তোমার আমার প্রণয় পর্ব-২০

0
4557

#তোমার_আমার_প্রণয়
#israt_jahan_arina
#part_20

সারাদিনের ক্লান্তি শেষে পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়েছে রক্তিম লাল সূর্য।বাহিরে আবছা অন্ধকার পেরিয়ে রাত নামতে শুরু করেছে।সেই সাথে ভয় বাড়ছে তমার।বিকেলে বেরিয়েছিল বান্ধবীর বাসায় জন্মদিন আছে বলে।তবে অনুষ্ঠান শেষ হতে হতে অনেকটা দেরি হয়ে গেলো।পরনে তার সবুজ শাড়ি।সব বান্ধবীরা মিলে প্ল্যান করেছে শাড়ী পড়বে।তাছাড়া স্কুল শেষ করে কলেজে উঠে গেছে।অনেক বান্ধবীরাই অন্য কলেজে ভর্তি হয়েছে।সময়ের ব্যবধানে হয়তো সবাই ছিটকে পড়তে পারে।তাই নিজের বেস্ট ফ্রেন্ড আফ্রার জন্মদিন উপলক্ষে সব ফ্রেন্ডরা মিলে একটু হাঙ্গআউট এর ব্যাবস্থা করেছে।মা বার বার বলে দিয়েছে সন্ধ্যার আগে ফিরতে।কিন্তু দেরি হয়ে গেলো।

এলাকায় ঢুকে সে দ্রুত হাঁটতে লাগলো।তবে তার সারা শরীর কেমন ছমছম করছে।সে যেই গলিতে ঢুকেছে সেটা সন্ধ্যা হওয়ার পর পরই অন্ধকার হয়ে যায়। তমার মনে হচ্ছে তার পেছনে আরো একজোড়া পা তার সাথে চলছে।তার শরীর কেমন কাঁপতে শুরু করেছে।

মেয়েদের সিক্স সেন্স অনেক প্রখর। একটা ছেলে এক মাইল দূর থেকে কোনো মেয়ের দিকে তাকালে সে মেয়েটা সেটা বুঝতে পারে। তবে খারাপ নজর গুলি বোধহয় একটু বেশি টের পায়। এটা মেয়েদের বিশেষ গুন।হয়তো মেয়েরা যাতে নিজেকে প্রোটেক্ট করতে পারে তাই এই গুণটি দেওয়া হয়েছে।

তমা দ্রুত হাঁটতে শুরু করল। তবে শাড়ি পরার কারণে খুব একটা সুবিধা করতে পারছে না। ভয়ে পিছন দিকে তাকাতে পারছে না। কিছু দূর হাঁটার পর হঠাৎ সেই পা জোড়ার মালিক তার সামনে চলে আসলো। তমা আচ্ছা আলোতে দেখতে পারলো ছেলেটা রকি। তমার আত্মা যেন শুকিয়ে আসলো। এই ছেলেটাকে তমার একদমই সহ্য করতে পারেনা। নিজে বহুবার দেখেছে এলাকার বিভিন্ন মেয়েদের ইভটিজিং করতে। এরকম একটা অসভ্য ছেলের সাথে ফাহিম ভাইয়া কিভাবে যে চলতে পারে সেটা তার মাথায় আসেনা। হঠাৎ রকি বলে উঠলো

-“এই তোমার নাম তমা, তাইনা?”

রকির কথায় তমার ভ্রু কুঁচকে আসলো।সে বললো
-“আপনি আমার নাম কি করে জানলেন?”

-“আরে এই আশেপাশের এলাকার সব মেয়েদের নাম আমার জানা আছে।”

-“সামনে থেকে সরে দাঁড়ান আমার দেরি হচ্ছে।”

-“বাড়ি যাবে তো, আগে একটু নাম্বারটা তো দিয়ে যাও।”

বিরক্তিতে তমার মাথা ধরে আসলো। ঝাঁজালো কন্ঠে বললো
-“আপনাকে আমি নম্বর দিব কেনো? আর আপনি কোন ক্যাটাগরির ছেলে সেটা আমার জানা আছে।”

রকি এবার কিছুটা অপমান বোধ করল। তাই বললো
-“আমার সম্পর্কে তো মনে হয় সবই জানো তাহলে এত নাটক করে লাভ নেই। জলদি নাম্বারটা দাও।”

-“আপনার মত একটা ছেলেকে আমি আমার নাম্বার দেবো আমাকে কি পাগলা কুত্তা কামড়েছে?”

