তোমার নিরব অভিমানীনি পর্ব ৫

0
1490

#তোমার_নিরব_অভিমানীনি(০৫)
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)
(কার্টেসি ছাড়া কপি নিষিদ্ধ)

কারো আনন্দ মুহূর্তে আপনি যখন কিছু আবদার করবেন তখন সে ফিরিয়ে দিতে পারবে না। ঠিক তেমনি হলো নজরাত এর সাথে। রুপকথার ব‌ই বের হ‌ওয়ার আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে আছে রাদ শাহমাত। তখন মিনমিনে গলায় নজরাত তাদের বাসায় ইনভাইট এর কথাটা বলে।
রাদ কিছুক্ষণ থম মেরে দাঁড়িয়ে বলে,
—” আমি যাচ্ছি আপনাদের বাসায়।
নজরাত এর ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটে উঠল। অন্তত তার ভাই তো আর সন্দেহ করবে না।এই অনেক কিছু।

ইচ্ছে করছে শ্বাশুড়ি মায়ের সাথে গল্প করতে তাই এক মুহুর্ত বিলম্ব না, নিজের হাতে কফি বানিয়ে চলে এলো। সাজেদা চৌধুরী হাদীসের ব‌ই পড়ছিলেন। ছেলে ব‌উকে দেখে ব‌ইটা বন্ধ করে পাশে ছোট কেবিনেটের উপর রাখেন। ইশারা করে নিজের পাশে বসায় নজরাত কে। নজরাত কফি মগ এগিয়ে দিয়ে বললো,
—” আমি কি খুব ডিস্টার্ব করলাম মা?
—” একদম ই না।জানো তো ইদানিং মনে হয় তুমি ছাড়া আর কেউ নেই আমার! নিজের সন্তানদের কাছে পর হয়ে গেছি আমি।অথচ ওদের বাবা মা’রা যাওয়ার পর ওদের কিভাবে মানুষ করেছি সে আমিই জানি।যাই হোক তোমাদের বাসায় তো আগামীকাল দাওয়াত আছে। ছেলেটা কি যাবে? বলেছো কিছু?
—” জ্বি, যাবেন বলেছেন।
—” আলহামদুলিল্লাহ।
তোমার শ্বশুর এবং তোমার বাবা দুজনেই কলিগ ছিলেন, ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব হয়।আর সেই সুবাধেই তোমাকে তোমার বাবা আমার অনুরোধে, আমার ছেলের সাথে বিয়ে দিতে রাজি হয়েছিলেন। এখন বুঝতে পারছি নিজের ইচ্ছে পূরণ করতে তোমার জীবনটা শেষ করে দিয়েছি আমি। আমাকে পারলে ক্ষমা করে দিও ব‌উমা? না যে স্বয়ং আল্লাহ তা’আলা ও যে ক্ষমা করবেন না আমাকে।

নজরাত খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললো,
—” আল্লাহ তা‘আলা প্রত্যেক মানুষের তাক্বদীর লিপিবদ্ধ করেছেন আসমান-জমীন সৃষ্টির ৫০ হাজার বছর পূর্বে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,আল্লাহ তা‘আলা সৃষ্টি জগতের ভাগ্য লিখে রেখেছেন আকাশ সমূহ ও জমীন সৃষ্টির পঞ্চাশ হাজার বছর পূর্বে’।[১]

তাক্বদীর-এর বিষয় অজ্ঞাত :
তাক্বদীর একটি গায়েবী বিষয়, যা মহান আল্লাহ ব্যতীত কেউ অবগত নয়। আল্লাহ তা‘আলা তাক্বদীরের বিষয় সৃষ্টিকুল থেকে গোপন রেখেছেন। এজন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ প্রসঙ্গে অহেতুক বিতর্কে জড়িয়ে পড়তে নিষেধ করেছেন।[২]

সাজেদা চৌধুরী নজরাত এর কপালে ভালোবাসার পরস এঁকে দিয়ে জড়িয়ে ধরেন। নজরাত নিরবে চোখের পানি ফেলে।যা বুঝতে পারে সাজেদা চৌধুরী। তিনি মেয়েটার এতো ধৈর্য দেখে দিন কে দিন মুগ্ধতায় আচ্ছন্ন হয়ে পরছে। কিছুতেই এই হিরের টুকরো কে হারাতে চান না সাজেদা চৌধুরী। আশায় আছেন একদিন রাদ কে হেদায়েত দান করবেন আল্লাহ তা’আলা। মেয়েটা সবসময় জোরপূর্বক হাসে। তিনি নজরাত এর ঠোঁটে প্রাণ খোলা হাসি দেখতে চান।
______

