তোমার আমার প্রণয় পর্ব-৪০

0
4539

#তোমার_আমার_প্রণয়
#israt_jahan_arina
#part_40

আকাশটা আজ ভীষণ মেঘলা।জায়গায় জায়গায় নীলচে কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলী মতো পাকিয়ে আছে। মাহাদ বারান্দায় বসে এক দৃষ্টিতে সেই ধোঁয়া পর্যবেক্ষণ করছে।এই মেঘের ঘনত্ব কি তার মনের আকাশের মেঘের চাইতে বেশি?
গলা কেমন শুকিয়ে আছে তার।কয়েকটা ঢোক গিলে বুঝতে পড়লো মুখটা কেমন তেতো হয়ে আছে।এমন কেনো লাগছে?মন তেতো হয়ে থাকলে কি মুখ ও তেতো লাগে?
এই মুহূর্তে সে বাবাকে ভীষণ মিস করছে।আগে মা কোনো কারণ ভুল করলে বাবা সামলে নিতো।মায়ের আক্রোশ থেকে বাঁচাতো।কিন্তু আজ তার বাবাকে বলতে ইচ্ছে করছে মা কেনো আমাকে বকা দিচ্ছে না?কেনো কথা বলছে না? মারুক আমাকে।মেরে রক্তাক্ত করে দিক।

একটু আগে সে গেছিলো মায়ের রুমে।মা রুমের লাইট অফ করে জানালা পর্দা দিয়ে ঢেকে রেখেছেন।তবুও রোদের আলো রুমটাকে অনেকটাই আলোকিত করে রেখেছে।মা খাটে হেলান দিয়ে বসে আছে। মাহাদ দরজায় দাড়িয়ে আছে।আজ প্রথম মায়ের রুমে ঢুকতে তার সংকোচ বোধ হচ্ছে। মায়ের মুখোমুখি হতে ভীষণ ভয় হচ্ছে।মাকে কি জবাবদিহি করবে সে?

কাপা কাপ পায়ে সে মায়ের রুমে ঢুকে বিছানার কাছে দাড়ালো।মায়ের পায়ের কাছে বসে পায়ের পাতায় হাত বুলালো।কিন্তু মায়ের কোনো রিএকশন নেই। তিনি এক দৃষ্টিতে পাশের বালিশের দিকে তাকিয়ে আছে।সেই বালিশটা বাবার।মাহাদের হৃদয়টাকে যেনো কেউ ছুরি আঘাত করছে।বাবার অনুপস্থিতি যে মাকেই সব চাইতে বেশি পীড়া দিচ্ছে। মাহাদের দু ফোঁটা চোখের জল গড়িয়ে পড়ল আখি রহমানের পায়ের পাতায়। এতেও তার কোনো সোধ বোধ নেই। মাহাদ বলতে লাগলো

-“জানো মা, বাবা সব সময় আমাকে বলতো প্রকৃত পুরুষ তারাই যারা নিজের আপন মানুষ গুলোকে ভালো রাখে।তাদের স্বপ্ন পূরণ করে।তাদের দিকে ধেয়ে আসা সকল বিপদ নিজের দিকে ঘুরিয়ে নেয়।কিন্তু আমাকে দেখো,আমি আমার আপন মানুষ গুলোকে ভালো রাখতে পারিনি।বিপদ আমার উপর দিয়ে বয়ে গিয়ে আমার আপন মানুষ গুলিকে আঘাত করছে।ক্ষত বিক্ষত করছে।অথচ আমি আটকাতে পারছি না।তার মানে আমি প্রকৃত পুরুষ নই।আমি একটা কাপুরুষ।”

আখি রহমান কিছুই বললো না। শুধু একবার মাহাদের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন।সেই দৃষ্টি মাহাদের হৃদয়টাকে ক্ষত বিক্ষত করে দিলো।মায়ের সেই দৃষ্টি চিৎকার করে বলছিলো

-“তুই একটা খুনি।তোর বাবাকে তুই খুন করেছিস।তোর মতো নিকৃষ্ট সন্তান আর কারো ঘরে না আসুক।”

একটা দৃষ্টি কতো কথা বলে দিতে পারে। এখন তার অপরাধ বোধ আরো কয়েক গুণ বেড়ে গেলো।সে বুঝতে পারলো শুধু বাবাকে না,সে তার মাকে ও হারিয়ে ফেলেছে।

