#তোমাতেই_অস্তিত্ব_আমার
লেখনীতে:মিথিলা মাশরেকা
৭.
সন্ধ্যায় বেলকনিতে দাড়িয়ে দুর রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে আরমান।আজ ছ মাস পর আবারো সে তার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সময়গুলোর একটাকে জীবন্ত হয়ে উঠতে দেখেছে।ছ মাস আগে যেভাবে তার জীবনের এক নব অধ্যায়ের সূচনা ঘটেছিলো,তা আজ আবারো নতুনভাবে ফিল করেছে সে।কি এক অদ্ভুত প্রশান্তি মনে হচ্ছে ওর!একবার চোখ বন্ধ করে অতীতে হারিয়ে মনে করে নিলো সেই দিনটার কথা,যেদিন বদলে যেতে শুরু করেছিলো ওর আট বছরের জীবন পদ্ধতি।
•
আট বছর আগের ট্রাজেডির পর বাবার টাকাতে কিছু করবে না বলেই কোনোমতে পড়াশোনা চালিয়ে গিয়েছিলো আরমান।তবে একটু বেশিই ভালো স্টুডেন্ট হওয়ায় অনার্সটা ফার্স্ট ক্লাস নিয়েই কমপ্লিট করেছিলো।নিজেকে পরিবার থেকে যতটা সম্ভব আলাদা করে নিয়েছিলো সে।ব্যস্ত থাকতো ওর নিজের দুনিয়া নিয়ে।গরিব লোকজনদের আইনি সাহায্য এনশিওর করতো ও।যারা ন্যায়বিচার পেতো না,তাদের জন্য সবধরনের সাহায্যের জন্য একটা আলাদা গ্যাং ছিলো ওদের।
সমাজের ক্ষমতাসীনদের ক্ষেত্রে সোজা কথায় কাজ খুব কমই হতো বলে অনেকটা বেআইনি পথেই তাদের কথা আদায় করাতো ওর গ্যাং।আপাতদৃষ্টিতে সমাজের চোখে গুন্ডামিই বলা চলে।তবে এ নিয়ে কোনো আক্ষেপ ছিলো না আরমান বা ওর টিমের কারোই।
আইনি ঝামেলার পুরোটাই আরমানের বাবা নিজে হ্যান্ডেল করতেন,টাকার জোরেই,যদিও এতে আরমানের মত ছিলোনা,আর একারনেই ও নিজের বাবার সাথে ভালো করে কথাও বলতো না।কিন্তু আরমানের বাবা নাছোড়বান্দা।উনার মতে তার ছেলে কখনোই খারাপ উদ্দেশ্যে কিছু করে না।তাই না আরমানের বারন শুনেছেন,না ওকে কখনো এসব ছাড়তে বারন করেছেন।এভাবেই সমাজের চোখে ভিলেন উপাধি নিয়েও বেশ ছিলো আরমান।
আরিশা ওর চান্স হওয়ার দিন আরমানকে বলেছিলো,ওর ভার্সিটির প্রথম দিনে ওর সাথে যেতে।যায় নি ও।ভার্সিটির সিনিয়রদের র ্যাগিং এর শিকার হয়ে বাসায় এসে পরদিন কেদে আরমানকে যেতে বলে আরিশা।একদিকে বোনের অপমান,অন্যদিকে এত ভালো রেজাল্টে ওর করা একমাত্র আবদার আর ফেলতে পারেনি আরমান।পরদিন গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পরে আরিশাকে নিয়ে ওর ভার্সিটির উদ্দেশ্যে।
