তোমার মায়ায় আবদ্ধ আমি পর্ব ১৪

0
666

#তোমার_মায়ায়_আবদ্ধ_আমি ?
#পর্বঃ14
#লেখনিতেঃসামিয়া_আক্তার_মুনা ?

মাকে জড়িয়ে ধরে ফুপিয়ে কেঁদে যাচ্ছে নিশি। মিসেস খান ও মেয়েকে অতি যত্নে জড়িয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। আর একটু পর পর নিজের চোখের জল মুছেন।বেশ কিছুক্ষণ পর আয়শা খান (নিশির মা)নিশির মুখটা তুলে হাতের মধ্যে নিয়ে মেয়ের চোখের জল মুছে বললো__

‘আমি জানি মা তোর কষ্ট হচ্ছে, আমারও হচ্ছে আমাদের সবারই হচ্ছে কিন্তু মা এটাই যে নিয়তি মেয়েদের তো এই নিয়তির সম্মুখে একদিন না একদিন পড়তেই হবে।তাই যা হয়েছে তা মেনে নেওয়াটাই ভালো নতুন জীবন শুরু করতে যাচ্ছিস তাই আর কান্নাকাটি না আমি তোর মুখে হাসি দেখতে চাই।’

মায়ের কথা শুনে নিশি বলল__

‘ আমি তোমাদের ছেড়ে কিভাবে থাকবো মা?’

এই বলে নিশি আবারও কান্না করতে থাকে এবার মাথায় কারো হাতে স্পর্শ পেয়ে নিশি চেয়ে দেখে ওর বাবা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।

‘ আয়শা, দেখো আমাদের সেই ছোট্ট নিশি যে কিনা দুইদিন আগেও আমার কাছে এটা ওটা নিয়ে বায়না করতো তার নাকি আজ বিয়ে হয়ে গেছে।আমার ছোট্ট নিশি নাকি আজ শ্বশুরবাড়ি চলে যাবে কবে এত বড় হলি মা আমার তো মনে হচ্ছে এই কয়েক দিন আগেই আমার হাত ধরে স্কুলে যেতিস।’

এই কথা বলে নিশির বাবাও মেয়েকে ধরে কান্না করে দেয়। তখনই ওখানে আসে মিস্টার আরহান খান (নিশির জেঠা) এসে বলে__

‘ আশরাফ (নিশির বাবাকে উদ্দেশ্য করে) ওদের এবার ছাড়ো আর ওদের বেশিক্ষণ আটকে রাখা যাবে না। চৌধুরী সাহেব বারবার ফোন করছে, তাছাড়া অনেক রাত ও হয়েছে ওনারা নিহানদের জন্য অপেক্ষা করছেন। আমি চৌধুরী সাহেবের সাথে কথা বলে নিয়েছি ওদের এবার যেতে দিতে হবে। আর নিহান তোমার বাবা অনেক আগেই তোমাদের জন্য গাড়ি পাঠিয়েছেন এই নাও তোমার গাড়ির চাবি।’

এই বলে আরহান খান নিহানের হাতে গাড়ির চাবি দিয়ে দেয়। চাবি হাতে পেতেই নিহান বলল __

‘আঙ্কেল তাহলে এবার আমরা যাই!’

এই কথা শুনে নিলয় নিহানের সামনে এসে বলল __

‘ভাই তোকে অনেক বিশ্বাস করে আমাদের বাড়ির প্রাণটাকে তোর হাতে তুলে দিচ্ছি।প্লিজ ওকে কখনো কষ্ট দিস না!’

নিলয়ের কথা শুনে নিহান ওর হাতে হাত রেখে বলল__

‘ বিশ্বাস আছে তো আমার উপর?’

‘হ্যাঁ আছে, আমি জানি তুই আমার বোনকে সবসময় আগলে রাখবি!’

‘আমি আমার প্রতি তোর আর এই বাড়ির সকলের বিশ্বাসের মর্যাদাটা ঠিক রাখবো দেখিস। তাহলে আমরা এবার আসি?’

