তোমাতেই অস্তিত্ব আমার পর্ব-১২

0
1999

#তোমাতেই_অস্বিত্ব_আমার
লেখনীতে:মিথিলা মাশরেকা

১২.

তোমার গানের “তোমাকে” সম্মোধনে যে আমি মিশে আছি কেনো বোঝোনা তুমি মিথি?কেনো এতটা সময় নিচ্ছো?আগেরবারও তো তোমাকে সময় দিতে গিয়ে সবটা উলোটপালোট হয়ে গিয়েছিলো।হারিয়ে ফেলেছিলাম তোমাকে,সাথে নিজেকেও। ‘তোমাতেই যে অস্তিত্ব’আমার!তোমাতেই তো মিশে থাকি আমি।কেনো বুঝেও বোঝো না তুমি?ছ মাস আগে তোমার ভার্সিটিতে আসার পর থেকে কি কি করি নি আমি?নিজের আট বছরের অন্ধকার অতীতকে ভুলে বাচতে শিখেছিলাম।কাউকে পরোয়া না করে যে আরমান নিজের মতো করে সমাজের ভাষায় গুন্ডা গ্যাং সামলাতো,সে অফিস জয়েন করে ফেলে,বিদেশে থাকা বাবার সাথে কথা বলে,বোনটাকে সময় দিয়ে ঠাট্টা করতে শেখে,মায়ের চোখের পানি মুছে দিয়ে নতুন করে সংসার গোছানোর আশা দেখায়।কি করি নি আমি?তোমার সিম্পল লাইফটাকে দেখে তোমার সাথে বাচার ইচ্ছা গাঢ়ো হতো আমার।

তোমার লাইফস্টাইল দেখেই বুঝতে পারি তোমার বাবার কাছে তুমি কমিটেড।লাইফের সবরকম স্বাধীনতা দিয়েছিলেন বলে তুমি নিজেই তাকে বলেছো তোমার জীবনসঙ্গী তিনিই চুজ করে দিবেন।ভয়টা তো সেখানেই ছিলো।আমার নামটা শুনলে যেখানে সবার চোখে গুন্ডামির অবয়ব ভাসে,সেখানে তোমার আব্বু তো…তবুও।তবুও জানোতো ভেবেছিলাম,নিজেকে পাল্টে নতুনভাবে প্রেজেন্ট করবো তোমার আব্বুর সামনে।তার অনুমতিতে,তার স্বেচ্ছায়,আপন করবো তোমাকে।যাতে তোমার কমিটমেন্টে এতোটুকো আঁচ না লাগে।কখনো এমন মনে না হয় তোমার,যে তোমার জন্য তোমার আব্বু কষ্ট পেয়েছেন।তার আগে নিজের একটা জায়গা করে নিতে চেয়েছিলাম তোমার মনে।

কিন্তু তুমি তো তুমিই।গানের কথার আর তোমার মনের মধ্যে আকা যে “তোমাকে” ব্যাক্তিটিকে ঘিরে এতোটা ভালোবাসা মুড়িয়ে রেখেছো,সামনে পেয়েও তাকে স্বীকার না করতে হাজারো বাহানা তোমার।আমার আচরনে তোমায় ভালোবাসি প্রকাশ পেলেও শুধুমাত্র মুখে বলি নি বলে সবটাকেই তুচ্ছ কতে দিতে তুমি প্রতিবার।তুমিই বলো,আমার কাজগুলোতে অদ্ভুত অনুভুতিতে তুমি কি জরিয়ে যেতে না?দিনশেষে আমার পাগলামিগুলো মনে করে আলতো হাসি হাসতে না?পড়ার টেবিলে দুহাতে মুখ গুজে একমনে কি ভাবতে না তুমি,মানুষটা এমন কেনো?তোমার মধ্যে আমাকে নিয়ে এতো ভাবনা কেনো?ভাবতে না তুমি?

জানি,ফিল করতে তুমি আমাকে নিয়ে,সবটা তো তাই ঠিকমতোই চলছিলো।তোমার রঙে রঙিন হতে শুরু করেছিলো তো আমার জীবন।তারপরই এক দমকা ঝড়ো হাওয়ায় সবটা এলোমেলো হয়ে যায়।কিছুটা সময়ের ব্যবধানে,নিজের হিংস্র রুপটা সামনে আনতে বাধ্য হই আমি।তোমার চেনা মানুষটা অচেনা কোনো জন্তুর মতোই আচরন করেছিলো তোমার সাথে সেদিন।তাই হয়তো….