সকাল দশটার দিকে চৌধুরী পরিবার বের হয় নজরাত এর বাড়ির উদ্দেশ্যে। রাদ ড্রাইভ করছে আর পাশে বসে আছে নজরাত। পিছনে সাজেদা চৌধুরী, রাহা চৌধুরী আর মণি বসেছে।

রাদের মনোযোগ সম্পূর্ণ ড্রাইভ করাতে। নজরাত কয়েকবার আড়চোখে তাকায় রাদ এর দিকে। একবার রাদ তাকাতে চোখাচোখি হয়ে যায় দুজনের। তারপর আবার দুজনে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। জানালা গলিয়ে বাহিরের ব্যস্ত সড়কে, মানুষের চলাচল দেখতে থাকে নজরাত।

রাহা চোখ মুখে কাঠিন্য ভাব ফুটিয়ে বসে আছে।সে জানিয়েছিল যাবে না ও বাসায়। কিন্তু সাজেদা চৌধুরী চোখ রাঙানি দিতে আর অমত করতে পারেনি।

সাজেদা চৌধুরী চোখ বন্ধ করে গাড়ির সিটে হেলান দিয়ে বসে আছেন।আর পাশে মণি চঞ্চল চোখ দুটো দিয়ে আসেপাশের বড় বড় দালান কোঠা দেখতে ব্যস্ত। সে ভীষণ আনন্দিত নজরাত এর বাড়ি যাবে বলে। নজরাত কে পেয়ে মণি নিজের দুঃখ কষ্ট গুলো কিঞ্চিৎ হলেও ভুলে থাকতে পারছে।
শ্বশুরবাড়ির লোকজনের এবং স্বামীর অত্যা’চার সহ্য করতে না পেরে বাপের বাড়ি চলে এসেছিল মণি। কিন্তু বাপের বাড়ির অবস্থা নুন আনতে পান্তা ফুরোয়।যার ফলে কাজ খুঁজতে গিয়ে চৌধুরী বাড়ির হদিস মিলে। এরপর থেকেই এ বাড়িতে থাকে মণি।
মণির এক ছেলে এক মেয়ে আছে।তারা মাদ্রাসায় পড়াশোনা করে, ছেলের বয়স নয় বছর আর মেয়ের ছয় বছর।এ কথা শুনে সাজেদা চৌধুরী মণি কে নিয়ে গিয়েছিল সেই মাদ্রাসায়। কিন্তু আশ্চর্য বিষয় ছেলে মেয়ে দুটো মায়ের প্রতি কোন মায়া নেই। মণি জোর করে কাছে আনে, কাঁদে কিন্তু ছেলে মেয়ে দুটো কেমন আলগা আলগা ভাব। দূরত্ব বজায় রেখে থাকে।এসব দেখে সাজেদা চৌধুরী বুঝতে পারে মণির শ্বশুরবাড়ির লোকজন প্রকৃত পক্ষে কেমন।তাই এর পর আর কোন দিন মণি কে নিয়ে যায়নি সাজেদা চৌধুরী।

দেখতে দেখতে ঠিকানা মোতাবেক গাড়ি থামায় রাদ। তারপর গাড়ির হর্ণ বাজাতে দারোয়ান কবির দরজা খুলে দিল।গাড়ি ভিতরে নিয়ে নির্দিষ্ট স্থানে পার্ক করে রাদ। সবাই গাড়ি থেকে নামলে কবির এগিয়ে এসে সালাম দেয়। খুশি মনে নজরাত কে বলে,
—” মামুনি কেমন আছো? মেলা দিন পর তুমি আইলা।এমনে ভুইলা গেলে হয় ক‌ও তো?
নজরাত মুচকি হেসে বলে,
—” আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আপনি কেমন আছেন চাচা?

