তোমাতেই অস্তিত্ব আমার পর্ব-১৬

0
1822

#তোমাতেই_অস্তিত্ব_আমার
লেখনীতে:মিথিলা মাশরেকা

১৬.

চোখেমুখে পানির ঝাপটায় চমকে উঠে চোখ মেলে তাকালাম।সামনের চেয়ারে আরমান বসে,হাতে কাচের গ্লাসে পানি।তাহলে কি উনিই আমার মুখে পানির ছিটা মেরেছেন?কিভাবে যেনো হাসছেন উনি,ভয় করছিলো আমার একটু।তার দিকে তাকাতেই যেনো তার মুখে আরো বড় করে হাসি ফুটলো।সে হাসি দেখে কোলগেটের ‘স্মাইল কারো অর শুরু হো যাও’ ট্যাগলাইনটা মনে পরলো।
ওয়েট,শুরু হো যাও!কি চাচ্ছেন টা কি উনি?একেতো পানি দিয়েছেন,আবার ওভাবে হাসছেন?দেখেই রাগ হচ্ছে আমার, ভয়ও করছে।তারপর মনে পরলো দোকানে তার ব্যবহারের কথা,বউবউ ডাক আর জরিয়ে ধরা!আমি উঠে বসে বললাম,

-আপনি দোকানে অমন করলেন কেনো?

উনি কিছু না বলে সেভাবেই মিটমিটিয়ে হাসছেন।

-কি হলো?আমার মুখে পানি মেরেছেন কেনো?

উনি এবার উনার হাতের দু আঙুলে কপাল ধরে মাথা নিচু করে হাসছেন।রাগ বেড়ে চলেছে আমার।মাথা পুরো ফেটে যাচ্ছে।চেচিয়ে বললাম,

-হচ্ছে টা কি?মিরাক্কেল চালিয়েছি এখানে আমি?

উনি মাথা তুলে বুকে হাত গুজে আবারো ঠোট টিপে হাসছেন।আমি দাত কিরমিরে কিছু বলার আগেই একবার নিজের দিকে তাকালাম।এবার আর রাগ না,লজ্জায় মাটির নিচে ঢুকে যেতে ইচ্ছা করছে। ওড়নাটা আমার গায়ে নেই!আমি তৎক্ষনাৎ হেলান দিয়ে বসে গায়ের চাদর গলা অবদি ঢেকে দিলাম।ছিহ!আমাকে ওভাবে দেখেই তারমানে হাসছিলেন উনি!আরমান জোরে হেসে উঠলেন।এবার রুমটাতে চোখ বুলালাম আমি।চিনতে ভুল হলো না এটা একটা হসপিটালের কেবিন।তারমানে আমি হসপিটালে!আরমানের দিকে তাকিয়ে দেখলাম উনি এখনো হেসেই চলেছেন,শব্দ করে পেট ধরে।

মাথাটা নিচু করে মনে করলাম দোকানটাতে কি কি হয়েছে।মনে পরলো আরুর পারফিউম চুজ করে দিচ্ছিলাম।প্রথম দুটো ভালো লাগে নি,তিন নম্বরটা বিদঘুটে ছিলো,চারনম্বরটা একটু নর্মাল ছিলো, ওটা শুকলাম।তারপর?তারপর কি হলো?কিছুই তো মনে নেই।আমি কি অসুস্থ্য হয়ে গিয়েছিলাম?এতোটা অসুস্থ্য যে হসপিটালে আসতে হলো?কতোক্ষন হলো আছি এভাবে?আপি কই?আমাকে কি আরমানই আনলেন এখানে?বাসায় কি হচ্ছে এখন?

-আ্ আমি কতক্ষন হলো এখানে?

আমার দিকে তাকালেন আরমান।আবারো নিশব্দে হাসতে লাগলেন উনি।

-আ্ আপি ক্ কোথায়?

……….

-আমাকে কেনো এনেছেন এখানে?

…….

