#তোমার_তুমিতেই_আমার_প্রাপ্তি
লেখক-এ রহমান
পর্ব ১২
ভারি চোখের পাতা খুলতেই চোখ যেন আলোতে ঝলসে গেলো। আবার খিচে বন্ধ করে ফেলল ঈশা। অনেকটা সময় ঘুমানোর কারনে চোখ মাথা সব ভারি হয়ে আছে। জোর করে চোখ খুলতেই দেখল ইভান চেয়ারে মাথা এলিয়ে দিয়ে তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। বেশ জোরে সরে ধাক্কা খেলো। সকাল বেলা এখানে ইভান আসবে কারন কি? ইভান উঠে এসে তার পাশে বসলো। গালে হাতের পিঠ ঠেকাল। মাথার চুলগুলো উলটে দিয়ে শান্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো
–কেমন লাগছে এখন?
ঈশা কথা বুঝতে না পেরে আশে পাশে তাকাল। চারিদিকে চোখ ফেরাতেই গতকালের কথা মনে পড়ে গেলো। অতিরিক্ত জ্বরের কারনে ক্লাসে সে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল। তারপর কি হয়েছে জানে না। চারিদিকে দেখেই বুঝে গেলো সে ইভানের কেবিনে। ইভানের সুবিধা মতো তার কেবিনে বেড রাখা আছে যাতে সে রেস্ট নিতে পারে। আর সেই বেডেই ঈশা শুয়ে আছে। একটু নড়েচড়ে উঠে বসতেই ইভান উঠে দাঁড়ালো। পাশ থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে এগিয়ে দিলো তার দিকে। গ্লাসটা হাতে ধরল ঠিকই কিন্তু খাওয়ার ইচ্ছেটা হল না। মুখটা পুরো বিস্বাদ হয়ে আছে জ্বরের কারনে। এই পানিটা এখন মুখে দেয়া মাত্রই সেই স্বাদ একেবারেই বাজে হয়ে যাবে আরও। হাত ধরে কিছু বলতে যাবে কিন্তু ইভানের মুখের দিকে তাকাতেই সাহসটা দপ করে নিভে গেলো। ক্লান্ত চেহারা। সারারাত ঘুমায়নি সেটা বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু ক্লান্তির চেয়ে রাগের মাত্রাটা বেশী দৃশ্যমান! চেহারার রক্তিম আভা দেখেই আর সাহস করে উঠতে পারলো না ঈশা। পানিটা মুখে দিয়েই বিকৃত করে গিলে ফেলল। ইভান পাউরুটিতে জেলি মেখে ঈশার সামনে ধরতেই সে হাত দিয়ে সেটা ধরতে চাইল। কিন্তু ইভান তার হাতে না দিয়ে নিজে হাতে তার মুখে ধরল। ঈশা কোন কথা না বলে খেয়ে নিলো। সে বেশ বুঝতে পারছে ইভান খুব রেগে আছে। তার শরীর খারাপ জন্য কিছু বলছে না। ঈশা সুস্থ থাকলে এতক্ষনে কুরুক্ষেত্র বেধে দিত। খাওয়া শেষ হতেই ইফতি দরজা ঠেলে ঢুকল। ইভান মাথা বাকিয়ে তার দিকে তাকাতেই বলল
–তোমাকে ওইদিকে ডাকছে ভাইয়া।
ইভান উঠে দাড়িয়ে ইফতির হাতে ঔষধের স্ট্রিপটা ধরিয়ে দিলো। খুব শান্ত সরে বলল
–খাইয়ে দে।
বলেই বের হতে জেয়ে দরজা খুলে আবার ঘুরে বলল
–আমি না আসা পর্যন্ত এখানেই থাকবি।
ইফতি মাথা নেড়ে একটা চেয়ার টেনে বসে পড়ল। ইভান চলে গেলো। ঈশা যেন হাফ ছেড়ে বাচল। এমন একটা ভাব করলো যেন এতক্ষন দম চেপে ছিল। ইফতি ঔষধ হাতে ধরিয়ে দিতেই ঈশা বলল
–কি হয়েছিলো কাল?