সবার তালির শব্দে ধ্যান ভাঙে আরমানের।
গান শেষে মাথা তুলে তাকালাম আমিও।ওরা সবাই কিছুক্ষন একে অন্যের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে হেসে একসাথে তালি বাজাতে লাগলো।আরমানের দিকে তাকিয়ে দেখলাম উনি কোনো কিছুর ভাবনা থেকে সবে হুশে ফিরলেন এভাবে তাকিয়ে আছেন।চারপাশে তাকিয়ে ঠোট বাকিয়ে হেসে নিজেও হাত উঠাচ্ছেন,

-থাক থাক!হাত উঠাতে হবে না।লেগে যাবে।

কথাটা বলেই জিভ কাটলাম।আশেপাশে তাকিয়ে দেখি সবাই ভ্রুকুচকে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।আমতা আমতা করে বললাম,

-ন্ না মানে,আমিতো জানি আমি বাজে গাই।ক্লাপস্ দিতে হবে না।

মালু বললো,

-হ্যাঁ,তুইতো সব জানিস।তুই জানিস আজ কতো সুন্দর গেয়েছিস তুই?এর আগে কলেজে তোর গান শুনে তো আমি জ্ঞান হারাতে হারাতে বেচে গিয়েছিলাম।

-উরিব্বাস!ভেবলি?তুই আমার গানের প্রসংশা করছিস?কিয়ামত আসন্ন!

-কেনো বলতো?যেনো সবসময় তোকে আমি খালি পচাইই?উর্বি,বলনা কিছু।

-হ্যাঁ রে!ঠিকই বলেছিস তুই।মিথি তো বেশ গায়।তবে বেবি,আজ থেকে তোমাকে রেগুলার গান শোনাতে হবে বলে দিলাম।

উর্বির কথায় আরুও সায় দিলো।

-ইহ্!রেগুলার!

-কেনো?প্রতিদিন একটা গান শুনালে যদি আশেপাশের মানুষগুলো,তোমার স্পেশাল বান্ধবীগুলো খুশি হয় তাতে আনন্দ হবে না তোমার?

আরমান শান্ত গলায় কথাটা বললেন।আমি তার দিকে তাকাতেই আবার বললেন,

-অনেক ভালো গান গাও তুমি।

মৃদ্যু হেসে বললাম,

-ধন্যবাদ।

-ধন্যবাদ দিতে হবে না।বান্ধবীদের আবদারগুলো রেখো।

-আহা!ভাইয়া কতো খেয়াল রাখে আমাদের!এরকম একজন…

উর্বির কথায় আমি তাকালাম ওর দিকে।বললাম,

-ব্যাগ দে আমার।

মালু বললো,

-কেনো রে মিথি?থাক।আর ভাইয়া?আসলে আপনি এতটা ভালো যে….

-ব্যাগটা দে আমাকে উর্বি।

-ক্ষেপেছিস কেনো?ব্যাগ দে,ব্যাগ দে,কি আছে কি তোর ব্যাগে?

-কথা কম বল ব্যাগ দে।

উর্বি আবারো ছুড়ে মারলো আমার ব্যাগ।সেটা আরুর কাছে না গিয়ে সোজা ওর ভাইয়ার কোলে গিয়ে পরলো।আমি বললাম,

-ব্যাগটা দিন।

উনি শক্ত করে ধরলেন আরো।হাসছেন ঠোট টিপে।বেশ মজা পাচ্ছেন যেনো।

-কি হলো?দিন।

উনি তবুও দিলেন না।সেভাবেই হাসছেন।আমি একটা জোরে শ্বাস ফেলে বললাম,

-দেখুন ভাইয়া,অলরেডি আপনার রিকুয়েস্ট শুনে এদের গান শোনাতে গিয়ে আমার দেরি হয়ে গেছে।এবার ব্যাগটা দিয়ে দিন,বাসায় যাবো।

আমার কথায় উনি দাড়িয়ে গেলেন।সাথে বাকি সবাইও।মালু,উর্বি কেমনভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।আরুর রাগী দৃষ্টি বুঝতে পারলাম।আমি নিজেও উঠে দাড়ালাম।চোখ‌ ঘুরিয়ে আরমানের দিকে তাকিয়ে দেখি উনি একটু বেশিই রেগে আছেন,হাত মুঠো করে অন্যদিক তাকিয়ে চোয়াল শক্ত করে জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলছেন।
এতুটুকু কথায় সবাই এভাবে রিয়্যাক্ট করছে কেনো?উর্বির কাছে উনার কেয়ার করার কথা শুনে রাগ হয়েছে আমার।তাই ব্যাগ চেয়েছি,বাসায় চলে যাবো বলে।ওরা এমন করছে কেনো?বাসায় যাবো এজন্য?আরমানকে তো শুধু এটুকু বললাম যে তার অনুরোধ রাখতে গিয়ে লেইট হয়েছে।এতেই এমন রাগ?বুঝিনা আমি ওনাকে!আরু বললো,

-মিথি তুই…এভরিথিং হ্যাজ আ‌ লিমিট!

-আসলেই মিথি,একটু বাড়াবাড়ি না করলে তোর চলে না তাই না?

-কি করেছি আমি?এমন করছিস কেনো তোরা?