-“আরে বাপরে তোমার তো দেখি সেই তেজ। অবশ্য তেজী মেয়ে আমার ভালই লাগে। আর সেটা যদি তোমার মত এমন হট হয় তাহলে তো কথাই নাই।”

তমার এবার রাগে মাথা ফেটে যাচ্ছে।সে রেগে বললো
-“আমার রাস্তা ছাড়ুন। আপনার মত একটা অসভ্য ইতর লোকের সাথে কথা বলার চাইতে রাস্তার কুত্তার সাথে কথা বলা হাজারগুন ভালো।”

রকি এবার প্রচন্ডভাবে রেগে বললো
-“আরে একটু হট বলেছি বলে এত রেগে যাচ্ছিস। যখন তোর মত হট মালকে ছুয়ে দেখবো তখন কি করবি?”

প্রচন্ড রেগে তমা রকির গালে একটা চড় বসিয়ে দিল আর বললো
-“তোদের মত অসভ্য ইতর গুলোকে তোদের বাবা-মা জন্মের সময় গলা টিপে মেরে ফেলে না কেন? তাহলে অন্তত সমাজ থেকে একটা কিট কমে যেতো।”

তমার দেওয়া চড়টা রকি ঠিক হজম করতে পারলো না। প্রচন্ড রেগে সে তোমার চুলের মুঠি ধরে বললো

-“তোর এত তেজ, আজ তোর সব তেজ আমি শেষ করবো।”

কথাটা বলেই অন্য হাতে তমাকে গলির পাশের নির্জন একটা জায়গায় টেনে নিয়ে আসলো আর শাড়ির আঁচল টেনে ফেলে দিল। পরক্ষনেই তমা দুই হাত আঁকড়ে নিজেকে ঢাকার চেষ্টা করছে। তার মনে হচ্ছে আজই তার জীবনের শেষ দিন। ভয়ে আতঙ্কে পুরো শরীর থরথর করে কাঁপছে।তবে কি সে তার নিজের সবচেয়ে বড় সম্পদ হারিয়ে ফেলবে?রকি এতক্ষণে তমাকে বেশ কয়েকটি থাপ্পড় দিয়ে দিল। তমার ঠোঁট কেটে রক্ত বেরুতে লাগল।নির্জন এই রাস্তাটিতে কিশোরী মেয়েটি আর্তনাদ করে উঠলো। কিন্তু সেই আর্তনাদ কি আদৌ কেউ শুনতে পাচ্ছে?নিজেকে রক্ষার চেষ্টা চলছে তার।

রকি এক টানে তমার গা থেকে শাড়িটা টেনে খুলে ফেললো। তমা যেনো এবার নিজের শরীরে বিন্দুমাত্র শক্তি অনুভব করতে পারছে না। দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে মাটিতে পড়ে গেল। জীবনের এই মুহূর্তে এসে একটা মেয়ে ঠিক কি অনুভব করতে পারে সেটা আসলেই কেউ কল্পনা করতে পারবে না। সামনে থাকা রকি কে তার এই মুহূর্তে এক ভয়ঙ্কর জানোয়ার মনে হচ্ছে। যে এখন তাকে ছিঁড়ে খুবলে খাবে। চোখের সামনেই একবার ভেসে উঠলো বাবা মা আর ফাহিমের মুখ। আচ্ছা সে যদি আজ মারা যায় তবে কি ফাহিম কোনদিন জানতে পারবে না কেউ একজন তাকে পাগলের মত ভালবাসতো?

