#তোমার_সন্ধানে ♥️
#ফারজানা_আফরোজ
২
ক্লাবের আবছা অন্ধকারে জুস হাতে দাঁড়িয়ে আছে নিয়তি। রাগ, অস্বস্তি সবকিছু মিলিয়ে ভীষণ খারাপ সে। হঠাৎ তার কোমরের বাঁ পাশে কোনো পুরুষের কঠিন স্পর্শ পেয়ে কেঁপে উঠলো। মুহূর্তেই চেহারা হয়ে উঠলো রক্তিম রঙা সূর্যের মতো। কোনো কিছু না ভেবে কোমল হাতে সজোরে ‘থাপ্পড়’ নামক শব্দটি বসিয়ে দিল লোকটির গালে। এক হাত গালে ধরে দাঁড়িয়ে আছে লোকটি। নিয়তি পিছনে ঘুরে লোকটার মুখ স্পষ্ট দেখতে না পেয়ে তীরের মত বলে উঠলো,
–” সমস্যা কী? মেয়ে দেখলে টাচ্ করতে ইচ্ছা করে? আমাকে কী বাজে মেয়ে পেয়েছেন? বেয়াদপ কোথাকার। সব জায়গায় মেয়ে দেখলে লুচ্চামি শুরু হয়ে যায় তাই না? মেয়ে দেখলেই তো ভোগের বস্তু মনে হয়। ইচ্ছা করতেছে তো তোকে পুলিশে দিয়ে চোদ্দ বছরের জন্য জেলে পাঠাই। লজ্জা শরম থাকলে আর কখনো কোনো মেয়েকে টাচ্ করবি না। মেয়েদের হাতে দাবাং মার্কা থাপ্পড় খেয়ে তোর তো মরে যাওয়া উচিৎ। অসভ্য পুরুষ কোথাকার।”
রাগে গজগজ করতে করতে হনহন করে চলে গেলো নিয়তি। লোকটির চেহারা সে দেখেনি। তবে লোকটি বেশ লম্বা এবং সুন্দর সাস্থ্য অধিকারী আবছা আলোতে ভালোই বুঝা যাচ্ছিল। ক্লাবের একদম মাঝে গিয়ে দাঁড়িয়ে পায়ের জুতো জোড়া খুলে যখনি ছুঁড়ে মারতে যাবে তার আগেই মিশু এসে খপ মেরে ধরে ভ্রু জোড়া কুঁচকে বলল,
–” সমস্যা কি তোর? জুতো ছুঁড়ে মারছিস কেন?”
–” শালী, আজ তোর জন্যই আমার এই খারাপ জায়গাতে আসতে হলো। তোর বয়ফ্রেন্ড কিন্তু মোটেও ভালো না। ভালো ছেলেরা কখনোই রাতের দশটা পর্যন্ত তার গার্লফ্রেন্ডকে ক্লাবে রাখে না। রাখে না কী বল ক্লাবের আশে পাশেই আসতে দেয় না। ব্যাটার অন্য কোনো মতলব আছে, আমি শিউর। দেখ বইন তোর কথা রেখে আমি আসছি। এখন কিন্তু আমাদের হোস্টেলে জায়গা দিবে না। চল তাড়াতাড়ি এইখান থেকে বিদায় হই।”
নিয়তির কথা শোনে মিশু কষ্টমাখা মুখ করে বলল,
–” আমাদের ব্রেকআপ হয়ে গেছে নিয়ু। তুই ঠিকই বলছিস তানভীর ভালো ছেলে নয়। সে আজ আমাকে খুব বাজে কথা বলেছে। তাইতো চলে আসছি, কিন্তু এসে দেখি তুই নাই, কই গিয়েছিলি?”
–” আর বলিস না। একটা বাজে ছেলে আমাকে….!”
