তোমাতেই অস্তিত্ব আমার পর্ব-৫

0
2997

#তোমাতেই_অস্তিত্ব_আমার
লেখনীতে:মিথিলা মাশরেকা

৫.

সকালে আব্বু আর এমদাদ আঙ্কেলের কথা শুনে রুমে এসে আবারো কেদেছি।আম্মু এসে খাইয়ে দিয়ে গেছে।কেদেছিলাম সেটাও বুঝেছে।আমি শুধু ছলছল চোখে তাকিয়ে ছিলাম তার দিকে।তারা কি করে এমনটা করতে পারে,এসবের শেষ কোথায় এসব ভেবে ভেবে রোবটের মতো ভাতের লোকমা গিলেছি।একপর্যায়ে কান্না পেলো আমার।আমাকে এভাবে দেখে কষ্ট হচ্ছে না আম্মুর?নাকি দেখে দেখে অভ্যস্ত হয়ে গেছে?আমাকে খাওয়ানো কিছু বলে ওঠার আগেই একটা ওষুধ মুখে পুরে দিলো আমার।চুপচাপ খেয়ে নিলাম।আম্মু বাইরে থেকে লক করে আবারো চলে গেলো।আবার কখন ঘুমিয়ে গেছি জানি না।
ঘুম থেকে উঠে গোসলটা সেরে রুমের দরজায় হাত লাগাতেই তা খুলে গেলো,মানে আম্মু দরজা খুলে দিয়েছে।ড্রয়িংয়ে রিজোয়ানের সাথেই কথা বলতে লাগলাম সোফায় বসে।

-পাখি?

দরজায় তাকিয়ে দেখি রিয়াপি দাড়িয়ে,পেছনে আব্বুও।কতটা পাল্টে গেছে ওর চেহারা!চোখের নিচের ডার্ক সার্কেল পরে গেছে,একদম হাড্ডিসার দেখাচ্ছে।আমি দৌড়ে গিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরলাম।কেদে দিয়েছি।আপিও আমার মাথায় হাত বুলাচ্ছে আর কাদছে।বেশ অনেকক্ষন পর আম্মু এসে দাড়ালো আমাদের পাশে।বললো,

-আচ্ছা বাবা হয়েছে হয়েছে,শুধু কি কেদেই যাবি মিথি?ছাড় ওকে।ভিতরে আসতে দে।

আমি চুপচাপ‌ ওকে ছেড়ে সরে দাড়ালাম।আপি‌ ভেতরে ঢুকে আমার রুমে গিয়ে বোরখা ছেড়ে ফ্রেশ হলো। সবার সাথে কুশল বিনিময় করে আমার কাছে এসে দাড়ালো।আমি তখনো নিচদিক তাকিয়ে ফুপাচ্ছিলাম।আমাকে ধরে আমার রুমে নিয়ে আসলো আপি,শুধুই দুজন আমরা।দরজা লক করে আপি কাছে এসে দাড়িয়েছে বুঝতেই আবারো ওকে জড়িয়ে ধরে জোরে জোরে কাদতে থাকি।আপি আমাকে ধরে নিয়ে বেডে বসালো।

-তোমার কান্না তো সহ্য হয়না আমার মিথি,এভাবে কাদতে থাকলে আমি কিন্তু থাকবো না এখানে।কষ্ট হয় না বুঝি আমার??

আমি চোখটা হাতের উল্টোপিঠে মুছে মাথা তুলে আপির দিকে একবার তাকালাম।আবারো তার কোলেই‌ মাথা রাখলাম।আপি বললো,

-রাগ হয়েছে?নাকি অভিমান?নাকি আমাকে কষ্ট দেওয়ার ছক কষেছো?

ফুপাতে ফুপাতে বললাম,

-কেনো এতোদিন আসো নি এ বাসায়?আমাকে মনে পরেনি তোমার?হসপিটালেও যাওনি তুমি।

-গিয়েছিলাম হসপিটাল।অজ্ঞান ছিলে তুমি।আর বাকি কথাগুলো বলবো বলেই তো এসেছি।তোমার সব প্রশ্নের উত্তর আজ দিবো মিথি।একটু রিল্যাক্স হও।

অবাক হলাম অনেকটাই।চোখ মুছে একটা শুকনো ঢোক গিলে বললাম,

-তুমি জানো?

