তোমাতেই অস্তিত্ব আমার পর্ব-২৮

0
2107

#তোমাতেই_অস্তিত্ব_আমার
লেখনীতে:মিথিলা মাশরেকা

২৮

ঘুম ভাঙলো আজও সেই চেনা শরীরের সুঘ্রানেই।তবে আজ মনে হচ্ছে সে মানুষটা এখনো কাছেই আছে,জরিয়ে রেখেছে আমায়।প্রতিদিনের মতো চলে যায়নি।আজ সকালে সে নিজের অস্তিত্বকে আমার সামনে জানান দিতে এখনো অবদি আমার কাছেই আছে।চোখ পিট পিট করে খুললাম।আবছা কারো গালের চাপ দাড়ি,গলার কাছে কালো শার্টের খোলা বোতামের মধ্য দিয়ে উদোম ফর্সা বুকটা চোখে পরছে।মাথাটা একটু ভারি হয়ে আছে।এ দৃশ্য আদৌও বাস্তব কিনা তা যাচাই করতে মাথা তুলতে গিয়ে বুঝলাম আধশোয়া কারো বুকের মধ্যে আছি আমি।এটা কি করে হতে পারে?ঘুমঘুম চোখে একরাশ অবিশ্বাস নিয়ে মানুষটার দিকে তাকাতেই আতকে উঠলাম।মুখে সেই নজরকারা হাসি ঝুলিয়ে আরমান তার ঠোট আমার কপালে ছুইয়ে বললেন,

-ভেরি গুড মর্নিং!

ধরফরিয়ে উঠে বসলাম।টকটকে লাল লেহেঙ্গা পরে আছি।গা ভর্তি ভারি ভারি গয়না আমার।বিস্ময় নিয়ে নিজেকে দেখছি আর কাল বিকেলের ঘটনাগুলো ভাবছি।কি হয়েছিলো কাল?আমাকে ভাবার সুযোগ না দিয়েই আরমান হুট করেই পিছন দিয়ে হাত দিয়ে আমার কোমড় জরিয়ে ধরলেন।রাগে গায়ে জ্বালা ধরে গেলো আমার।চমকে উঠে হাত ছাড়াতে ছাড়াতে বুঝলাম আমি আমাদের বাসারই ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে,সেন্টার টেবিলে পা ছড়িয়ে আরমানও একই সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে আধশোয়া হয়ে আছেন।আমি ওনার হাত কোমড় থেকে ছাড়ানোর চেষ্টায় আছি।উনি একটানে তার উপর আমাকে ফেলে বললেন,

-কালরাতে এভাবে সোফায় ঘুমাতে তোমার কষ্ট হয়নি তো?এই কোমড়ে লেগেছে?এখানে?

সাথে সাথে একটা কিছুর আওয়াজ হলো।আমি শব্দ অনুসরন করে সেদিকে তাকালাম।সে দৃশ্য দেখে বুক ফেটে কান্না আসছে আমার।সামনের ডাইনিং টেবিলের চেয়ারগুলোতে আব্বু,কবির আঙ্কেলকে হাত পা বেধে রাখা।চোখমুখও কালো কাপড়ে বাধা।

-আব্বু!

আর্তনাত করে আরমানের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়াতে ব্যস্ত হয়ে পরলাম।পারলাম না,উনি হাত ধরে আছেন শক্তকরে।ব্যথা পাচ্ছি আমি।আব্বু,কবির আঙ্কেলও নড়াচড়া করছেন,কিছু বলতে চাইছেন।কিন্তু গায়ের বাধনের জন্য নড়তে পারছেন না, মুখের বাধনের জন্য বলতে পারছেন না।পাশের রুম থেকে আওয়াজ এলো,

-মিথি!জেগে গেছো তুমি?আরমান!ছেড়ে দাও মিথিকে।দরজা খোলো।

এটা রিয়াপির গলা।আপিকে লক করে রেখেছে।ভেতর থেকে আম্মু বললো,

-আরমান! দরজাটা খোলো।কি করছো তুমি এসব?প্লিজ দরজাটা খোলো।

-আম্মু,,,আম্মু তোমরা?

-আপু!আপু তুমি ঠিক আছোতো?