আরু কিছুটা রাগী গলায় বললো,

-কি করেছিস মানে?ভাইয়াকে…

-আরু চল বাসায়।

-ভাইয়া তুই এভাবে….

-বাসায় চল।গাড়িতে ওঠ।যা।

-ভাইয়া?

-তোকে গাড়িতে উঠতে বলেছি ড্যামিট!!

আরমান এতোটাই চেচিয়ে বললেন কথাটা যে সবাই চমকে উঠেছি।আরু একবার আমার দিকে বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে হাটতে লাগলো।আরমান একটা জোরে শ্বাস ফেলে আমার দিকে ব্যাগ বারিয়ে দিয়ে বললেন,

-সাবধানে যেও।

বলেই হাটা শুরু করলেন।আমি হতবাক হয়ে তার চলে যাওয়া দেখছি।কি বলেছি আমি?খুব কষ্ট দিয়েছি তাকে?উর্বি আমার কাধে হাত রেখে বললো,

-বাসায় যাবি না?

-উর্বি,উনি…

-ইটস্ ওকে।চল।

-কিন্তু উনিতো….

-কষ্ট হচ্ছে আরমান ভাইয়াকে স্যাড দেখে?

মালুর প্রশ্নে ওর দিকে তাকালাম।কি জবাব দিবো ওকে?

-মালু উনি এভাবে রাগ করলেন কেনো?

-হয়তো তোর কথায় কষ্ট পেয়েছেন।

-কিন্তু আমি এমন কি বললাম?

-বুঝলে তুই বলতিই না।

-তোরা জানিস না?বুঝিস নি?

-ভাইয়ার রাগের কারন সেই তো শুধু বলতে পারবে।

-মালু আমি…

-সরি বলবি?

……

-কি হলো?বল?

-কি করেছি আমি তাই তো বুঝতেছি না!

-তোর জন্যই‌ উনি মন খারাপ করেছেন এটা বুঝতেছিস তো?

আমি মাথা নিচু করে চুপ করে রইলাম।মালু আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে যেতে বললো,

-কোনো বিষয়ে এভাবে জটিলতা রাখা তো তোকে দেখিনি মিথি।চল,সবটা ক্লিয়ার করবি।

আমি নিচদিক তাকিয়েই ওর সাথে পা বাড়ালাম।কি করবো,কি বলবো জানি না।শুধু উনাকে ওভাবে দেখতে পারবো না।কিন্তু কেনো?
কিছুদুর হেটে গিয়ে মাথা তুলে তাকালাম।যা দেখলাম তাতে পা থেমে গেছে আমার,দাড়িয়ে গেলাম।এটা কেনো দেখলাম আমি?কেনো চোখে পরতে হবে আমার?ঠিকই‌তো ছিলো সবটা।যদিও‌ শুধু ধারনায় ছিলো,তবুও মেনে নিয়েছিলাম তো।তবে এভাবে সামনে আসার কারন কি?দু সেকেন্ডের সে দৃশ্য সহ্য হলো না,পিছনদিক ঘুরে দাড়ালাম।গালে দু ফোটা চোখের পানি গরিয়ে পরলো।মালু বললো,

-কিরে থামলি কেনো?চল?

উর্বি সামনে এসে আমাকে কাদতে দেখে বললো,

-কি রে?কাদছিস কেনো?যাবি না?

আমি তড়িঘড়ি করে চোখের পানি মুছলাম।এরা বরই খাপছাড়া হয়ে গেছে,একদম নির্লজ্জ।হুটহাট এভাবে বেরিয়ে আসে অকারনে।অকারনে কি?কষ্ট হচ্ছে না আমার?

-মিথি?কি হয়েছে টা কি তোর?

নিজেকে শক্ত করে বললাম,

-কিছু হয়নি।কোথাও যাবো না আমি।ডিরেক্ট বাসা যাবো।

-ভাইয়াকে সরি বলবি না?

-একবারও বলতে চেয়েছি?তুইই টেনে এনেছিস আমাকে।

-কিন্তু তুই তো…

-আর একটাও কথা না।ভালো লাগছে না আমার।

-কেনো?কিসের জন্য?কেনো কষ্ট পাচ্ছিস তুই?

কষ্ট?কষ্ট পাচ্ছি আমি?কেনো পাচ্ছি?নাহ্!কষ্ট পাওয়ার কোনো কারন নেই আমার। না হচ্ছে না কষ্ট আমার।ইশতিয়াক আরমান আমার কেউ হননা যে তার জন্য আমি কষ্ট পাবো।আর উনার সুখে?তখন তো আরো কষ্ট পাবো না আমি।তুচ্ছ আমার সরি না বলাতে কিছু আসবে যাবে না উনার।ভালো থাকুক উনি।দ্রুত পায়ে বেরিয়ে এলাম ভার্সিটি থেকে।

#চলবে…

®

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here