-হ্যাঁ,জানি।তাইতো আসলাম জানাতে,কৈফিয়ত দিতে,কেনো এ একমাসে আসিনি তোমার বাসায়,যোগাযোগ করি নি কেনো।সবটা বলবো।শান্ত হও তুমি আগে।এর আগে বরং লান্চ টা করে নেই।উফ্ফ!বড্ড খিদে পেয়েছে।

আমাকে টেনে এনে খাইয়ে দিলো আপি।অতিকষ্টে কান্না সংবরন করে ছিলাম।কিছু খেয়েই রুমে চলে আসলাম।রিয়াপি আব্বুর সাথে কথা বলে রুমে আসলো।আমার চোখে প্রশ্ন,আপির মুখে আশ্বসের হাসি।ও এখন সবটা বলবে আমাকে।আমি নিজেকে সামলিয়ে প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম ভয়ানক কিছু শোনার জন্য।কি ঘটেছে আমার জীবনে?আজ জানবো সবটা।রিয়াপি বেডে আমার কাছে বসে আমাকে জরিয়ে ধরে শান্ত গলায় বললো,

-ক্যালেন্ডার দেখেছো?

কোনো ক্যালেন্ডার এ বাসায় নাই।আব্বু,আম্মুর ফোন খুজেছি অনেক,কখনোই পাইনি।বাসার টিভি অবদি চলে নাই এ একমাসে।আম্মু বলতো আমি হসপিটালে থাকতে নাকি নষ্ট হয়ে গেছে।সিচুয়েশনস্ নিয়ে আমিও এতো ডিপ্রেসড্ ছিলাম যে কোনোদিকেই হুশ ছিলোনা আমার।এ একমাসে সারাদিন ঘরের কোনে মুখ গুজে শুধু কি হয়েছে আমার সাথে সবটা মনে করার চেষ্টা করতাম আর আম্মুকে জিজ্ঞাসা করতাম !আপি বললো,

-হসপিটালে সেন্স আসার পর লাস্ট কি করেছিলে বলে তোমার মনে পরেছিলো?

আমি মাথা তুলে আপির দিকে তাকিয়ে বললাম,

-সবটাই ঝাপসা আপি,আমার শুধু কলেজের র্যাগ ডের কথাটাই মনে আছে।তারপর চায়নার প্যান্ডেমিক।জ্ঞান ফেরার পর জানতে পারি এদেশেও বেশ তান্ডব চালিয়েছে করোনা এই তিন মাসে।

-ওটা তিন মাস নয় মিথি।প্রায় দেড় বছর!

ওর কথা শুনে আমি আকাশ থেকে পরলাম।কি বলছে কি ও এসব?আপি বললো,

-শান্ত হও মিথি,নিজেকে প্রেশারাইজ করো না।সবটা বলবো বলেই তো এসেছি।আঙ্কেল তোমার সুস্থতার কথা ভেবেই কিন্তু আমাকে ডেকে পাঠিয়েছে।আমাকে তার কাছে ছোট হতে দিওনা প্লিজ।

-ত্ তারমানে আমি…

-হুম।তোমার লাইফের বেশ কিছুটা সময়,না বেশ অনেকটা সময়ই তুমি হারিয়ে ফেলেছো।

কাদতে লাগলাম।আপিকে জরিয়ে কাদতে কাদতে বললাম,

-কতটা?কতটা আপি?বলো?এই সময়ের সাথে আর কি কি হারিয়েছি আমি আপি?বলো?প্লিজ বলো?

আপি আমার চোখ মুছে দিয়ে বললো,

-কেদোনা তুমি,তেমন কিছুই হয়নি এ কয় মাসে।বরং আরো ভালো কিছু পেয়েছো তুমি।আফসোস একটাই যে সেই সুন্দর মুহুর্তগুলোর স্মৃতি নেই তোমার কাছে।

কান্না থামিয়ে আপির দিকে তাকালাম।আপি হেসে দিয়ে বললো,

-তুমি জানো তুমি এখন কোন ক্লাস?