-এভাবেই হাসবেন?নাকি বলবেন?

আরমান তার শব্দহীন হাসি থামালেন।আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,

-একটু বেশিই প্রশ্ন করো তুমি।

-তো আমি,,,,,

-দোকানে সেন্সলেস হয়ে গেছিলা।

আমি চোখ‌ ছোট ছোট করে বললাম,
-তখন কি স্মেল করিয়েছিলেন আমাকে?

আরমান ভাবলেশহীনভাবে বললেন,

-ক্লোরোফর্ম!

আমি লাফিয়ে উঠে বসে বললাম,

-কি?

উনি আমার বসা দেখে আবারো হেসে দিলেন।দ্বিতীয়বারের মতো আমারো উনার হাসি দেখেই ওড়না ছাড়া উঠে বসার বোকামোর কথা মনে পরলো।চাদরটা টেনে বললাম,

-দ্ দেখুন,আপনি ক্ কেনো,,,,

-হেই!ডু ইউ রিয়েলি থিংক আমি অমন কিছু স্মেল করাবো তোমাকে?লাইক‌ সিরিয়াসলি?

আমি চুপ করলাম।সত্যিই‌ তো!নার তো কোনো দায় পরেনি,কেনো করবেন উনি ওরকম।

-ত্ তো আপনিই তো বললেন।

-আরে,মজা করে বলেছি।আই থিংক তুমি বাসায় খাওয়াদাওয়া ঠিকমতো করো না,তাই উইক।তো বাচ্চাদের মতো খাওয়াটা নিয়ে বাহানা মা করলেই আজ আমার এ ঝামেলাটা হতো না।সামনে ওভাবে অজ্ঞান হয়ে গেলে,ফেলে আসতাম কি করে?

ঝামেলা?আমি উনার কাছে ঝামেলা?হ্যাঁ,তাইতো।তা নয়তো কি?হয়তো চুড়ির শব্দে যে মাথাব্যথা শুরু হয়েছিলো,তার জন্যই অজ্ঞান হয়েছিলাম।তার উপর ডিওটাও বাজে ছিলো।আচ্ছা,উনি কিভাবে এনেছেন এখানে আমাকে?উনার গাড়িতে?গাড়িতে কিভাবে তুললেন?ফিল্মি স্টাইলে কোলে তুলেছিলেন?তাহলে তো আমার ওয়েট বুঝে খাওয়া নিয়ে কথা বলতেন না,যা ভারি আমি!ধুর,এনেছেন হয়তো কোনো ভাবে,আমাকে কোলে তুলতে যাবে কেনো?তার তো আছেই,ভালোবাসার কেউ!

-তুমি বাচ্চাদের মতো কল্পনাবিলাসী তাইনা?

-মানেহ?

-হুটহাট ভাবা শুরু করলে আর দুনিয়ায় থাকো না।একদম বাচ্চাদের মতো।

-কি বাচ্চা বাচ্চা করছেন?আ’ম নাইন্টিন।ভার্সিটিতে পড়ি আমি।

-ইউ মিন তুমি বাচ্চা নও?

-তো এখন কি বার্থ সার্টিফিকেট দেখাবো?নাকি সেলের কার্বন ডেটিং করবেন?

-তোমার কিছু কিছু গুনাবলি ওভার লোডেড!

-মানে?

-ওভার অ্যাঙ্গার!ওভারথিংক!এন্ড দ্যা মেইন ওয়ান,ওভার টক!

-কি?আপনি আমাকে…

-চুপ!এখনই ডক্টর আসবে,তোমাকে দেখবে,যা বলবে করবে চুপচাপ।ওকে?