নিয়তির বলার আগেই একটি ছেলে এসে নিয়তির হাত খপ মেরে ধরে ফেলল। নিয়তি চিৎকার দিতে যাবে তার আগেই ছেলেটি নিয়তির মুখে আঙ্গুল দিয়ে চুপ করিয়ে বলে উঠলো,
–” কাম বেবি, এত কিসের অহংকার তোমার? একটু আগে দেখলাম দেশের নামকরা খেলোয়াড় শুদ্ধ স্যারকে থাপ্পড় মারলে। টাচ্ করলাম আমি আর থাপ্পড় খেলো শুদ্ধ স্যার। বাহ তোমার দেখছি হেব্বি সাহস। ওকে আজ তোমার এই সাহসের সাথে আমি আরো কিছু না হয় যোগ করে দিবো। তখন তো শুদ্ধ স্যারের ভয়ে চলে আসছিলাম।”
ছেলেটির কথা শোনে নিয়তির চাহনি আকাশ ছোঁয়ার মত। সে যে কি বড় ভুল করেছে ভাবতেই পুরো শরীর কাঁটা দিয়ে উঠছে। তার জীবনের সবচেয়ে বড় ক্রাশ, যার সাথে একটা সেলফি তোলার জন্য কতই না আফসোস তার আর সে কিনা ওই ব্যক্তিকে থাপ্পড় মেরেছে? যেখানে কোনো রকম দোষ ছিল না তার। ছিঃ ভাবতেই হাতখানা কেটে ফেলতে ইচ্ছা করছে তার।
–” কি রূপসী কি ভাবছো গো? আজকের রাতের কথা নাকি?”
বিচ্ছিরি হাসি এবং কথা শোনে নিয়তির পুরো শরীর ঘিরঘির করে উঠলো। এইবার উল্টো হাতটা দিয়ে লোকটির গালে চড় বসিয়ে দিয়ে রাগান্বিত স্বরে বলল,
–” আগের বার ভুল করে মেরেছি কিন্তু এইবার আর ভুল করব না। হাতে জুতো দেখছিস? ওইটা দিয়েই আজ তোর কল কলকারখানা খতম করে ফেলবো, ফাজিল ছেলে। ভবিষ্যতে পরিবারের বাত্তি আর জ্বালাতে পারবি না।”
বলেই হাতে থাকা জুতো দিয়ে সবার সামনেই জুতো পেটা করতে লাগলো নিয়তি। নিয়তির এই বাঘিনী রূপ দেখে বাকিরা গোল হয়ে দাঁড়ালো। নিয়তি গরম চোখে মিশুর দিকে তাকাতেই মিশুও তার জুতোজোড়া খুলে মারতে লাগলে। পাবলিক প্লেসে দুই মেয়ের হাতে দাবাং মার্কা মার খেয়ে ফ্লোরে শুয়ে পড়লো ছেলেটি। হঠাৎ একটি হাত এসে নিয়তির হাত ধরতেই নিয়তি রেগে কিছু বলতে যাবে তার আগেই লোকটির মুখ দেখে নিয়তি চুপ হয়ে গেলো। তার সামনে তার ক্রাশ শুদ্ধ দাঁড়িয়ে আছে। অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে এতদিনের দেখার স্বাধ নিতে লাগলো নিয়তি। এই তাকানো যেন শেষ হবার নয়। শুদ্ধ চোখে মুখে বিরক্তি নিয়ে গর্জে উঠলো,
–” মেয়ে মানুষের এত সাহস থাকা ভালো নয়। কথা নেই বার্তা নেই যাকে খুশি তাকেই মারবেন নাকি? আমি বলে চুপ করেছিলাম কিন্তু বাকিরা থাকবে না। তাছাড়া নিজেকে এতই যেহেতু পবিত্র ভাবেন তাহলে এত রাতে আসলেন কেন ক্লাবে? ক্লাবে ভালো ছেলে মেয়েরা আসে না ওকে? যত্তসব নেকামো।”
কথাগুলো বলেই নিচ থেকে ছেলেটার হাত ধরে উঠিয়ে চোখের ইশারায় বলল চলে যাওয়ার জন্য। ছেলেটিও চলে গেল কিন্তু সে রাগী চোখে নিয়তিকে একবার দেখে নিল। মিশু তখন শুদ্ধের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে বলতে লাগলো,
–” স্যার, আপনি এইখানে? আমি তো বিশ্বাসই করতে পারছি না। প্লিজ স্যার একটা সেলফি। জানেন আমার ফ্রেন্ড নিয়তি সে তো আপনার খুব বড় ফ্যান। আপনার সাথে সেলফি তোলার বড্ড ইচ্ছা তার। প্লিজ স্যার একটা সেলফি।”
মিশুর কথা শোনে আড়চোখে নিয়তির দিকে তাকালো শুদ্ধ। চোখ মুখ দেখে বুঝা যাচ্ছে না তার পরবর্তী শব্দ কী হবে, হ্যাঁ অথবা না।