আমি চুপ করে আপির হাসিটা দেখছি।আপি আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো,

-আমার পাখিটা এবার অনার্স ফাস্ট ইয়ারের সেকেন্ড সেমিস্টার।

আমি একপ্রকার শকে চলে গেছি।কলেজ পেরিয়ে ভার্সিটি?আমার এইচএসসি?অ্যাডমিশন টেস্ট?আমি কিছু বলে ওঠার আগেই আপি বলতে লাগলো,

-প্যান্ডেমিকের জন্য এইচএসসি পিছিয়ে যায়।তোমাদের এইচএসসি বাতিল হয়। অটোপাশ।প্যান্ডেমিক কমলে সাত মাস আগে অ্যাডমিশন দিয়েছিলে তুমি।আল্লাহর ইচ্ছা,আর তোমার পরিশ্রমের ফলস্বরুপ চান্স হয়ে যায় তোমার। কাঙ্ক্ষিত ভার্সিটিতে,কাঙ্ক্ষিত সাব্জেক্টে।তুমি এখন ফার্স্ট ইয়ার কোয়ান্টাম মেকানিক্সের স্টুডেন্ট!

আপির কথায় চোখ দিয়ে পানি পরছে আপনাআপনি।খুশির।যেনো আজ নতুন করে রেজাল্ট বেরোলো আমার।আপি বললো,

-দু মাস ক্লাসও করেছো তুমি তোমার ভার্সিটিতে!

এবার কষ্ট হচ্ছে আমার।না আমি এতোবড় আনন্দগুলো কিভাবে ওদের সাথে সেলিব্রেট করেছি তা মনে করতে পারছি না পারছি ভার্সিটির প্রথম দিলগুলো কিভাবে কাটিয়েছি তা মনে করতে।হুট করে নিলুর কথা মনে পরলো আমার।তারমানে ও সেদিন আমার ভার্সিটি আসার কথাই বলেছিলো,তাই আমার কিছু মনে ছিলো না।

-জানো?তোমার এক্সিডেন্টের পর ডাক্তার বলেছিলো মাথায় চোট পাওয়ার জন্য তোমার ম্যামোরি লস হবে।কিন্তু ওরা ক্লিয়ারলি বলতে পারছিলো না কতটা সময় তোমার স্মৃতি থেকে মুছে যাবে।বলেছিলো দু মাস,দু বছর,বা দশ বছরও হতে পারে।তুমি জানোনো কতটা কেদেছিলাম আমরা সবাই।তোমাকে ছাড়া যে আমরা অসম্পুর্ন। কি ভয় যে পেয়েছিলাম!বিশ্বাস করো,তুমি আমাদের ভুলে গেলে খুব কষ্ট পেতাম আমরা।খুব!তারপর তোমার সেন্স আসার পর ওবজার্ভেশনে ডক্টরস্ বুঝতে পারে খুব বেশি না,আনুমানিক দেড় বছর বা তার বেশি কিছুটা সময় তোমার ম্যামোরি থেকে মুছে গেছে।

আপি আমার চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে গালে হাত রেখে বললো,

-কাদছো কেনো বলোতো?কোনো খারাপ কিছুতো না,ইট ওয়াজ এন এক্সিডেন্ট!

-আমি কি সত্যিই ওয়াশরুমে পরে গিয়েছিলাম?নাকি অন্যকিছু হয়েছিলো?

আমার কথায় আপি মাথা নিচু করে ফেললো।আমি বুঝলাম বড়সড় কিছুই হয়েছে।আপির হাত মুঠো করে বললাম,

-বলো আপি?কি হয়েছে আমার সাথে কেনো আমার সেইফটির জন্য আব্বুকে পুলিশ ফোর্স অবদি এফোর্ট করতে হলো?

আপি অবাক হয়ে তাকালো আমার দিকে। বললো,

-তুমি এটা কি করে জানো?

-তা বড় কথা নয়,আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দাও!কেনো আব্বু এসব করছে?কেনো বেরোতে দেয়নি আমাকে?ম্যামোরি লস নিয়ে কেনো কিচ্ছু বলেনি আমাকে?কেনোই বা আমার মেডিসিন দিয়ে সুস্থ্য হও‌য়াতেও তারা ভয় পাচ্ছেন?কেনো বাসা ছেড়ে আমাকে কোথাকার সেইফজোনে পাঠানোর চিন্তাভাবনা করছেন?কেনো আপি?কেনো?

