#তোমাতেই_অস্তিত্ব_আমার
লেখনীতে:মিথিলা মাশরেকা
১০.
আরেকটা নতুন সকাল!!!কিন্তু অনুভুতিটা গতকালের সকালের মতোই।আজও কেউ আমায় জরিয়ে ছিলো,আমি চেয়েও তাকে দেখে উঠতে পারিনি।ফ্রেশ হয় রুমে এসে পড়ার টেবিলে বসলাম।কিছুক্ষন পরই ফোনটা বেজে উঠলো।আমার নতুন বাটন মোবাইলে রিয়াপি,আব্বু,ভার্সিটির চারজনের নাম্বারই আছে শুধু।এ সকালে কে ফোন করবে?ফোন হাতে নিয়ে দেখলাম আরুর নাম্বার।রিসিভ করলাম,
-হ্যা,আরু বল।
……….
-হ্যালো?
…………
-কিরে কথা বলছিস না কেনো?
কেটে গেলো।কিছুক্ষন পর আরেকবার ওই নাম্বার থেকেই কল আসলো।
-হ্যালো,,,
…….
-আরু?কথা বল?
……..
-ভার্সিটি আসি,তোর খবর আছে।রাখছি।
ফোনটা কেটে দিলাম।শুধুশুধু এভাবে কথা না বলার কোনো মানে হয়?একটু পর আবারো ফোনটা বেজে উঠলো।নাম্বার না দেখে রিসিভ করেই বললাম,
-এবার কথা না বললে বাসায় এসে কানের নিচে লাগাবো তোর!
-কি হয়েছে পাখি?কানের নিচে লাগাবা মানে?
এইরে!এটাতো আপি!ধ্যাত!রাগের বশে কি যে করি আমি!বললাম,
-ও্ ওই আসলে আরু কল করে কথা না বলে চুপ করে থেকে জ্বালাচ্ছিলো।তাই ভেবেছি ওই কল করেছে,তাই ওভাবে ঝেড়েছি।
-ও,আরুর সাথে এর আগে ফোনে কথা হয়েছে তোমার?
-না,কালই ও ওর নাম্বার সেভ করে দিলো আমার ফোনে।
-নাম্বার দেখছো?
-নাম্বার দেখার কি আছে?এগারো ডিজিটেরই হবে,কোনো লটারির নাম্বার নয় তো আর!
-দেখে নিও।
-কেনো?
-উফ্ তোমার এই কেনো!রাখছি আমি।
-না না না আপি,রাগ করো না।আর বলবো না কেনো।হয়েছে?কল কেটো না প্লিজ।
-আচ্ছা বেশ।আচ্ছা শুনো তো,আজ কোন ড্রেস পরবে?
-ভালো কথা মনে করিয়েছো।বলোতো কোনটা পরবো?আমার মেরুন রঙের গোলজামা টা?ওটা কেমন হবে?
-না,আজ ওটা না।তুমি নেভি ব্লু টা পরো।ওই যে হোয়াইট ওড়না,আমরা সেইম ডিজাইনের কিনেছিলাম,ওইটা!
-হ্যাঁ,মনে আছে।পরা হয়নি আমাদের একসাথে তাইনা?
-হুম?ন্ না মানে,এই শোনো আজ আমি দেখা করবো তোমার সাথে,ভার্সিটিতে আসবো।
আমি লাফিয়ে উঠে বললাম,
-সত্যি?
-আরে হ্যাঁ,রিয়াপি মিথ্যে বলে?
-নাহ্।লাভ ইউ।
-হুম,টু।আসো তবে,ক্লাস শেষে দেখা হচ্ছে।
-ওকে।
কল কেটে ফোনে আগে আরুর নাম্বারটা দেখলাম।চার পাচ ডিজিট পরতেই পরেরগুলো না দেখেই অটোমেটেক্যালি মুখে চলে আসলো আমার।যেনো কতটা চেনা আমার এই নাম্বার।এজন্যই কি আপি ওভাবে বললো?আমি মালিহা,উর্বি,আপির নাম্বারও চেক করলাম।ওদেরটাতে কোনো কিছুই মনে হলো না।শুধু আব্বুর নাম্বারই মুখস্ত আমার।তাহলে আরুর নাম্বার এভাবে মনে থাকার কারন কি?আরুর সাথে কি বেশি কথা বলতাম আমি?আপির চেয়েও?