মাহাদ চেয়ে রইলো মায়ের মলিন মুখটার দিকে।এই কয়দিনে মায়ের সন্দৌর্যে যেনো ভাটা পড়েছে।চোখের নিচে কালি জমেছে।মুখটাও শুকিয়ে গেছে।চুলগুলি এলোমেলো।তার দেখা সবচাইতে সুন্দর নারী হলো তার মা।ছোট বেলায় সে নাকি তার মাকে সামনে বসিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা দেখতো।আর নাকে, মুখে, চোখে চুমু খেতো।তখন তার বাবা নাকি বলতো

-” বুজলে ম্যাডাম,আমার ছেলেও মনে হয় বউ পাগলা হবে আমার মত।”

আখি রহমান ধেত বলে উড়িয়ে দিলে তিনি বলতেন
-“আরে যে ছেলে মাকে এতো মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে দেখে
সেই ছেলে যে বউকে কতটা নেশাক্ত চোখে দেখবে সেটা বুঝা হয়ে গেছে।”

আর তার দেখা দ্বিতীয় নারী দৃশ্য।এই মেয়ের সৌন্দর্যের বর্ণনা তার কাছে নেই।তবে সে এটা নিশ্চিত তার সেই পাগল করা সৌন্দর্য একমাত্র তার চোখেই পড়ে।এই মেয়েটার চোখের পলক ফেলাটাও সৌন্দর্যে ভরপুর।আর এতো নিখুঁত ভাবে নিশ্চয়ই কেউ তার সৌন্দর্য পর্যবেক্ষণ করবে না। অন্তত মাহাদ এটা করার সুযোগ দিবে না।

মাহাদ মায়ের পায়ে কয়েকটা চুমু খেয়ে চলে এসেছে।সেখানে আর বসে থাকতে পারলো না।

মাহাদের বাড়ির সামনে দাড়িয়ে দৃশ্য কয়েকবার ঢোক গিলে নিলো।বাড়িটা কেমন নিস্তব্ধ হয়ে পড়ে আছে। শোকের ছায়া যেনো বাড়ির প্রতিটা দেয়ালে দেয়ালে ছড়িয়ে পড়েছে।তার হাত পা কাপছে।প্রথম দিন এই বাড়িতে আসার সময় সে যতটা নার্ভাস ছিলো, আজ তার চাইতে বেশি নার্ভাস আর অসস্তি ফিল হচ্ছে।অপরাধ বোধ তাকে ঘিরে ধরেছে।নিজের পরিবারে নিকৃষ্ট ব্যাবহারের জন্য এই পরিবার আদো তাকে ক্ষমা করবে?

সামসুন্নাহার বেগম সোফার রুমে বসে আছেন।হতে তার ছবির অ্যালবাম।এইখানে তার দুই ছেলের ছোট বেলার অনেক ছবি আছে।সেটা দেখছেন আর চোখের জল ফেলছেন।কোনো মা কি দুই সন্তানেরই এই করুন পরিণতি মেনে নিতে পারে?আর সবটাই হয়েছে একজনের জন্যই।
তার পাশে বসে আছে আমরিন আর মাহাদের দুই মামী।আমরিন এর চোখ ফুলে আছে।তার ফুপার মতো এতো পজিটিভ মাইন্ডের মানুষ সে জীবনে খুব কম দেখেছে।আর তিনি ছিলেন বিচক্ষণ।নাহলে যা করো চোখে পড়েনি সেটা তার চোখে কেনো পড়লো?যেই অনুভূতি গুলি সে মনের মাঝে গোপনে সংরক্ষিত করে রেখেছিল সেটা ফুপা কেমন করে বুঝে গেলো?

বেশ কিছুদিন আগে যখন দৃশ্য এই বাসায় এসেছিলো সেদিন রাতে অনুষ্ঠানের পর রাতে ফুপাকে নিজের হাতের তৈরি চা দিতে গেছিলো, সেদিন ফুপা চা নিয়ে পরম আদরে তাকে পাশে বসিয়ে কিছুক্ষণ গল্প করেছিলেন।আর এক পর্যায় বলেছিলেন