এতক্ষণ মিসেস মিলি (নিশির জেঠি)রান্না ঘরের এক কোণা থেকে সব দেখছিল নিশির যাওয়ার কথা শুনে উনি বেরিয়ে আসতেই ওনাকে দেখে নিশি তার কান্না আরো বাড়িয়ে দেয়।কারণ উনিও কান্নাকাটি করে চোখ মুখ একেবারে লাল করে ফেলেছে উনাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে।জেঠি কে দেখে নিশি দৌড়ে গিয়ে ওনাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে থাকে। উনিও পরম স্নেহে নিশির মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন__

‘দেখ মা আর কান্নাকাটি করে না,বিয়ের পর মেয়েরা শ্বশুর বাড়ি যাবে এটাই তো নিয়ম তাই না?’

এমন হাজারো কথা নিশি কে বুঝিয়ে শুনিয়ে সবাই পরিশেষে নিহানের হাতে তুলে দেয়। বিদায়ের সময় মেঘলা, নিরব, অপুও কান্না করেছিল।অপু তো নিশিকে ছাড়তেই চাইছিল নিশিও অপুকে ছাড় ছিল না যতই হোক একমাত্র ভাই নিশির।তারপর সবাই অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে নিশি কে নিহানের গাড়িতে তুলে দেয়। নিশি গাড়িতে উঠতেই নিহান গাড়ি স্টার্ট দেয় আর গাড়ি চলতে শুরু করে তার আপন গতিতে। নিশি আর নিহান পা রাখে তাদের নতুন জীবনে।
___________

মধ‍্য রাত হওয়ায় রাস্তা পুরোই ফাঁকা পিচ ঢালা রাস্তা দিয়ে শো শো করে এগিয়ে চলছে গাড়ি চৌধুরী ম্যানসনের উদ্দেশ্যে। নিশি গাড়ি গাড়ির জালনার সাথে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে আছে নিশি,চোখের পানিগুলো শুকিয়ে গালের উপর কেমন দাগ পড়ে আছে। ল্যাম্পপোস্টের মিটিমিটি আলোতে তা বেশ ফুটে উঠেছে নিশির মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে বেশ ক্লান্ত সে। নিহান ড্রাইভ করছে আর একটু পর পরই নিশির দিকে তাকিয়ে দেখছে।

বেশ কিছুক্ষণ পর,,,

নিশিদের গাড়ি এসে পৌঁছায় চৌধুরী ম্যানসনে। গাড়ির শব্দ পেয়ে ভেতর থেকে আফরিন (নিহানের একমাত্র ছোট বোন এবার এসএসসি পরীক্ষা দিবে।নিশির থেকে থেকে দেড় বছরের ছোট হবে) দৌড়ে আসে গাড়ির সামনে।

এইদিকে গাড়ি থামতেই নিশি গাড়ি থেকে নামতে যাবে তখন আফরিন দৌড়ে এসে নিশি কে জড়িয়ে ধরে বলে__

‘ কেমন আছো নিশি আপু?থুরি ভাবি!তুমি জানো আমি কতটা খুশি হয়েছি তোমাদের বিয়ের কথা শুনে, এখন থেকে তুমি আমাদের বাড়িতে থাকবে তাহলে তো আমরা অনেক মজা করতে পারব। ‘

আফরিনের কথা শুনে নিশি মুচকি হেসে বলল___

‘ হ্যাঁ আফরিন আমরা অনেক মজা করব।’

নিশির বাবা, কাকা আর নিহানের বাবা বিজনেস পার্টনার হওয়ায় দুই পরিবারের মধ্যেই খুব ভালো সম্পর্ক আছে। সেই সুবাদেই নিশি আর আফরিনের মধ্যে খুব ভালো সম্পর্ক রয়েছে।

‘এই তোরা কি আজ আমার বউ মাকে বাহিরেই দাঁড় করিয়ে রাখবি?’