রকি তার দিকে আরো এগিয়ে আসলো। যখন শরীরে হাত দেবে ঠিক এমন সময় হঠাৎ রকি আর্তনাদ করে উঠলো। তমা দেখতে পেলো রকি পাশের দেয়ালে প্রচণ্ড আঘাত পেয়ে পড়ে আছে। এক মুহূর্তের জন্য তমার মনে হল সে সবকিছু কল্পনা করছে। না হলে ঠিক বাঘের থাবার মুখ থেকে জীর্ণশীর্ণ হরিণকে বাঁচিয়ে আনা নিতান্তই অসম্ভব। আচ্ছা কোন সুপার হিরো চলে এলো নাতো? সে চোখ তুলে সামনে তাকাতেই দেখতে পেল অতি প্রিয় মানুষটির সামনে দাঁড়িয়ে। ফাহিমের চোখ দিয়ে যেন রক্ত ঝরছে। একপলক তমাকে দেখে রকিকে ইচ্ছেমত মারতে শুরু করলো। আর বলতে লাগলো

-“কুত্তার বাচ্চা। তোর সাহস কেমনে হলো ওর গায়ে হাত দেওয়ার? তোরে বলছিনা ওর থেকে দূরে থাকতে। জানোয়ারের বাচ্চা! আমার এলাকায় ঢুকে মেয়েদের দিকে বাজে নজরে তাকাস।”

ফাহিম উন্মাদের মত রকিকে মেরেই চলছে। তমার মনে হল ফাহিম কোন সুপারহিরো থেকে কম নয়। সে তো আসলেই তার হিরো। সে কাঁপা গলায় বলে উঠলো

-“ফাহিম ভাইয়া!”

ফাহিম দ্রুত তমার দিকে এগিয়ে আসলো। তমার অবস্থা দেখে চোখ ফিরিয়ে নিলো। পাশেই দেখতে পেলো তমার শাড়িটা পড়ে আছে। দ্রুত সেটা হাতে নিয়ে তমার গায়ে জড়িয়ে দিল। তখন তমার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করলো

‘ফাহিম ভাই আপনি আমার জন্য ফেরেশতা হয়ে এসেছেন।আপনার সকল গুন্ডামি কে আমি আজ থেকে মেনে নিলাম।এইযে আপনি আমার শরীরে শাড়ী না দেখে চোখ ফিরিয়ে নিলেন,তাই আজ থেকে আমার শরীর থেকে শাড়ী খোলার অধিকার শুধু আপনাকে দিলাম।এই শরীর ছোঁয়ার অধিকার শুধু আপনার।আমার জীবনে আপনার মত একটা গুন্ডার প্রয়োজন।ভীষণ প্রয়োজন।’

তবে তমা বলতে পারলো না।তবে এবার আর নিজেকে আটকে রাখতে পারেনি। ফাহিমকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করলো। এই মুহূর্তে তমাকে কী বলে সান্ত্বনা দেওয়া উচিত তা ফাহিমের জানা নেই। সিগারেট খেতে বের হয়েছিল বাসা থেকে। পাশের গলিতে কিছু শব্দ শুনেই এখানে এসে দেখতে পেলো রকি আর তমাকে।

বাসার কলিং বেলের শব্দ পেয়ে দৃশ্য গেল দরজা খুলতে। দরজা খুলতেই সে কিছুটা চমকে উঠলো। ফাহিমকে বিক্ষিপ্ত দেখাচ্ছে। হাতের জায়গায় জায়গায় রক্ত লেগে আছে। দৃশ্যর বুঝতে বাকি রইল না আজও তার ভাই কোথাও ঝামেলা করে এসেছে। এ আর নতুন কি? আনিকা কবির ছেলের এই অবস্থা দেখে ছেলেকেই বকতে শুরু করলেন। ছেলের মধ্যে তিনি স্বামীর প্রতিচ্ছবি দেখতে পান। বিয়ের পর তিনি মানুষটাকে খুব শান্ত ভাবলেও মানুষটা মোটেও এতটা শান্ত ছিলো না। প্রায় সময়ই ঠিক এমনভাবেই বাইরে নানান ঝামেলা করে বাসায় ফিরতেন। আনিকা কবির বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলে তার সাথে খুব বাজে ব্যবহার করতেন।