-“জানিস মা জীবনটা বড্ডো অদ্ভুত।অনেক সময় আমরা যা চাই তা পায়না।ছুটে বেড়াই মরীচিকার পেছনে।যেই জিনিস আমার না তার পেছনে ছুটে নিজের কষ্টের মাত্রা বাড়ানো নেহাত বোকামি।বরং আমাদের সেই জিনিসটাই বেছে নেওয়া উচিত যেটা আমাদের জন্য মরিয়া হয়ে উঠে।আমাদের মূল্যায়ন করে।আমাদের অনুভূতির সম্মান দিতে পারে।আর আমি জানি তুই যথেষ্ট বুদ্ধিমতী।”

কথাটা শুনে সে ভীষণ চমকে উঠেছিলো।তার ফুপা কি ইঙ্গিত দিয়েছে সেটা বুঝতে তার এক মিনিট সময় লাগলো না।
মাহাদের বড়ো মামী অনেক চেষ্টা করেও কাউকে কিছু খাওয়াতে পারেনি।শামসুন্নাহার,আখি, মাহাদ,মাহিম,আরিফ কেউ একটা দানাও মুখে তুলেনি।বাকি সবারটা বাত দিলেও শামসুন্নাহার বেগমকে খাওয়ানো অতীব জরুরী। না হলে এই বয়সে এতো ধকল সামলাতে পারবে না।আরো অসুস্থ হয়ে পড়বে।সন্তান হারানোর যন্ত্রণা আসলেই লাঘব করা অসম্ভব।
সবাই যখন নানান চিন্তায় মগ্ন ঠিক সেই সময় আগমন ঘটে দৃশ্যর।সকলেই দৃশ্যকে দেখে অবাক হয়ে যায়।এই মুহূর্তে কেউ তাকে এখনে আশাই করেনি।

দৃশ্যকে দেখেই শামসুন্নাহার বেগম তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন।এই মেয়েটার জন্য।শুধু মাত্র এই মেয়েটার জন্য আজ এতো কিছু।সেদিন দৃশ্যকে দেখে অনেক ভালো লাগলেও আজ দৃশ্যকে তার কাছে বিষের মতো লাগছে।যার পদার্পণের সাথে সাথে তার পরিবারের সব সুখ নিমিষেই ধ্বংস হয়ে গেছে।

মাহাদের মামীরাও ভীষণ ক্ষিপ্ত হলেন।আর আমরিন।তার মন চাইছে এই মেয়েটার মুখটা ঝলসে দিতে।তাহলে আর মাহাদ ভাইকে মায়ার ফাঁদে ফেলতে পারবে না।
সকলের দৃষ্টি দেখে দৃশ্য চুপসে গেলো।সামনে সকলেই তার দিকে অগ্নিকুন্ডের শিখা দুই চোখে জ্বালিয়ে রেখেছে।যেনো এক্ষনি তাকে ভৎসো করে দিবে।দৃশ্য ভীষণ ভয় পাচ্ছে।
শামসুন্নাহার বেগম চিৎকার দিয়ে বলে উঠলেন

-“ওই অলক্ষী আমার বাইত কোন সাহসে আইছস?আমার পোলারে খাইয়াও তোর মন ভরেনাই? এহন আমার নাতিরে খাইতে আইছস?”

দৃশ্যর চোখ ভিজে উঠলো।সে দাদীর কাছে এসে দুই হাত চেপে নিজের হাতে ধরে বললো
-“দাদী আমাকে মাফ করে দিন।আমাদের একটা ভুলের জন্য এতো বড়ো ঝামেলা হবে আমি বুঝতে পড়িনি?আজ আংকেল ও আমাদের মাঝে নেই।”

শামসুন্নাহার বেগম যেনো আরো তেতে উঠলেন।তিনি হাত ঝাড়া মেরে সরিয়ে নিলেন। আর বললেন

-“নাটক করবিনা জানোয়ারের বাচ্চা।আমার নাতির মাথা খাইছিস তুই।নাইলে তোর মতো কুলাঙ্গার বাপের মাইয়ারে পছন্দ করতো না।আমার সংসারের সব সুখ শান্তি তোরা নষ্ট করছিস।বহু বছর আগে আমার ছোডো পোলার জীবনেডা নষ্ট কইরা তোগো মন ভরে নাই।অহন আমার নাতির পিছে পড়ছিস।”

দৃশ্য কাদতে কাদতে বললো
-“দাদী আপনি আমাকে ভুল বুঝছেন।আমি মাহাদকে সত্যি ভীষণ ভালোবাসি।”