মাঝ রাস্তায় প্রচন্ড জ্যামে গাড়ি আটকে যায়।সকালের রোদ,জ্যামের ভ্যাপসা গরমে যে কেউ রাগতে বাধ্য।প্রায় আধা ঘন্টা একটু আধটু এগোতে পেরে বিরক্ত হয়ে স্টেয়ারিং এ পান্চ মারে আরমান।একজন আরিশার ওপাশের জানালা দিয়ে বললো,সামনে অনেক বেশি জ্যাম,আরো অনেক্ষন লাগবে।আরিশা নিজেও জানে এসময় এ রাস্তায় এরকমটাই হয়।আরমানের দিকে তাকিয়ে ওর রাগী লুক দেখে ভয় পেয়ে কিছুটা কাচুমাচু হয়ে অন্যদিক ঘুরে বসে ও।
টানা এতক্ষন বসে থেকে একফুট এগোতে না পেরে বিরক্তির চোখে বাইরে তাকায় আরমান। চোখ পরে পাশে দাড়ানো রিকশায়।রিকশার হুক উঠানো,কে বসে আছে তা দেখা যাচ্ছে না,তবে রিকশাওয়ালাটা উল্টোদিক হয়ে তার রিকশায় বসে থাকা কারো সাথে জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছে।লোকটার মাথার উপর একটা কবজি অবদি ঢাকা কালো ছোট হাতঘড়িওয়ালা শ্যামবর্নের হাত ছাতা ধরে আছে।আর ওই মানুষটা তার নিজের দুহাত নাড়িয়ে নিজের সম্পুর্ন আনন্দ আবেগ দিয়ে কিছু বলে চলেছে।যেনো তার কোন পরমাত্মীয় তার রিকশায় শুধু তার জীবনের গল্প শোনার জন্যই উঠেছে।
রিকশাওয়ালার হাসি আর কথা বলার ভঙিমা দেখেই আনমনে হাসলো আরমান।জানালার কাচ নামিয়ে দিলো ও।রিকশাওয়ালা হেসে হাত নাড়িয়ে কিছু বললো,একটা মিষ্টি আওয়াজ এলো,খিলখিলিয়ে হেসে উঠেছে রিকশার মানুষটি।কোনো মেয়ের গলা!হাসিটা শুনে আরমানের নিজের মনে একদফা ঝড়ো হাওয়া বয়ে গেলো।শান্তির নাকি তোলপাড়ের তা বুঝলো না ও।এমনো মানুষ হয়।যারা রিকশায় উঠে চালকের সাথে এভাবে গল্পে মাতে।এভাবে ছায়া করে দিয়ে শান্তিতে তাদের মনের কথা প্রকাশ করার সুযোগ করে দেয়।তাদের আনন্দে এভাবে হাসে।যেনো সেও মেতে উঠেছে তার কথাতে।জানা ছিলো না আরমানের।
মেয়েটাকে দেখার খুব ইচ্ছা হলো ওর।জীবনে প্রথমবারের মতো!কোনো মেয়েকে দেখতে এতটা পাগলপ্রায় হয়েছে ওর মন!উকিঝুকি দিয়ে দেখার মধ্যে শুধু সিটের নিচে পুরোটা জুরে ছড়িয়ে থাকা কালো জামা,আর হাতের ঘড়িটাই দেখতে পেলো।জ্যাম এতটাই বেশি যে গাড়ির দরজা খুলে নামতেও পারছে না আরমান।
বেশ অনেকক্ষন চেষ্টা করেও কোনো হদিশ পেলো না আরমান।জ্যাম ধীরে ধীরে কেটে যেতে লাগলে ওই রিকশাচালক ঘুরে বসে এগিয়ে যায়।এদিকে আরমান বেরোতেই পারে নি গাড়ি থেকে।রিকশাটাকে হারিয়ে ফেলে ও।
কষ্ট হচ্ছে ওর!না দেখা কাউকে হারিয়ে ফেলে ওর কষ্ট হচ্ছে!খুব কষ্ট হচ্ছে! মনে মনেই বললো,
-হারিয়ে ফেললাম ওকে?এতোদিন পর যখন বিক্ষত মনটা একটু শান্তি পেতে যাচ্ছিলো,ওকে হারিয়ে ফেললাম?
আরিশা ড্রাইভিং করার সময় ওর ভাইয়ের অস্থিরতা দেখলো ঠিকই কিন্তু কারন বুঝে উঠতে পারলো না।আরমান ভার্সিটির সামনে এসে গাড়ি থামালো।আরিশা বললো,
-বাইরে আসবি না ভাইয়া?