আজকাল ছেলে মেয়ে বড় হয়ে যাওয়ায় তার মধ্যে অনেক গাম্ভীর্যতা চলে এসেছে। ছেলে মেয়ের সামনে তিনি স্ত্রীর সাথে খুব একটা বাজে ব্যবহার করেন না।
ফাহিম কে নিয়ে তার ভয় হয়। ছেলেটা কি শুধুমাত্র বাবার স্বভাবটাই পেলো, তার স্বভাবের কোন অংশ কি ছেলের মধ্যে নেই?
দৃশ্য ভাইয়ের হাত তুলো দিয়ে পরিষ্কার করছে আর বলছে

-“আচ্ছা ভাইয়া তুমি এত ঝামেলা করে কি ক্লান্ত হওনা? তোমারে বন্ধু সারকেল আমার একদম পছন্দ না। রিজভী ভাইয়া ছাড়া বাকি সবগুলোকেই আমার ভীষণ বিরক্ত লাগে। এদের সাথে থেকে থেকে তুমি একদম পাতি মাস্তান হয়ে গেছো।”

দৃশ্যের কথা শুনে রেগে ফাহিম বললো
-“তোর সাহস তো কম না তুই আমাকে পাতি মাস্তান বলিস? দেখিস তোকেও এক গুন্ডার সাথে বিয়ে দিব।”

দৃশ্যও মুখে ভেংচি কেটে বললো
-“আমি কেন কোন গুন্ডাকে বিয়ে করতে যাব। আমিতো ধূসর চোখের কোন রাজপুত্রকে বিয়ে করব। যে আমাকে ভীষণ আদর যত্নে রাখবে।তবে আমার তো তমার আপুর জন্য ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।”

তমার কথা শুনে ফাহিমের মুখটা মলিন হয়ে গেল। ছোট থেকে বড় হতে দেখেছে মেয়েটাকে। তাছাড়া রফিক চাচার একমাত্র মেয়ে তমা। আর আজ যদি তমার কিছু হয়ে যেতো তাহলে, বাকিটা সে আর ভাবতে পারছে না।

পর দিন সন্ধ্যার দিকে দৃশ্য বসে বসে ফেইসবুক এ স্ক্রল করছিলো। হঠাৎ মাহাদের কল আসায় দৃশ্যর মুখে অমায়িক হাসি ফুটে উঠলো। সে কলটা রিসিভ করে বললো
-“কি এতক্ষণে মনে পড়লো আমার কথা?”

-“জি না ম্যাডাম আপনার কথা আমার মাথায় সারাক্ষণই থাকে। আচ্ছা তোমাদের এলাকায় এতো মশা কেনো? পাঁচ মিনিটেই আমাকে জামাই আদর শুরু করে দিয়েছে।”

মাহাদের কথা শুনে দৃশ্য অবাক হয়ে এক দৌড়ে বারান্দায় চলে গেলো। বারান্দায় আসতেই দেখতে পেলো মাহাদ তাদের বাসার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। কাধে একটা ব্যাগ ঝোলানো।দৃশ্যকে দেখেই হাত নাড়িয়ে হ্যালো জানালো। মাহাদ মুচকি হেসে বললো

-“আমার পিচ্চি পাখিটা তো দিন দিন অনেক ইন্টেলিজেন্ট হয়ে যাচ্ছে। আমি বলার আগেই বুঝে গেল যে আমি তার বাসার সামনে।”

-“ফালতু কথা রাখো। তুমি এই রাতে এখানে কি করছো? ভাইয়া বা অন্য কেউ দেখলে কিন্তু খবর আছে।”

দৃশ্য কথা শুনে মাহাদের মুখ কিছুটা মলিন হয়ে গেলো। পরমুহুর্তেই মুচকি হেসে দৃশ্যর দিকে তাকিয়ে বললো

-“দেখলে দেখবে। এলাকার জামাই এসেছে সবার জানা উচিত না?”