ধুর!বান্ধবীই তো।ফোনটা রেখে নাচতে নাচতে জামাটা বের করলাম।আপি আর আমি সেইম ডিজাইনের এই জামাটা কিনেছিলাম।আপি তো থ্রিপিস ছাড়া পরতেই চায় না,অনেক জোরাজুরিতে কিনিয়েছিলাম।আর আমাকে শাড়ি কিনতে হয়েছিলো।মাইশু কত কান্নাকাটি করেছিলো সেদিন সেইম ডিজাইন কেনার জন্য!কিন্তু পুরো মার্কেটেও ওর সাইজের ছিলো না।মুচকি হেসে হ্যাঙ্গার থেকে সাদা ওড়না টা নামালাম।কেমন যেনো অন্যরকম লাগছে ওড়নাটা।অনেকদিন ধরি না তাই হয় তো!রেডি হয়ে ভার্সিটির জন্য বেরিয়ে গেলাম।
ভার্সিটি পৌছে চারজনকেই দেখতে পেলাম।সকালে আরুর কাজের জন্য ওকে কিছু বলবো বলে সবে মুখ খুলেছি,ওমনি উর্বি বলে উঠলো,
-কিরে আরু?আজ ভাইয়া আসেনি?
-এসেছিলো।কাজ আছে বলে তোদের সাথে কথা না বলেই চলে গেছে।
-ওহ্!এতো ব্যস্ততার মধ্যেও কি সুন্দর তোকে ছাড়তে আসে!
-হুম,কাল আব্বুও ফিরেছে।
রায়হান বললো,
-তোমার বাবা এসেছেন?
-হ্যাঁ,আট বছর পর।
-চিনেছে তোমাকে?পুচকি দেখে গিয়েছিলো হয়তো!চিনতে সমস্যা হয়নি আট বছর পর?
-মোটেও না।ভিডিও কলে কথা হতো আমাদের।
-বাহ্!
মালু বললো,
-কিরে মিথি?আজ চুপসানো কেনো?সোডিয়াম আসে নাই?
ওরা হাসতে লাগলো।ওই লোকের কথা মনে পরতেই রাগ উঠলো আমার।মালু বললো,
-হেই!!!কই আপনি?
-ন্ না কিছু না।
উর্বি বললো,
-কিছু তো অবশ্যই।সোডিয়ামের ক্লোরিন হবা নাকি তুমি?
আমি দাতে দাত চেপে বললাম,
-দিনে হাজার হাজার বার ওই লোকের নাম উচ্চারন করার কি আছে?ওই লোককে আমি সহ্য করতে পারি না।
-তো তুই তার গাড়িতে উঠেছিলি কেনো?
-আব্বু বলছিলেন তাই।
-তো আঙ্কেল বলবে বিয়ে করে নে,তুই তো তাই করে নিবি।
আমি দম মেরে দাড়িয়ে রইলাম।কথাটা সত্যিই।আব্বু এধরনের কিছুতে আমার মতামত জানতে চাইলে মানা করতে পারবো কি?মালু বললো,
-কি রে?আবার গুম?
-না,তেমন কিছু না।আর শোন,এ বিষয়ে আব্বু অবশ্যই আমার মতামত চাইবেন।
-তারমানে তুই কি কিছু আন্দাজ…
-না,তবে আব্বু উনাকে বেশ পছন্দ করেন।
-এতো ফাস্ট কেনো আঙ্কেল?
-এটা নিতান্তই আমার মনের ভয় মালু,নাথিং এলস্!
-দেখা যাক।
আরু বললো,
-থাক এসব।মিথি,চল ক্লাসে যাই।তোর সাথে কথা আছে আমার।
আমার সকালের কথা মনে পরে গেলো।রাগে বললাম,
-তোর কোনো কথা শুনবো না।কল করে কথা বলিস না কেনো শাকচুন্নি?হ্যালো,হ্যালো করতে জান যায় আমার!