-ইহ্!আপনার অর্ডার কেনো শুনতে যাবো আমি?আর আ’ম ফিট এন্ড ফাইন।পারবো না ওসব করতে।বাসায় যাচ্ছি আমি।রিয়াপি খুজে না পেয়ে কি করছে কে জানে?দেরি হচ্ছে দেখে আব্বুও টেনশন করছে হয়তো।

বলেই পাশে রাখা ওড়না টা যেই নিতে যাবো আরমান ছো মেরে ওটা নিয়ে নিলেন।আমি কটমটে চোখে তাকালাম উনার দিকে।এতোটুকো ভ্রুক্ষেপ নেই তার তাতে।বললাম,

-একদম অসভ্যতামি করবেন না।অলরেডি শপকিপারের সামনে আপনি যেসব বলেছেন তা নিয়েই আমি…

উনি পকেট থেকে মোবাইলটা বের করলেন।স্ক্রলিং করতে করতেই বললেন,

-ভার্সিটিতে সরি বলা ছেড়ে গায়েব হয়ে গিয়েছিলে কেনো?

উনার প্রশ্নে থেমে গেলাম।কি বলবো?উনি বললেন,

-কি হলো?বলো?

-কিসের সরি?

-আমাকে স্যাড করার জন্য।

-আমি আপনাকে স্যাড করি নি।

-করেছিলে।আর সুহানাকে দেখে ফিরেও গিয়েছিলে।

ওহ্!তারমানে মেয়েটা সুহানা।ওই হয়তো উনার সেই ভালোবাসার কেউ,মালু যার কথা বলেছিলো।তাহলে উনার প্রেমিকার নাম সুহানা?

-না,আমার কাজিনের নাম সুহানা।আমার বড় চাচার মেয়ে ও!

আমি বিস্ময় নিয়ে উনার দিকে তাকালাম।চাচাতো বোন?তবে কি ভাই বলে ওভাবে জরিয়ে ধরেছিলো মেয়েটা?উনি আবারো বললেন,

-ও অমনই।বিদেশে বড় হয়েছে।আর তাই এক্সাইটমেন্টে আমাকে ওভাবে জরিয়ে ধরেছিলো।

নিজেও তো জরিয়ে ধরেছিলো ওকে। আমি নিশ্চিত এ ওই বিদেশী বোনুকে জানু ভাবে।

-আমিও ওকে বোন হিসেবেই দেখি।

তবে যে আমি দেখলাম উনিও জরিয়ে ধরে আছেন!

-তখন ওকে ছুয়েছিলাম কাছ থেকে সরানোর জন্য।আর তুমি একপলক দেখে ভেবে বসে আছো যে আমিও ওকে জরিয়ে ধরেছিলাম।

ওহ্!তারমানে ভাইটু বোনটির সম্পর্ক!এক মিনিট!এসব কথা তো আমি মনে মনে বলছি।উনি জবাব দিচ্ছেন কিভাবে?

-মাইন্ড রিড।

আমি আরো বড় করে তাকালাম উনার দিকে।উনি মোবাইল থেকে চোখ তুলে বললেন,

-চোখ দুটো এবার বেরিয়েই আসবে মনে হচ্ছে!

বলে আবারো ফোনে মন দিয়ে বললেন,

-আরো কিছু শুনবে?নাকি ক্যান্ডিক্রাশের মতো মিসআন্ডারস্ট্যান্ডিংয়ের আরো লেভেল পার করবা?

-আ্ আপনি…

-হ্যাঁ,আমি?

-আপনি এসব কেনো বললেন আমাকে?

-মনে মনে নিজেই প্রশ্ন করতে করতে হাপিয়ে উঠেছে!নিজেই বলছে আমি এসব কেনো বললাম!

-তো মনে মনে প্রশ্ন আপনি কি করে জানলেন?

উনি ফোন থেকে চোখ তুলে কিছুটা আমার দিকে ঝুকে বাকা হেসে বললেন,

-তারমানে মিথির মন আমাকে নিয়ে সত্যিই প্রশ্ন করে?