বন্ধ দরজার ওপারে রিয়াপি,মাইশু,আম্মু,রিয়াপির আম্মু সবার গলার আওয়াজ আসছে।চারপাশ দেখে কি থেকে কি হয়ে গেলো ভাবতে লাগলাম।

*
কাল দুপুরের পর ছাদ থেকে বাসায় ঢুকে আব্বুকে দেখতে পাই।ঘাবড়ে গেলাম আমি।আব্বু গম্ভীরভাবে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে বিচলিত হয়ে বললেন,

-কবে বড় হবে তুমি মিথি?এখনো কি বৃষ্টি দেখলেই এভাবেই বেরোনোটা জরুরি?ভিজতেই হবে?অসুস্থ্য হয়ে পরবে তো!

মাথা নিচু করে বললাম,

-সরি আব্বু।আপনি জেগে আছেন?

-ডোরবেল বাজালো কে?

চুপ থাকলাম।কিছু বললাম না।আব্বু বললেন,

-যাও,চুপচাপ চেন্জ করে নাও।ঠিকমতো মাথা মুছো।

আমি মাথা নেড়ে রুমে ঢুকলাম।বাথরুমে গিয়ে আগে চেন্জ করে নিলাম।অসুস্থ্য হলে এরা সবাই টেনশন করবে।বেরিয়ে আবারো জানালার কাছে বসে ছাদের ঘটনাগুলো ভাবছি আর কাদছি।মাইশু তখনো ঘুমাচ্ছে।এতোটা খারাপ ব্যবহার করতে পারলেন আরমান আমার সাথে?কেনো করলেন উনি এমন?আমি শুধু ওনার এমনটা বলে গেলেন কেনো?কি করবেন উনি?কখন সন্ধ্যা হয়েছে টেরই পাইনি।কেউ সামনে কফির মগ এনে ধরলো।তাড়াতাড়ি চোখের পানি মুছে পাশ ফিরে দেখি মাইশু মগ হাতে দাড়িয়ে।বললো,

-নাও।ফ্রেশ লাগবে।

অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষন।আমার জন্য মাইশু কিচেনে গিয়ে কফি এনেছে?ও আবারো বললো,

-হা করে দেখলে কি খাওয়া হয়ে যাবে?না তো তাইনা?আমার নিজে হাতে বানানো কফি ঠান্ডা হয়ে যাবে।খেয়ে নাও।ধরো।

এবার আরো অবাক হলাম।যাকে একটু এটা ওটা এগিয়ে দেওয়ার সময় ঝগড়া লাগিয়ে,কথার ফাদে ফেলেই কাজ হাসিল করাতে হতো,সে কিচেনে গিয়ে নিজে হাতে কফি বানিয়েছে আমার জন্য!ও চোখ পাকিয়ে ইশারা করলো কফিটা নেওয়ার জন্য।চুুমুক দেওয়ার পর বিশ্রি স্বাদের রিয়্যাক্ট দেওয়ার আগেই আব্বু ডাক দিলেন।আমি মুখের টুকো কোনোমতে গিলে বেরিয়ে আসলাম।আব্বু বললেন,

-এদিকে আসো মিথি।

আমি এগিয়ে গেলাম।আব্বু হাত দিয়ে তার পাশে বসতে বললেন।করলামও তাই।আমার মাথায় হাত রাখলেন উনি।আমি তার কাধে মাথা রাখলাম।শান্তি লাগছে আমার।কিন্তু কষ্টও হচ্ছে।অনেক।আব্বু আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন আমি নিচদিক তাকিয়ে আছি।আচমকাই ওনার ফোন বেজে উঠলো।আব্বু আরেকহাতে রিসিভ করে কানে ধরলেন।যদিও মাথা উঠাতে চেয়েছিলাম,উনি সরাতে দেননি।ওপাশ থেকে বললো,

-হ্যা্ হ্যালো?

-হ্যাঁ সিয়াম,তুমি আজ আসলে না যে?

-আ্ আঙ্কেল,আসলে আ্ আজ…

-কি হয়েছে সিয়াম?এভাবে কথা বলছো কেনো তুমি?

….

-হ্যালো?

-কিছু না আঙ্কেল।আজ কাজ ছিলো।আমার সাডেন ট্রান্সফারের ওর্ডার হয়েছে।আজই লেটার দিয়েছে।আঙ্কেল,কালই বান্দরবন যেতে হবে আমাকে।

-কি?হুট করে এসব…

-আঙ্কেল,কথা শেষ হয় নি আমার।শুনুন,আমি মিথিকে আজই বিয়ে করতে চাই।ওকে একা এখানে রেখে যেতে পারবো না আমি।ওকে নিয়ে কাল চলে গেলে স্বস্তি পাবো।আরমানের চিন্তা করতে হবে না আর!