-আ্ আরে নেট প্রবলেম ছিলো।
-জানা আছে।চল এবার।
আরুর সাথে ক্লাসে ঢুকলাম।ক্লাস শেষে সবাই এক সাথেই বেরোলাম।বাকিরা চলে গেছে।গাড়ি আসতেই আরুও চলে গেলো।গাড়ির লোকটা একটাবার কথাও বললো না।আরুর ভাইয়াই তো ছিলো,না দেখা গেলেও আমি জানি।সেই তো আসে ওকে পিক করতে।কাল অমন বিহেভ করে আজ এভাবে ইগ্নোর করলো?তাতে কি আমার খারাপ লাগছে?উনাকে কালকের জন্য ঝাড়বো সেই ভয়েই নামেননি উনি।আদৌও কি ভয় পান উনি আমাকে?তা না হলে এভাবে ইগ্নোর করলেন কেনো?গাল ফুলিয়ে আপির জন্য ওয়েট করছিলাম।গেইটের পাশেই একটা আইসক্রিমের দোকান।দোকানের লোকটা আইসক্রিম হাতে আমার দিকে এগিয়ে এসে বললেন,
-ম্যাডাম,আপনার গিফট্।
আমি কিছুক্ষন অবাক চোখে চেয়ে থেকে ওটা হাতে নিলাম।কেসটা কি হলো?আপি তো আসছেই।নিজে দিলেই পারতো।লোকটা আবারো বললো,
-ম্যাডাম,কাইন্ডলি আপনি একটু কষ্ট করে যদি নিজে এসে রেগুলার নিয়ে যেতেন,তাহলে ভার্সিটির ভেতরে ,মানে…
-জ্বী ঠিক আছে।
উনি চলে গেলেন।রাস্তায় দাড়িয়ে রাক্ষুসীর মতো আইসক্রিম গিলছি আর আপির রাস্তা দেখছি।আইসক্রিম সাবার!আপির দেখা নেই।রাস্তাটা একটু জনমানবশুন্য হয়ে গেছে।লোকজন কম।তবুও ভালোলাগছে।
-কি ব্যাপার?একা দাড়িয়ে?
আমি পিছন ফিরে তাকালাম।সিয়াম এসেছেন।সিভিল ড্রেস।কোনো কাজ নেই নাকি উনার?
-আপনি?এখানে?
-আনএক্সপেক্টেড?
-আপনার কাছে আবার কিসের এক্সপেক্টেশন?
-লাগবেও না।চলো পৌছে দিচ্ছি।
বলে উনি যেই না আমার হাত ধরতে যাবেন,কোথা থেকে মাস্ক পরা একজন লোক এসে উনার হাত ধরে ফেলেন।আমি বড়বড় করে দুজনের দিকে তাকিয়ে আছি।অচেনা লোকটা বললেন,
-মাঝরাস্তায় একটা মেয়ের গায়ে হাত দিচ্ছেন?
মাস্কের জন্য ভয়েজটা বেশ মোটা মনে হচ্ছে,তবে তার পারসোনালিটিটা চেনা চেনা লাগছে।সিয়াম চেচিয়ে বললেন,
-হোয়াট ননসেন্স?আমি ওকে চিনি,ওউ চেনে আমাকে।
-রিয়েলি?তুমি তোমার হাত ধরার অনুমতি দিয়েছো ওকে?
