তোমার নামে আমাকে ডাকো পর্ব ৫

0
270

#তোমার_নামে_আমাকে_ডাকো
#লেখিকাঃ সারজীন ইসলাম

|পর্ব-০৫|

সকালের মিষ্টি রোদের আলো একরাশ মুগ্ধতা ছড়িয়ে দেয় চারদিকে। ভোরের দিকে রাহাত খান চৌধুরীর জ্ঞান ফিরেছে। ডক্টারের পরামর্শে পরিবারের লোকজনের সাথে বেলা নয়টার পরে রাহাত খান চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করার অনুমতি দিয়েছে। কেবিনে উপস্থিত আছে, ইমন খান চৌধুরী, রায়হান খান চৌধুরী, মামুন খান চৌধুরী, ইরা খান চৌধুরী, ডক্টর মিথিলা আরো বেশ কয়েকজন ডক্টর। বাড়ির অন্য সবাই এখন হসপিটালে এসে পৌঁছয় নি। সবার দৃষ্টি কোন রাহাত খান চৌধুরীর উপরে। ডক্টাররা যা যা জিজ্ঞেস করছে তার উত্তর দিচ্ছে রাহাত খান চৌধুরী। ডক্টর একে একে সব কিছু জিজ্ঞেস করে কেবিন ত্যাগ করে। ডক্টর বেরিয়ে গেলে জমিদার রাহাত খান চৌধুরী তার বড় নাতি ইমন খান চৌধুরী দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বলল,

‘ তুই কী তোর বোনকে খুঁজে পেয়েছিস? খুঁজে পেয়ে থাকলে আমাকে ওর কাছে দিয়ে যায়। না হলে আমার দুচোখ যেদিকে যায় সে দিকে চলে যাই। আমার আর তাদের নিত্যদিনের এই সমস্যাগুলো ভালো লাগেনা। আমার বড় নাতনি আজ কত বছর ধরে নিজেকে লুকিয়ে রেখেছে আমাদের থেকে। এই বয়সে কোথায় পরিবারের সঙ্গে হাঁসি আনন্দ করে দিন পার করবো তা না দুশ্চিন্তা আমার দিন পর হয়।’

একটুকু বলে থামে রাহাত খান চৌধুরী। এইটুকু কথা বলে হাঁপিয়ে যাচ্ছেন তিনি। বড় বড় নিঃশ্বাস নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে তিনি। ইমন খান চৌধুরী করুন চোখে তাকালো ওর দাদুভাইয়ের দিকে, ওর আদরের বোনটা তো অনেক আগেই ওদের সঙ্গে রাগারাগি করে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে এখন আবার দাদুভাই ও চলে যাবে ওদের ছেড়ে?

————

গায়ে হলুদের উৎসবে মেতেছে সবাই। ইধা হইহুল্লোড় থেকে দূরে সোফায় বসে সবকিছু কৌতুহল চোখে দেখছে। হালিমা চৌধুরী ধীর পায়ে হেঁটে এসে ইধার পাশে সোফায় বসে। এক পলক ইধার দিকে তাকিয়ে হালিমা চৌধুরী কাটকাট গলায় বলল,

‘ এসব কী শুরু করেছে ছেলেমেয়েরা? আজকাল বিয়ের অনুষ্ঠানে এমন ভাবে করে যেন কোন পার্টি হচ্ছে। সেই আগের দিনের সাবেকি বিয়ের আমেজ আর পাওয়া যায় না।’

ইধা কান খাড়া করে তার বলা কথাগুলো মন দিয়ে শোনে। হালিমা চৌধুরীর কথা বলা শেষ হলে ইধা মোলায়েম গলায় বলল,

‘ এখনো কিছু পরিবারের সেই আগের দিনের সাবেকী বিয়ের আমেজ পাওয়া যায়। কিন্তু এই অত্যাধুনিক অস্ট্রেলিয়ার বুকে সেই সাবেকী বিয়ের আমেজ খোঁজা অনেকটা অমাবস্যার রাতে চাঁদ খোঁজার মতো ব্যাপার।’