সবটাই শুনলাম আমি।বিয়ে আর আরমানের নাম শুনে মাথা সরিয়ে নিলাম আব্বুর কাধ থেকে।দাড়িয়ে গেলাম।কি বলছে সিয়াম এগুলো?আজই বিয়ে?আরমান আমাকে পছন্দ করে এসব জানে উনি?আব্বুও কি তবে?

-কি বলছো কি তুমি এসব?এতো তাড়হুড়োয় বিয়ে?আর তাছাড়া আরমান তো এখন আর…

-প্লিজ আঙ্কেল,কোনো না নয়।আপনি বিশ্বাস করেন না আমাকে?মিথিকে অনেক ভালো রাখবো আমি।আর আরমানকে আমার এতোটুকো বিশ্বাস নেই।

-সিয়াম,তবুও,,,তোমার আব্বু?

-আপনি শুধু বলুন আপনি রাজি কি না?আজ রাতেই‌ বিয়ে হবে আমার আর মিথির।আমি লোক পাঠাচ্ছি।নইলে…

আব্বু একপলক আমার দিকে তাকালেন।তারপর শক্তভাবে বললেন,

-বেশ।এসো তুমি।

ফোনটা কেটে আমার দিজে তাকালেন আব্বু।করুনভাবে তাকিয়ে আছি তার দিকে আমিও।কি দোষ করেছি আমি?কেনো এতোবড় শাস্তি পেলাম?একটা দিনের ব্যবধানে সবটা তোলপাড় হয়ে গেলো।দাড়িয়ে থাকতে পারলাম না আর।সবকিছু আবছা হয়ে আসলো।জ্ঞান ফেরার পর দেখি রিয়াপি বিছানায় আমার পাশে পানির গ্লাস হাতে বসে।রুমে চোখ বুলিয়ে আব্বু বাদে সবাইকে পেলাম।রিয়াপিরা আবার এসেছে তিনজনই।আম্মু ডুকরে কেদে উঠে বললো,

-মিথি,তুই এমন করিস না মা।তোর আব্বুও অসুস্থ্য হয়ে পরবে তাহলে।তুই এভাবে…

রিয়াপি আম্মুকে থামিয়ে দিয়ে বললো,

-আন্টি,আপনারা যান।আমি মিথিকে বুঝিয়ে রেডি করে আনছি।

আম্মু আচলে মুখ চেপে ধরে কাদতে কাদতে বেরিয়ে গেলো।আন্টিও পেছন পেছন গেলেন।মাইশু রিজোয়ানকে নিয়ে চলে গেলো।রিয়াপি বললো,

-সবটা জানো তুমি রাইট?

চোখ দিয়ে অনবরত পানি পরছে।মাথা উপরে নিচে নাড়ালাম শুধু।আপি বললো,

-আঙ্কেলকে মানা করতে পারবে?
মাথা নেড়েই না বললাম।

-দেন অস্রুবিসর্জন বাদ দাও।এতে সবার কষ্ট বাড়বে।লেহেঙ্গাটা পরে নাও।

বিছানার পাশেই লাল লেহেঙ্গা রাখা,সাথে অনেক গয়নাও।একপলক দেখে আবারো কান্না করতে লাগলাম।আপির গলায় এতো কঠোর কথা শুনে আরো বেশি কান্না আসছিলো।বেশ কিছুক্ষন পর নিজেকে সংবরন করলাম অতিকষ্টে।মানতেই হবে এসব আমাকে।শক্ত হয়ে উঠে দাড়িয়ে পরে নিলাম লেহেঙ্গাটা।আপি গয়নাগুলোও পরিয়ে দিলো,সাজিয়ে দিলো।রিয়াপির সাজানোর হাত বেশ ভালো,পার্লারের কোনো অংশে কম না।নিজের দিকে একটাবারো না তাকিয়েও আমি বুঝতে পারলাম,আর দশটা বিয়ের কনের মতো আমাকে ভালো লাগছে দেখতে।তবে এ সাজ আমি তাকে দিতে পারবো না যাকে চাই।অবশ্য চাইও না আর,এখন তো ঘৃনা করতে শুরু করছি আরমানকে আমি।ঘৃনা।আপি দুটো ওষুধ হাতে দিয়ে গ্লাসে পানি দিয়ে বললো,