আমার দিকে তাকিয়ে বললো আগুন্তক।কি বলা উচিত আমার?চাই না তো সিয়াম আমাকে স্পর্শ করুক।উনি পথচারী হয়ে হয়তো আমার অস্বস্তিটা বুঝতে পেরেছেন।না করলে কথা শুনিয়ে সিয়ামকে সরানো যাবে।হ্যাঁ বললে এই লোক চলে যাবে আর সিয়াম আবারো হাত ধরার চেষ্টা করবে।বেশি কিছু না ভেবে কড়া গলায় বললাম,
-না।আমি চাইনা উনি আমার হাত ধরুক।
লোকটা একপ্রকার ধাক্কা মেরে সিয়ামের হাত ছেড়ে দিয়ে বললেন,
-চল যা।
সিয়াম চেচিয়ে বললেন,
-হু দ্যা হেল আর ইউ?আমাদের মাঝে কেনো আসছেন?মিথি চলো তুমি।
বলে যেইনা আমার হাত ধরতে যাবেন লোকটা আবারো ওর হাত ধরে ফেললেন।সিয়াম রেগে গিয়ে হেচকা টানে হাত ছাড়িয়ে অগ্নিদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন।ঝামেলা হবে ভেবে আমি বললাম,
-ও্ ওকে।আ্ আমি য্ যাচ্ছি।
-ভয় পেয়ে যেতে হবে না তোমাকে।
সিয়াম আচমকাই লোকটার কলার চেপে ধরলো।এতোক্ষন শুধু ওই লোকটার শান্ত গলার কথাগুলোই শুনছিলাম।কিন্তু এবার তার চোখ রক্তবর্ন ধারন করেছে।
-আবে সালা,তুই এতো কথা কেনো বলছিস?মাস্ক তো খোল।
এই বলে যেই না উনার মাস্ক ধরতে যাবে লোকটা সিয়ামের নাক বরাবর ঘুষি মেরে দেয়।কলার ছেড়ে চারপা পিছিয়ে যায় সিয়াম।নাক থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত পরছে ওর।লোকটা কলার ঝারতে ঝারতে বললো,
-এটা না করলেও পারতি।
সিয়াম রেগে আবারো তেড়ে দু পা এগোয়।আমি দৌড়ে সামনে গিয়ে দাড়িয়ে পরলাম।বললাম,
-প্লিজ।আপনি চলে যান।রিয়াপি আসছে,আমি ওর সাথেই ফিরবো।আর ঝামেলা করবেন না।
ততক্ষনে আশেপাশে লোক জড়ো হয়ে গেছে।লোকটা সিয়ামের গায়ে হাত তুললেও আশ্চর্যজনকভাবে সবাই সিয়ামকেই দোষ দিচ্ছে।সিয়াম চারপাশে চোখ বুলিয়ে জোরে শ্বাস ফেলে বললেন,
-কাজটা ঠিক করলে না।
এরপর ওই লোকের দিকে তাকিয়ে বললেন,
-তোকেও দেখে নেবো আমি।
সিয়াম গটগট করে চলে গেলেন।মাস্ক পরা লোকটা একটু পিছিয়ে গিয়ে পাশে পার্ক করা গাড়িতে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে হাতের উপরে অন্য হাত দিয়ে হাত বুলাচ্ছেন।লেগেছে ওনারও,যেই মারটা লাগিয়েছেন!জানিনা কেনো সিয়ামের নাকে লাগার থেকে উনার হাতে লাগাটায় আমার কষ্ট হলো।হবারই কথা,ওই লোক মার খেলে শান্তিই লাগে।তবুও ওভাবে কলার ধরার জন্য বেচারা মার খেলো।একদম ঠিক হয়নি।এগিয়ে গিয়ে বললাম,
-আপনি উনাকে মারলেন কেনো?
উনি ভ্রুকুচকে তাকালেন আমার দিকে।
-কি হলো?বলুন?শুধুশুধু ঝামেলা করলেন কেনো?
আবারো চুপ।আমি কিছুটা চেচিয়ে বললাম,
-লোকটার নাকে লেগেছে,দেখেননি আপনি?
উনি সোজা হয়ে দাড়ালেন।একটা জোরে শ্বাস ফেলে বললেন,
-সো হোয়াট?
-সো হোয়াট মানে?চেনা জানা নেই,গায়ে হাত তুললেন একজনের?
শক্ত গলায় বললেন,
-এতে তোমার কি?