আপি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,

-বেরোতে দেয়নি,পুলিশ ফোর্স,সেইফজোন,এসব তোমার ভালোর জন্যই ভেবেছেন তারা।

-সেটাই‌তো জানতে চাচ্ছি,আমার এতো সিকিউরিটির কি দরকার?

-সব বাবা মাই চায় তাদের মেয়ের সিকিউরিটি।

-তা বলে এতোটা?যেনো কেউ এসে তুলে নিয়ে যাবে আমাকে!

-এমনটা তারা ভাবতেই পারেন।

-না পারেন না,বুঝতে শেখার পর থেকে তাদেরকে দেখেছি আমাকে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে দিয়েছেন,নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিয়েছি আমি সবসময়।তাহলে হুট করে কি হয়ে গেলো যে এভাবে ঘরবন্দি করে রাখছেন আমায়?আমার ম্যামোরি লস নিয়ে জানায়নি কেনো?আর মেডিসিন…

-এ বয়সে ম্যামোরি লস হয়েছে জানলে মানতে কষ্ট হতো তোমার।কষ্ট পেতে তুমি।মেডিসিন তোমার প্রয়োজনটা ভেবেই দিয়েছেন তারা।

-তবে বলো,এতোসব সিকিউরিটি?

-বললাম তো,তোমাকে নিয়ে চিন্তা করেন তারা।ভালোবাসেন তোমাকে।

-কিন্তু আপি…

আপি কিছুটা রেগে বললো,

-এভাবে উনাদের ভালোবাসাকে প্রশ্ন করতে তোমাকে তো কোনোদিন দেখিনি।কেনো এভাবে ভাবছো তুমি?

-এভাবে ভাবার বিষয় নয় কি?তোমার সাথে হুট করে দু চারজন বডিগার্ড লেগে গেলে কেমন ফিল হবে তোমার?

আপি গম্ভীরভাবে বললো,

-কিছু কিছু সময় কিছু কিছু ঘটনা জীবন থেকে মুছে যাওয়াই ভালো।তোমার লাইফেরও এটা একটা দুঃস্বপ্ন ছিলো।আজ তোমাকে সে ঘটনা মনে করিয়ে দেওয়ার ফল ভালো হবে না কারো জন্যই।আমি চাই তুমি সামনের দিনের কথা মনে করো।তোমার আশেপাশে শুধু ভালো মুহুর্তের ছোয়া এনে দেওয়ার দায়িত্ব আমাদের মিথি।এসব আর ভেবো না প্লিজ।হাতজোর করছি তোমাকে।

আপির কথার মানে বুঝলাম।তারমানে আমার জীবনে অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু ঘটে গেছে,যেটা ওরা না চায় আমাকে জানাতে,না চায় আমার মনে পরুক। আপি আবারো বললো,

-দুটো চয়েজ আছে তোমার,সবটা ভুলে সামনের দিনগুলোকে সাজিয়ে নেওয়া,নয়তো অতীতের কিছু দুঃস্বপ্ন মনে করতে গিয়ে বর্তমানকে হারানো।আমি বলছি তো তোমাকে,এক্সাক্টলি সবটা তুমি যেমন চাইবে তাই হবে যদি পুরোনো কথাগুলো নিয়ে এ বাসায় কিছু না বলো,আমি আঙ্কেলকে বোঝাবো।নইলে এরা আবার তোমার পায়ে বেড়ি পরাবে মিথি,তোমার ভালোর জন্যই।

-কি হলো?বলো মিথি?আগের লাইফটাই চাও,নাকি এসব কথার জন্য নিজের স্বাধীনতা হারাতে চাও?