আমি হচকিয়ে গেলাম।একে কিছু না বলাই ভালো।কিসব ভুলভাল ভেবেছিলাম আমি।আচ্ছা,উনি ওই মেয়েকে ভালোবাসেন না শুনে এতো শান্তি লাগছে কেনো আমার?আমি তো…ধুর!মনে মনেও কিছু বলা যাবে না,বুঝে যায়।কেবিনে তখনই এমদাদ আঙ্কেল আসলেন।তারমানে আরমান আমাকে উনার হসপিটালেই এনেছেন?তাকে দেখে কিছুটা স্বস্তি পেলাম।আঙ্কেল বললেন,

-এখন কেমন আছো মিথি?

-পুরোটাই ভালো।আমি আপনার হসপিটালে?

-হ্যাঁ।

-এই লোক এনেছে আমাকে?

-হ্যাঁ,রাস্তায় নাকি অসুস্থ্য হয়ে পরেছিলে তুমি?

কিছুই তো মনে নেই কি হয়েছে ওখানে।বললাম,

-আঙ্কেল,রিয়াপি?

-হুম,কথা হয়েছে আমার ওর সাথে।ওকে আসতে বলেছি।আসছে ও।ও আসলেই একসাথে যেও তোমরা।আমি গাড়ি পাঠিয়ে দেবো।

-আ্ আর আব্বু?

-তোমার সেন্স ফেরারই ওয়েট করছিলাম।অবশ্য ওর সাথেও কথা বলেছি আমি।কল করে বলে দাও তুমি আমার এখানে।

এমদাদ আঙ্কেল আমার কাছে ফোন ধরিয়ে দিলো।আর ইশারায় ম্যানেজড্ ইট বোঝালো।

-আ্ আসসালামুআলাইকুম আব্বু।

-ওয়ালাইকুমআসসালাম।তুমি এমদাদের ওখানে?

-হুম।

-এমদাদ বললো ডিনার করে আসবা?

-না খেয়ে তো যেতে দিবে না মনে হয়।

-আচ্ছা।রিয়া কই?

-আ্ আপি,আপি…

-হ্যাঁ,কই ও?

আমি কিছু বলবো তখনই আরমান একটু ভয় দেখিয়ে ইশারায় হাত কচলে বুঝালেন ওয়াশরুম বলতে।আমিও কিছুটা ভয়ে ফট করে বলে উঠলাম,

-ওয়াশরুমে,ওয়াশরুমে আব্বু।

-ওহ্!আচ্ছা।বেশি লেইট করো না।

-জ্বি আব্বু।

কলটা কেটে জোরে জোরে শ্বাস নিলাম আমি।আব্বুকে মিথ্যে বললাম?এতোবড় মিথ্যে?তাও আরমানের কথামতো?ভাবতেও অবাক লাগছে।
নাহ!রিয়াপিকে নিয়ে মিথ্যেটা তো বললাম যাতে আব্বু টেনশন না করে।এমদাদ আঙ্কেল বললেন,

-বেশ।এখন তবে টেস্ট গুলো করিয়ে নেওয়া যাক?

-কিসের টেস্ট আঙ্কেল?

আরমান বলে উঠলেন,

-ভেজা টেস্ট!

-হোয়াট?

-ইয়াহ্!মাথায় সমস্যা আছে কি না সেই টেস্ট।

-দেখুন আপনি কিন্তু…

উনি এমদাদ আঙ্কেলের দিকে ঘুরে বললেন,

-মামু বলোতো,এক্সাক্টলি কতোটা পাগল হলে মানুষ একপলক দেখেই পুরো সিচুয়েশনটা আন্দাজ করে নিতে পারে?যদি না অভারথিংকিং এর দোকান হয়!

-দেখুন আপনি…

উনি ওনার হাতে থাকা আমার ওড়নাটা নাড়িয়ে বললেন,

-কি দেখুন দেখুন করছো বলোতো?কি দেখাতে চাও?