-হোয়াট দ্যা…আপনাকে তো বললাম উনাকে চিনি আমি।তারপরেও…
আমার কথা শেষ করতে না দিয়ে লোকটা একটানে তার মাস্ক খুলে ফেললেন।তার দিক তাকিয়ে আকাশ থেকে পরেছি আমি।আরমান।উনি?এখানে?এভাবে??আরুর সাথে ছিলেন না উনি?
-আপনি?
-হ্যাঁ,কেনো?
-আপনি এখানে কি করছেন?
-তোমার ভার্সিটিতে ঢুকে প্রিন্সিপালের ব্যান করা বসন্ত উৎসব পালন করতে পারি আর রাস্তায় থাকতে পারবো না?অস্বাভাবিক কিছু?
আগেরদিনের কথা মনে পরলো আমার।রাগ হলো খুব।ঠিক করলাম সিয়ামকে মার দেওয়া নিয়েই কথা শুনাতে শুরু করবো।যদিও এতোটুকো রেগে নেই আমি সিয়ামের মার খাওয়া নিয়ে তবুও এগিয়ে গিয়ে কিছুটা রাগী গলায় বললাম,
-এই সিম্পল বিষয়ে ঝামেলা না করলেও পারতেন।
এবার উনি আমার দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকালেন।ওই চাওনিতে আমি ভয় পাচ্ছি।শুকনো ঢোক গিলে বললাম,
-রাগ করছেন কেনো?আপনিই তো আমাদের মাঝে কথা বলছিলেন এজন্যই উনি রেগে কলার ধরেছে আপনার।আর আপনি উনার গায়ে হাত তুললেন?
উনি হাত মুঠো করে,দাতে দাত চেপে রাগ সংবরন করছেন,বুঝতে পারছি আমি।আরো,আরো রাগাবো আপনাকে ইশতিয়াক আরমান।আরো অপমান করবো আপনাকে।কেনো আমাকে ছোবেন আপনি?কেনো ওতোটা কাছে আসবেন আমার?
-কি হলো?বলুন?দোষটা আপনার নয়?কাল আমাকেও আপনি…
আমার কথার মাঝেই একটা শব্দ হলো।চোখ খিচে বন্ধ করে নেই আমি।কিছুক্ষন পর তাকিয়ে দেখি পাশের গাড়ির জানালার কাচ গুড়ো গুড়ো হয়ে পরে আছে।নিচেই আরমানের ঝুলে থাকা ডানহাত দিয়ে রক্ত পরছে,কাচ বিধে আছে।তারমানে উনি গাড়ির কাচে পান্চ মেরেছেন!আমি ব্যস্ত হয়ে তার হাত ধরে উপরে তুলে কয়েকটা কাচ বের করে আমার ওড়নায় হাত পেচিয়ে ধরলাম।
-এ্ এটা,এটা ক্ কি করলেন,,,,
………
-ক্ কি করলেন এটা আপনি?এ্ এভাবে,,,,,
লোকটা শান্ত চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।যেনো কিছুই হয়নি।আমি শশব্যস্তের জলভরা চোখে মতো তার হাত পর্যবেক্ষন করছি,কাচ ছাড়াচ্ছি,ওড়নায় মুছছি।সাদা ওড়নার চারভাগের একভাগ রক্তে পুরো ভিজে গেছে।কিছুক্ষন পর উনি তার হাত এক ঝটকায় ছাড়িয়ে নিলেন।আমি অবাক চোখে তাকালাম তার দিকে।উনি আমার দিকে এগিয়ে এসে বললেন,
-হুহ্!এটা দেখছো?আর এই এখানকার?এখানকার আঘাত দেখো না তুমি?চোখে পরেনা তোমার?তাইনা?