-এটা খেয়ে নাও।ভিজেছিলে তো।অসুস্থ্য হয়ে পরবে নইলে।

চুপচাপ তাই করলাম।আপি বিছানায় বসিয়ে দিলো আমাকে।অল্পকিছুক্ষনের মধ্যেই রাজ্যের ঘুম এসে জরো হলো আমার চোখে।ঘুমিয়ে পরলাম।তারপর?তারপর কি হয়েছে?সকাল হয়ে গেলো!আর আমি তখন আরমানের বুকে!!!

*
অসহায়ভাবে আরমানের দিকে তাকালাম।উনি আমার দিকে তাকিয়ে ঠোট উল্টে এমনভাবে হাসলেন যেনো কিছুই না এগুলো।তারমানে উনিই ইচ্ছা করে এসব করছেন!কেনো করছেন?কি লাভ এসব করে?আমি তো ভালোবাসবো না কোনোদিন ওনাকে!কেনো শুধুশুধু এতো নিচে নামাচ্ছে নিজেকে?এতে যে আমার ঘৃনা বেড়েই চলেছে।কি করবেন উনি এখন?

-জানো মিথি,একদম পরীর মতো লাগছে তোমাকে!চোখ সরাতে পারছি না।এদিকে ওনাদের সামনে তোমাকে দেখবো,আমার আবার লজ্জাও লাগছিলো।তাই চোখটা বেধে দিলাম।ডোন্ট ওয়ারি,মেয়েপার্টি আর রিজোয়ান ওই রুমে আছে!

আমি তখনো আমার হাত ছাড়ানোর চেষ্টায়।নিজে ছাড়া পেলে তবেই তো ওদের ছাড়াতে পারবো।যা থেকে যাই হয়ে থাকুক,এখন আরমানের হাত থেকে রক্ষা পেতে হবে।

-হাত ছাড়ুন।এসব কি করছেন আপনি?এভাবে আমার বাসায় গুন্ডামো দেখাচ্ছেন কেনো?কি লাভ এসব করে?

-উফ্,একসাথে এতো কোশ্শেন?ওকে শোনো,রাইট নাও,চেষ্টায় আছি যেনো সবটা মনে পরে যায় তোমার।এটাই আমার লাভ।

আমি আরো জোরে কেদে বললাম,

-ওদেরকে ছেড়ে দিন না।কষ্ট হচ্ছে ওদের।

-এই এই এই এই!কান্নাটা থামাও।কান্না থামাও।তোমার কান্না দেখবো না বলে ও বাসাতেই সবটার ব্যবস্থা করলাম।আর তুমি এখনো কাদছো?

-ব্যবস্থা মানে?আপনি কিভাবে এ বাসায়?

উনি আবারো সামনে বসিয়ে জরিয়ে ধরলেন আমাকে।ছোটার চেষ্টা করছি,তবে গায়ের জোর ফুরিয়ে আসছে আমার।হাপিয়ে গেছি।সামনে আব্বুকে ওভাবে দেখে কান্নাটা বাড়ছে।আরমান আমার কাধে থুতনি ঠেকিয়ে বললেন,

-সিয়ামকে তো কাল বাসায়ই যেতে দেইনি।সন্ধ্যায় কলটা যে করে তোমার আব্বুকে যা যা বলেছিলো তা সবটা আমার কথায় করেছে ও।তোতলামি করেছিলো একটু,মার পরতেই সেরে গিয়েছিলো।একচুয়ালি,তোমার সাজুগুজুটা চাইছিলাম।তাই আর কি,,,!আর তুমি যখন ঘুমোচ্ছিলে,বরপক্ষ ভেবে তোমার আম্মু যাদের জন্য দরজা খুলে দিলো,আমার সেই গার্ডরাই তোমার ফ্যামিলির আপ্যায়ন করেছে।

এই মানুষটার এমনও রুপ হতে পারে কল্পনাতেও ছিলো না আমার।জীবনে কাউকে কোনোদিন এতোটা ঘৃনা করবো ভাবিও নি।আস্তে আস্তে বুঝতে পারলাম,ঘৃনাটা কিভাবে শুরু হয়।আরমান বললেন,

-হেই!বললে না তো কিছু মনে পরলো কি না?