একটা জোরে নিশ্বাস ফেলে আরমান বললো,
-হুম।তুই যা আমি গাড়ি পার্ক করে আসছি।ভেতরে যাবো,তোর সিনিয়রদের দেখতে।
আরিশা নেমে গেলো।গাড়িটা বেশ জোরেই স্টার্ট করেছে আরমান।বাসায় গিয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওর অশান্ত মনকে শান্ত করবে ও।কিছুদুর এগোতেই হুট করে গাড়ির সামনে একটা ফুলের ঝুড়িওয়ালা ছোট বাচ্চা চলে আসে।কিছু বুঝে ওঠার আগেই ব্রেক কষে,স্টেয়ারিং ঘুরিয়ে পাশ কাটানোর সর্বোচ্চ চেষ্টাটা করে আরমান।কিন্তু তা যথেষ্ট ছিলো না।
গাড়ি থামানোর পর আরমানের বুঝে উঠতে সময় লাগে কি ঘটেছে এতোক্ষন।ইতিমধ্যেই পথচারীরা ওর গাড়ির জানালার কাচে হাত দিয়ে বাড়ি দেওয়া শুরু করেছে।সবটা বুঝে উঠে আরমান বাইরে বেরিয়ে আসে।লোকগুলো তাকে দেখে ভালোমতোই গালাগালি শুরু করে দিয়েছে।এসব ওর কানে যাচ্ছে না,খুজে চলেছে ওই ছেলেটাকে।ওর কিছু হয়েছে কি না।কিন্তু দেখতেই পাচ্ছে না ফুলের ঝুড়িওয়ালা ওই বাচ্চাটাকে।একজন বললো,
-দেখে গাড়ি চালাতে পারেন না?আজ কি হয়ে যেতে পারতো!
আরমান ছেলেটাকে খুজতে খুজতেই বললো,
-দেখুন আমার কোনো দোষ নেই,ছেলেটাই আমার গাড়ির সামনে এসেছিলো।
-দেখেছেন,দেখেছেন আপনারা।একেতো দোষ করছে,স্বীকার করবে,তা না ওই বাচ্চা ছেলের উপর দোষ চাপাচ্ছে।
-আরে,দোষ চাপাবো কেনো?ইট ওয়াজ এন এক্সিডেন্ট!
-হ্যাঁ,হ্যাঁ,তাহলে?যদি বড়সড় কিছু হয়ে যেতো?হুশ থাকেনা গাড়ি চালানোর সময়?
আরমান বুঝলো এদের সাথে কথা বলাই বেকার।তখনো ছেলেটাকেই খুজে চলেছে ও।এক লোক হুট করেই আরমানের কলার ধরে বললো,
-বড়লোক?গাড়ি আছে বলে রাস্তার মানুষকে মানুষ মনে করো না তাইনা?
আরমান একবার ওই লোকের হাতের মুঠে থাকা ওর কলারের দিকে তাকালো।এখানে আদিব থাকলে একটারও হালাত ঠিক থাকতো না।কারন ওর কোনো দোষই নেই,ছেলেটাই ওর গাড়ির সামনে চলে এসেছিলো।সবাই না বুঝে ওকে এভাবে দোষারোপ করছে।রাগ সংবরন করে হাতের মুঠো করে বললো,
-দেখুন আমি কিছু করি নি।
-করো নি কিছু?তোমাকে তো…
-আরে আরে কি করছেন টা কি?ছাড়ুন উনাকে।ছাড়ুন।
কথাগুলো বলে কেউ আরমানের গলায় থাকা ওই লোকের হাত থেকে ওর কলার ছাড়িয়ে দেয়।আরমান মুখ তুলে তাকালো এবার।একটা আঠারোর এপার ওপার বয়সের মেয়ে।গায়ের রঙটা একটু চাপা।পরনে কালো গোলজামা,চুড়িদার।নাক কান একদম খালি,কোনো সাজ নাই।কোমড়ের উপরের চুলগুলো ছাড়া,সাইডে সিথি করা,এলোমেলো,সামনে এসে কেউ কেউ বিরক্ত করছে বারবার,তবুও মেয়েটার কথার জোরে এতোটুকো প্রভাব নেই।ছেচড়া চুলগুলোকে যতবারই হাত দিয়ে কানে গুজে দিয়ে কথার ঝাঝ বারিয়ে দিচ্ছে ও,ততবারই কোনো দমকা হাওয়া আবারো বাধা না মানা চুলগুলোকে সামনে এনে দিচ্ছে।
-কি করছেন বলুন তো আপনারা?
