‘ বোঝার চেষ্টা কর রুহি, পরশুদিন মুভির শুটিংয়ের জন্য আমাকে চেন্নাই যেতে হবে। অন্তত পনের দিন সেখানে থাকতে হবে। এর মধ্যে আমি কিভাবে তোর সঙ্গে অস্ট্রেলিয়া যাব বল?’
সব কথা শোনার পরে ফোনের ওপাশ থেকে রুহি মৃদু চিৎকার দিয়ে বলল,
‘ তুই নায়িকা হবি তোর ইন্ডাস্ট্রিতে। আমার কাছে না। তুই আমার কাছে সেলিব্রেটি হওয়ার আগেও যা ছিলিস এখনও তাই আছি। আমি আর বাড়তি কোন কথা শুনতে চাই না ইধা। এক সপ্তাহ পরে বাবার বন্ধুর মেয়ের বিয়েতে তুই উপস্থিত হবি অস্ট্রেলিয়ায়। তাতে যদি তোর শুটিং ক্যানসেল করতে হয়, আই ডোন্ট কেয়ার।’
এইটুকু বলে ফট করে ফোনের কেটে দেয় রুহি। ইধা কিছুক্ষণ ফোনের দিকে তাকিয়ে থেকে অস্থিরতায় ছোট নিঃশ্বাস ফেলে। ইধা খুব ভালো করে জানে রুহি মেয়েটা বড্ড অভিমানী এবং রাগী। রুহির যত রাগারাগী, অভিমান সবকিছুই ইধা কে ঘিরে। রুহি যখন একবার বলছে অস্ট্রেলিয়া যেতে হবে, তাহলে ওকে যেতেই হবে।
হলিউড কিংবা বলিউডের একজন দক্ষ অভিনেত্রী ইধা, ইধা চৌধুরী। মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে ইধা পৃথিবীর বুকে নিজের নামটা খোদাই করে লিখে ফেলেছে। প্রথম ছবিটা সুপার-ডুপার হিট হওয়ার পরে চারদিকে ইধার নাম ছড়িয়ে পড়ে। তৃতীয় ছবি করার পরে ইধা সুযোগ পায় হলিউডের মুভি করার। এরপরে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। একের পর এক হিট মুভি উপহার দিয়ে গেছেন তার ভক্তদের। তবে মুভির কন্ট্রাক্ট পেপারে সাইন করার ক্ষেত্রে ইধার কিছু শর্ত থাকে, লিপ কিস, রেপ সিন, কুরুচিপূর্ণ মর্ডান ড্রেস, অতিরিক্ত রোমান্টিক সিন এসব কিছু থাকতে পারবে না মুভিতে। তার এসব শর্তে যদি ডিরেক্টর প্রোডিউসার রাজি থাকে তবেই সে কন্ট্রাক্ট পেপারে সাইন করে। তার এই সব শর্তে কারণে অনেক ভালো ভালো মুভি করার সুযোগ হাতছাড়া করেছে ইধা। তা নিয়ে তার বিন্দুমাত্র আফসোস নেই ইধার। ইধা মনে করে এই মস্ত বড় পৃথিবীতে তার আপনজন বলতে তার বেস্ট ফ্রেন্ড রুহি এবং তার পরিবার আছে। অয়ন আহমেদ এবং নাদিয়া আহমেদের একমাত্র মেয়ে রুহানি আহমেদ। শুটিং শিডিউল ছাড়া ইধা তার পুরো সময়টা রুহির পরিবারের সঙ্গে কাটায় দিল্লিতে। ইধা কে তার কাজের জন্য সব সময় এখান থেকে ওখানে ঘুরে বেড়াতে হয়। তার জন্য রুহির বাবা-মা দুজনেই ইধার জন্য চিন্তিত থাকে। রুহির বাবা পেশায় একজন আইনজীবী। রুহির বাবা ইধার সুরক্ষার জন্য কয়েকজন দেহরক্ষী নিযুক্ত করেছে। তাদের