আমি হাত মুচরাতে মুচরাতে বললাম,

-ছাড়ুন আমার হাত!এতোটা হিংস্র আপনি?আমি তো আপনাকে ভালো…

-ইউ ওয়ান্ট কিস?সবার সামনে?অবশ্য চোখ বাধা ওদের।দেখবে না।

-আপনি,,,ছেড়ে দিন না সবাইকে।

-আগে বলো কিছু মনে পরলো কি না?

-না।কিছু মনে করতে চাইনা আমি।আমার হাত ছাড়ুন!

-নাহ্!একটু বেশিই নড়াচড়া করছো তুমি।তুমি তো বেশ ঘুমিয়েছো আমার বুকের মাঝে,আমার ঘুম উড়িয়ে দিয়ে।রাতটাতে চোখ বুজিনি একটাবারের জন্যও।খালি তোমাকে দেখে গেলাম।এখন এতো টায়ার্ডনেসের মধ্যে জোরাজুরি করতে হবে তোমার সাথে!উফফ্!!

কথাটা বলে আমাকে সোফায় বসিয়ে দুহাত পিছনে দিয়ে মেঝেতে থাকা দড়ি দিয়ে হাত বেধে দিতে লাগলেন উনি।আমি শব্দ করছি আর নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টায় আছি।আব্বু,কবির আঙ্কেল বাদে ও ঘর থেকে বাকি সব আওয়াজ করছে।আমাকে ছেড়ে দিতে বলছে।তাতে আরমানের এতোটুকো হেলদোল নাই।শেষ অবদি হাত পা বেধে সোফায় বসিয়ে দিলেন আমাকে। নিজে হাতলের উপর বসে বললেন,

-বলো।কিছু মনে পরলো?

রাগে চেচিয়ে বললাম,

-কি মনে পরলো,মনে পরলো শুরু করেছেন আপনি?কেনো এমন করছেন?দেখুন কিছুতেই কোনো লাভ হবে না।ছেড়ে দিন আমাদের।প্লিজ।আর ঘৃনা করতে বাধ্য করবেন না আপনাকে।

আমার আওয়াজে আরমান চোখ বুঝে একবার অন্যদিকে ঘাড় ঘুরালেন।তারপর আবারো আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,

-শেষ বারের মতো বলছি,মনে করার চেষ্টা করো মিথি।তোমাকে জোর করতে ভালোলাগে না আমার।

-ভালোলাগে না?তবে এগুলো কি?কেনো জোর করছেন আমাকে?কিছু মনে পরা নিয়ে আপনার কি?

-অনেককিছু।

-আমি কিছুই মনে করার চেষ্টাও করবো না।ছেড়ে দিন না আমাদের।প্লিজ!!!ছেড়ে দিন।পায়ে পরি আপনার।আব্বুর কষ্ট হচ্ছে।সবার কষ্ট হচ্ছে।

-এরথেকে বেশি কষ্ট যে আমি পেয়েছি সেটা?

-জোর করে সবকিছু হলেও মন পাওয়া যায় না আরমান।আপনার প্রতি শুধু ঘৃনা…

আমার কথা শেষ করতে দেননি আরমান।আব্বুর কাছে গিয়ে দাড়িয়ে তার পিছন থেকে গান ধরে আছেন কপাল পাশ বরাবর।চোখ বাধা জন্য কিছু দেখতে পারছেন না আব্বু।কিন্তু এটা দেখার আগে হয়তো মৃত্যুই ভালো ছিলো আমার।যাকে ভালবাসতে শুরু করেছিলাম সেই মানুষটা আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ন,ভালোবাসার,প্রিয় মানুষ আমার আব্বুর কপালে বন্দুক‌ ঠেকিয়ে আছেন।বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে নিজের চোখকে।এই মানুষটাকে ভালোবাসতে শুরু করেছিলাম?কি করে?এতোবড় ভুলটা কি কতে করলাম আমি?সবটা ভুলে আব্বুর দিকে তাকালাম।গাল বেয়ে পানি গড়ছে তো গড়ছেই।অস্ফুট স্বরে বললাম,
-আ্ আব্বু…

আব্বু সেভাবেই গায়ের জোরে বাধন খোলার চেষ্টাতেই আছেন।চোখে দেখতেও পারছেন না,বলতেও পারছেন না।আমি দেখেও কিছু করতে পারছি না।কাদছি শুধু।আরমান রিভলবারটা ঘুরিয়ে বললেন,

-এখন?এবার তো বলো মনে পরেছে,হুম?