আমি পিছন থেকে বালিশটা নিয়ে উনার মুখে ছুড়ে মারলাম।এমদাদ আঙ্কেলকে চেচিয়ে বললাম,

-আঙ্কেল,আমাকে এখানে পৌছে দিয়েছেন,ওনার দায়িত্ব শেষ।ওনাকে যেতে বলুন।

-মামু,ওকে বলে দাও আমার পা,আমার মর্জি।যখন মন চাবে তখন যাবো।

-তো এখানে থেকে কি করবেন আপনি?

-তোমাকে তার এক্সপ্লেনেশন দিবো?সৃজনশীলতা এখন কাজে আসে না তোমার?

-মানে?

-বসে বসে আকাশপাতাল ভাবো এখন।তুমি না অভারথিংক করতে এক্সপার্ট?

-আঙ্কেল,এখান থেকে নিয়ে চলুন আমাকে।পাগল হয়ে যাবো আমি নয়তো।

আরমান কিছুক্ষন হেসে আমার ওড়নাটা দিয়ে দিলেন।আমি এমদাদ আঙ্কেলের সাথে বেরিয়ে এলাম।ঐ লোকটাও দেখলাম দাত কেলিয়ে আমাদের পিছন পিছন আসছে।উনার কিসের দায় আর?এমদাদ আঙ্কেলের এখানে এসেছি আর কোনো ঝামেলা হবে না।আমি আবারো বললাম,

-আপনি চলে যান।আমি ম্যানেজ করে নিবো আর আপি তো আসছেই।

-তোমার কথা শুনতে হবে আমাকে?

আর কি বলবো?বিরক্তি নিয়ে রুমে ঢুকলাম।ইয়া বড় বড় ডাক্তারি যন্ত্র!এগুলোতে আমার টেস্ট করাবে নাকি?

-আঙ্কেল এগুলো?

-আরে আর বলো না।এগুলোর দুটো টেস্ট করাবো তোমাকে।

-কিন্তু কেনো?এমন কিছুই হয়নি।আমিতো ঠিক আছি।ফুলটু এনার্জিতে হাটছি তো আপনার সাথেই!

আরমান পিছন থেকে বলে উঠলেন,

-মামু,এই ঝাঝ লবঙ্গের চিকিৎসার কিছু কমতি হলে বাসায় আরু আমাকে ছাড়বে না।সবগুলো টেস্ট করাও।

-কি বললেন?

-বললাম তুমি ঝাঝ লবঙ্গ!

-আপনি আবারো আমাকে অপমান করছেন?আপনাকে তো…

-কি?কি করবে তুমি?

-আমি!আমি আপনাকে…

এমদাদ আঙ্কেল বললেন,

-হয়েছে,আর ঝগড়া করো না।আরমান,চুপ।মিথি স্টপ ইট।চলো চেকাপটা করাই।

-আঙ্কেল,আপনি দেখছেন না,উনিই তো আগ বারিয়ে ঝগড়া করছেন আমার সাথে,কিসব বলছেন।আর এসবের কি দরকার?

আরমান বললেন,

-কথাটা কম বলতেই জানে না এ মেয়ে!

-তাতে আপনার কি,হ্যাঁ?আপনার কি?আমার মুখ আমার ইচ্ছা!আর আঙ্কেল,আমি কোনো টেস্ট করাবো নাবলে দিলাম।এই লোককেও বিদেয় করুন আপনি।

আরমান তেড়ে এসে আমার সামনে দাড়িয়ে বললেন,

-তুমি টেস্ট করাবে।

-না করাবো না।

-এখন কি চাও তোমাকে জবরদস্তি করি আমি?