মধ্যে তুষার সারাক্ষণ ইধার সঙ্গে ছায়ার মত থাকে। রুহির পরিবার এবং ইধা দীর্ঘ বছর ধরে ইন্ডিয়া বসবাস করে কিন্তু তাদের আদি বাড়ি বাংলাদেশ। রুহির বাবা একবার কাজের সূত্রে কলকাতায় গেলে সেখানে তুষারের সঙ্গে পরিচয় হয়। তুষারের ব্যক্তিত্বকে পছন্দ করে তিনি ইধার দেহরক্ষী হিসেবে কে নিযুক্ত করে। বর্তমানে যে মুভির জন্য কাজ করছে ইধা, তার জন্য পুরো টিমকে নিয়ে দুদিন পরে চেন্নাইতে যাওয়ার কথা। কিন্তু তার এই অভিমানী বেস্ট ফ্রেন্ড এর জন্য হয়তো এখন তাকে শুটিং শিডিউল সবকিছু ক্যানসেল করে তার সঙ্গে ছুরতে হবে অস্ট্রেলিয়ায়। ইধার ভাবনার সুতো ছিঁড়ে তুষারের কণ্ঠস্বর শুনে। ফোনটা বিছানার উপর রেখে দরজা খুলে ড্রইংরুমে যায় ইধা। ইধা এদিকে আসতে দেখে তুষার শান্ত গলায় বলল,
‘ ম্যাম আপনার শুটিংয়ের সময় হয়ে গেছে। ডিরেক্টরঃ ফোন করেছিল হাফ আন হাওয়ার মধ্যে শুটিং শুরু হবে।’
ইধা বর্তমানে শুটিংয়ের জন্য মুম্বাই শহরের নিজের আলিশান ফ্ল্যাটে থাকছে কিছুদিন ধরে। ইধা ওর হাতে থাকা ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে চিন্তিত গলায় বলল,
‘ তুমি বসো তুষার আমি ফোনটা নিয়ে আসছি। এদিকে রুহি আমার উপরে খুব ক্ষেপে আছে। দেখি ডিরেক্টরের সঙ্গে কথা বললে চেন্নাইয়ের শুটিংটা কিছুদিনের জন্য পেছানো যায় কিনা।’
কলিং বেলের শব্দে নীলা চৌধুরীর হাতের কাজ থামিয়ে পাশে থাকা মেয়েটার দিকে তাকিয়ে মৃদু স্বরে বলল,
‘ লিমা দেখ তো এখন আবার কে এসেছে?’
লিমা নীলা চৌধুরী দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ ম্যাডাম এসেছে মনে হয়।’
এইটুকু বলে লিমা গিয়ে দরজা খুলে। অতি সুন্দরী একজন মহিলা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। লিমা কে দেখে মৃদু হেসে বলল,
‘ কেমন আছিস তুই, আর বাড়ির সবাই কোথায়?’
কথাটা বলে ভদ্রমহিলা হল রুমের দিকে হেঁটে আসে। ভদ্র মহিলাকে দেখে নীলা চৌধুরী ঠোঁটে হাসি টেনে বলল,
‘ আরে ইশা এসে গেছিস তুই?’
ইশা সোফায় বসে চোখ বন্ধ করে বলল,
‘ হ্যাঁ ভাবি কিন্তু বাড়ির সবাই কোথায়? কাউকে দেখছি না যে?’
নীলা চৌধুরী মুখ বাঁকা করে বলল,
‘ তোর দুই ভাই অফিসে গেছে। মা তার রুমে আছে। রিমি সে ছাদে আছে। রনক আর রবিন ভার্সিটিতে। আর তোর আদরের দুই ছেলে এখনো পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে।’
ইশা চোখ খুলে অবাক গলায় বলল,
‘ সে কী এত বেলা হয়ে গেল এখনও তারা ঘুমাচ্ছে?’