আমি দুহাতে চোখ মুছে বললাম,

-যা ছিলো,তা অতীত।আমি তোমার সাথে,আব্বু আম্মু সবার সাথে সেই আগের লাইফটাই লিড করতে চাই।যেখানে এতোটা বাধ্যবাধকতা নেই,আটকে রাখা নেই।

আপি হেসে বললো,

-জানতাম,তুমি বুঝবে আমার কথা।আজ থেকে তুমি আবারো মুক্তভাবে বাচবে।শুধু একটু আমার কথা শুনো,দেখবে সবটা ঠিক আছে।

আমি আপিকে জরিয়ে ধরলাম।অনেক কথাই বললো আপি আমাকে,এই দেড় বছর নিয়ে,আমার আনন্দের কথা সব।কিন্তু কেনো জানি না মনে হচ্ছিলো এসবের মধ্যে আমি আমার অনেক প্রিয় কিছু,ভালোবাসার কিছু হারিয়ে ফেলছি,যদিও তেমনটা কিছু থাকার কথা না।কিছুক্ষন পর বললাম,

-আপি,আমি কি খুব স্পেশাল কিছু ভুলে গেছি?স্পেশাল কাউকে হারিয়েছি?

আপি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,

-তোমার কাছে কিছু স্পেশাল ছিলো কিনা সেটা তো তুমিই জানতে,তবে তা থাকলে আমার কাছে লুকোতে না।যাই হোক,কাল থেকে তুমি ভার্সিটি যাচ্ছো,উইথআউট গার্ড অর পুলিশ।আ’ইল মেক শিওর অফ দ্যাট।আর হ্যা,আজ রাতে আমরা ভিডিও কলে আশু মালুর সাথেও কথা বলবো হুম?

খুশি হয়ে গেলাম আমি।এবার ভালো লাগছে।ভার্সিটি যাবো,আশু মালুর সাথে কথা বলবো,এতেই মন ভালো হয়ে গেছে আমার।বিকালটা আব্বু,আম্মু সবার সাথে বেশ ভালোভাবেই কাটিয়েছি।আপির কথামতো কিচ্ছু জিজ্ঞাসা করিনি কাউকে।অনেকটাই ঝেড়ে ফেলেছি‌ মাথা থেকে,ওরাও বেশ মজাতেই রেখেছে আমাকে।

রিয়ার রুমের খাটেরতলায় ঠুকঠুক করে কাপছে আদিব।আজ মিথির বাসায় কি কি হলো গার্ডসদের কাছে তার ডিটেইলস্ চেয়েছে আরমান।আদিব জানে গার্ডসদের কাজের ধরন।ওরা কোন বিষয়ে কতোটুকো গুরুত্ব দিতে পারে।তাই সবসময় আরমানের প্রতিটা অর্ডারের ডাবল ইনিশিয়েশন করে ও।এমনিতেও বাসায় বসে বোর হচ্ছিলো,আর আরমানের কাছে মিথির ইম্পর্টেন্স জানতো।তাই মিথির ব্যাপারে খোজ নিতে ও নিজেই বেরিয়ে আসে।কিন্তু মিথির বাসার চারপাশে বেশ ভালোমতো সিসিক্যামেরা লাগানো দেখে আর সাহস পায়না ভেতরে যাবার কোনো উপায় খোজার।আদিব জানে,রিয়ারা যেহেতু ও বাসায় গিয়েছিলো,তাহলে ওরা জানে কি হয়েছে ওখানে।আর এতোদিন পর যেহেতু গিয়েছিলো,তাহলে ওদের বাসায় নিশ্চয়ই আলোচনা হবেই এ বিষয়ে। তাই গাড়ি ঘুড়িয়ে রিয়াদের বাসার দিকেই এগোতে থাকে।

এখানে এসে কিছুটা অবাক হয় ও।কালঅবদি এ বাসাতেও গার্ডস ছিলো,আজ সবটা ফাকা।যেনো খোলা দাওয়াতের বোর্ড ঝুলছে,এন্ট্রি ফর অল।কিছুক্ষন ভেবে তারপর বুঝতে পারে এর কারন।আরমানের সবটা জানা শেষ,তাই ও আর ওদের নিয়ে টানাহ্যাচড়া করবে না এমনটা ওরাও বুঝে গেছে।বাসাটা একবার চক্কর দিয়ে ব্যালকনির সাথের দরজাটাই খোলা পায় আদিব।ব্যস!আর কি লাগে!কিন্তু সমস্যা হলো ঘরে ঢোকার পর বুঝতে পারলো ওটা রিয়ারই ঘর ছিলো।ও ঢোকার সাথে সাথেই রিয়াও ভেতরে ঢুকে পরে।বাসায় কিছু একটা রেখে গিয়েছিলো তাই আসে রিয়া।অতি সৌভাগ্যের জোরে হামাগুড়ি দিয়ে খাটের নিচে লুকাতে সক্ষম হয় আদিব।