দৃশ্যর মন চাইছে তার বারান্দার একটা টপ মাহাদের মাথায় ছুড়ে মারতে। এখানে সে ভয়ে কাতর আর সেখানে সে কিনা মজা নিচ্ছে। দৃশ্য বললো

-“তুমি ব্যাগ কাঁধে কোথায় যাচ্ছ?”

-“জানপাখি আজকে রাতের বাসে ঢাকায় যাচ্ছি। তাইতো আমার পিচ্চিকে একনজর দেখার জন্য চলে এলাম।”

মুহূর্তেই দৃশ্য মন খারাপ হয়ে গেল। মাহাদ রাজশাহীতে আসলে দৃশ্য ঠিক যতটা খুশি হয় সে যাওয়ার সময় সে ঠিক ততটাই কষ্ট পায়।দৃশ্যর মন খারাপ দেখে মাহাদ একটা ফ্লাইং কিস ছুঁড়ে দিল। আর বললো

-“সাবধানে থেকো পিচ্চি। আমার পরীক্ষার জন্য হয়তো বেশ কিছুদিন আসতে পারব না। তাই অবশ্যই নিজের খেয়াল রাখবে। আর কল করলে যেন পাই মনে থাকবে?”

এতক্ষণ এই দৃশ্যের চোখ ভিজে উঠেছে। সে কিছুই বলতে পারোল না শুধু মাথা নেড়ে হ্যা জানালো। ভীষণ ইচ্ছে করছে দৌড়ে মাহাদকে একবার জড়িয়ে ধরতে। নিশ্চয়ই তখন মাহাদ পরম আদরে তার কপালে চুমু খেতো। আর সে হারিয়ে যেত সে ধূসর চোখ জোড়ার। এই মানুষটার সবকিছুই দৃশ্যর ভীষণ ভালো লাগে। আদর শাসন সবকিছুতেই যেন অসম্ভব ভালোবাসা লুকিয়ে থাকে। ভালোবাসাটা নিশ্চয়ই কোন আর্ট। যেটা মাহাদ খুব ভালো পারে। অসম্ভব ভালবাসায় জড়িয়ে রাখে সারাক্ষণ।

তার জীবনের প্রথম পুরুষ মাহাদ। এটাই যেন তার জীবনের শেষ পুরুষ হয়।

কেটে গেল বেশ কয়েকটা দিন। দৃশ্য ও নিজে লেখাপড়া নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। সাইন্স নিয়ে সে কি যে বড় ভুল করেছে তা এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। এই কঠিন কঠিন সাবজেক্ট গুলো কিভাবে পড়বে মাথায় ঢুকছেনা। তাকে যে কোন কুত্তা কামড়ে ছিলো, না হলে কি সে সাইন্সে নিতো?

মাহাদের সাথে তার দেখা হয় না বেশ কয়েকদিন। মাহাদের পরীক্ষা চলছে তাই দেখা করতে পারছে না। দৃশ্য দের বাসায় তার ছোট মামা বেড়াতে এসেছেন। তারা ঢাকায় থাকেন। তার মামাতো বোন লাবিবা আপু আর রামিশাও এসেছে। লাবিবা আপু এবার ঢাকা ভার্সিটিতে পড়ছেন। ভীষণ ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট। রামিশা এবার ক্লাস সেভেনে। আজ অনেকদিন পর ছোটমামা তাদের বাসায় বেড়াতে এসেছেন। সারাটা দিন তার কাটে লাবিবা আপু আর রমিশার সাথে গল্প করে। লাবিবার সাথে তার ভীষণ মিল। এই মানুষটার সাথে মন খুলে কথা বলা যায়। দৃশ্য কে আপন ছোট বোনের মতই ভালোবাসে। লাবিবার কাছে দৃশ্য একটা ছোট্ট পুতুল মনে হয়। যে কিউট পুতুলকে নিয়ে শুধু আদর করতে মন চায়।