ইফতি ভ্রু কুচকে ফেলল। তারপর তার মনে হল ঈশার তো সেন্স ছিলোনা তাই তার কিছু মনে না থাকাই স্বাভাবিক।
–তুই ক্লাসে নন্সেন্স হয়ে গিয়েছিলি।
এমনিতেই শরীর খারাপ আরও এরকম উলটা পাল্টা কথা শুনে ঈশার মাথা ঘুরতে লাগলো। ধ্মক দিয়ে বলল
–ঠিক করে কথা বল।
ইফতি ভ্রু কুচকে বলল
–তোর কি ধারনা আমি ভুল করে কথা বলছি?
ঈশা বুঝতে পারলো ইফতি একদম পুরোদমে তার ক্যারেক্টারে আছে। সে এখন এভাবেই কথা বলবে। তাই আর কথা না বাড়িয়ে শান্ত ভাবে জিজ্ঞেস করলো
–তারপর কি হয়েছে?
–তারপর ভাইয়ার কানে যাওয়া মাত্রই নায়কের মতো তোকে কোলে করে সোজা এখানে! অতিরিক্ত জ্বর, শরীর দুর্বল আর বি পি লো হওয়ার কারনে সেন্স হারিয়েছিলিস। তারপর এখানে এনে তোকে ঘুমের ইঞ্জেকশন দিয়ে পুরো ২৪ ঘণ্টা তোর জীবন থেকে গায়েব করে দিয়েছে।
–মানে?
ঈশা একটু চেচিয়ে বলল। ইফতি মুচকি হেসে বলল
–তুই উঠে গেলেই বাসায় চলে যাবি। তাই তো এমন ব্যবস্থা করেছে যাতে ২৪ ঘণ্টার জন্য তুই এভাবেই স্ট্যাচু হয়ে থাকিস। আর তোর জতক্ষন সেন্স ফিরেনি ততক্ষণ কেউ আর বাসায় নিয়ে যাওয়ার কথাও বলবে না। আর ভাইয়ার কাল নাইট শিফট ছিল। তুই বাসায় গেলেও সে তো যেতে পারত না। জানতেও পারতনা তোর কি হচ্ছে। তাই তো এতো আয়োজন।
ঈশা বড় বড় চোখে তাকাল। তার মানে তাকে ইচ্ছা করে এভাবে অসুস্থ বানিয়ে রেখেছে ইভান। সারা রাত তাকে নিজের কাছে রাখার জন্য এসব নাটক। সে ততটাও অসুস্থ না। একটা শ্বাস ছেড়ে বলল
–বাসায় সবাই জানে?
–জানে মানে? কাল সন্ধ্যায় দুই গাড়ি ভর্তি করে সবাই এসেছিল। দেখে গেছে। ভাইয়া অবশ্য কাউকে থাকতে দেয়নি। বলেছে নিজেই থাকবে। তাই আর কেউ আপত্তি করেনি। ঈশান ভাইয়া সকালে এসে একবার দেখা করে গেছে। তুই তখনও ঘুমিয়েছিলি।
ইফতির কথা শেষ হতেই ইভান ঢুকল। ইফতি উঠে বলল
–আমি আসি। ক্লাস আছে। আমি স্যারের সাথে কথা বলে নিবো। আর তোর সব নোট এনে দিচ্ছি।
ঈশা মাথা নাড়াল। ইভান এপ্রন টা এক পাশে ঝুলিয়ে রেখে চেয়ারে বসে চোখ বন্ধ করে ফেলল। সারা রাত না ঘুমানোর জন্য এখন মাথাটা ব্যাথা করছে। এই মুহূর্তে স্ট্রং কফি হলে ভালো হতো। কিছুক্ষন পর চোখ খুলতেই দেখল ঈশা কফি হাতে দাড়িয়ে আছে। একটু অবাক হল। আবার মনে মনে খুশিও হল যে ঈশা তার প্রয়োজন বুঝতে পারছে। চোখের ইশারায় কাপটা টেবিলে রাখতে বলল। ঈশা কাপটা টেবিলে রাখল। ইভান আবার মাথা চেয়ারে এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল। কিছুক্ষন পর খেয়াল করলো তার কপালে নরম আঙ্গুলের স্পর্শ। বুঝতে বাকি থাকল না এটা কার হাত। মনে মনে হাসল। কিন্তু মুখে গম্ভীর ভাব এনে চোখ খুলে বলল
–নাটক শুরু করেছিস কেন?