ইধার কথা শুনে হালিমা চৌধুরী হেসে দিয়ে বলল,

‘ না তুমি ঠিক বলেছ। তা সুন্দরী তোমার নামটা তো জানা হলো না।’

ইধা কিছু বলবে তার আগে হঠাৎ করে কেউ বলল,

‘ আরে দিদুন তুমি একে চেনো না? এইতো তোমার আদরের নাতির হবু বউ। আমাদের একমাত্র ভাবি।’

ইধা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় কথা টা কে বললো তা দেখার জন্য। তাজ! ছেলেটা সাংঘাতিক দুষ্টু। কখন কোথা থেকে উদয় হয় তা বলা মুশকিল। এখানে এসেছে পর থেকে তাজের দুষ্টুমির সঙ্গে একের পর এক সাক্ষাৎ হচ্ছে ইধার। কখনো ভাবি কখনো ভাইয়ার হবু বউ কখনোই ভাইয়ার গার্লফ্রেন্ড ইত্যাদি নামে সম্বোধন করছে তাকে। যার দৌলতে এতগুলো নামের সম্মোধন পেয়েছে তাকে সেই রাতের পরে ইধা এক পলকের জন্য তার ছায়াও দেখেনি। ইধার ভাবনার সুতো ছিঁড়ে তার পাশে বসে থাকা ভদ্রমহিলার কথায়। তিনি জিজ্ঞাসু গলায় তাজকে বলল,

‘ ভাবি? মানে কার ভাবি? তাজ আমি নিশ্চিত তুই আবার কোন বাদরামি করছিস? সত্যি করে বল ঘটনা কী?’

তাজ ইনোসেন্ট মুখ বানিয়ে বলল,

‘ হ্যাঁ, হ্যাঁ এখন তো সব দোষ আমারই হবে। এখন কী আর তোমার বড় নাতি দোষ হবে? তোমার বড় নাতি নিঝুম আপুর বিয়ে রং উৎসবের আগের রাতে সবার সামনেই তো এই আপুটা কে প্রপোজ করে। ভাইয়ার প্রপোজ করার বেলায় দোষ নেই, আর আমি ভাবি বললেই যত দোষ তাই না?’

তাজের কথা শুনে হালিমা চৌধুরি উৎসুক হয়ে ইধার দিকে তাকায়। তা ওমন গুরুগম্ভীর নাতি কিনা কাউকে প্রপোজ করবে? বিষয়টি মানতে তা ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। ফ্যাল ফ্যালে দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ইধার দিকে। মেয়েটার ঠোঁটের কোনে হাসি। তাহলে কী তাজ সত্যি বলছে? হালিমা চৌধুরি গলা পরিষ্কার করে নিজেকে প্রস্তুত করে এই বিষয়ে জিজ্ঞাসা করার জন্য কিন্তু তার আগেই ইধা ঠোঁটে হাসি নিয়ে বলল,

‘ আমি আপনাকে কী বলে সম্বোধন করব বুঝতে পারছি না। তাই আপনি বলেই বলছি। আপনার এই নাতি, এক কথায় বলতে গেলে সাংঘাতিক দুষ্টু। তাজ এতক্ষণ ধরে যেগুলো বলেছে তার সবটাই সত্যি আমার সবটাই সত্যি নয়। মানে তাজ যে রাতের কথা বলল, সে রাতে এ বাড়ির সব কাজিনরা মিলে ট্রুথ ওর ডেয়ার খেলছিলো, খেলার মাঝে যখন তাজের ভাইয়ার ট্রান আসে তখন তাজ দুষ্টুমি করে বলে বাড়ির গেট দিয়ে প্রথমে যে ঢুকবে তাকে প্রপোজ করতে হবে। আনফরচুনেটলি তখন গেট দিয়ে প্রথমে আমি ঢুকি, ব্যস শর্ত মোতাবেক তাজের ভাইয়া আমাকে প্রপোজ করে। এই ঘটনার রেশ ধরে তাজ আমাকে ভাবী বলে সম্বোধন করছে। এই হলো পুরো ঘটনা।’