নীলা চৌধুরী ইশার দিকে তাকিয়ে হতাশা গলায় বলল,
‘ তুই দেখে নিস ইশা আমি আমার এই দুই ছেলের যন্ত্রণা নির্ঘাত পাগল হয়ে যাব। কাল শেষ রাতে ঘুম ভাঙ্গে পানির তৃষ্ণায়। হল রুমে এসে দেখি, সোফা, কুশন সবকিছু লন্ডভন্ড করে তারা দুই ভাই মারামারি করছে। চিন্তা করে দেখ তখন বাজে রাত চারটা। তখন তারা দুজনে মারামারি করছে। পরে আমি ওদের দুজনকে ধমকে রুমে পাঠাই। কাল ওতো রাতে ঘুমানোর কারণে এখন তারা ঘুমোচ্ছে। আমার ছোট ছেলে তো বড় ছেলের থেকে বেশি বিচ্ছু। কালকে রাতে ভাইয়ার সঙ্গে মারামারি করে আবার গিয়ে ভাইয়ার বুকের উপর ঘুমিয়েছে।’
নীলা চৌধুরীর কথা শুনে ইশা শব্দ করে হেসে দেয়। ইশা হাসি থামিয়ে বলল,
‘ ওরা দু’জন তো বরাবরই এমন ভাবি। দুজনের বয়সের কতো ফারাক অথচ একজন আরেকজনের পিছে সারাক্ষণ লেগে থাকে। যাইহোক তোমাদের সবকিছু গোছগাছ হয়ে গেছে? আজকের সন্ধ্যার পরে সবাই রওনা দিবে। আমার ভাইয়াদের সঙ্গে কথা হয়েছে, তারা বলেছে এই বিয়ের জন্য জাস্ট দুই সপ্তাহ সময় দিবে।’
নীলা চৌধুরী কপট রাগ দেখিয়ে বলল,
‘ তুই তোর ভাইদের হয়ে একদম কথা বলবি না। আমার ভাইয়ের মেয়ের বিয়ে অথচ আমি এখনো যেতে পারলাম না। তাও কী না তোর বড় ভাইয়ের জন্য। আমি একবার বাপের বাড়ি যাই, তারপরে দেখি তিন মাসেও আর এ বাড়িতে ফিরব না। তখন তুই তোর ভাই কে সামনে রাখিস।’
ইশা হেসে দিয়ে বলল,
‘ তা থেকো, কেউ তোমাকে বারণ করবে না। যাই আমি ফ্রেস হয়ে আসি আর তোমার ওই বিচ্ছু দুই ছেলেকে ডেকে নিয়ে আসি।’
ইশা ফ্রেশ হয়ে ওর বড় ভাইয়ের ছেলের রুমে যায়। দরজা ঠেলে রুমে ঢুকে, পুরো রুমে একনজর চোখ বুলিয়ে ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে। পুরো রুমের অবস্থা নাজেহাল করে ফেলেছে এরা দুই ভাই মিলে। ইশা হেঁটে গিয়ে কাচের গ্লাসের উপর দিয়ে পর্দা সরিয়ে দিয়ে বিছানার দিকে তাকায়। নিলাংশের বুকের উপর ঘুমিয়ে আছে তাজ। ইশা মুচকি হেসে ওদের দিকে তাকিয়ে।
নীলা চৌধুরী এবং তৌফিক চৌধুরীর বড় ছেলে নিলাংশ নীর চৌধুরী। ছোট ছেলে তাজ চৌধুরী। নিলাংশ লেখাপড়া শেষ করে নিজের মর্জি মতো জীবন যাপন করছে। তাজ সব সে আট বছরে পা রেখেছে। তৌফিক চৌধুরীর মা হালিমা চৌধুরী, ছোট ভাই আরমান চৌধুরী তার স্ত্রী রিমি চৌধুরী। আরমান চৌধুরীর বড় ছেলে রনক চৌধুরী এবং ছোট ছেলে রবিন চৌধুরী। তৌফিক চৌধুরী এবং আরমান চৌধুরীর একমাত্র আদরের ছোট বোন ইশা চৌধুরী। এই নিয়ে তাদের সুখী পরিবার।
ইশা ধীর পায়ে গিয়ে তাজের গায়ে হাত দিয়ে মৃদু স্বরে বলল,
‘ এই তাজ ওঠ ঘুম থেকে কত বেলা হয়ে গেছে খেয়াল আছে? এই তাজ। তাজ!’