ঈশা ধমকে ভয় পেয়ে গেলো। ইভান বুঝতে পারলো একটু বেশী জোরেই ধমক দিয়ে ফেলেছে। তাই ঈশার হাত টেনে সামনে চেয়ারে বসাল। ঈশা চেয়ারে বসে মুখ গোমড়া করে বসে আছে। ইভানের ফোন বেজে উঠলো। ফোনটা ধরে একটু সময় কথা বলে রেখে কফির কাপ হাতে নিয়ে উঠে গেলো। এক পাশ থেকে ফাইল নিয়ে মনোযোগ দিয়ে দেখছে আর কফিতে চুমুক দিচ্ছে। ঈশা উঠে দাঁড়ালো। একটু শব্দ করতেই ইভান সেদিকে ঘুরে তাকায়। একবার দেখে আবার চোখ ফিরিয়ে নেয়। ঈশা বিরক্ত হয়ে বলল
–আমি বাসায় যাবো।
ইভান ফাইলের দিকে তাকিয়েই বলল
–আমি কাউকে বেধে রাখিনি তো।
ঈশা আবার বলল
–সত্যি সত্যি চলে যাচ্ছি।
–আমি মিথ্যা কথা শুনতে পছন্দ করিনা।
ইভানের কথায় ঈশার গায়ে যেন আগুন লেগে গেলো। ঝাঝাল কণ্ঠে বলল
–এভাবে কথা বললে কিন্তু আমার খুব মেজাজ খারাপ হয়?
ইভান এবার ঘুরে তাকাল। রেগে বলল
–তেজ কাকে দেখাচ্ছিস? আমাকে? খুব সাহস?
ঈশা দমে গেলো। গলা নামিয়ে বলল
–তেজ আবার কই দেখালাম?
ইভান আরও রেগে গেলো। একটু জোরেই বলল
–এতো তেজ কাল কই ছিল? বলেছিলাম খারাপ লাগলে আমাকে ফোন দিবি। তার তো কোন প্রয়োজন মনে করিস নি। বড় হয়েছিস। নিজের খেয়াল রাখতে শিখে গেছিস। তাই কর না। আমাকে কেন বিরক্ত করছিস? আমার অনেক কাজ থাকে। তোর এসব নখরা সহ্য করার সময় আমার নেই।
কথা শেষ হতেই সে আবার ফাইলে তাকাল। ঈশা একটু তেজি ভাবে বলল
–এতো টুকু বিষয়ে এতো রাগ করার কি আছে?
কথাটা কানে আসতেই ইভান কঠিন দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো ঈশার দিকে। সেই দৃষ্টি দেখেই ঈশা ভয় পেয়ে গলা নামিয়ে বলল
–না মানে এভাবে রাগ দেখালে আমার আরও বেশী খারাপ লাগছে। আমার মাথা ঘুরাচ্ছে। সব কিছু কেমন ঝাপসা হয়ে আসছে।
বলেই মাথায় হাত দিল ঈশা। ইভান ভ্রু কুচকাল। ফাইলটা রেখে ধির পায়ে তার সামনে এসে দাঁড়ালো। তার দিকে তাকিয়ে দুষ্টুমির সুরে বলল
–কি হচ্ছে?
ঈশা কোন কথা বলল না। ইভান তার সামনে এসে দাড়াতেই সে সম্পূর্ণ শরীরের ভর ছেড়ে দিলো। ইভানের বুকে গিয়ে পড়লো। ইভান তাকে এক হাতে জড়িয়ে সামলে নিলো। দুষ্টুমির সুরে বলল
–কি হল? জ্ঞান হারিয়ে গেলো বুঝি?
ঈশা চুপ করে থাকল। ইভান একটু হেসে আদুরে কণ্ঠে বলল
–খারাপ লাগছে?
–উহু!
–তাহলে?
–ভালো লাগছে।
–এতো কাছে আসতে ভয় করেনা?
–কিসের ভয়?
ইভান কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিস ফিস করে বলল
–যদি বাড়াবাড়ি হয়ে যায়? কোন অঘটন ঘটে যায়?