কথাটা বলে ডেভিল হাসি দিলেন উনি।আমি অসহায়ভাবে এমদাদ আঙ্কেলের দিকে তাকালাম।আরমানের জবরদস্তির নমুনা আমি আগেও দেখেছি।আঙ্কেলও ‘কান্ট হেল্প!’ একটা লুক দিলো।আর কিছু না বলে বিরক্তি নিয়ে চুপচাপ টেস্ট করালাম।আরমানও ওখানে দাড়িয়েই ছিলেন,টেস্ট শেষে আর দেখিনি ওনাকে।

দোকানদারের সাথে কথা বলতে গিয়ে আদিবকে হারিয়ে ফেলেছে রিয়া।এবার ওর ভয় করছে।মাহমুদ আলমের ফোনের ভয়ে হাত পা ঠান্ডা হতে শুরু করেছে ওর।পাশের একটা ছাউনির নিচে বসে কতক্ষন নিরবে কেদেছে তার হুশ নেই ওর।অনেকক্ষন পর ড. এমদাদ কল করলেন ওকে।চোখ মুছে ফোনটা রিসিভ করলো ও।

-হ্যালো আসসালামুআলাইকুম আঙ্কেল।

-ওয়ালাইকুমআসসালাম।রিয়া তুমি কই?

-আঙ্কেল আমি তো…

-আচ্ছা শোনো,মিথি আমার এখানে,তুমিও চলে এসো।

রিয়া উঠে দাড়ালো।একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বললো,

-আপনার ওখানে?

-হুম,তুমিও চলে আসো।একসাথে চলে যেও কেমন?

-ও ওখানে কিভাবে গেলো আঙ্কেল?

-ও্ ওই আসলে,একা দেখলাম,নিয়ে আসলাম।

-কখন গেছে ও?

-বেশ অনেকক্ষন।

-আচ্ছা আঙ্কেল আমি আসছি।

-হুম,এসো।মাহবুবকে বলেছি তোমাদের ডিনার শেষ করেই পাঠাবো।

-আঙ্কেল জানে মিথি একা ওখানে?

-না,ওভাবে কথা হয়নি,জাস্ট বলেছি তোমরা এখানে আর তোমাদের ডিনার শেষে গাড়ি করে বাসায় দিয়ে আসবো।

-গ্রেট!আসছি আমি।

একবার ভাবলো বাসায় যাবে,তারপর ভাবলো আদিবকে খোজার আরেকটা চেষ্টা করবে।মিথির খোজ যেহেতু পেয়ে গেছে ও!টাকাটাও তো দিতে হবে।ওই লোকের টাকা নিবে না ও,কোনো পরিস্থিতিতেই না!
রিয়াকে একটু ঘোরাবে বলে গার্ডসের আগেই পাঠিয়ে দিয়েছে আদিব।মেয়েটা তালগোল পাকিয়ে ওকেই হারিয়ে ফেললো?ও নিজেও খুজে পাচ্ছে না রিয়াকে।ওর চোখে পরার জন্য মাঝরাস্তায় গাড়ি দাড় করালো আদিব।লোকজন জ্যাম হবে এ নিয়ে সাথেসাথেই হট্টগোল শুরু করে দিলো।শব্দ অনুসরন করে রিয়া আদিবের গাড়িটা দেখতে পেলো।আগেও এ গাড়িতে উঠেছে ও,চিনতে অসুবিধা হয়নি।টাকা ফেরত দিতে একপ্রকার দৌড় লাগালো ও।
রিয়াকে দৌড়াতে দেখে আদিব বেশ খুশি হলো। ‘যাক,নজরে পরেছি।চিনেছে তবে আমার গাড়ি।এইবার লাইনে এসেছো ম্যাডাম ‘ ।বাকা হেসে গাড়ি স্টার্ট দিলো ও।রিয়া তবুও যাচ্ছে পিছন পিছন।কিছুটা দুর এসে গাড়ি থামালো আদিব।রিয়া হাপাতে হাপাতে এসে বারি লাগালো কাচের জানালায়।

-এইযে বেরোন!বেরোন বলছি!

আদিব বেরিয়ে এসে বললো,

-কি সমস্যা?ফলো করছেন কেনো আমাকে?

রিয়া ভ্রুকুচকে তাকালো।

-আপনি কোথাকার কোন প্রিন্স চার্মিং যে আপনাকে ফলো করতে যাবো?

-প্রিন্স চার্মিংএর ফলোয়ার আপনি?