সব কথা শুনে তাজ বিড়বিড় করে বলল,

‘ দিলো, দিলো হাটের মাঝে আমার হাঁড়ি ফাটিয়ে দিলো।’

হালিমা চৌধুরি সব কথা শুনে চোখ বড় বড় করে তাজের দিকে তাকায়। তা দেখে তাজ শুকনো গলায় ঢোক গিলে হাসার চেষ্টা করে। বোকা বোকা হাসি দিয়ে বলল,

‘ দিদুন দেখো না ওদিকে তোমাকে কে যেন ডাকছে?’

হালিমা চৌধুরি তাজের কথা শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে পিছন ফিরে তাকায়, কই কেউ তো তাকে ডাকছে না! সামনে ফিরেত তাজকে কিছু বলবে তার আগেই দেখে তাজ সেখান থেকে গায়েব। এই তাজ আবার তাকে বোকা বানিয়েছে ভেবেই রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে ইধা কে বলল,

‘ এই ছেলে দিনদিন বাদরে পরিণত হচ্ছে। না জানি এর ভবিষ্যৎ কী? এইটুকু বয়সে এমন বাদরামি করে সামনে তো বাকী জীবনটা পড়ে আছে তখন কী করবে এই ছেলে?’

হালিমা চৌধুরি নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে ইধার দিকে তাকিয়ে মৃদু স্বরে বলল,

‘ তুমি কিছু মনে করো না ওর কথায়। তাজ বরাবরই এমন। আমার বড় তিন নাতির আদরে তাজ আজ এমন। তাজ…

কথা সম্পূর্ণ করতে না দিয়ে ইধা হালকা হেসে বলল,

‘ আরে না না আমি কিছু মনে করিনি। আপনি শুধু শুধু মন খারাপ করছেন। তাছাড়া তাজকে আমার বেশ ভালো লেগেছে। সব সময় হাসিখুশি থাকে ছেলেটা। সবাইকে আনন্দে মাতিয়ে রাখে।’

ইধার কথা শুনে হালিমা চৌধুরী ওর মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। ইধার কথা বলার ধরন তার খুব পরিচিত মনে হচ্ছে। কোথাও যেনো এমন কথা আরো একবার শুনেছে। কিন্তু কোথায়? তা এই মুহূর্তে মনে করতে পারছে না হালিমা চৌধুরী।

—————-

বাগানে পরিচিত কিছু ফুলের সঙ্গে অপরিচিত ফুলগুলো বাতাসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে খেলা করা দেখছে ইধা। মৃদু বাতাসের কারণে একটা ফুলগাছ অন্য আরেকটা ফুল গাছের গায়ে হেলে পড়ছে। ইধা এই বাগানে থাকার সব ফুল চিনে না। হাতে গোনা কয়েকটা ফুল ছাড়া সবগুলোই তার অচেনা ফুল। কিন্তু সেই অচেনা ফুলগুলোর সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়েছে ইধা। গুটি গুটি পায়ে সারা বাগান ময় হেঁটে চোখের পল্লব ফেলে দেখছে ইধা। পিছনে কোন মানব বা মানবি এর উপস্থিতি টের পেয়ে ইধা ভাবনার বিচূর্ণ হয়। ধীর গতিতে পিছন ফিরে তাকায়। সেই ছোট্ট বিচ্ছু তাজের তৈরি অযাচিত সম্পর্কের নিলাংশ নীর চৌধুরীর ফুপি ইশা চৌধুরী দাঁড়িয়ে আছে তার পাশে। ইশা চৌধুরীকে ইধার অকারণেই ভীষণ ভালো লাগে। কী সুন্দর দেখতে তাকে। হাসলে পরে ইধার মত তার গালেও টোল পড়ে। পার্থক্য শুধু ইধার ডান গালে টোল পড়ে আর ইশা চৌধুরী বাম গালে। সেই হাসি যুক্ত টোল দেখার একবার সৌভাগ্য হয়েছে তার দুষ্টু তাজের দৌলতে। আজ সকালে ডাইনিং টেবিলে তার সঙ্গে পরিচয় হয় ইধার। তিনি বাড়ির সকলের জন্য তার হাতে তৈরি স্পেশাল আলুর পরোটা তৈরি করে। অদ্ভুত ভাবে ইধাও আলুর পরোটা ভীষণ পছন্দের। জিম ডায়েট এসবের জন্য পছন্দের খাবারগুলো খুব একটা খাওয়া হয় না ইধার। আজ রুহির জড়াজড়িতে খেতে রাজি হয় ইধা। প্রথম টুকরো পরোটা মুখে দেওয়ার পরে পরোটার সাধ অসম্ভব ভালো লাগে যায় ইধার। ডায়েটের কথা চিন্তা না করে পরপর দুটো পরোটা খেয়ে ফেলে ইধা। যখন ইধা সকলের ঘটনাগুলো ভাবতে ব্যস্ত তখন ইশা চৌধুরী হাসিমুখ নিয়ে ইধার দিকে তাকিয়ে বলল,