একজন বললো,
-এরে শাস্তি দিক।এক্সিডেন্ট করার আগে চালকের শাস্তির একটা উদাহরন থাকা দরকার।ওর জন্যই ওই নিস্পাপ ছেলেটা…
-কিচ্ছু হয় নি তো ওর।
-হতেও তো পারতো!
-হ্যাঁ তবে হয়নি তো!আর হলেও উনার কোনো দোষ ছিলো না।
-কি কইতাছো কি তুমি মাইয়া?শুনো,তোমরা বড়লোক হইবার পারো,কিন্তু আমাগো গরিব গোও জীবনের দাম আছে!
-তো নেই তা আমি কখন বললাম?
-তাইলে উনারে বাচাইতাছো ক্যান?
-আরেহ্,বাচাতে যাবো কেনো?আর আপনারাই বা উনাকে দোষ দিচ্ছেন কেনো?ওই ছেলেটাই গাড়ির সামনে এসেছিলো।উনার কোনো দোষ সত্যিই নেই।
-কিহ?
-হ্যাঁ,নিলু,এদিকে আয় তো!
ফুলের ঝুড়িওয়ালা ছেলেটা ভিড় ঠেলে এগিয়ে আসলো।মেয়েটা ওর দিকে তাকিয়ে বললো,
-বলতো কি কান্ড ঘটিয়েছিস তুই?
ছেলেটা মাথা নিচু করে অপরাধির মতো বললো,
-মায়ে কইছিলো আইজকা বিশ ট্যাকা বেশি কামাই করতে না পারলে গাড়ির সামনে যাইয়া মরিস।জ্বালা একটা কমবো আমার।সকাল থাইকা বিশ টাকা বেশি কি,প্রতিদিনের মতো তো দুরে থাক,ফুলই বেচবার পারি নাই।তাই মায়ের জ্বালা কমাইতে আমিই গাড়ির সামনে গেছিলাম।
মেয়েটা ঝাঝালো কন্ঠে বললো,
-বুঝেছেন?শুনে নিয়েছেন সবটা?এবার বলুন,ওর জন্য কে কতটা করতে চান?এবার কেউ সহমর্মিতা দেখাতে চান?বলুন?
সবাই চুপ।কেউ কেউ মুখ লুকিয়ে চলেও যাচ্ছে।মেয়েটি আবারো বললো,
-ঘটনাটাকে ইস্যু বানিয়ে এই লোকটাকে হ্যারাস না করে ওর একটা খোজ নিয়েছেন কেউ?না,তা কেউ নেননি।আমি যদি ঠিকসময়ে ওকে সরিয়ে না আনি তাহলে…
আরমানের এবার হুশ ফেরে।বিস্ফোরিত চোখে তাকালো ও মেয়েটার দিকে।ওই তাহলে বাচিয়েছে ছেলেটাকে।হ্যাঁ,এমনটাই তো ঘটেছে।ছেলেটাকে বাচাতে কোথথেকে দৌড়ে এসে একটানে সাইডে নিয়ে আসে কেউ।অল্পের জন্য বাচিয়ে নেয় শিশুটাকে।সেটা এই মেয়ে?রাস্তায় এতোগুলো মানুষ থাকতেও এটুকো একটা মেয়েই এতোকিছু করলো।মেয়েটি বললো,
-নাটক দেখা শেষ?আপনারা আসতে পারেন।
ওর লোকজন সরে গেলো।বাচ্চাটা আরমানের কাছে এসে বললো,
-কিছু মনে কইরেন না,আমার জন্যে আপনারে এতোকিছু সওন লাগলো।আমি…
আরমান ওর কাছে হাটু গেরে ওর কাধে হাত রেখে বললো,
-আমি কিছু মনে করিনি,আমারো সাবধান হওয়া উচিত ছিলো।
-আপনে বরই ভালা মানুষ।এক্কেরে আপার মতোই।