তাজ পিটপিট করে চোখ খুলে তাকায়। পাশে তার ফুপিকে বসে থাকতে দেখে ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে তোলে। ঘুমিয়ে থাকা অবস্থায় ঘুম ঘুম কন্ঠে তাজ বলল,
‘ ফুপি এক গ্লাস পানি দাও তো বড্ড তৃষ্ণা পেয়েছে।’
ইশা ছোট ছোট ছোট করে বলল,
‘ আগে ওটা ফ্রেশ হয়ে এসে তারপরে পানি খাবি।’
তাজ ইনোসেন্ট মুখ করে বলল,
‘ ততক্ষণে তোমার এই ছেলে পানির তৃষ্ণায় ছাতি ফেটে মরে যাবে ফুপি।’
ইশা ধমকের সুরে বলল,
‘ সকাল-সকাল এইসব কি কথা বলছিস তুই। মার খাবি আমার হাতে? এই নে তোর পানি। খেয়ে তারপর ফ্রেশ হয়ে আয়।’
বিছানার পাশের টেবিলের উপর থেকে পানির গ্লাস এগিয়ে দেয় ইশা। তাজ গ্লাসটা হাতে নিয়ে ওর ভাইয়ার বুকের উপর থেকে উঠে গ্লাসের সব পানি নিলাংশের জিন্সের প্যান্টের উপর ফেলে দিতে দিতে বলল,
‘ কাল রাতে আমাকে খুব মেরেছিলে ব্রো। এবার বুঝবে এই তাজ কী জিনিস।’
ইশা অবাক হয়ে বলল,
‘ এই তাজ তুই এগুলো কী করছিস? ওর গায়ে পানি ফেলছিস কেনো?’
তাজ ইশার দিকে তাকিয়ে শয়তানি হেসে নিলাংশের গায়ে ধাক্কা দিয়ে বলল,
‘ ভাইয়া, এই ভাইয়া ওঠো। দেখো তুমি কী করেছো? এত বড় ছেলে হয়ে এখনো তুমি বিছানায় ইয়ে করো। ছিঃ ছিঃ ছিঃ এ লজ্জা আমি কোথায় রাখবো?’
নিলাংশ ঘুম ঘুম চোখে উঠে তাজের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ তোর আবার কী হয়েছে সকাল সকাল?’
তাজ হেসে দিয়ে বলল,
‘ আমার আবার কী হবে? হয়েছে তো তোমার। সকাল সকাল এত বড় ছেলে হয়ে বিছানায় ইয়ে করে দিয়েছো? ছিঃ ভাইয়া ছিঃ।’
তাজের কথা শুনে নিলাংশ বিছানার দিকে তাকায়। চোখ পড়ে নিজের প্যান্টের দিকে। ব্লু রঙের জিন্সের প্যান্টটা পুরো ভিজে আছে। নিলাংশ অসহায় চোখে একবার ছোট ভাইয়ের দিকে তাকাচ্ছে আর একবার ফুপির দিকে তাকাচ্ছে। তাজের মুখ অতিরিক্ত ইনোসেন্ট বানিয়ে রেখেছে আর ফুপি বিচ্ছু তাজের কর্মকাণ্ড দেখে মুখে হাত দিয়ে সমানে হেসে যাচ্ছে।
চলবে….
#তোমার_নামে_আমাকে_ডাকো
#লেখিকাঃ সারজীন ইসলাম
|পর্ব-০১|