দুজনে কথা বলছে আর সবাই বাড়িটার চারদিকে দেখছে। ভীষণ সুন্দর তিন তলা বাড়িটি। বিশেষ করে বাড়ির সামনের গার্ডেন টা খুব বড়, আর এর অর্ধেক টা জোরে আছে বিদেশি বাহারী ফুলের সমারোহ। নজরাত এর প্রিয় জিনিস গুলো এমনি করে তার বাবা এবং ভাইয়া সাজিয়েছে।
রাদ এক পলক দেখে বুঝতে পারলো নজরাত এর বাপের বাড়ির আর্থিক অবস্থা। বিয়ের সময় গার্ডেনে ডেকোরেশন করা হয় তাই আর এতো কিছু লক্ষ্য করেনি রাদ। তাছাড়া মায়ের সাথে রাগ করে বিয়ের পূর্বে ও এ বাড়িতে আসেনি সে।আর বৌ-ভাত অনুষ্ঠানের পরেও কাজের অজুহাতে ঢাকার বাহিরে চলে গিয়েছিল।রাদ মনে মনে ভাবলো এত্ত আভিজাত্যের ছোঁয়া অথচ সে কিনা টাকার অফার করেছিল নজরাত কে। এত্ত কিছু থাকার পরেও কোন মেয়ের লোভ থাকবে না নিশ্চয়ই। তবে তার বারন করা সত্ত্বেও কেন বিয়েটা করলো নজরাত?

খবর পৌঁছাতে রূপক আসে। রাদ এর সাথে হ্যান্ডসেক করে বাসায় নিয়ে যায় সবাই কে।
বাসার ভিতরে ঢুকে আরো মুগ্ধ হয়ে যায় সবাই।রাহা সবচেয়ে অবাক হয় এতো কিছু থাকার পরেও নজরাত এর মাঝে কখনো অ’হংকার, দাম্ভিকতা দেখতে পায়নি। এ দিক থেকে রাহা’র মন, নজরাত এর প্রতি নরম হলো।

সাজ্জাদ হোসেন এসে সবার সাথে কুশল বিনিময় করে। মেয়েকে পাশে বসিয়ে আদর করে, ভালো মন্দ জিজ্ঞাসা করেন। এর মাঝে একজন হেল্পিং হ্যান্ড সবার জন্য কফি এবং অন্যান্য নাস্তা নিয়ে আসে। সবার আড়ালে রাহা রূপক এর দিকে তাকায়। রূপক এর নজর পরলে দেখতে পায় রাহা তার দিকে তাকিয়ে আছে। তখন রূপক ভ্রু নাড়িয়ে জিজ্ঞাসা করে, কি?
রাহা খানিকটা লজ্জা বোধ হয়, দৃষ্টি নত করে নেয়।
_______

দুপুরে খাবার খাওয়ার পর, সাজ্জাদ হোসেন নজরাত কে বললেন,
—” রাদ কে নিয়ে তার রুমে যেতে বিশ্রাম এর জন্য।
নজরাত বাবার কথা মতো নিয়ে চলে রাদ কে। একটা রুমের কাছে আসতে রাদ খেয়াল করলো দরজায় ডিজাইন করে লেখা “গল্পপুড়ি”‌। তারপর, ভিতরে প্রবেশ করে রাদ বিষ্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইল! রুমটা আসলেই একটা গল্পপুড়ি। রুমের চার দেওয়ালের মধ্যে তিন দেওয়াল ই বুক সেলফ জুড়ে আছে। বুক সেলফ গুলো বিভিন্ন ডিজাইনের কারুকার্য খচিত।আর এক পাশে আছে ড্রেসিং টেবিল,কাবার্ড আর একটি ছোট টেবিল। যেখানে বসে নজরাত পড়াশোনা করতো।সব কিছুর মাঝে রাউন্ড ডিজাইনার বেড। জানালা আর দরজা গুলোতে নীল জর্জেটের পর্দা গুলো মৃদু মন্দ হাওয়ায় দুলছে।সব মিলিয়ে অসাধারণ একটি রুম।রুমটা দেখলে যে কেউই বলবে রুমের মালিক একজন সৌখিন মানুষ।

তবে এতটুকুর মাঝে রাদ শাহমাত বুঝতে পারে তার মতো নজরাত ও সাহিত্য প্রেমী।
______

বিকাল বেলা ঘটলো এক ঘটনা, রাদ কে উত্তেজিত হয়ে গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে যেতে দেখা গেল! কিন্তু কেন?
_______
রেফারেন্স:
[১]. মুসলিম হা/২৬৫৩; মিশকাত হা/৭৯।
[২]. তিরমিযী হা/২১৩৩; মিশকাত হা/৯৮।
______

#চলবে…. ইনশা আল্লাহ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here