দুইদিন থেকে তারা চলে গেলেন ঢাকায়। সাথে নিয়ে আসলেন দৃশ্য কে। অনেকদিন ধরে সে ছোটমামার বাসায় আসে না। তাই লাবিবা আপু জোর করেই দৃশ্য কে নিয়ে এসেছে। দৃশ্যর বাবা অবশ্য রাজি ছিলেন না। পরে ফাহিম ভাইয়াকে অনেক কষ্টে রাজি করিয়ে বাবার কাছ থেকে অনুমতি নিয়েছে।

আজ দৃশ্য লাবিবার সাথে এসেছে তার ভার্সিটিতে। বাসায় থেকে থেকে সে ভীষণ বোর হচ্ছিলো। তারা পৌঁছালো কলাভবনে।দৃশ্য আশেপাশে চোখ বুলাচ্ছে। চারপাশের পরিবেশ ভীষণ পছন্দ হয়েছে তার। সে তো অত ভালো স্টুডেন্ট না যে এই কলেজে জীবনে চান্স পাবে। মনে হয় না তার পক্ষে এটা সম্ভব। দৃশ্য চারদিকে দেখতে শুরু করল। তোর চোখ দুটো খুঁজছে অন্য একজন মানুষকে। মাহাদকে কিছু জানায়নি যে সে ঢাকায় এসেছে। মূলত সে মাহাদকে একটা সারপ্রাইজ দিতে চাচ্ছে।
লাবিবা বললো

-“কিরে দৃশ্য কেমন লাগছে আমাদের ভার্সিটি?”

-“ভীষণ সুন্দর আপু। চারদিকে ভীষণ মনমুগ্ধকর। ইসস আমিও যদি এই ভার্সিটিতে চান্স পেতাম না তাহলে সেই মজা হত।”

-“ভালোভাবে লেখাপড়া কর দেখবি ঠিক পেয়ে যাবি।”

-“আর চান্স? আমারতো সাইন্সের সাবজেক্ট দেখলেই মাথা ঘুরায়।”

-“আরে ব্যাপার না আস্তে আস্তে দেখবি ঠিক হয়ে যাবে। জানিস এখানকার আকর্ষণীয় জিনিস কি?”

-“কি?”

-“হাকিম চত্বরের পাকোড়া আর ভুনা খিচুড়ি। তোকে আজ খাওয়াবো দেখবি ভীষণ মজা।”

-“তাই নাকি আমিতো তাহলে অবশ্যই খাবো।”

-“তবে এই ভার্সিটির সবচেয়ে আকর্ষণীয় জিনিস টা দেখবি?”

-“সেটা কি?”

-“চল দেখাই।”

একথা বলেই লাবিবা আপু দৃশ্যর হাত ধরে সামনে এগিয়ে গেলো।দৃশ্যর অবশ্য এই আকর্ষণীয় জিনিস দেখার খুব একটা ইচ্ছা নেই। সে তো তার কাঙ্খিত মানুষটিকে কখন থেকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। কিন্তু মহাশয়ের দেখাই পাচ্ছে না। লাবিবা একটা জায়গায় এসে থামলো আর দৃশ্য কে বললো

-“আমাদের ভার্সিটির সবচেয়ে আকর্ষণীয় জিনিস টা হলো ওই যে ঐখানে?”

দৃশ্য সেদিকে তাকিয়ে স্তব্ধ হয়ে গেল। সে যাকে এতক্ষণ ধরে খুঁজে বেড়াচ্ছে সেই মানুষটা এখানে গিটার হাতে গান গাইছে। সাথে আরো কয়েক জন গিটার বাজাচ্ছে। আর তার চারপাশে ঘেরাও করে বেশ কয়েকজন বসে আছে। আশেপাশের অনেক ছেলেমেয়েরাই দাঁড়িয়ে তার গান শুনছে। কতগুলো মেয়ে হা করে মাহাদকে গিলে খাচ্ছে।দৃশ্যর এবার মেজাজ খারাপ হচ্ছে। ও কোন ছেলের সাথে কথা বললেই তাকে আচ্ছা মতো বকা দেয়। আর নিজে হাজারো মেয়ের সাথে বসে গানের আসর জমায়।দৃশ্য কে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে লাবিবা মুচকি হেসে বললো