রাগী চোখে তাকিয়ে আছি।মনে করা নিয়ে এতোকিছু?প্রচন্ড ঘৃনা হচ্ছে তার উপর আমার।নিজের ওপরও।কিন্তু এবার ভয়টা বেশি।করুনভাবে বললাম,

-ছাড়ুন!রাখুন ওটা।প্লিজ!

-আগে বলো,ইউ রিমেম্বার এভরিথিং হুম?

-ন্ নাহ!মনে নেই।মনে নেই।প্লিজ ওটা সরান।

-তুমি মনে করার চেষ্টা করছো না কেনো?

আব্বুকে ওই অবস্থায় দেখে মাথা কাজ করছে না আমার।কাদছি শুধু।আরমান এবার রাগে চেচিয়ে বললেন,

-ডোন্ট মেক মি ওয়েট মোর মিথি!বাধ্য করো না আমাকে খারাপ কিছু করতে।ট্রাই টু রিকল ড্যামিট!

তার চিৎকারে বাসায় পিনপতন নিরবতা।পাশের রুমের সবাই চুপ মেরে গেছে।আমি নিজেও চমকে উঠেছি।আব্বুর কপালের পাশে থাকা রিভলবার দেখে কাচুমাচু হয়ে ভাবার চেষ্টা করলাম।এমনিতেও সবটা চেনাচেনা লাগছিলো আমার।এভাবে সবাইকে আটকে রাখা,আমার কনে সাজ,আরমানের হাতে গান,সবটার সাথে মিল‌ পাচ্ছিলাম আমি।চোখ ছোট ছোট করে ভাবছিলাম কবে কোথায় ঘটেছে এসব।তখনি ভেতর থেকে আপি জোরে করে বলে উঠলো,

-কেনো আবারো,আবারো মেয়েটার সাথে এমন করছো আরমান? আগেরবার তো উদ্দেশ্য হাসিল করেছিলে তুমি।তার ফল সবাইকে ভোগ করতে হয়েছে।আজ আবারো কেনো সবাইকে এভাবে আটকে রেখেছো?যতই হোক,একটু মায়া করো মেয়েটার ওপর!তোমাদের বিয়েটা…

-রিয়া কি বলছিস টা কি তুই?

তারপর ও রুম থেকে কোনো আওয়াজ আসে নি।কিন্তু এটা কি বললো আপি?তোমাদের বিয়ে?এসব কেনো বললো ও?আপির কথা শুনে মাথায় আকাশ ভেঙে পরলো আমার।এই সাজে আছি আমি কিন্তু বিয়ে কার?আমার তো নয়।আরমানের?কার সাথে?আরমান হেসে গলা উচু করে চেচিয়ে বললেন,

-রিয়াপি!ভালো কথা বলেছো।সবকিছুর একটাই কারন।বউ নিয়ে যাবো বাসায়।বউ!আমার বউ!

বিস্ময় নিয়ে একবার আব্বুর দিকে তাকালাম।এতোক্ষন ছাড় পাওয়ার জন্য চেষ্টা করলেও,আরমানের কথার পর নুইয়ে গেছেন উনি।কিন্তু এসব কি হচ্ছে?বউ নিয়ে যাবেন মানে?কাকে?আমি তো ওনার বউ নই,বিয়ে তো হয়নি।নাই ওনাকে ভালোবাসি আমি!তাহলে?আরমানের দিকে তাকাতেই উনি চোয়াল শক্ত করে রিভলবারটা আব্বুর কপালে ঠেকালেন।আব্বু কপালে ছোয়া পেয়ে চমকে উঠলেন।আরমান বললেন,

-নাও বেয়ার দ্যা কনসিকুয়েন্সেস!

-না প্লিজ!না!

সাথেসাথে একটা বিকট শব্দ!গুলির আওয়াজ!!! ‘ না ‘ বলে কানে হাত দিয়ে চোখ খিচে বন্ধ করে নিলাম আমি।পাশের রুম থেকে তীব্র কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে।দুহাতে মুখ ঢেকে আমিও কাদছি চিৎকার করে।চোখ খোলার সাহস পাচ্ছি না আমি।

#চলবে…

®

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here