেন না। কারন তিনি জানতেন তার মেয়ে গভির ভাবনায় ডুবে আছে। ঈশা বাবার দিকে তাকিয়ে বেশ কিছুক্ষন পর বলল
–জি আব্বু।

তিনি একটু ভেবে বললেন
–তোমার কি কোন সমস্যা হয়েছে মামনি?

ঈশা বাবার দিকে অবাক হয়ে তাকাল। এমন প্রশ্ন করার কারন বুঝতে পারল না। কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলো
–কেন আব্বু? আমার কিছু হয়নি তো।

তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। চোখ ঘুরিয়ে টিভির দিকে তাকিয়ে বললেন
–বলতে না চাইলে আমি জোর করবো না। তোমার ইচ্ছা।

ঈশা তার বাবার দিকে তাকাল। চোখ ছল ছল করে উঠলো। বলতে তো চায় অনেক কিছুই। কিন্তু কোথা থেকে শুরু করবে। তার মধ্যে যে এক রাশ অপরাধ বোধ। ছল ছল চোখের দৃষ্টি নামিয়ে বলল
–আব্বু তুমি কি আমার উপরে রাগ করে আছো?

আশরাফ সাহেব মেয়ের কথা বুঝতে পারলেন। কারণটাও তার বোধগম্য হল। তিনি হালকা হেসে বললেন
–তুমি ইভান কে পছন্দ করো সেটা নিয়ে আমার কোন আপত্তি নেই। তবে আফসোস আছে। তুমি আমাকে আগে কেন বলনি? আমার কি জানার অধিকার নেই আমার মেয়ে তার জীবন সঙ্গি হিসেবে কাকে চায়।

তিনি মেয়ের দিকে তাকালেন। রহস্যময় হাসি দিয়ে একটু ধিরেই বললেন
–জানো তো ইভান কে আমারও পছন্দ। তোমরা কখনও এসব নিয়ে কথা বলনি তাই আমিও আর এই বিষয়ে কথা বলিনি। যদি বুঝতে পারতাম তাহলে অনেক আগেই আমি তোমাদের এঙ্গেজ করিয়ে রাখতাম। ছেলেটা খুব ভালো। অমন একটা ছেলেই হয়না।

কথা গুলো ঠোট কামড়ে ধরে ঈশা শুনছিল। চোখের পানি উছলে যাওয়ার উপক্রম। কিন্তু সে বাবার সামনে কাঁদতে চায়না। তাই ধরা গলায় বলল
–আমার কাল পরিক্ষা আছে আব্বু আমি যাই।

তিনি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিতেই উঠে চলে গেলো। মেয়ের যাওয়া দেখে তিনি একটু হাসলেন। মেয়েটা হয়ত তার মনে এই কারনে অপরাধ বোধ পুষে রেখেছিলো। তাই এতো আড়ষ্ট সে। ঈশা প্রায় এক রকম দৌড়ে ঘরে এসে দরজা লাগিয়ে দিলো। মেঝেতে বসে পড়লো। মুখে হাত দিয়ে কান্না আটকাবার চেষ্টায় ব্যস্ত সে। তবুও পারছে না। চোখের পানি যেন আজ কোন বাধাই মানবে না। অবিরত তারা ঝরেই পড়েছে। সবাই ইভান কে পছন্দ করে। সবাই তাকে সোনার মতো ছেলে বলেই জানে। কিন্তু আসলেই তো সেরকম নয়। ঈশা যে তাকে কোন ভাবেই পছন্দ করেনা। ভালবাসা তো দুরের কথা। ওই মানুষটাকে সে নিজের জিবনের সব থেকে বড় শত্রু মনে করে। সে আশে পাশে থাকলে পরিবেশটা ঈশার কাছে বিষাক্ত মনে হয়। কোন ভাবেই সে মানতে পারেনা।

—————–
নিজের কেবিনের চেয়ারে হেলানি দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে আছে ইভান। দরজায় নক করার শব্দ হতেই সে চোখ খুলে বলল
–কাম ইন।

কারও রুমে ঢোকার আওয়াজ শুনে সেদিকে তাকাল। মেঘলা কে ভিতরে ঢুকতে দেখে জোর করে হাসার চেষ্টা করে বলল
–আরে মেঘলা তুমি এখানে?

মেঘলা হাস্যজ্জল চেহারা নিয়ে ভিতরে ঢুকে বসে পড়লো চেয়ারে। হাসি মুখে বলল
–তুমি কি ব্যস্ত?

ইভান মাথা নেড়ে না বলল। মেঘলা সামনে বোতল থেকে পানি খেয়ে বলল
–ভাবলাম তোমার সাথে একটু কথা বলে যাই। আচ্ছা আঙ্কেল কবে আসবে?

