তোমার সন্ধানে, পর্ব:৩

0
811

#তোমার_সন্ধানে ♥️
#ফারজানা_আফরোজ

দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে একটা গাড়ির সামনে যেতেই কেউ একজন খপ করে হাত ধরে একদম নিজের শরীরের সাথে
আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলো নিয়তিকে। নিয়তি কিছুক্ষণের জন্য একদম জমে বরপ হয়ে গেলো। শ্বাস দ্রুত চলতে লাগলো তার। বারবার চোখের সামনে তার লাশ ভেসে উঠতে লাগলো। নিজের বাচ্চামোর কারণে একটুর জন্য তার মৃত্যু হতে পারতো।

–” এই মেয়ে এই সমস্যা কী আপনার? মরতে চান? তো মরুন না, আমার গাড়ির নিচে মরে আমাকে ফাঁসাতে চাচ্ছেন কেন? যখন থেকেই দেখা হয়েছে একটা না একটা গন্ডগোল করেই যাচ্ছে। আপনার নাম তো গন্ডগোল পাকানো মেয়ে রাখা উচিৎ। ডাফার।”

–” বাচ্চা মেয়েটাকে এইভাবে বকছিস কেন শুদ্ধ? মেয়েটা এমনিতেই ভয়ে চুপসে গেছে। রাস্তা ঘাটে এখন হামেশাই অল্পস্বল্প এইসব ঘটে।”

গাড়ি থেকে সুদর্শন এক পুরুষ নেমে আসলো। গায়ে হোয়াইট শার্ট, সামনের চুলগুলো ব্রাউন কালার। ছেলেটাকে দেখা মাত্রই চিনে ফেলল মিশু এবং নিয়তি। ছেলেটির নাম অভ্র। শুদ্ধের বেস্ট ফ্রেন্ড। শুদ্ধের বুক থেকে সরে কিছুটা দূরে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে নিয়তি। লজ্জা, রাগ, ভয় সবকিছু মিলিয়ে সে এখন ভীত। অভ্র মুখে হাসির জলক ফুটিয়ে রেখে নিয়তির সামনে দাঁড়িয়ে ভদ্রভাবে বলল,

–” এইযে কুইন, রাস্তাঘাটে কেউ এইভাবে দৌঁড়াদৌঁড়ি করে? একটুর জন্য তো আমার গাড়ির নিচে পরে যেতেন। শুদ্ধ না বাঁচালে কি হতো ভেবেছেন?”

নিয়তি এখনও চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। মিশু নিয়তির কাঁধে হাত রেখে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করল। শুদ্ধ কিছু না বলেই গাড়ির দিকে হাঁটা শুরু করলো। অভ্র তখন মিশুর মুখের দিকে তাকিয়ে আবারো হাসলো, এই লোকটা যেন হাসার জন্যই পৃথিবীতে এসেছে বলে মনে হচ্ছে মিশুর, তবুও ভদ্রতার খাতিরে সেও মৃদু হাসলো।

অভ্র বলল,

–” শুদ্ধ ফোন দিয়ে বলল গাড়ি আনার জন্য। তাই তাড়াহুড়ো করে ড্রাইভ করছিলাম হঠাৎ দেখলাম একজন মেয়ে দৌঁড়াচ্ছে। বহু কষ্টে ব্রেক করতে গিয়েও পারছিলাম না ভাগ্যিস শুদ্ধ এইখানে ছিল। তা না হলে আজ আমার হাতে কারো মৃত্যু হতো। ভাবতেই বুকটা কেঁপে উঠছে। বাই দা ওয়ে, রাস্তায় দৌঁড়াদৌঁড়ি করছেন কেন দুজন? কোনো ছেলে কিছু বলেছে?”

গাড়ির পাশ থেকে দাঁড়িয়ে বিরক্তি কণ্ঠে শুদ্ধ চেঁচিয়ে বলতে লাগলো,

–” এই মেয়ের কাছে স্বয়ং যমদূত ভয় পাবে, ছেলেরা তো এর আশে পাশে থাকলে নির্ঘাত খুন হয়ে যাবে। যে সাহস, নিজেকে বাঘিনী ভাবে এই মেয়ে। তাড়াতাড়ি সরে আয় এই মেয়ের কাছ থেকে নাহলে তোকেও জুতো পেটা করবে।”

শুদ্ধের কথা শোনে ভ্রু কুঁচকে আসলো অভ্রের। কিন্তু মুখের হাসি যেন যাচ্ছেই না। অভ্র নিয়তির পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বলল,

–” কোথায় যাবেন আপনারা?”