আঙুল দিয়ে বুকের বা পাশ দেখিয়ে বললেন আরমান।আমি তখনো নির্বোধের মতো তাকিয়ে।উনি চোখ বন্ধ করে দম নিলেন।তারপর শান্ত গলায় বললেন,
-আমার বাহ্যিক আঘাতে তোমার চোখেমুখের এই যন্ত্রনা,চিন্তা,উত্তেজনা আমাকে স্বস্তি দেয়,মিথি।এতোটা কেয়ার করো না আমার!বারবার আঘাত করতে ইচ্ছে করে নিজেকে।
কথাগুলো বলে গাড়ি নিয়ে চলে গেলেন উনি।আবারো থামিয়ে দিয়ে আমাকে।আবারো সবটা আমার চেনা চেনা মনে হচ্ছে।হাতের সাদা ওড়নায় টকটকে লাল রক্তের দাগ দেখে মনে হচ্ছে বারবার যে আগেও এভাবে রক্তে ভিজেছিলো আমার সাদা ওড়না।আগেও এভাবে কেউ বলেছিলো তার আঘাত,আমার যন্ত্রনা,তার স্বস্তি।কেনো করলেন উনি এমন?উনার হাতে কাচ বিধলে আমার সহ্য হয় না অথচ সিয়ামের নাক দিয়ে বের হওয়া রক্ত নিয়ে এতোটুকু ভাবলাম না আমি?তার স্পর্শে কেনো তাকে কিছু বলতে পারি না আমি?কেনো?এই আমিকে তো আজ আমিই চিনতে পারছি না।মাথায় ব্যথা হচ্ছে প্রচুর!মাথা ধরে পাশের স্টপেজের সিটে বসে পরলাম।কিচ্ছু মনে নেই,অথচ সবটাই চেনা মনে হচ্ছে।কেনো মনে পরছে না আমার কিছু?
-পাখি?
মাথায় কারো স্পর্শ পেয়ে উপরে তাকালাম।রিয়াপি এসেছে।আমি আপিকে জরিয়ে ধরে হুহু করে কেদে দিলাম।কেনো কাদছি নিজেও জানিনা।আপি আমার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললো,
-কি হলো?কাদছো কেনো ?কি হয়েছে বলবে তো?
…….
-বলো?কি হয়েছে?
……..
-মিথি?বলো আমাকে।কেউ কিছু বলেছে তোমায়?
……..
-এভাবে কাদলে জামান আঙ্কেলকে কি জবাব দিবো আমি মিথি?তোমাকে হ্যাপি দেখতেই তো সবটা করলাম।আর তুমি কাদছো?
থেমে গেলাম আমি।কান্নার কারন কি ছিলো আমার?আপিকে কি বলবো?আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে আপির চোখে পরে ওড়নায় লেগে থাকা রক্ত।একপ্রকার চেচিয়ে বলে ওঠে,
-ক্ কি হ্ হয়েছে মিথি,,,,,,
আরমানের হাতের রক্ত ভেবে বুক ফেটে কান্না আসছে আমার।তবুও নিজেকে সামলে বললাম,
-রিল্যাক্স আপি।আমার কিছু হয়নি।
-ত্ তাহলে?ক্ কি করে এভাবে,,,,
রাস্তার পাশে গুড়ো গুড়ো হয়ে পরে থাকা কাচের টুকরোর দিকে তাকালাম।চোখ পানিতে ভরে উঠলো আমার।রোদের আলো চোখের পানি আর কাচের টুকরোয় প্রতিফলিত হয়ে ঝলসে দিচ্ছে আমার চোখ।আরো কান্না পাচ্ছে।তবুও আঙুল দিয়ে ইশারা করে আপিকে দেখিয়ে শক্তভাবে বললাম,
-একজনের একটা এক্সিডেন্ট হয়েছে আপি।
রিয়াপি একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো।তারপর আমার কাধে হাত রেখে বললো,
-ওহ্!তাকে হেল্প করতে গিয়ে ওড়নায় লেগেছে?তার আঘাতে,কষ্টে মিথিরও কষ্ট হয়েছে,তাই মিথি এভাবে কেদেছে,তাইতো?
আমি আপির দিকে তাকালাম।তাই নয় কি?আরমানের কষ্টেই কি কাদছি না আমি?উনার জায়গায় অন্য কেউ হলেও এভাবে কাদতাম?চোখ দিয়ে আবারো টুপ করে দু ফোটা পানি বেরিয়ে এলো।আপি চোখের পানি মুছে দিয়ে বললো,
-ইটস্ ওকে মিথি।এক্সিডেন্ট ইজ এক্সিডেন্ট।উনি ঠিক আছেন তো?