–আব্বু আসতে দুইদিন সময় লাগবে।

মেঘলা চিন্তিত হয়ে বলল
–ইভান কালকে কলকাতা থেকে মেডিকেল টিম আসছে। আঙ্কেল থাকলে ভালো হতো।

তার কথা শুনে ইভান চিন্তিত হয়ে পড়লো। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল
–তারা আসার আগে আমাদের কিছু প্রস্তুতি নিতে হবে।

মেঘলা হেসে বলল
–তুমি ভেবনা। সব প্রস্তুতি শেষ। শুধু তুমি একবার দেখে নিলেই হবে সব ঠিক আছে কিনা।

ইভান কোন কথা বলল না। ইভান কে আজ অন্য রকম লাগছে। মেঘলা ইভানের দিকে তাকিয়ে চিন্তিত হয়ে বলল
–ইভান তোমার কি শরীর খারাপ?

–না তো কেন?

গম্ভির গলায় বলল ইভান। মেঘলা চেয়ার থেকে উঠে এসে ইভানের কপালে হাত রাখল। কপালটা বেশ গরম। মনে হচ্ছে গায়ে জ্বর। মেঘলা বিচলিত হয়ে বলল
–ইভান তোমার তো অনেক জ্বর। মেডিসিন নিয়েছ? নাওনি তো? ঠিক বুঝেছি। তুমি কখনই নিজের খেয়াল রাখনা। ইস! জ্বর বেড়ে গেলে কি হবে বল দেখি?

মেঘলাকে এমন বিচলিত হতে দেখে ইভান বিরক্ত হল। একটু কড়া গলায় বলল
–আমি ঠিক আছি মেঘলা।

মেঘলা ইভানের শরীর থেকে নিজের হাত সরিয়ে নিলো। কিছুক্ষন থমকে দাড়িয়ে গেলো। ইভান কে এভাবে অসুস্থ হতে দেখলে সে যে নিজেকে ঠিক রাখতে পারেনা কোন ভাবেই। তারা একসাথে পড়াশুনা করেছে। খুব ভালো বন্ধু তারা। আর সেই সময় থেকেই ইভানের প্রতি মেঘলার দুর্বলতা প্রকাশ পায়। কিন্তু নিজের মনের কথা মুখ ফুটে বলার আগেই সে জানতে পারে সে সেই ছোটবেলা থেকে ঈশাকে ভালোবাসে। অসীম ভালবাসা তার। মেঘলার ঈশাকে দেখলে খুব হিংসা হয়। এই ভালোবাসাটা তার হতে পারত। কিন্তু আফসোস! ইভান তাকে সেভাবে কোনদিন দেখেই নি। মেঘলা আবারো নিজের হাত বাড়িয়ে দিতেই ঈশা দরজা খুলে ভিতরে ঢুকল। মেঘলা ইভান দুজনে সেদিকে তাকাল। ঈশা তাদেরকে ওই অবস্থায় দেখে এমন আচরন করলো যেন এসবে তার কোন কিছুই যায় আসেনা। মেঘলা একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। ইভান ঈশার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বিড়বিড় করে বলল
–এসে গেছে আমার মেডিসিন।

কথাটা ঈশার কানে না গেলেও মেঘলা ঠিকই শুনতে পেলো। বুক চিরে বেরিয়ে এলো দীর্ঘশ্বাস। ঈশার দিকে তাকিয়ে একটু ইতস্তত বোধ করে বলল
–ইভানের অনেক জ্বর এসেছে।

ইভান মেঘলার এমন কাজে বেশ বিরক্ত হয়ে গেলো। বিরক্ত হয়ে বলল
–আমি বাচ্চা না মেঘলা।

বলেই ঈশার দিকে তাকাল। ঈশা খুব শান্ত ভাবে বলল
–তোমাকে একবার রাউন্ডে যেতে হবে।

–কিন্তু ইভান এই অবস্থায় যাবে কিভাবে? ওর খুব শরীর খারাপ। তুমি বুঝতে পারছনা ঈশা?

হাত গুঁজে ঈশাকে অপমান করার জন্য ভালো করে প্রস্তুতি নিয়ে মেঘলা আবারো ভারি গলায় বলল
–ইভানের অসুস্থ হওয়ার কথা শুনে তোমার বেশী বিচলিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তোমার তো কোন অনুভুতিই দেখছিনা।