–” বানিয়া মহিলা হোস্টেল।”

নিয়তি ধীর কণ্ঠে বলল। অভ্র চমকে উঠে আবারো বলল,

–” আপনারা হোস্টেলে থাকেন? রাত করে বের হতে দেয় হোস্টেল থেকে?”

নিয়তি তখন মিশুর মুখের দিকে তাকালো। মিশু অসহায়ের মতো মুখ করে আমতা আমতা করে বলল,

–” আমরা দুজন লুকিয়ে আসছি। আপনারা প্লিজ আমাদের হোস্টেলের সামনে পৌঁছে দেন আমরা ঠিকই রুমে যেতে পারবো।”

–” কিভাবে যাবেন?”

অভ্রের এই প্রশ্নটি পছন্দ হলো না মিশুর। হোস্টেলের সামনে নামিয়ে দিবে, এইখানে এত প্রশ্ন কিসের? প্রশ্ন ছাড়া কিছু বুঝে না নাকি? মিশুর হঠাৎ মনে পড়ল অভ্র একজন রিপোর্টার।

–” কি হলো বলছেন না কেন?”

মিশু তখন কাটকাট গলায় বলল,

–” আমাদের ইচ্ছা। ওই বিষয়ে কথা না বলে আগে বলুন আমাদের নিয়ে যাবেন কি না? না নিয়ে গেলে সমস্যা নেই আমরা হেঁটেই যেতে পারবো। ”

অভ্রের মুখ এখন কিছুটা মলিন। সে কি এমন বলল যার কারণে মেয়েটা রেগে গেছে। তবুও মনের কথা মুখে প্রকাশ না করে স্বাভাবিক কণ্ঠেই বলল,

–” চলুন।”

অভ্রের মুখের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করতে লাগলো শুদ্ধ, মোট কথা অভ্রের এই ভালো মানুষী, অবলা এই দুই নারীকে গাড়িতে উঠতে দেওয়া মোটেও পছন্দ হয়নি তার। গরম চোখের অভ্রের দিকে তাকাতেই অভ্র ফ্লাই কিস ছুঁড়ে দিলো। মুহূর্তেই হেসে দিল শুদ্ধ।

শুদ্ধ ড্রাইভ করছে, পাশের সিটে অভ্র। মিশু এবং নিয়তি পিছনে বসে আছে। নিয়তির দৃষ্টি শুদ্ধর দিকে। সে এখনও এই লোকটার বিচ্ছিরি রূপ ভুলতে পারছে না। সামান্য একটা সেলফি তোলা নিয়ে কত কটু কথা শোনালো তাকে। তার উপর এই লোকটির গাড়িতে এখন বসে আছে সে। ভাবতেই ঘৃনা হচ্ছে নিজের প্রতি। বেশ কিছুক্ষণ সবাই চুপ করে রইলো। অভ্র নিশ্চুপ নিরবতা ভেঙে দিয়ে প্রশ্ন করলো নিয়তিকে,

–” আপনার নাম কী কুইন?”

–” নিয়তি ভাইয়া।”

–” আর আপনার?”

–” মিশু।”

মিশুর নাম শোনে অভ্রের ইচ্ছা করলো একটু দুষ্টুমি করার জন্য তাই না শোনার ভান করে বলল,

–” কি শিশু?”

–” আশ্চর্য, শিশু কেন হবে? আপনি কি কানে শুনতে পান না? নাকি না শোনার ভান করছেন। যাইহোক আবারো বলছি মিশু।”

অভ্রের কাছে মনে হল এই মিশু নামের মেয়েটা অতিরিক্ত ঝাল, অর্থাৎ বোম্বে মরিচ। তাই পাশ কাটিয়ে নিয়তিকে প্রশ্ন করলো,

–” রাতে ক্লাবে কেন আসলেন? মনে হচ্ছে না আরো এসেছেন।”

নিয়তি মৃদু স্বরে বলল,

–” একজনের সাথে মিট করতে এসেছিলাম। বুঝতে পারিনি এত দেরি হয়ে যাবে। আমাদের জন্য আপনাদের কষ্ট হচ্ছে তার জন্য দুঃখিত আমরা।”

নিয়তির মুখে ভালো কথা শোনে আড়চোখে তাকালো শুদ্ধ। দুজনার চোখের ঘটলো দৃষ্টি মিলন। শুদ্ধ সাথে সাথেই চোখ সরিয়ে সামনে তাকিয়ে নিয়তিদের উদ্দেশ্য বলল,