হঠাৎ কারো কন্ঠ পেয়ে নিশি পেছনে চেয়ে দেখে নিহানের মা মিসেস রেহানা চৌধুরী আর নিহানের বাবা মিস্টার আশরাফ চৌধুরী দাঁড়িয়ে আছেন।নিশিকে দেখে নিহানের মা বললেন__

‘ কিরে নিশি তোর মুখটা এইটুকু হয়েছে কেন?নিশ্চয়ই আজ ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া হয়নি আর এত কান্নাকাটি করেছিস যে মুখটা কেমন হয়ে আছে।’

‘ আরে আন্টি! তেমন,,,,,’

‘চুপ!তুই আর আমার সাথে কথা বলবি না ‘

‘কেন? আমি আবার কি করলাম? আঙ্কেল নিহানের (বাবাকে উদ্দেশ্য করে) দেখেন আন্টি কি বলছে!’

‘ ঠিকই তো বলছে তুই আমার সাথেও কথা বলবি না!’

‘যা বাবা আমি আবার কি করলাম?’

নিশির কথা শুনে মিসেস রেহানা বললেন__

‘ এই যে তুই আমাদের আঙ্কেল -আন্টি বলে ডাকছিস এটাই তোর দোষ।’

মিসেস রেহানার কথা শুনে নিশি বলল__

‘তাহলে কি বলে ডাকবো?’

‘ কেন বাবা -মা বলে ডাকবি ‘

মিসেস চ‍ৌধুরির কথা শুনে নিশি একটু ভেবে বলল__

‘উম,,, না আমি তোমাদের মামনি আর বাবাই বলে ডাকবো!’

নিশির কথা শুনে আশরাফ চৌধুরী বলল__

‘তাই ডাকিস,,, এখন চল ভেতরে চল
__________

‘হ্যাঁ মা, আমি তো এখন কিছুই না আমি যে আজ তিনদিন পর বাড়ি ফিরলাম সেই খেয়াল আছে তোমার?’

নিহানের কথা শুনে মিসেস চৌধুরী মুচকি হেসে বলল__

‘ কেন, হিংসে হচ্ছে?

‘না আমি কেন হিংসে করতে যাব তাও আবার ওর উপর নিশি (কে উদ্দেশ্য করে)।’.

নিহানের কথা শুনে নিশি বলল__

‘ আমার তো মনে হচ্ছে আপনি হিংসেই করছেন!আপনি যেই,,,’

‘ আমি কি’

‘ এই তোরে চুপ করবি? শুনেছি যখন না তখনই তোরা শুরু হয়ে যাস। এবার থাম চল ভেতরে চল’

তারপর মিসেস চৌধুরী নিশি কে বরণ করেন বরণ শেষ হতেই নিশি চৌধুরী বাড়িতে পা রাখে।ভেতরে যেতেই মিসেস চৌধুরী বললেন __

‘নিশি যা ফ্রেশে আয় তারপর কিছু খেয়ে নিবি।’

মিসেস চৌধুরীর কথা শুনে নিশি বলল__

‘ না আন্টি,,’

নিশির কথা শুনে মিসেস চৌধুরী ওর দিকে তাকাইতেই নিশি বলল___

‘ না মানে মামনি এখন তো অনেক রাত হয়ে গেছে এখন আর খেতে পারব না।’

নিশির কথা শুনে মিসেস চৌধুরী বলল __

‘না মা কিছু তো খেতেই হবে! আফরিন যা নিশি কে তোর সাথে নিয়ে যা,ও ফ্রেশ হয়ে আসুক।’

নেশি আর কি করবে মিসেস চৌধুরীর কথা মতো চলে গেল আফরিনের সাথে আফরিনের রুমে ফ্রেশ হতে আর নিহান তো ভেতরে এসেই নিজের রুমে চলে গেছিল।

ফ্রেশ হয়ে এসে নিশি কোন মতো খেয়ে উঠে যায় নিশি খাওয়া শেষ হতেই আফরিন নিশি কে নিহানের রুমে দিয়ে আসে। বেশ অস্বস্তি নিয়ে বসে আছে নিশি আর এই শাড়ি সামলানো সহ্য হচ্ছে না কি আর করার বেশ অস্বস্তি নিয়ে বসে আছে নিশি। আর চারপাশটা চোখ বুলিয়ে দেখে বলছে __