-শাট আপ!আপনার জন্য কতোটা ঝামেলা পোহাতে হলো আমাকে জানেন?

-বাব্বাহ্!উপকার করে আসলাম,এখন আমাকেই ঝামেলার জন্য দায়ী করছেন?

-শুনুন,আপনার প্যানপ্যানানী শোনার টাইম নাই আমার।এই নিন আপনার টাকা।

রিয়া টাকাটা বারিয়ে দিলো।আদিব ওর হাতের দিকে একবার তাকিয়ে আরমানকে ফোন লাগালো।রিয়া ওকে ইগ্নোর করে ফোন করতে দেখেই জ্বলে উঠলো একদম।‌কিছু না বলে টাকাটা গাড়ির উপর রেখে হনহনিয়ে চলে এলো ওখান থেকে।আদিব আরমানের কাছে সবটা শুনছে আর রিয়ার চলে যাওয়া দেখছে । মেয়েটাকে চলে যেতে দেখে কেনো যেনো ওর বলতে ইচ্ছে করছিলো
‘ওয়েট,আপনাকে পৌছে দেই? ‘-মনের এ কথাটা মুখে আনার সাহস পেলো না ও।আরমানের কথা শেষে গাড়ি নিয়ে বাসায় চলে আসলো।

এমদাদ আঙ্কেলের বাসার ড্রয়িংরুম!আঙ্কেলের দুটো ছোট ছোট ছেলে,একটা একদম ছোট,রিজোয়ানের মতো আরেকটা একটু বড়।এই বার ফাইভে।দুজনেই একদম মাতিয়ে রেখেছে আমাকে।আন্টি দেখলাম কোমড় বেধে রান্নাঘরে তোরজোর শুরু করেছেন,এগোতে গেলাম আঙ্কেলের এক ধমক।আর উঠতেও দেয়নি বাচ্চাগুলো আমাকে।এরমধ্যেই আপি হাপাতে হাপাতে এসেই জরিয়ে ধরলো আমাকে।

-ইটস্ ওকে আপি,আমি ঠিক আছি।

-আল্লাহর অনেক শুকরিয়া।চলো বাসায় তাড়াতাড়ি।

এমদাদ আঙ্কেল বললেন,

-আগে ডিনার,দেন আমি নিজেই গাড়ি পাঠাবো।

-কিন্তু আঙ্কেল অলরেডি অনেক দেরি হয়ে গেছে।

-বলেছি তো রিয়া আগে ডিনার।আর এটুকোই তো রাস্তা,এতো চিন্তা কেনো করছো তুমি?মাহবুবের সাথেও কথা হয়েছে তো আমার,বলেছি তো তোমাকে।

রিয়াপি আর কিছু বললো না।আঙ্কেল যেতে দেবে না জানতাম আমি,তাই আমিও কিছু বলিনি।আন্টি ডাকলে সবাই একসাথে খেতে বসে গেলাম।এমদাদ আঙ্কেলের বাসার সব জিনিসগুলো আগেরমতোই আছে।আন্টি সার্ভ করতে করতে বললো,

-মিথি,সেবার এসে তুমি আমাদের সাথে কতো মজা করেছিলে মনে আছে?আগেতো কতো আসতা,এখন আর আসো না কেনো বলোতো?পর হয়ে গেছি নাকি আমরা?

আন্টির কথা শেষ হওয়ার আগেই আমার পাশ থেকে একটা কাচের গ্লাস পরে চুর্নবিচুর্ন হয়ে গেলো।আমার যতোদুর খেয়াল আছে,আমার সাথে ছোয়া লাগেনি ওটার,তাহলে?আর সবাই তো যথেষ্ট দুরে বসে।ভাঙা গ্লাসটা দেখে আমি বলে উঠলাম,

-একারনেই আসি না আন্টি।মনে আছে?আগেরবারও তোমার গ্লাস ভেঙেছিলাম?আর তুমি বলছো মজা করেছি?