–” চলে এসেছি। নামুন তাড়াতাড়ি।”

নিয়তি শুদ্ধর কথা শোনে রেগে গিয়ে গাড়ির দরজা খুলে নামতে যাবে তখনই পায়ে হোচট খেয়ে রাস্তায় পরে গেলো। মিশু গাড়িতে বসেই হাসতে লাগলো। নিয়তি সে তো রাস্তায় বসে বসেই হাসছে, এইখানে তাদের লজ্জা পাওয়া উচিৎ কিন্তু তারা পাচ্ছে না। মনে হচ্ছে তারা এইভাবে অভ্যস্ত। পাশে দুজন ছেলে যে তাদের দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে সেদিকে কোনো হুস তাদের নেই। অভ্র অবাক হয়ে ফিসফিস করে বলল,

–” লজ্জার বদলে হাসছে কেন দুজন?”

শুদ্ধ নিজের ঠোঁট জোড়া চেপে ধরে ফিসফিস করে বলল,

–” মেন্টাল হসপিটালের রোগী এরা , এইভাবে কারণে অকারণে হাসে।”

শুদ্ধর কথা শোনে জোরে জোরে হাসতে লাগলো অভ্র। মিশু এবং নিয়তি হাসি থামিয়ে দিলো। হাত পা ঝেড়ে উঠে দাঁড়ালো নিয়তি। অভ্রের দিখে তাকিয়ে কঠিন কণ্ঠে বলল,

–” হাসছেন কেন? দেখছেন এক মেয়ে পরে গেছে তাকে ধরে উঠাবেন তা না করে হাসছেন। ভেবেছিলাম আপনি আপনার অকর্মার ঢেঁকি অর্থাৎ আপনার বন্ধুর মত নন। খুব ভালো এবং সুন্দর মনের মানুষ। কিন্তু শেষমেষ এসে আপনিও বুঝিয়ে দিলেন, আপনিও আপনার বন্ধুর মত।আপনার থেকে আশা করিনি।”

মিশু গাড়ি থেকে নেমে নিয়তির সাথে দাঁড়িয়ে আস্তে আস্তে বলল,

–” আমি জানতাম উনি এমন তাইতো বেশি কিছু আশা করিনি। আর হে ধন্যবাদ আপনাদের আমাদের পৌঁছে দেওয়ার জন্য।”

দুই বান্ধুবী হেঁটে হোস্টেলের পিছু যেতে নিচ্ছিল শুদ্ধ তাদের থামিয়ে গাড়ি থেকে নেমে ভদ্রভাবে বলল,

–” হোস্টেলের পিছনে কেন যাচ্ছেন?”

নিয়তি মুখ বাঁকিয়ে বলল,

–” করিম চাচা পাহারায় আছে। আমাদের দেখলে এক্ষুনি গিয়ে স্যার ম্যামকে বলে দিবে। পিছনে গাছ আছে ওইটা দিয়েই উঠে রুমে যেতে পারবো।”

অভ্র জিজ্ঞাসা করলো,

–” আপনারা গাছে উঠতে পারেন? বাহ কি সাহস।”

মিশু তখন ঠোঁট কামড়ে বলল,

–” শুধু গাছে নয়, ছেলেদেরও গাছের সাথে ঝুলাতে পারি।”

অভ্র এইবার চিল্লিয়েই বলল,

–” অসভ্য মহিলা মানুষ। ”

মিশু দাঁতে দাঁত চেপে ধরে গর্জে ওঠে বলল,

–” কি বললেন?”

–” যা শুনতে পেয়েছেন তাই বলেছি।”

নিয়তি বুঝলো পরিবেশ খুব গরম হয়ে উঠেছে তাই মিশুকে থামিয়ে দিয়ে সুন্দর করে বলল,

–” আপনারা আমাদের সাহায্য করেছেন সেইজন্য ম্যানি ম্যানি থ্যাংকস । প্লিজ এইবার চলে যান, আমরা আমাদের রুমে ঠিকই যেতে পারবো।”

নিয়তি হাঁটা শুরু করতেই শুদ্ধ নিয়তির হাত ধরে রাগী এবং ধমকের সুরে বলল,

–” আপনাদের যেহেতু সাহায্য করেছি তাহলে সামান্য সাহায্য তুলে রেখে কি লাভ চলুন পুরোটাই না হয় করি।”

— মানে?

চলবে.

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here