-“জল্লাদের বাচ্চা আমারে ভালোবাসা শিখাস?তোর বংশে মায়া মহব্বত বলতে কিছু আছে?সব হইলি শয়তান।আইজ তোর বাপের লাইগা আমার বড়ো পোলাডা মরছে।আমার বুকের মানিক আর নাই।”

এই বলে তিনি কাদতে লাগলেন। মাহাদের বড়ো মামী বললেন
-“ছি ! এর জন্যই লোক বলে জাতের মাইয়া কালো ভালো।এই মেয়ের তো জাত ঠিক নাই।যার বাপ একটা জানোয়ার তার মেয়ে কেমন হবে জানা আছে।”

দৃশ্য কাদঁছে।ভীষণ কাদঁছে।কথা গুলি বিষাক্ত লাগছে।কিন্তু তার কাছে এই কথার কোনো জবাব নেই।
শামসুন্নাহার বেগম ক্ষিপ্ত হয়ে বললেন

-“এহনি আমার বাসা থাইক্যা বাইর হ।তোর মতো অলক্ষ্মী মাইয়া যে বাড়িতে কদম ফালাইবো সে বাড়ির সুখ-শান্তি নিমিষে শেষ হইয়া যাইব।”

দৃশ্য আবারো দাদীর হাত ধরে বললো
-“দাদী আমাকে এই ভাবে তাড়িয়ে দিবেননা।আমি সব কিছু পেছনে ফেলে এসেছি।”

ঠিক এই সময় বাড়িতে প্রবেশ করে মাহাদের বড়ো মামা।দৃশ্যকে দেখে তার ভীষণ রাগ হয়।এতো কিছুর পর এই মেয়ের সাহস কি করে হয় এই বাড়িতে আসার?তিনিতো ওই আশরাফ হুসাইনকে জেলের ভাত খাইয়ে ছারতো।আমজাদ রহমান হসপিটালে থাকা অবস্থায় তিনি আশরাফের নামে মামলা করতে চেয়ে ছিলেন।কিন্তু আমজাদ রহমান তাদের সাফ শব্দে মানা করে দিয়েছেন।নাহলে এই মেয়ের চোদ্দো ঘুষ্ঠিকে তিনি জেলের ভাত খাইয়ে ছাড়তেন।তিনি রাগী গলায় বললেন

-“এই মেয়ে তুমি এই বাসায় কি করো?বের হও এক্ষনি।সাহস তো কম না তোমার।”

দৃশ্য দাদীর দিকে হাত জোড় করে বললো
-“দাদী আমি কোথায় যাবো?এটা আমার স্বামীর বাড়ি।প্লিজ আমাকে তাড়িয়ে দিবেন না।”

শামসুন্নাহার বেগম এবার যেনো নিজের রাগটা কিছুতেই সামলাতে পড়লেন না।আল্লাহ জানেন তার মধ্যে কি শক্তি ভর করেছে।তিনি দৃশ্যর গালে পর পর কয়টা চর মেরে চুলের মুঠি ধরে বললেন

-“কিসের স্বামীর বাড়ি?তোর বাপ না এই বিয়ে মনে না? তোরে নিয়া যাওয়ার লাইগা আমার পোলারে চোট দিলো?আর অহন তুই নাটক করতে আইছস?”

অনেক্ষন যাবত বাহিরে চেচা মেচির শব্দ পাচ্ছেন আখি রহমান।কিন্তু উঠে যাবার কোনো ইচ্ছে নেই।তবে এতো শব্দে আর নিজেকে সামলাতে না পেরে বেরিয়ে এলেন।আর দৃশ্যকে দেখেই চমকে গেলেন।

হটাৎ দৃশ্যর নজর পড়ে আখি রহমানের দিকে।দৃশ্য ভরসা পায়।এই মানুষটা নিশ্চয়ই তাকে বুজবে।এই মানুষটার মধ্যে সে নিজের মাকে দেখেছিল।সেদিন কত আদরে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছিলেন।কিন্তু দৃশ্যর চিন্তা ধারাকে বদলে দিলো আখি রহমানের দৃষ্টি।তার সেই কঠিন দৃষ্টি দৃশ্যকে ক্ষত বিক্ষত করে দিলো।যে দৃষ্টিতে ছিলো ঘৃণা।দৃশ্যর গায়ে হাত তোলা দেখেও তিনি সেখানেই নির্লিপ্ত ভাবে দাড়িয়ে ছিলেন।
অন্য দিকে সবাই তাকে যাচ্ছে তাই বলে যাচ্ছে।এমনকি আমরিন ও বাদ যায় নি।শামসুন্নাহার বেগম এর মধ্যে বেশ কয়েকটা চর বসিয়েছেন তার গালে।