আমি কি করে বলবো?উনি তো ওভাবেই বেরিয়ে গেলেন।ওই কাটা হাতে তো আরো কাচ বিধে আছে বোধহয়।কিভাবে ড্রাইভ করবেন উনি?আরো চিন্তা হচ্ছে এবার!আপি বললো,
-আচ্ছা থাক।চলো এবার।
-কোথায়?
-আর কোথায়?বাসায়।যে হালাত বানিয়েছো নিজের,তার উপর মনটাও ভালো নেই আমি জানি।চলো আজ আর ঘুরবো না।বাসায়ই যাই।
-হুম।
দুজনে মিলে রিকশায় উঠলাম।দুহাতে শক্ত করে ধরে আছি ওড়নাটা।
-আপি?
-হুম বলো?
-এটা কি সেই ওড়নাটাই যেটা আমরা একসাথে কিনেছিলাম?
-হুম কেনো?সাদা ওড়না তো তোমার এই একটাই।
তাহলে?তাহলে এমন কি করে সম্ভব? আমার সাদা ওড়না এর আগেই কি করে রক্তে ভিজতে পারে?কি করে?মানুষটা ওভাবে কেনো বললো?উনার কথা আমার কেনো শোনা শোনা মনে হয়?আচ্ছা,ওভাবে রাগ করে চলে গেলেন উনি,রাস্তায় কিছু হয়নি তো?গাড়ি চালাতে প্রবলেম হবে তো ওই হাত নিয়ে!হসপিটাল গিয়েছেন কি বা যাওয়ার কথা ভেবেছেন কি একবারো?উনি ঠিকমতো বাসায় পৌছেছেন তো?
“বাসায় আমি যাইনি মিথি।সরি।কষ্ট দিলাম তোমাকে।আমার কষ্টে কষ্ট পাচ্ছো তুমি,আমার বাসায় পৌছানো নিয়ে চিন্তা হচ্ছে তোমার,আপির কাছে আমার কথা লুকিয়ে আমাকে হারানোর ভয় কাটাচ্ছো তুমি।মনে পরে তোমার মিথি?এর আগেও এভাবে কেটেছিলো আমার হাত।এর আগেও তোমার সামনে বাজে একটা রুপ বেরিয়ে এসেছিলো আমার।এর আগেও তোমার ওই জামারই সাদা ওড়না আমার রক্তে ভেসেছিলো।মনে পরে না তোমার?
সেদিন রাস্তার দুটো টোকাই রিকশা থামিয়ে তোমাকে হ্যারাস করেছিলো।বরাবরের মতো ফলো করছিলাম তোমাকে।চোখে পরে যায় ওরা আমার।গাড়ি থামিয়ে তোমার সামনে মেরেছিলাম ওদের খুব।তুমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলে মিথি।তারপর যখন ওদের হাতের চাকুতে হাত কেটে যায় আমার,সব ভুলে যাও তুমি।ছুটে এসে নিজের ওড়নায় জরিয়ে নাও আমার হাত।আজকের মতো এভাবেই ব্যস্ত হয়ে পরছিলে তুমি সেদিনও।জলভরা চোখে আমার আঘাতের জায়গার যত্ন করেছিলে তুমি সেদিনও।সেদিনও তোমাকে এ কথাগুলোই বলেছিলাম।তবে স্পর্শ না করে।আজ তো তোমাকে স্পর্শ না করে থাকতে পারলাম না মিথি।পারলাম না নিজেকে আটকাতে।কবে সবটা মনে পরবে তোমার?কবে এক হবো আমরা মিথি?কবে?”
মনে মনে কথাগুলো বলে চোখের কোনের পানি মুছে নেয় আরমান।স্টপেজের একটু আড়ালের রাস্তা থেকে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বাসায় চলে আসে।
#চলবে…
®