তোমার নামে আমাকে ডাকো পর্ব ১২সংযোজিত অংশ

0
225

#তোমার_নামে_আমাকে_ডাকো
#লেখিকাঃ সারজীন ইসলাম

|পর্ব-১২| সংযোজিত অংশ
জানলা দিয়ে বাগানের রংবেরঙের ফুল দেখা যাচ্ছে। মৃদু বাতাসে জানান দিচ্ছে শীতকালে কে বিদায় দিয়ে বসন্তের আগমন ঘটতে চলেছে। বসন্ত শুরুর আগেই বাড়ির গেটের পাশে থাকা মস্ত কৃষ্ণচূড়া গাছে রাশি রাশি ফুল ফুটেছে তারই এক মগডালে বসে কোকিল নিজের সুর তুলছে। প্রকৃতির এমন অতুলনীয় রূপবৈশিষ্ট্যর দিকে গুরুত্ব না দিয়ে ইধা তাকিয়ে আছে আকাশ সমান প্রশ্ন নিয়ে সামনে থাকা মানুষগুলোর দিকে। চৌধুরী বাড়ির প্রতিটি সদস্য এখানে উপস্থিত। রাহাত খান চৌধুরী দিঘী কে বলে তাজ কে এখান থেকে নিয়ে যেতে। ইধা বিস্ময় নিয়ে কিছু বলবে তার আগে হাত বাড়িয়ে রাহাত খান চৌধুরী ইধাকে তার কাছে ডাকে। রাহাত খান চৌধুরীর পাশে তার স্ত্রী এবং তার স্ত্রীর পাশে নিলাংশ নীর চৌধুরীর ফুপি ইশা চৌধুরী বসে আছে। শুধু বসে আছে বললে ভুল হবে আশা খান চৌধুরীর হাতে হাত ধরে বসে আছে। ইধা এক পলক তাকায় ওর দাদুভাইয়ের পাশে গিয়ে বসে। রাহাত খান চৌধুরী ইধার হাতটা শক্ত করে ধরে বলল,

‘ দাদু ভাই আমি জানি তুমি জীবনে কম কষ্ট পাও নি। তুমি তোমার বাবার উপর অভিমান করে এতগুলো বছর তুমি আমাদের থেকে লুকিয়ে ছিলে। এখন আমি তোমাকে এমন কিছু কথা বলব যা শুনে হয়তো তোমার দাঁড়িয়ে থাকার ভিত নাড়িয়ে দেবে। তারজন্য প্রথমেই আমি আমার ছেলের অপকর্মের জন্য তোমার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি দাদু ভাই।’

ইধা বিষ্ময় দৃষ্টিতে তাকায় রাহাত খান চৌধুরীর দিকে। তার বলা কোন কথার মানে ইধা বুঝতে পারছে না। পুরো রুম জুড়ে নিস্তব্ধতা। রাহাত খান চৌধুরী আবার ধীর গলায় বলতে শুরু করে।

‘ তোমাকে ছোটবেলা থেকে জানানো হয়েছে তোমার মা এবং মামার বাড়ির সকলে একটা বিমান দুর্ঘটনায় মৃত্যু বরণ করে। তখন তোমাকে অর্ধেক সত্য জানানো হয়েছিল। আমাদের জমিদারবাড়ির একটা প্রথা আছে, এর বাড়িতে কোনো শিশুর জন্ম হলে তার বয়স যেদিন ছয় মাস পূর্ণ হয় সেদিন দুধভাত খাওয়ানো হয়। সে অনুষ্ঠান বেশ ঘটা করে পালন করা হয়। তুমি বাড়ির বড় নাতনি হওয়ায় তোমার যখন বয়স ছয় মাস পূর্ণ হয় তখন ধুমধাম করে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানের দিন সকালবেলা আমার কাছে একটা ফোন আসে আমার বন্ধু এক্সিডেন্ট করে হাসপাতালে ভর্তি আছে। তার পরিবারের কেউ তখন দেশে ছিল না। খবর পাওয়া মাত্র ছুটে যাই সেখানে। এদিকে তোমার মুখে দুধভাতের অনুষ্ঠান সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়। অনুষ্ঠান শেষে বাড়ির বড়রা যখন আড্ডা দিচ্ছিল তখন উপরের ঘর থেকে চিৎকার চেঁচামেচি কান্নার আওয়াজ শুনে সবাই ছুটে যায় সেখানে। সবাই গিয়ে দেখে তুমি বিছানায় শুয়ে হাত-পা ছড়িয়ে কাঁদছো। ইমন কপালে রক্ত নিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে কেঁদে যাচ্ছে। ইমনের দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকালে সকলের কলিজার পানি শুকিয়ে যায়। নিলাংশ দাদু ভাই রক্তাক্ত অবস্থায় মেঝেতে সুয়ে আছে। শরীরের নানা স্থানে কাঁচ ভিদে গেছে। তা দেখে সবাই হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। তোমার মা ইমনকে ধরে বারবার জিজ্ঞেস করেছে কী করে এসব হলো? তোমার বাবার ইমন প্রথম সন্তান হওয়ায় তার প্রতি টান টাও বেশি ছিল তোমার বাবার। তোমার বাবা রেগে যায় তোমার মায়ের কর্মকাণ্ডে। ইমনের মাথায় ব্যান্ডেজ করে না নিয়ে কী অহেতুক জিজ্ঞাসাবাদ করছে। এদিকে তোমার মা রেগে চিৎকার করছে ইমনের জন্য আজ তার ভাইয়ের ছেলের এই অবস্থা। এক দুই কথায় তোমার বাবা তোমার মাকে রেগে গিয়ে থাপ্পড় দিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বলে। তোমার মাও রাগের মাথায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। এদিকে নিলাংশ দাদু ভাই কে হসপিটালে ভর্তি করানো হয়। দেশে তখন চিকিৎসাব্যবস্থা এত ভাল ছিলনা। তার উপরে দাদু ভাইয়ের মাথায় কাচ ভেঙে ঢুকে গেছিল। ডাক্তাররা পরামর্শ দেয় দাদুভাইয়ের চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিয়ে যেতে। তৌফিক আর আরমান অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার ব্যবস্থা করে ফেলে। তৌফিকের শ্বশুরবাড়ি অস্ট্রেলিয়া তাই দেরি না করে ঐদিন ই তার অস্ট্রেলিয়ার উদ্দেশ্যে দেশ ছাড়ে। তোমার বাবা জেদের বশে হসপিটালে যায়নি ঠিকই কিন্তু লোক লাগিয়ে খোঁজ নিয়েছে। ঐ লোকের মাধ্যমে জানতে পারে পরেরদিন ভোরে ফ্লাইটে অস্ট্রেলিয়া যাবে তারা। লোকটা অবশ্য মিথ্যা কথা বলেনি। তোমার মামাদের ঐ দিন ই যাওয়ার কথা ছিল কিন্তু নিলাংশ হঠাৎ আরো বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ায় ইমার্জেন্সি ঐদিনের টিকিটের ব্যবস্থা করে তৌফিক। লোকটা বলা ফ্লাইটটা অস্ট্রেলিয়া পৌঁছানোর আগে ভয়ানকভাবে ব্লাস্ট হয়ে যায়। কারো মৃতদেহ উদ্ধার করা যায়নি। কতৃপক্ষ সকলকে মৃত হিসেবে ঘোষণা করে। সেই সূত্র ধরে আমরা এত বছর যেনে এসেছি আমাদের বাড়ির বৌমা এবং তার পরিবারের সদস্যরা সকলে মৃত। তুমি রাজস্থানের যাওয়ার পরে একদিন তৌফিক আসে এ বাড়িতে। প্রথমে ওকে দেখে সকালে ভুত দেখার মত চমকে উঠে। পরে ওর কাছ থেকে সবকিছু বিস্তারিত শুনি। সব শুনে চরম ক্ষোভ আর হতাশা গ্রাস করে।’