ঈশা ইভানের কথা বুঝতে পেরে মাথা তুলে পিছিয়ে গেলো অনেকটা। অস্পষ্ট সরে বলল
–অসভ্য!
এতটাই অস্পষ্ট যে ইভানের কানেও পৌঁছায়নি। ইভান একটু এগিয়ে এসে ঈশার হাত শক্ত করে ধরে বলল
–কিছুই তো করলাম না। করে দেখাই অসভ্যতামি?
ঈশা চোখ বড় বড় করে তাকাল। ইভান কিভাবে শুনতে পেলো? আমতা আমতা করে বলল
–আ…আমি ওরকম বল……।
–আমাকে মিথ্যা বলে পার পাবি? তুই না বললেও আমি শুনতে পাই আর যেটা উচ্চারণ করেছিস সেটা আমার কান পর্যন্ত আসবে না সেটা ভাবা বোকামি।
ঈশা কিছু বলল না। ইভান আবারো বলল
–তুই কতো সভ্য মেয়ে? একটু আগেই যে আমার গায়ে পড়ছিলিস।
ইভানের কথায় ঈশা অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। একটু ভেবে বলল
–সেটা তো মাথা ঘুরে গিয়েছিলো তাই। তাছাড়া আমার এসব গায়ে পড়া অভ্যেস নেই।
ইভান একটু কাছে আসল। দুষ্টুমির সুরে বলল
–তোর এসব অভ্যেস অনেক ছোটবেলার। মনে করিয়ে দিবো?
ঈশা ভ্রু কুচকাল। সরু চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো
–কি মনে করিয়ে দিবে?
ইভান হাসল। ঈশার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল
–সেই যে ছোটবেলায় একদিন ছাদে উঠে রেলিঙ্গের উপরে দাড়িয়ে ছিলিস। আর আমি নিচ থেকে তোকে বকছিলাম। বলছিলাম পড়ে যাবি। কিন্তু তুই আমাকে বলেছিলি ‘ইভান ভাইয়া আমি এখান থেকে পড়ে গেলে তোমার গায়ে পড়বো। আর তুমি আমাকে ধরবে। আমি জানি নিচে পড়তে দিবে না।’
ঈশার কথাটা মনে পড়তেই সে অবাক হয়ে গেলো। অনেক ছোটবেলার কথা। ইভানের এখনো মনে আছে। ঈশা অবাকের সুরে বলল
–তোমার মনে আছে?
ইভান হেসে বলল
–তোর সব কথা আমার মনে আছে।
দরজায় শব্দ হতেই ইভান ছেড়ে দিলো ঈশাকে। একটু দূরে দাঁড়ালো। ঈশার দিকে তাকিয়ে বলল
–কাম ইন!
একটা মেয়ে ভিতরে এসে বলল
–চেয়ারম্যান স্যার ঈশা ম্যামকে ডাকছে।
–আব্বু ডাকছে?
ইভান একটু অবাক হল। কেন ডাকছে? এর মাঝেই ঈশা বলল
–যাচ্ছি।
মেয়েটা চলে গেলো। ইভান ঈশার দিকে তাকাতেই ঈশা মিষ্টি করে হাসি দিলো। ইভান গম্ভীর গলায় বলল
–কি ভেবেছিস এসব হাসি দিয়ে আমাকে পটাবি? ইভান রহমান এতো সস্তা না।
ঈশা বিড়বিড় করে বলল
–পোটেই তো আছো।
ইভান ভ্রু কুচকে বলল
–কি বললি?
ঈশা মাথা নাড়িয়ে কিছুনা বোঝাল। ইভানের পাশ কেটে বের হতে যাবে তার আগেই ইভান হাত ধরে ফেলল। শীতল কণ্ঠে বলল
–এই দূরত্বটা আমি শেষ করতে চাই। কিন্তু যেদিন শেষ হবে সেদিন যে আমি ঝলসে যাব ওই রুপের আগুনের লেলিহান শিখায়। পারব না নিজেকে বাচাতে।
চলবে………
(আমার কোন গল্পেই এখনো স্যাড এন্ডিং দেয়া হয়নি। একটা স্যাড এন্ডিং দিলে কেমন হয়?)