আমার কথায় সবাই মুখ তুলে অবাক হয়ে তাকালো আমার দিকে।যেনো আমি কতোবড় মহান কোনো বাক্য শুনিয়েছি তাদের।আপি কিছু বলতে চাইছিলো,এমদাদ আঙ্কেল বলে উঠলেন,

-হয়েছে হয়েছে,খাওয়ার সময় অতো কথা বলতে হবে না।

আপি চুপ মেরে গেলো।ডিনার শেষে আপি হাত ধুতে উঠে গেলো।আঙ্কেল একা ছিলেন।আমি আঙ্কেলকে বললাম,

-আঙ্কেল আমার সিটি স্ক্যান করালেন কেনো?অন্য আরেকটা কি ছিলো?রিপোর্ট দিয়েছে?কোনো সমস্যা হয়েছে আমার?

এমদাদ আঙ্কেল বিশম খেলেন।পানির গ্লাস এগিয়ে দিয়ে আমি আবারো বললাম,

-কি হলো বলুন?

আঙ্কেল পানি খেয়ে বললেন,

-আরেহ্!একজন নরমাল মানুষেরও স্ক্যান করা যায়,জাস্ট এজ আ চেকাপ।আর তোমার তো জানোই মেমোরি লসের কেস,সেন্সলেস হয়ে গিয়েছিলে ভাবলাম স্ক্যানটা করিয়ে নেই।আমার ওখানে তো আলাদা কোনো ঝামেলা নেই তাইনা?

-রিপোর্ট দিয়েছে?

-না,তবে আমি স্ক্যানের সময়ই‌ বুঝেছি,নরমাল আছে সব।ইনফ্যাক্ট বেটার!

-আমার কি সিরিয়াস কিছু হয়েছিলো আঙ্কেল?

-আরেহ না মিথি,এমনি চেক করলাম,বললাম তো!

আমি আরো কিছু বলতে যাবো আর আপি চলে আসলো।ও এসে বললো,

-আঙ্কেল,মিথিকে কোথায় পেলেন আপনি?মিথি কই ছিলে তুমি?

ঠিক তখনি আঙ্কেলের ফোন বেজে উঠলো।নাম্বারটা দেখে কল রিসিভ না করেই আঙ্কেল তাড়াতাড়ি উঠে পরে বললেন,

-আমার ইমারজেন্সি আছে।যেতে হবে আমাকে।তোমাদের গাড়ি বলে দিচ্ছি ওকে?আসছি।মিথি টেক কেয়ার।আসছি রিয়া।

বলে একপ্রকার দৌড়ে বেরিয়ে গেলেন আঙ্কেল।আন্টি এসে বললেন,

-এই ডক্টরদেরও জীবন!এভাবেই জানোতো হুটহাট চলে যায় তোমাদের আঙ্কেল।আমি তাই ভেবেছি,ওর হসপিটালেরই কোনো এক স্টোররুম ভাড়া নিয়ে সংসার পাতবো।

আমি আর আপি হাসলাম।সত্যিই তো তাই।ডক্টরদের এভাবেই দৌড়ের উপর থাকতে হয়।কখন কার কেমন দরকার!ওখানে আর কিছুক্ষন আড্ডা দিয়ে আঙ্কেলের গাড়িতে করে বাসায় ফিরলাম,আপিও ওর বাসাতে চলে গেলো।থাকতে বলেছিলাম অনেক,রাজি হয়নি।আঙ্কেল নাকি রাগ করবেন,এমনিতেই শপিং থেকে এমদাদ আঙ্কেলের বাসায় হুট করে যাওয়াতে নাকি তিনি রাগ করেছেন।তবে রাস্তায় আপি আমার হঠাৎ করে উবে যাওয়া নিয়ে কোনো কথা বললো না দেখে বেশ আশ্চর্য হলাম।বাসায় আব্বু আম্মুও কিছু বলেনি,এমদাদ আঙ্কেলের বাসা বলে কথা,কিই বা বলবেন উনারা।

#চলবে…

®

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here