‘বাহ,, পাজিটা মনে হয় অনেক পরিষ্কার থাকতে পছন্দ করে আর আমার ঘর তো মাশাল্লাহ আমার মা তো আমাকে কত কথা শোনা তো।’

হঠাৎই দরজা আটকানোর শব্দে নিশি দরজার দিকে তাকিয়ে দেখে নিহান রুমে এসেছে নিহান কে দেখে নিশিক কিছু বলতে যাবে তার আগে রেহান বেশ গম্ভীর গলাতেই বলল__

দেখো আমি কোন সিনেমার হিরো নই যে ফিল্মি ডায়লগ দিয়ে বলবো তুমি বিছানাতে ঘুমাও আমি ফ্লোরে বা সোফায় ঘুমাবো। এমন কিছুই হবেনা কারণ আমি আমার বেট ছাড়তে পারবো না আর আমার এসব মেযে বা সোফায় শোয়ার অভ্যাস।’

নেই নিহানের কথা শুনে নিশি বলল__

‘হ্যাঁ তা পারবেন কেন, আর আপনি তো ঠিকই বলেছেন আপনি হিরো না আপনি হলেন ভিলেন!’

নিশির কথা শুনে নিহান বলল__

‘ কি বললে তুমি?’

‘কেন শুনতে পাননি?’

‘ ইডিয়েট গার্ল!আ,,,,,’

নিহান আর কিছু বলার আগেই নিশি ন্যাকা কান্না করে বলল __

‘আমি জানতাম আপনি এমনই করবেন, আপনি আমাকে শুধু শুধু বকবেন’

নিশির কথা শুনে নিহান বলল__

‘তোমার যদি ইচ্ছে হয় তাহলে তুমি মেঝেতে বা সোফায় শুতে পারো আমার কোন প্রবলেম নেই কিন্তু আমি এসব জায়গায় শুতে পারবো না আর যদি তোমার কোন প্রবলেম না থাকে বেডের একটা সাইট আমি তোমাকে খালি দিয়ে দিচ্ছি ওইখানে শুয়ে পড়ো ঠিক আছে।এখন আমি বেশ ক্লান্ত আর প্রায় ২:০০ টা বেজে গেছে আমি আর পারছিনা তোমার ঘুমাও হলে ঘুমাও না হলে নাই আমি তো গেলাম ঘুমোতে।

এই বলে নিহান গিয়ে শুয়ে পড়ল। নিশি আর কি করবে অনেক ভেবে চিন্তে দেখল মেঝেতে বা সোফায় শুলে তো শরীর ব্যথা করবে তাই নিশি সিদ্ধান্ত নিল যে ও বেডেই শুবে কিন্তু এখন প্রবলেম হল ও তো শাড়ি পড়তে পরে ঘুমাতে পারবে না।এই ভেবে নিশি নিহানের কাছে গিয়ে বলল__

‘ স্যার আমার ব্যাটা কোথায়? আমি তো এই শাড়ি পড়ে ঘুমাতে পারবো না (নিশি ওদের বাড়ি থেকে আসার টাইমে সময় ওর কিছু ড্রেস আর রাতে শোয়ার জন্য গেঞ্জার প্লাজু এনেছিল)’

নিশির কথা শুনে নিহান বলল__

‘ তোমার ব্যাগটা এখন ড্রয়িং রুমে যাও ওখান থেকে নিয়ে আসো’

নিহানের কথা শুনে নিশি বলল ___

‘কিহ! ড্রয়িং রুমে কিন্তু এখন ওখানে গেলে তো,,,’

এত রাতে নতুন বউ যদি ব‍্যাগ খুজে তাহলে খারাপ দেখায় এই ভেবে নিশি মনে মনে বলে__

‘ থাক আর দরকার নেই শাড়ি পরেই শুয়ে পড়ি’

এই বলে নিশি বেডের এক পাশে ঘুটি শুটি হয়ে শুয়ে পড়ে।সারা দিন এত দখল যাওয়ায় নিশি বেশ ক্লান্ত এখন লম্বা একটা রেস্ট প্রয়োজন।তাই নিশি শোয়ার সাথে সাথেই যেন হারিয়ে গেল ঘুম রাজ্যে।

#চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here