রাহাত খান চৌধুরী একটানা কথা বলে কিছুক্ষণ থেমে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে আবার বলল,

‘ তোমার দাদিমার পাশে যে বসে আছে তিনি তোমার জন্মদাত্রী মা। এইবারের বড় বৌমা।’

সব শুনে ইধা বিস্ময়বিমূঢ় দৃষ্টিতে একবার ইশা চৌধুরীর দিকে তাকাচ্ছে আর একবার ওর দাদুভাইয়ের দিকে তাকাচ্ছে। নিজের জীবনের চরম নির্মম সত্য টা জানতে পেরেছে ইধা। নিজের কাছে নিজের অনুভূতি শূন্য লাগছে ইধার। এতদিন যা জেনে এসেছে তা মিথ্যে? ছলনা?

——————–

পশ্চিমাকাশে সূর্য হেলে পড়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সূর্যাস্ত হবে। সূর্যের রঙের আবির যেনো পুরো আকাশ জুড়ে ছড়িয়ে আছে। পুরো আকাশ জুড়ে কমলাটে রং এ নিজেকে রাঙিয়ে নিয়েছে। খোলা আকাশে তাকালে দেখা যায় পাখিরা ব্যস্ত তাদের নীড়ে ফিরতে। সূর্য তার শেষ বিকেলের উত্তাপে সবাইকে উত্তাপিত করে তুলছে। কিন্তু শৈত্য প্রবাহে সূর্যের উত্তাপ উপলব্ধি করা যাচ্ছে না। হিম বাতাসের মধ্যে শীতবস্ত্র পরিধান না করে নদীর তীরে নিদারুণ বিষন্ন মন নিয়ে বসে আছে ইধা। সব কিছু কেমন এলোমেলো হয়ে গেছে। ইধা প্রথমে এই নির্মম সত্যর কিছুই জানতো না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ইধা যখন নায়িকা হিসেবে পরিচিতি লাভ করে তখন ইধা তুষারের মাধ্যমে অর্ধেক সত্য জানতে পারে। ওর মা যে এত বছর বেঁচে ছিল তা ইধাও জানতে পারেনি। আজ এতগুলো বছর পর সত্যি জানতে পেরে খুশি হওয়ার থেকে অভিমানের পাল্লা ভারী হয়ে যায়। ইধার সমস্ত অভিযোগ আর অভিমান শুধু ওর বাবা-মা কে ঘিরে। তখন রাহাত খান চৌধুরীর সমস্ত কথা শুনে ইধা একটু টু শব্দটি ও করেনি। নিস্তব্ধ পায়ে হেঁটে গেছে নিজের রুমের দিকে। দমবন্ধ অস্থির পরিবেশে ঘিরে ধরে ইধা কে। যেনো নিঃশ্বাস নিতে অক্সিজেনের বড্ড অভাব। তাই আর এক দন্ড অপেক্ষা না বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সকলের আড়ালে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে ইধা। নিরিবিলি নির্জন পরিবেশ দেখে চলে আসো এখানে। নিজের সঙ্গে নিজেই কিছু বোঝাপড়া করা দরকার তার। নিজের অন্তরালে পাহাড় সমান অভিমান লুকিয়ে রেখেছে ইধা। অভিমানী শুধু ওই দুটো মানুষকে ঘিরে। এক সময় নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করে, কখনো কি ভাঙ্গবে এই অভিমান? নাকি গোটা জীবনটা এই মান অভিমানের খেলায় কেটে যাবে?

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here