তিনি এক প্রকার জোর করে দৃশ্যকে দরজার কাছে নিয়ে যাচ্ছেন।এই মেয়েকে তিনি এক মুহূর্তও এই বাড়িতে রাখবেনা।দৃশ্য এবার শামসুন্নাহার বেগমের পায়ে পড়ে গেলো।সে কাদতে কাদতে বললো

-“দাদী আমি আপনার পায়ে পড়ছি।এতো নিষ্ঠুর হবেননা।আমাকে একটা বার মাহাদের কাছে যেতে দিন।আমি এই সময় তার পাশে থাকতে চাই।আমারও তাকে বড্ডো প্রয়োজন।আমাকে তাড়িয়ে দিবেননা।আমার স্বামীকে ছেড়ে আমি যাবো না।”

শামসুন্নাহার বেগমের রাগে মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে।এই মেয়ের জন্য তার বিন্দু মাত্র মায়া হচ্ছে না। বরং একটা কালনাগিনী লাগছে।যার ছোবলে তার পরিবার ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। অথচ এই মেয়ে কেমন নাটক করে যাচ্ছে।এই মেয়েও বাপের মতোই শয়তান। এর ছায়াও তিনি মাহাদের উপর পড়তে দিবেননা।প্রচন্ড ক্ষিপ্ত হয়ে তিনি দৃশ্যর পেট বরাবর একটা লাথি মারে।দৃশ্য “ও মাগো” বলে পেতে হাত রেখে চিৎকার দিয়ে উঠে।শামসুন্নাহার বেগম আজ নিজের মধ্যে নেই।তিনি চিৎকার করে বলে উঠে

-“বেয়াদবের বাচ্চা বের হ আমার বাড়িত থাইকা।এই বাড়িত তোর কোনো জায়গা নাই।আমার চোখের সামনে থাইকা বের হ।”

কথাটা বলেই তিনি আরো দুইটা লাথি মারেন।যার একটা লাগে দৃশ্যর বুকে আর একটা লাগে তলপেটে।তীব্র যন্ত্রণায় দৃশ্য ফ্লোরে গড়াগড়ি করতে থাকে।দুই হাতে পেতে ঝাপটে ধরে রেখেছে মেয়েটা।

এমন কান্ডে সবাই হতবম্ব হয়ে যায়।শামসুন্নাহার বেগম এমন একটা কাজ করে বসবেন কেউ ভাবতে পারেনি।আখি রহমান নিজেও হতবম্ব।তিনি কয়েক কদম আগাতেই শুনতে পেলো মাহিমের চিৎকার।তিনি উপরে তাকিয়ে দেখলেন মাহিম ভাবী বলে ডাকতে ডাকতে সিড়ি বেয়ে নিচে নামছে।আর মাহাদ সিড়ির ধরে ঠায় দাড়িয়ে আছে।কেমন পথন বনে গেছে মাহাদ।এক দৃষ্টিতে দৃশ্যর দিকে তাকিয়ে আছে।আখি ভাবলো কখন আসলো মাহাদ?

মাহিম নিজের রুমের বারান্দায় বসে ছিলো।বাবাকে ছাড়া দিন গুলি কেমন বিষাদ লাগছে।বাবা যে মন ভালো করার ঔষধ। হঠাৎ নিচ থেকে অনেক শব্দ শুনতে পেয়ে রুম থেকে বের হয়ে দেখলো তার ভাই সিড়ির ধরে দাড়িয়ে আছে।একদম পাথরের মতো।হয়তো এই দুনিয়াতে নেই।সে দ্রুত সিড়ির কাছে আসতেই দেখলো দৃশ্য ফ্লোরে পড়ে আছে আর তার দাদী একটা লাথি মারলো।যেহেতু দৃশ্য পেটে হাত রেখে ছিলো তার মানে দাদী আগেও লাথি দিয়েছে।এটাই প্রথম না।সে আর ভাবতে পারলো না।চিৎকার দিয়ে নিচে চলে আসলো।দৃশ্যর কাছে এসে ফ্লোরে বসে পড়লো।আর বলতে লাগলো

-“ভাবী তুমি ঠিক আছো?বেশি খারাপ লাগছে?দাদী তোমার মাথা ঠিক আছে?ভাবির গায়ে কেনো হাত তুলছো?”