বলে ছেলেটা ওখানেই বুকে দুহাত ভাজ করে দাড়িয়ে হাসতে থাকা ওকে বাচানো সেই মেয়েটার দিকে তাকালো।মিথি ওর দুহাত নিলুর সামনে বাড়িয়ে বললো,
-তাই বুঝি?আমি বরই ভালা মানুষ?তবে এই ভালা মানুষটাকে কিছু দে।
মিথির বাড়ানো হাতের দিকে তাকিয়েই আটকে যায় আরমান।এ যে সেই হাত যা রিকশাওয়ালার মাথায় ছাতা ধরেছিলো,সেই হাত যাতে তখনকার সেই কালো ঘড়িটা এখনো আছে।আরমান আরেকবার মিথির পা থেকে মাথা অবদি স্ক্যান করে বুঝতে পারে এই সেই মেয়ে যাকে ও রাস্তায় জ্যামে দেখেছিলো,রিকশাওয়ালার সাথে আড্ডায় মাততে,তার কথায় খিলখিলিয়ে হাসতে।যাকে দেখার জন্য সে এতোটা অধীর হয়ে উঠছিলো,যাকে হারিয়ে দুনিয়াকে হারিয়েছিলো।নিলু ছেলেটা বললো,
-কি দিমু তোমারে আপা?তুমিই তো উল্টা আমারে দৈনিক ফুল না নিয়াও বিশ টাকা দিতে চাইলা।
মিথি ওর গাল টেনে হেসে বললো,
-বেশ!এখন তোলা থাক।পরে চেয়ে নেবো।ভার্সিটিতে প্রথম ক্লাস,মিস করা যাবে না।একেতো কাল আসিনি,তারউপর জ্যামের জন্য এমনিতেও লেট হয়েছিলো আজ।আসছি আমি।তুই সাবধানে থাকিসহু?আর ঠিক সময়মতো আসিস প্রতিদিন কেমন?
নিলু মাথা বাকালো।কথাগুলো বলেই চলে গেলো মিথি।আরমান খুশিতে নিলুকে জরিয়ে ধরেছে।আজ ওর জন্যই সবটা হয়েছে,সে যে সিচুয়েশনেই হোক না কেনো!ওর জন্যও আরমান বেচে থাকার নতুন মানে পেয়েছে,নতুন করে শুরু করার নতুন কারন পেয়েছে।
কিছুক্ষন পর নিলুকে ছেড়ে ওর হাতে বেশ কিছু টাকা দিয়ে ভার্সিটিতে ঢোকে আরমান।বেশি দিলে হয়তো ফুল বেচতে আসবে না আর মিথির সাথে দেখা না করলে ও কষ্ট পাবে তাই দিলো না।ভেতরে ঢুকেই দেখে আরিশা হাসিমুখে দাড়িয়ে কারো সাথে কথা বলছে।মেয়েটা উল্টোদিক হয়ে দাড়িয়ে আছে।তবে জামাটা চেনা আরমানের।ঝুলে থাকা বাম হাত দিয়ে বারবার চুল কানে গুজে দিচ্ছে সে।হাতের ঘড়িটাও ওর চেনা।মনে মনে হাসলো ও।আরমান এগিয়ে যেতেই আরিশা বলে উঠলো,
-জানিস ভাইয়া,আজও ওই ছেলেগুলো আমার পথ আটকেছিলো।অনেকক্ষন দাড়িয়ে ছিলাম।তুই তো বাইরেই ছিলিস।এতো দেরি করলি যে?
-তোমার ভাইয়াকে রাস্তায় সংবর্ধনার ব্যবস্থা করা হচ্ছিলো!
আরমান তাকিয়ে দেখে মিথি মিটমিটিয়ে হেসে কথাগুলো বলছে।আরিশা বললো,
-মানে?
-নাথিং!পরে শুনে নিও।ক্লাসে যাই এখন?
আরমান আরিশাকে গম্ভীর গলায় বললো,
-তোকে বাড়াবাড়ি কিছু বলেছে ওরা?