-“কি টাশকি খেয়ে গেলি তো? এই ছেলে হচ্ছে এখন আমাদের ভার্সিটির প্রধান আকর্ষণ। সব মেয়েরাই এই ছেলেকে দেখে ক্রাশ খেয়ে বসে আছে। এই ছেলে যখন গান গায় ভার্সিটি সব মেয়েরা হা করে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। আমি কিন্তু ছোট খাট একটা ক্রাশ খেয়েছি। কি কিউট ছেলেটা তাই না? জানিস আমাদের ভার্সিটির সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে ইবদিতা এই ছেলেকে বেশ কয়েকবার প্রপোজ করেছে। শুধু ইবদিতা কেনো, কত মেয়ে যে এই ছেলেকে প্রপোজ করেছে তার ঠিক নাই।”

কথাগুলো শুনে দৃশ্যর মেজাজ গরম হয়ে যায়। মন চাইছে মাহাদের চুল টেনে ছিড়ে ফেলতে। লাবিবা আবার বলতে শুরু করলো।

-“তবে এই ছেলের ভাব অনেক। কোন মেয়েকে পাত্তা দেয় না। ইবদিতা তো অনেকদিন ধরেই মাহাদের পেছনে পড়ে আছে। মেয়েটাকে দেখলে বলবি আগুনঝরা সুন্দরী।”

দৃশ্য মনে একরাশ ভয় জমা হতে লাগলো। হাজারো সুন্দরীর মাঝে মাহাদকে হারিয়ে ফেলবে না তো? হঠাৎ লাবিবা বললো

-“দৃশ্য দেখ আমি এতক্ষণ এই মেয়েটার কথাই বলছিলাম।”

দৃশ্য দেখলো একটা প্রাইভেট কার থেকে একটা মেয়ে নেমে এদিকেই আসছে। মেয়েটার ড্রেসআপ দেখলেই বোঝা যায় সে ভীষণ স্মার্ট। লাবিবা আপু যা বলেছে তা একদম সত্যি। মেয়েটা আসলেই আগুনঝরা সুন্দরী।দৃশ্যর কেন যেন নিজেকে ভীষণ ছোট মনে হতে লাগলো। এই মেয়ের সামনে দৃশ্য কিছুই না।দৃশ্যর পৃথিবীটা অনেক ছোট। কিন্তু এই জায়গায় মাহাদের পৃথিবীটা অনেক বড়। সেখানে কি দৃশ্যর জায়গা হবে? মাহাদ কি এই সাধারণ দৃশ্যর পাশে সারা জীবন থাকবে?

এতক্ষণে মাহাদের গান শেষ হয়েছে। চারদিকে সবাই করতালিতে চারপাশ মুখরিত করে তুলেছে। সে শব্দে দৃশ্য ভাবনার জগত থেকে বেরিয়ে আসলো। গান শেষ হতেই মাহাদ সবার সাথে হাসিমুখে কথা বলতে লাগলো। অনেক মেয়েরাই তার সাথে ঘেঁষে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। কয়েকটা মেয়ে সেলফি তুলছে। দৃশ্য মন চাইছে এই মেয়েগুলোর চুল টেনে মাথা টাক করে ফেলতে। দৃশ্য মোটেও সহ্য করতে পারছে না মাহাদের আশেপাশের মেয়েগুলোকে। আচ্ছা দৃশ্য যদি এখন মাহাদের সামনে দাঁড়ায় তাহলে কি মাহাদ না চেনার ভান করবে? দৃশ্য যেন আর কিছুই ভাবতে পারছে না। দৃশ্যর মনে ভীষণ ভয় কাজ করছে মাহাদকে হারাবার ভয়।

ইবিদিতা মেয়েটা এসেই মাহাদের সাথে কি যেন বলছে। মাহাদ ও মুচকি হেসে কথা বলছে। তার শরীর কাঁপতে শুরু করল। এখন মনে হচ্ছে এখানে না আসলেই বোধহয় ভাল হত। কেন আসলো সে এখানে?