মাহিমের মুখে ভাবী শুনে শামসুন্নাহার বেগম রেগে গেলেন।আর বললেন
-“খবর দার ওরে ভাবী কবি না। এই জানোয়ারের বাচ্চার কোনো যোগ্যতা নাই এই বাড়ির বউ হওয়ার। এহনি বের হইতে ক।”

-“দাদী তুমি পাগল হয়ে গেছো?ভাবী এই বাড়ির বউ।তুমি তাকে এই ভাবে আঘাত করতে পারো না।সে কোথাও যাবে না।”

-“ভালোই জাদু জানিস মাইয়া।আমার পোলাগো আর নাতি দুইডারে বস কইরা ফালায়ছস।”

-“দাদী চুপ করো।”

আখি রহমান আর দাড়িয়ে থাকতে পারছেন না।আজ কেনো যেনো দৃশ্যর প্রতি তার মায়া কাজ করছেনা।এই মেয়েটার জন্য আজ তার স্বামী তার কাছে নেই।তিনি মাহাদের দিকে তাকালেন। মাহাদের দৃষ্টি মায়ের দিকে।যে দৃষ্টি বলছে মা ওর কষ্ট হচ্ছে।দাদীকে থামাও।কিন্তু তিনি কিছুই বললেন না। বরং আরো কঠিন দৃষ্টিতে মাহাদের দিকে তাকালেন।তার দৃষ্টি কঠিন হলেও চোখে ঝরছে অশ্রু।তারপর নিজের রুমে চলে গেলেন।

মায়ের চোখের জল মাহাদের অন্তর আত্তাকে নাড়িয়ে দিলো।তার পুরো শরীর কাপছে।

দৃশ্যর নজর পড়ল মাহাদের দিকে। মাহাদের জির্ণ শীর্ণ চেহারা দেখে মুহূর্তেই দৃশ্য নিজের পেটের বেথা ভুলে গেলো।ইসস কি হাল হয়েছে মানুষটার। এলোমেলো চুলে মাহাকে বেমানান লাগছে।মন চাইছে হাত দিয়ে চুল গুলি ভাঁজ করে দিতে।চোখ গুলো ফোলা।সে কষ্টে জোড়ে কাদতে লাগলো।আর বললো

-“মা.. মাহাদ! মাহাদ দেখো আমি চলে এসেছি।দাদীকে বোঝাও না একটু।”

মাহাদ নিচে নেমে আসলো।দৃশ্যর সামনে দাড়ালো।হাত ধরে দার করিয়ে দিলো দৃশ্যকে।দৃশ্য ব্যাথায় কুকিয়ে উঠলো।কিছুতেই দাড়িয়ে থাকতে পারছে না।পড়ে যেতে নিলে মাহাদ দ্রুত তাকে কোলে তুলে নেয়।

এই দৃশ্য দেখে শামসুন্নাহার বেগম প্রচন্ড রেগে গেলেন।আর বললেন
-“ছি মাহাদ! লজ্জা করেনা তোর?আবার এই মাইয়ার জালে ফাইসা গেলি?এই মাইয়ার লাইগা তোর বাপ আজ নাই।আমাদের কইলজাডা আজ মাডির নিচে।আর তুই এই বেহায়া মাইয়ারে এই বাড়িতে তুলবি?নিজের মায়ের লাইগা মায়া লাগে না?এই মাইয়ার লাইগা আজ তোর মা বিধবা।আর তুই কিনা ছি!!তুই একটা কুলাঙ্গার।”

বিধবা শব্দটা মাহাদের বুকে তীরের নেয় বিধলো।বুকে রক্তক্ষরণ হলো।তার চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো।সে কাউকে আর কিছু না বলে দৃশ্যকে নিয়ে সোজা বাসা থেকে বেরিয়ে আসলো।

দৃশ্য মাহাদকে ঝাপটে ধরে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।নিজেকে নিরাপদ মনে হচ্ছে।পেটের ব্যাথাকে আর বেথা মনে হচ্ছে না।সে তার স্বামীর কোলে আছে।তার বুকের কাছে আছে।আর কি লাগে? বাকি দুনিয়া যা খুশি বলুক।এই মানুষটা পাশে থাকলে সে সব হজম করে নিবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here