রুমে ঢুকেই আয়নার সামনে গিয়ে হিজাব বোরখা ছেড়ে ওয়াশরুমে ঢোকে রিয়া।আদিব ভেবে পাচ্ছে না ও কি করবে!দুমিনিটেই বাইরে বেরিয়ে আসে রিয়া।এদিকে ফ্লোরের ঠান্ডায় জমে যাচ্ছে আদিব।ঝুলে থাকা বিছানার চাদরের নিচ দিয়ে চোখ বের করতেই ওর চোখে পরলো ফর্সা দুটো পায়ের গোড়ালির উপরের অংশে লেগে থাকা পানির কনা।তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বারবার বেডের এপাশ থেকে ওপাশে হাটছে রিয়া।সিচুয়েশনগুলো এমন ছিলো যে,প্রতিবারই রিয়ার শুধু বিধ্বস্তরুপেই দেখা মিলেছে আদিবের।আগেরদিনও বাবার শোকে এলোমেলোভাবেই হসপিটালে গিয়েছিলো মেয়েটা।আদিবের খুব ইচ্ছা হলো উঠে ওর সবেমাত্র ফ্রেশ হওয়া চেহারাটা দেখতে।কিন্তু আবারো পরিস্থিতির বাধা দেয়াল!যে কাজে এসে সেটাও হচ্ছে না ভেবে মেঝেতেই মাথা ঠুকে উপুর হয়ে শুয়ে পরে আদিব।

মিথিকে ওসব কথা বলার পর চিন্তাটা কমেছে না বেড়েছে তার আইডিয়া করতে পারছে না রিয়া।মেয়েটা একটু বেশিই চঞ্চল।ওকে তো ওর মতোন করে বুঝিয়েছি যাতে ও নিজেকে কোনোভাবে হেল্পলেস না ভাবে,আমাদের ভুল না বোঝে।কিন্তু কয়েনের আরেক পিঠ তো দেখেনি ও।কি জানি কি হতে চলেছে সামনে!মোবাইল হাতে নিয়ে ফোন লাগায় মাহবুব আলমের ফোনে।

-আসসালামুআলাইকুম আঙ্কেল।

রিয়ার কথা বলার ভঙ্গিমা শুনেই খাটের তলার আদিব বুঝলো ও মিথিলার বাবার সাথেই কথা বলছে।তড়িঘড়ি করে মাথা উঠাতে গিয়ে খেলো এক বাড়ি।মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে গাল ফুলিয়ে ওর কথা শোনায় মনোযোগী হলো।
মাহবুব আলম রিয়ার কল দেখে খুশি হয়ে সোফা থেকে উঠে এসে রিসিভ করলেন।

-ওয়ালাইকুমআসসালাম।বলো রিয়া।বাসায় চলে গেছো কেনো?

-আসলে একটা ইম্পোরটেন্ট কাজ ছিলো।আঙ্কেল মিথি কই?

-এইতো ড্রয়িংয়েই বসে টিভি দেখছে।তোমার কল পেয়েই আমি সরে আসলাম ওখান থেকে।জানো রিয়া,তুমি ওকে কিভাবে কতোটা বোঝালে আমার মাথাতেও কিছু ঢুকলো না,কিন্তু ওর এই হাসিমুখ!এটা দেখে আমার যে কি খুশি লাগছে!