হঠাৎই লাবিবা দৃশ্যর হাত ধরে সামনে এগুতে লাগলো। দৃশ্য এখনো তার ভাবনার জগতে আছে।

মাহাদ এতক্ষণ সকলের সাথে হেসে কথা বলছিল। মাঝে মাঝেই এই খোলা আকাশের নিচে তাদের গানের আসর বসে। এখানে এসে তার ছোটখাটো একটা ব্যান্ড তৈরি হয়েছে। প্রায় বিকেলে তারা এখানে গানের আসর বসায়। আজও সেভাবেই এখানে গানের আসর বসিয়েছে তারা।

এত মানুষের ভিড়ে হঠাৎ মাহাদের চোখ গেল সামনের দিকে। হাজার কেনো কোটি মানুষের ভীড়েও মাহাদের চোখ ঠিক এই জায়গাতেই এসে আটকাবে। কারণ এটা যে তার প্রাণ।তার প্রিয়সি। তবে সে কি ভুল দেখছে? দৃশ্য এখানে কি করে আসতে পারে? তার মনে হলো সে হ্যালুসিনেশন করছে।

পিচ্চিটাকে বেশ কিছুদিন ধরে দেখা হয় না তাই হয়তো। তবে কিছুক্ষণের মধ্যেই সে বুঝতে পারলো এটা তার হ্যালুসিনেশন না এখানে স্বয়ং দৃশ্য দাঁড়িয়ে আছে। খুশিতে মাহাদ আত্মহারা হয়ে গেল। সে ভাবতেই পারছে না তার প্রিয়সি তার সামনে দাঁড়িয়ে।দৃশ্য কেমন করুন চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। তার পিচ্চিটা যে তাকে এতো বড় সারপ্রাইজ দিবে সেটা ভাবতেই পারেনি। মাহাদ আর নিজেকে দমিয়ে রাখতে পারলো না। ভিড় ঠেলে একদৌড়ে এসে দৃশ্যকে জড়িয়ে ধরলো। তার বুকটা কেমন প্রশান্তিতে ভরে যাচ্ছে। এই মেয়েটা তার ভালো থাকার একমাত্র ঔষধ। এই কয়েক দিনে তার মনে যে অস্থিরতা ছিল তা মনে হয় এক নিমিষেই দূর হয়ে গেল। মনে হয় তার জ্বর হলে ওষুধের বদল এই পিচ্চিকে এনে দিলে সে ঠিক হয়ে যাবে। তার সব রোগের ঔষধ এই পিচ্চিটা। তার সকল মুগ্ধতা এখানেই আছে।

মাহাদের এমন কাজে লাবিবা বোকা বনে গেলো। ঠিক কি হলো তা সে বুঝতে পারলো না। আশেপাশের সকলেও অবাক হয়ে তাদের দুজনকে দেখছে। ভার্সিটির অতি সুদর্শন ছেলেটি কিনা একটা মেয়েকে জড়িয়ে ধরে আছে, অবশ্যই সেটা ভাবনার বিষয়। তবে এদের মধ্যে কি সম্পর্ক হতে পারে সেটা সম্পর্কে সবাই আন্দাজ করতে পারেছে।

ইবদিতা মেয়েটা তো অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। যে ছেলেকে সে এতদিন ধরে নিজের দিকে আকর্ষিত করার চেষ্টা করছিল সেই ছেলে কিনা একটা বাচ্চা মেয়ের মাঝে ডুবে আছে? সে তো কখনোই মাহাদকে কোন মেয়ের সাথে তেমন একটা মিশতে দেখেনি।এই পনেরো সোলো বছরের মেয়ের মাঝে মাহাদ এমন কি পেলো?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here