‘ তুমি এখানে একা একা কী করছো? ওদিকে অনুষ্ঠানে বাচ্চারা সবাই নাচ-গানের শুরু করে দিয়েছে। যাবে না তুমি সেখানে?’

ইধা ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসে ইশা চৌধুরীর কথায়, হাতের ইশারায় দিয়ে বাগানের ফুলগুলোর দিকে তাকিয়ে মৃদু স্বরে বলল,

‘ এই ফুলগুলো দেখছিলাম। ভারি সুন্দর দেখতে। নাম কী তা জানি না। নাম না জেনে আমি এই ফুলের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়েছি। তাই এই ফুলগুলোর সৌন্দর্য কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে উপভোগ করছিলাম।’

ইধার কথা শুনে ইশা চৌধুরী হাসে। কিশোরী জীবনে তিনিও এমন ছিলেন। প্রকৃতির সৌন্দর্যের মাঝে নিজেকে বিলিয়ে দিতেন। ইশা চৌধুরী মৃদু হেসে বলল,

‘ তোমার পছন্দের ফুলটির নাম পার্পল কুকটাউন অর্কিড।’

ইধা ঠোঁটগুলো হালকা হা করে বলল,

‘ পার্পল কুকটাউন অর্কিড।’

————

করিডোর দিয়ে যাওয়ার সময় ইধার ঠিক বাম পাশ দিয়ে একটা ছায়া সরে যায়। ইধা উৎসুক হয়ে সে দিকে তাকায়। করিডোরের সেই রাস্তা বলছে ছাঁদে যাওয়ার পথ। ইধা কতক্ষণ নয়-ছয় হিসাব করে ছাঁদে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়। সমস্ত ছাঁদ জুড়ে লাইটিং করা। ইধা আনন্দিত চোখে এসব দেখে ঘনঘন পল্লব ফেলে। ইধা চার কদম এগিয়ে গিয়ে ছাদে রাখা চেয়ারে বসে চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সমস্ত সৌন্দর্য তা উপভোগ করে। চোখ পরে ছাদে চিলেকোটায় মত রুম টার দিকে, সেখানে দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মিস্টার নিলাংশ নীর চৌধুরী। পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। ইধা অসস্থির চোখে চোখ ঘুরিয়ে আবার তাকায় মিস্টার নিলাংশ নীর চৌধুরীর দিকে। সে এখনো তার দিকে তাকিয়ে আছে। ইধার মনে প্রশ্ন হল মিস্টার নিলাংশ নীর চৌধুরী এখানে এল কখন? তাহলে কী নিচের করিডোরের ছায়াটা ছিল মিস্টার নিলাংশ নীর চৌধুরীর?

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here