কথাটা যে তাকে অপমান করার জন্য বলা হয়েছে সেটা সে ভালো করেই বুঝতে পারল। ইভানেরও বিষয়টা বুঝতে অসুবিধা হল না। সে চাইলেই এখন অনেক কড়া ভাবে এটার জবাব দিতে পারত। আর এতদিন সেটাই করে এসেছে। কিন্তু ইভানের এমন সব কিছুতে ঈশাকে রক্ষা করায় সে নিজের অজান্তেই তার উপরে নির্ভর করতে শুরু করেছে। ইভান চায় সে নিজেই নিজের উত্তর দিক। তাই তো ইভান চুপ করে একদম শান্ত হয়ে গেলো। ঈশার বিষয়টা বোধগম্য হল না। এই কথা শোনার পর এতক্ষন ইভানের হিংস্র সিংহ এর মতো তার উপরে ঝাপিয়ে পড়ার কথা থাকলেও সেরকম কিছুই হল না। তাই কিছুটা রাগ নিয়েই ঈশা নিজের উত্তর নিজেই দিতে প্রস্তুত হয়ে গেলো।
–শুনলেই তো উনি বাচ্চা না। আর জ্বর হয়েছে এটা এমন কোন বড় কথা না মেডিসিন নিলেই ঠিক হয়ে যাবে। এতো বিচলিত হওয়ার কিছু নেই। এখন সিজনাল ফিভার হতেই পারে। আর তাছাড়াও উনি নিজেই একজন ডক্টর। তোমার থেকে নিজের ফিজিক্যাল কন্ডিশনটা ভালই বুঝে মেঘলা আপু।

ঈশার কথা শুনে মেঘলা জব্দ হলেও ইভান খুব মজা পেয়েছে। সে চায় ঈশা সবাইকে এভাবেই নিজের যোগ্য জবাব দিক। ঈশা ইভানের দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক ভাবে বলল
–আমার মনে হয় ডক্টর দের কাছে নিজেদের ফিজিক্যাল কন্ডিশন নিয়ে ভাবার চেয়ে পেশেন্ট নিয়ে আগে ভাবা উচিৎ। কাল যে পেশেন্ট এর অপারেশন হবে তাকে ইমিডিয়েটলি চেকাপ করতে হবে। যেটা শুধু এই মুহূর্তে ডক্টর ইভান কেই করতে হবে।

এই অপমান খুব বেশী গায়ে লাগায় মেঘলা সেখানে আর না দাড়িয়ে বের হয়ে চলে গেলো। যাওয়ার সময় কিছুক্ষন ঈশার দিকে তাকিয়ে থাকল। ঈশা সেদিকে তাকাল না। মেঘলা চলে যেতেই ইভানের দিকে তাকাতেই দেখল সে প্রশস্ত ঠোঁটে তার দিকে তাকিয়ে আছে। উত্তর দেয়াতে ইভান এতো খুশি হয়েছে সেটা ঈশা ভালো করেই বুঝতে পারল। কিন্তু পাত্তা দিলনা। ইভান চুইংগাম চিবুতে চিবুতে ঈশার কাছে এসে দাঁড়ালো। তার ঠোটের দিকে তাকিয়ে হালকা হেসে বলল
–অথই সমুদ্রে ডুবে যেতে ইচ্ছা করছে। গোলাপি সমুদ্রে। একবার ডুব দিলেই সব শরীর খারাপ নিমেশেই শেষ।

ঈশা তার কথা বুঝতে না পেরে ভ্রু কুচকে বলল
–কিসব বলছ?

–আমার সামনে এমন ভাবটা ধরিস যেন ভাজা মাছটা উলটে খেতে জানিস না আর এদিকে ভাজা মাছ খেয়ে কাঁটা বেছে ফেলে দিস। আমি কিছুই বুঝিনা না?

ঈশা হতাশ হয়ে বলল
–সত্যিই তোমাকে আমি বুঝতে পারিনা।

ইভানের অনেকটা কাছে আসায় ঈশা একটু পিছনে ঝুকে বিরক্তি নিয়ে বলল
–কি করছ?

–চুইংগাম খাচ্ছি। খাবি? ওহো! আমার কাছে তো একটাই ছিল। আর সেটাও আমার মুখে।

ঈশা ভ্রু কুচকে তাকাল। ইভান দুষ্টুমির সুরে বলল
–তুই চাইলে এটাই দিতে পারি। আগে কখনও এভাবে কোন মেয়েকে দেইনি। কারন কারও প্রতি এরকম ফিল আসেনি। তোর জন্য প্রথমবার ট্রাই করতে পারি। এখন থেকে অভ্যেস করলে পরে গিয়ে আর কোন সমস্যায় পড়তে হবে না। করবো?

ঈশা দুই কদম পিছিয়ে গিয়ে বলল
–কিসব উলটা পাল্টা কথা বলছ?

ইভান হাত গুঁজে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। বাকা হেসে বলল
–বুঝিস না নাকি? উলটা না সিধা বুঝলি কেমনে?

চলবে……

(আমি আপনাদের সবার কমেন্ট পড়ে রিপ্লাই দেয়ার চেষ্টা করি। আপনারা এতো কষ্ট করে কমেন্ট করেন আমি আপনাদের কাছে সত্যিই কৃতজ্ঞ। আমি কি এভাবেই গল্পটা চালিয়ে যাব? নাকি আপনাদের বিরক্ত লাগছে?)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here