-না না না।তবে দাড় করিয়ে রেখেছিলো বেশ কিছুক্ষন।হয়তো বলতো।বাট থ্যাংকস্ টু মিথি।ও নিজেও ফার্স্ট ইয়ার স্টুডেন্ট হয়ে অনেক সুন্দরভাবে দু মিনিটেই সিচুয়েশন হ্যান্ডেল করেছে।ওদের আমি নাকি ভিসির চাচাতো ভাইয়ের মামাতো বোনের মেয়ে!!!এতেই ছেড়ে দিয়েছে।
কথাটা বলে হাসলো আরিশা।মিথিও হাসছে।আরমানের নিজেরও হাসি পেলে হাসলো না ও।এগিয়ে গিয়ে মিথিকে বললো,
-থ্যাংকস্,এখনকার জন্য আর তখনকার জন্যও।
-ইটস্ ওকে।আর থ্যাংকস্ কেনো দিচ্ছেন?আপনার তো দোষ ছিলোই না।আমার জায়গায় যে কেউ থাকলে এমনটাই করতো।
-না করতো না,সবাই তোমার মতো না।
মিথি ভ্রুকুচকে তাকালো।আরমান বুঝলো ওর হুট করে প্রথম দেখাতেই তুমি সম্বোধনের জন্য এমন লুক দিয়েছে ও।আরিশা বললো,
-তুই তখনকার কিসের কথা বলছিস ভাইয়া?
আরমান মিথির দিকে তাকিয়েই বললো,
-বাসায় গিয়ে বলবো।তোমার ফুল নেইম কি মিথি?কোন ডিপার্টমেন্ট?
ওভাবে তাকিয়ে থাকায় কিছুটা অস্বস্তিতে পরে যায় মিথি। সৌজন্যের হাসি হেসে বললো,
-মিথিলা মাশরেকা।আমি ফার্স্ট ইয়ার।কোয়ান্টাম মেকানিক্স এ।
আরিশা বললো,
-আরেহ্!আমিও তো।গ্রেট!
আরমান নিজেও অনেক খুশি হলো।বাকি ডিটেইলস্ ও জোগাড় করে নেবে।বললো,
-বেশ,এবার ক্লাসে যা আরু।আমি আসছি।বাসায় একা যেতে হবে না।পিক করতে আসবো নে তোকে।
আরিশা অবাক হলো।আসতেই চাচ্ছিলো না,এখন পিক করতে চাচ্ছে।ওরা হাসিমুখে চলে গেলে আরমানও বেরিয়ে আসে।মনে এক চিলতে সুখ!!!প্রানে এক অসম্ভব প্রশান্তি!!
•
-আরমান বাবা!!!তোমার কফি।
রোজি খালার ডাকে ধ্যান ভাঙে আরমানের।কফিটা হাতে নিয়ে চুমুক দিয়ে আবারো ভাবনায় ডোবে ও।সেই একটা দিনেই মিথিকে চার চারবার দেখেছিলো।তবুও মন ভরেনি ওর।রাতের অন্ধকার নেমে আসলে আরো হাহাকার বেড়েছিলো বুকের মাঝটায়।ওর ডিটেইলস্ জোগার করতে খুব বেশি একটা সময় লাগেনি।বাইক নিয়ে রাতের আধারে গিয়ে ওকে ওর বাসায় গিয়ে দেখে আসার মধ্যে সুখ খুজে পেতো।ভার্সিটিতে লুকিয়ে দেখতো,প্রতিদিনই বাসায় যেতো মিথির ঘুমন্ত মমুখ দেখতে। বুঝতে বাকি রয়নি আরমানের,জরিয়ে গেছে ও।ওর অস্তিত্বে মিশে গেছে মিথি।কফি শেষ করে ফোনটা নিয়ে আদিবের নাম্বার ডায়াল করলো।রিসিভ করতেই বললো,
-হ্যাঁ,আদিব।কই তুই?
-তোর দেওয়া ফাইলগুলো দুদিন ধরে কমপ্লিট করে বাসায় আসছি মাত্র।কেনো?
-ওকে ফ্রেশ হয়ে কল দিস।
-ফ্রেশ হইছি।তুই বল কি বলবি?
-ওকে শোন,তোর একটা কাজ করতে হবে।
-শুনছি তো।বল না কি কাজ?