-আপনি একদম চিন্তা করবেন না আঙ্কেল।সব ঠিক হয়ে যাবো।ওকে সবটা বলাতেই আরো ভালো হয়েছে।এবার অন্তত ও আমাদের ভুল বুঝবে না বা এমন কিছু করবে না যাতে আমরা বারন করেছি।

রিয়ার কথা শুনে আদিবের মাথায় যেনো রীতিমতো খাটটাই ভেঙে পরেছে,তার উপর আকাশ।কি বলছে টা কি এই মেয়ে?মিথিকে সবটা বলে দিয়েছে?এতে তো ওর আর আরমানের প্লানের অনেকটারই বারোটা বেজে গেলো।দাতে দাত চেপে রাগ সংবরনের চেষ্টা করছে আদিব।এই মেয়ে একটু বেশিই বোঝে!মিথিলার ফ্যামিলি বা কবির রহমান বা অন্য কারো মাথাতেই ওকে সবটা বলার প্লান আসবে না,পারলে উনারা আরো লুকিয়ে যাবেন।এটা এই অতিরিক্ত সবজান্তা সমশেরনির মাথাতেই আসবে।ইচ্ছা তো করছে একে…

-আঙ্কেল,আমি সন্ধ্যায়ই আসছি ওই বাসায়।মিথি বলেছে আমাকে ও ভার্সিটিতে যাবে,নতুন করে শুরু করবে সবটা।আর…

কথাগুলো বলে রিয়া ড্রেসিংটেবিলে ফোন রেখে লাউডস্পিকার অন করে দেয়।কানের দুল চেন্জ করবে বলে।আওয়াজ পেয়ে আদিব মাথা বের করে একটু উকি দিয়ে দেখলো।মনে মনে খুশি হলো।যাক কিছুতো করলো আমার পক্ষে,আমার সুবিধার জন্য!মাহবুব আলম বললেন,

-কি বলছো টা কি তুমি?ও এখনই ভার্সিটি যাবার কথা ভেবেছে?

-হ্যাঁ আঙ্কেল।আপনি একদম চিন্তা করবেন না।আমি এসে আপনাকে সবটা বলছি।ওকেও আবারো বুঝিয়ে বলবো।

-বেশ,আসো তুমি।আমি আরেকজনকে ডেকে পাঠিয়েছি।

রিয়া ভ্রুকুচকে দুল রেখে মোবাইলের লাউড অফ করে কানে ধরে বললো,

-আরেকজন মানে?কাকে আঙ্কেল?

এই মেয়েটাও না,একেবারে বেশি চালাক।পুরাই একপিস।সবসময় আমার ভাবার উল্টোটাই করবে।আবারো রাগ উঠলো আদিবের।মেইন সময়টায় এসেই ওকে লাউড অফ করতে হবে!শেষ উনার দুল পড়া!একদিন তোমার কানে যদি লকারের লক সিস্টেম দুল না পরিয়েছি তিনঘন্টা যাবত তো আমিও….উইথআউট সাউন্ডের একটা পাঞ্চ মারলো মেঝেতে।ওপাশের কথা শুনে রিয়া বললো,

-ওওওও!আচ্ছা!ঠিক আছে।

-আচ্ছা,বেশ।তুমি আসো বাসায়।দেখা হচ্ছে তাহলে।

-জ্বী আল্লাহ হাফেজ।

মোবাইল রেখে চুলগুলো আচড়াতে আচড়াতে ব্যালকনিতে চলে যায় রিয়া।কিছুক্ষন পর রুমে আসে,তবে ব্যালকনির দরজা লাগিয়ে।এবার এতো শীতের মধ্যেও আদিবের ঘাম ঝড়ছে।একেতো রাগ,তারউপর যাওয়ার রাস্তায় এভাবে অ্যালার্ম ধরিয়ে দিলো,দরজা খুললে নির্ঘাত শব্দ হবে।এ মেয়েটা পারেও!!!খাটের নিচেই মশার সাথে মনালাপ করতে লাগলো।চুল আচড়িয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছে রিয়া।ক্লান্ত লাগছে ওর অনেক।মিথিকে হ্যান্ডেল করাটা কি তা একমাত্র ওই জানে।হঠাৎই দরজা খোলার শব্দে চোখ মেলে ও।ব্যালকনির দরজা খোলা।ধুপ করে কিছু পড়ারও শব্দ হলো।দৌড়ে গিয়েও কাউকে পেলোনা রিয়া,তবে এটা বুঝলো ঠিকই যে কেউ ছিলো।কিন্তু কে??
কোনোমতে পালাতে পেরে আদিবের খুশি দেখে কে!তবে রিয়ার উপর রেগে আছে।আরমানকে ফোনে সবটা বললো ও।দুঘন্টা হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেয়ে আরমান বললো,