–” ছবি তোলার মত আপাতত কিছু খুঁজে পাচ্ছি না। তাছাড়া আমি যার তার সাথে সেলফি তুলি না। সরি ম্যাম।”
শুদ্ধের এই দুই বাক্য কথায় আবারো রেগে গেল নিয়তি। কর্কশ কন্ঠে বলতে লাগলো,
–” ওই মিশু, তোকে আমি বলছি আমি এই লোকের সাথে সেলফি তুলবো? আমি অহংকারী, ভাব ওয়ালা মানুষের সাথে সেলফি তুলি না। নামকরা ক্রিকেটার বলে কি দুনিয়া কিনে ফেলছে নাকি? আজব মানুষ। চল তো এই লোকের সাথে সেলফি তুলে সেলফি নামক শব্দটিকে অপমান করতে পারবো না।”
শুদ্ধের দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে থেকে মিশুর হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে লাগলো নিয়তি। একে তো ক্রাশ তার উপর আজ বড় ধরনের বাঁশ সহ্য করেছে সে। এইজন্যই লোকে বলে ক্রাশের নাম বাঁশ। ক্রাশ যত ফেমাস তার বাঁশটাও তেমন ফেমাস। মনে মনে শুদ্ধর গুষ্টি উদ্ধার করে মাঝ রাস্তায় এসে দাঁড়ালো দুজন। মিশু তখন নিজের মুখটা ধরে বাম হাতে চিমটি কেটে বলল,
–” দোস্ত, আজকে কি সত্যিই শুদ্ধ স্যারের সাথে দেখা হয়েছে আমাদের? আমি তো ট্রাস্ট করতে পারছি না। বারবার মনে হচ্ছে স্বপ্ন দেখছি। সামনাসামনি কিন্তু হেব্বি দেখতে বোস।”
–” লুইচ্চা গিরি বাদ দে। ওই বেয়াদপ ছেলের নাম শুদ্ধ না রেখে অশুদ্ধ রাখা উচিৎ ছিল। দেখছিস শালার ভাব কত? নিজেকে প্রেসিডেন্ট ভাবে মনে হয়। ইচ্ছা করতেছে পা দিয়ে পিশিয়ে সকোজে সাজিয়ে রাখি।”
মিশু বাঁকা চোখে তাকিয়ে আশপাশ দেখলো। একটা গাড়ি নামক বস্তু খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আকাশের দিকে তাকিয়ে উচ্চ শব্দে বলতে লাগলো,
–” হে আল্লাহ, জানি আজ আমরা খুব বড় ভুল করেছি। নিষিদ্ধ জায়গায় চলে আসছি, প্লিজ ক্ষমা করে দাও। এমনিতেই কলেজ হোস্টেলে থাকি তার উপর লুকিয়ে আসছি। কিভাবে যে রুমে যাবো তাই ভাবছি। আপাতত এইখান থেকে সুস্থ শরীরে হোস্টেলের সামনে পৌঁছে দেও। প্লিজ আল্লাহ প্লিজ।”
মিশুর কথা শোনে নিয়তিও বলতে লাগলো। নিয়তির কথার মাঝেই একটা হলুদ রঙের কুকুর এসে ঘেউঘেউ করতে লাগলো। নিয়তি পা থেকে আবারো জুতোজোড়া খুলে জোরে দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে মিশুকে চিল্লিয়ে বলতে লাগলো,
–” চৌদ্দটা ইনজেকশন নিতে না চাইলে দৌঁড় দে মিশু। দেখে মনে হচ্ছে পাগলা কুত্তা। আমি কিছুতেই ইনজেকশন নিমু না মিশু।”
নিয়তির দৌঁড়ানো দেখে কুকুরও পিছু নিলো নিয়তির। সামনে নিয়তি পিছনে কুকুর তার পিছনে মিশু। মিশু চিৎকার করে বলতে লাগলো,
–” আন্টির মেয়ে শালী, তোর দৌঁড়ানো দেখে কুত্তাও দৌঁড়ানো শুরু করছে সাথে আমাকেও দৌঁড়তে হচ্ছে। বইন থাম দেখবি কুত্তাও থেমে যাবে।”
মিশুর কথা শোনে নিয়তিও চেঁচিয়ে বলতে লাগলো,
–” হে আল্লাহ তোমার কাছে দু’আ চাইছি সুস্থ শরীর নিয়ে যেন বাসায় যেতে পারি। আর তুমি আমাদের ভুলের জন্য কুত্তার দৌঁড়ানি খাওয়াচ্ছ। প্লিজ সরি আর কখনোই আসবো না ক্লাবে।”
দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে একটা গাড়ির সামনে যেতেই কেউ একজন খপ করে হাত ধরে একদম নিজের শরীরের সাথে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলো নিয়তিকে।
চলবে,