-রিয়াপিকে মিথির বাসা থেকে বের করতে হবে।
রিয়ার কথা শুনে ঘাবড়ে গেছে আদিব।যে ডেন্জারাস মেয়ে ও।বললো,
-আমাকে ছেড়ে দে ভাই!ওই মেয়ে খুব চালাক!আমি পারবো না।
-আমি জানি রিয়াপি কেমন,তাইতো তোকে বললাম।গার্ডস্ রা কি করতে পারে জানিসই তো তুই।আমারও একটু কাজ আছে।
-কিন্তু আরমান…
-কোনো কিন্তু না ইয়ার।এটা করতেই হবে তোকে।প্লিজ ভাই,প্লিজ!
আর মানা করতে পারলো না আদিব।হাড়িকাঠে মাথা দিতে রাজিই হয়ে গেলো।রিয়ার সাথে চালাকি করতে যাওয়া মানে এমনটাই,ধরা পরলে আস্ত রাখবে না ওকে।আর ওর কাছে ধরা পরার পসিবলিটিও অনেক বেশি।ফোন রেখে মুখ গোমড়া করে বেরিয়ে পরলো আদিব।
আদিবকে মানিয়ে ফোনটা হাতে ঘোরাছে আরমান।এবার আরেকটা প্লান অ্যাপ্লাইয়ের সময় এসেছে,আরেকটা কল করলো ও।
-হ্যালো?
-কেমন আছেন মিস্টার আলম?
গলাটা শুনে ইজি চেয়ার থেকে উঠে দাড়ালেন মাহবুব আলম।পত্রিকা পড়ায় এতোটাই মগ্ন ছিলেন যে নাম্বারটাও দেখেননি উনি।কান থেকে ফোন নামিয়ে নাম্বার টা দেখলেন একপলক।এই নাম্বার থেকে কল আসতে পারে এ সেটা ভুলেই গিয়েছিলেন উনি।বললেন,
-তুমি?
-শকড্?
-কেনো ফোন করেছো?
-মনে হচ্ছে মেয়ের মতো আপনিও ভুলে গিয়েছেন আমার সব কাজের কারন!যাই হোক মনে করিয়ে দেই,কারনটা মিথি।
-কি বলতে চাও?কেনো ফোন করেছো?
-হুউউউম,কেনো?আচ্ছা বলুনতো আপনার মেয়ে এখনো ও বাসায় কি করে?ওর তো এখন আমার কাছে থাকার কথা রাইট?
-কি বলতে কি চাচ্ছো তুমি?
-মানে আমার জানার খুব ইচ্ছা যে মাত্র চারটা পুলিশ মিথির পেছন লাগিয়ে ওকে ভার্সিটি পাঠালেন?এতোটাই ন্যারো মাইন্ড আপনার আমাকে নিয়ে যে চারজন পুলিশকে আমি পাশ কাটাতে পারবো না?সিরিয়াসলি?
মাহবুব আলম অবাক হয়ে বললেন,
-ত্ তুমি কি করে জানো এসব?
-তো অস্বাভাবিক কিছু নাকি আমার জানাটা?ওকে ফাইন,আজ বলেই দেই আপনাকে তাহলে যে কি করে ও বাসার সবটা জানতে পারি আমি।একচুয়ালি আপনার বাসায় লাগানো চারটে সিসি ক্যামের সাথে একটা এক্সট্রা আছে,আর ওটা আমার কাছে কানেক্ট করা।
মাহবুব আলম আবারো অবাক।বললেন,
-ত্ তারমানে?
-আরে ছাড়েন আপনার মানে!অতো মানে বুঝানোর সময় নাই আমার।জরুরি কথা জানাবো বলে ফোন করেছি আপনাকে।
-কি কথা?
-শুনুন,আপনার বাসার ওই পাঁচটা ক্যামেরা আর চারটে পুলিশ আমার কিছ্ছু করতে পারবে না,আটকাতে পারবে না।কিন্তু আপনার মেয়ের তো কিছুই মনে নেই আমাকে নিয়ে,আমিও অনেক ভেবে সবটা ভুলে যেতে চাচ্ছি।এতে আপনার কি মত?
……..
-কিছু বলছেন না যে?আচ্ছা বলতে হবে না আপনাকে।আমি আসছি আপনার মেয়েকে আনতে।
-না!না তুমি আসবে না।তোমার মতো একটা গুন্ডার কাছে কিছুতেই আমার মেয়েকে যেতে দেবো না আমি।
-দেন লেটস্ মেক এ ডিল!!!আপনার মেয়েকে আনবো না আমি।উটকো পুলিশ আর সিসিক্যামের ঝামেটাও পোহাতে হবে না আপনাকে।কিন্তু কিন্তু কিন্তু…
-কিন্তু?