-এতোটা রিস্ক না নিলেও পারতি তুই ভাই।যে রিয়াপি!বাপরে বাপ!যাই হোক,আমার প্লানের সবটা ঠিকই আছে,এমদাদ মামুকেও ধরেছিলাম।টেনশন করিস না।মাহমুদ আলম কাকে ডেকেছেন আজ তারও আন্দাজ করতে পারছি আমি।কিছুই করতে হবে না এখন আমাদের।আমিতো কিছু করবোই নাহ্।মাম্মি কা গুড বয় হয়ে গেছি।

আদিব হেসে বললো,

-হ্যাঁ,তা তো দেখতেই আই‌মিন বুঝতেই পারছি।যাই হোক,রাখছি এখন।মশার কামড় খেয়ে শরীর জ্বলছে আমার।টেক কেয়ার।

-হুম ভালো থাক।বাই।

কল রেখে বাকা হাসলো আরমান।যেমনটা চাচ্ছিলো তেমনটাই হচ্ছে সবটা।পরক্ষনে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললো,

-হাহ মিস্টার আলম!নিজের আশেপাশের লোকগুলোকে না চিনে তাদের সাথে হাত মেলাচ্ছেন?তবে আপনার বোকামোর জন্য মিথিকে কষ্ট পেতে দিবোনা আমি।সবটা আমার প্লানমতোই হবে।ঠিক যেমনটা আমি চাই!

সন্ধ্যায় আপি আসার আগেই কনফারেন্স কলে আশু মালুর সাথে কথা বললাম।এতোদিন খবর না পেয়ে বেশ রেগে ছিলো ওরা।সবটা বুঝিয়ে বললাম ওদের,ঠিক যেমনটা রিয়াপি বলেছে আর বলতে বলেছে।আমার কথা শুনে বেশ কিছুক্ষন নিরব থেকে আশু বললো,

-যা হওয়ার হয়েছে।সো?এবার কি থ্রি ইডিয়টস্ এক হবে নাকি মিথি নামক র্যাঞ্ছোরদাশ শ্যামলদাস চ্যাঞ্চোর এভাবেই হাওয়া হয়ে থাকবি?

আমি হেসে দিয়ে বললাম,

-নো বেবস্,এবার আমরা এক হবো।কাল ভার্সিটি যাবো।আসবি তোরাও,নো তিন নাম্বার হাত।অনেক কথা আছে।আন্টি আঙ্কেলকে আমার সালাম দিস।আল্লাহ হাফেজ।

ওরাও হেসে ওকে বললো।ওদের সাথে কথা বলে বেশ হালকা লাগছিলো।আমি পিছন ফিরে দেখি আব্বু খুশির অশ্রু ভরা চোখে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে।এগিয়ে গিয়ে জরিয়ে ধরলাম,আব্বুও দুহাতে জরিয়ে আছেন।কিছুক্ষন আগে উনিই আমার হাতে মোবাইল ধরিয়ে দিয়ে বলেন,

-এই কয়েকদিনের জন্য সরি।আর হবেনা এমন।তুমি যা চাইবে তাই হবে মিথি।আর হ্যাঁ,আজ ডিনারে একজনকে ডেকেছি।পরিচয় করাবো তোমাকে।

আব্বুকে এভাবে কথা বলতে দেখে বেশ ভালো লাগছে।তবে কাকে ডেকেছে ডিনারে?কার সাথে পরিচয় করাবে আমার?এটা ভেবেই খুশি হলাম বাসায় কেউ আসছে,আমিও বেরোবো কাল!!আবারো সবটা ফিরে পেয়েছি আমি।আর কিছু চাইনা আমার।যাকনা কিছু মুহুর্ত জীবন থেকে,যদি তেমন কিছু হয়েও থাকে হোক!ওরা সবাই আমার পাশে আছোতো!!আপনজনদের মাঝে এভাবেই‌ বাচতে চাই আমি।

#চলবে…

®

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here