-বিনিময়ে আমার কিছু চাই।আপনার সাথে গিভ এন্ড টেক ছাড়া অন্য সম্পর্ক সম্ভব না।
মাহবুব আলম এবার ভড়কে গেছেন ওর কথায়।ক্ষমতা,টাকাপয়সার কমতি নেই ওর।কি চায় কি ছেলেটা?মিথিকে নিয়ে না যাওয়ার বিনিময়ে অবশ্যই ছোটখাটো কিছু চাইবে না ও!তাহলে???
•
রুমে গাল ফুলিয়ে বসে আছি।আপি ব্যাগ গোছাচ্ছে আর আমার দিকে তাকাচ্ছে।কিছুক্ষন আগে ওর বাসায় কেউ একজন কিসব চিঠির খাম দিয়ে গেছে।আঙ্কেল তৎক্ষনাৎ চলে এসেছেন আপিকে নিয়ে যেতে।কি লেখা আছে চিঠিতে তাও বলেননি।সবে একটা দিন থাকলো ও,এরমাঝেই!
-সরি পাখি!
-সরি কেনো বলছো?ইটস্ ওকে।
-তুমি রাগ করেছো আমি যাচ্ছি বলে!
-ধুউউর!ভাল্লাগেনাহ!আপি বলোনা আঙ্কেলকে।বোঝাও না আর দুটো দিন থাকতে দিতে তোমাকে।
-আপু তুই থাম না।কেনো রিয়াপিকে ওভাবে বলছিস?ওর তো বাসায় যেতেই হতো তাইনা?
-হ্যাঁ,তাইতো।দেখেছো মিথি,মাইশু ঠিকই বুঝেছে।আর তুমিই বাচ্চাদের মতো করছো।কথা হবে তো আমাদের!
আমি আর কিছু বললাম না।আপি ব্যাগ গুছিয়ে আমাকে জরিয়ে ধরে বললো,
-আসছি আমি।এবার চিরল দাতের হাসিমুখটা দেখাওতো দেখি।
ওর কথায় আমি হেসে দিলাম।আপিও হেসে বললো,
-বাই দ্যা ওয়ে,তোমার নতুন স্টার্টিংয়ের জন্য শুভেচ্ছা।আরেকটা সারপ্রাইজ পাবে তুমি।আসছি।আল্লাহ হাফেজ।
আপি চলে গেলো।আমার লাইফটাকে আমার মনের মতো করে গুছিয়ে দিয়ে।রুমে ঢুকতেই আবারো দমকা হাওয়া গায়ে লাগলো,জানালা খোলা পেলাম।কিন্তু এটা আমি সন্ধ্যায়ই লাগিয়েছিলাম।জানালা লাগাতে এগিয়ে গিয়ে দেখলাম টেবিলে একটা চিরকুট।পাশেই একটা ছোট ব্যাগ।চিরকুটে লেখা,
“প্রেসক্রিপশন দেখে ওষুধগুলো ঠিকমতো খেয়ে নিও।যদি কথা শুনো তাহলে রেগুলার আইসক্রিম পাবা।আর হ্যা,আঙ্কেল আন্টিকে জানিও না হুম?আমিতো তোমার ভালোই চাই,এভাবে বলে জাস্ট ভালোবাসায় মুড়িয়ে রাখলাম এই ছোট দায়িত্বটাকে,তোমার কাছে নাই আমি তাই।টেক কেয়ার”
আপির কাজ।বলে গেলো না যে সারপ্রাইজ পাবো!কখন করলো এসব ও?কারন,অনুরোধ,ভালোবাসা,কেয়ারিং সবকিছু এটে দিয়ে গেছে ওটুকো লেখায়।ডিনার পর ঠিকঠাক ওষুধটা খেয়ে ঘুমিয়ে পরলাম।আজকের দিনটা আমার মনের মতোই ছিলো।কালটাও যেনো আরো ভালো হয় ভাবতে ভাবতেই ঘুমিয়ে গেলাম।
#চলবে…
®