#তোকে_ঘিরে ❤
#পর্ব_৬২.
#ফাবিয়াহ্_মমো
(অংশ – ০৩)
পূর্ণতার প্রতিটা চিৎকার যেনো আয়েশার মনে ক্ষরণ করছে। তিনি কোনোভাবেই পূর্ণতাকে সামলাতে পারছেন না। পূর্ণতার হাউমাউ চিৎকার শুনে আয়েশার চোখ থেকে নির্লিপ্তে পানি ঝরছে। দুহাতে পূর্ণতাকে জড়িয়ে ধরে আগলে রাখলেও পূর্ণতার কান্না যেনো প্রতিটি কষ্ট পাওয়ার সাক্ষী বহন করছে। বারবার পূর্ণতা অশ্রুবিদ্ধ গলায় থেমে-থেমে বলছে, ‘ওরা হাত ভেঙ্গে দিয়েছে মা, ওরা ওকে মেরে ফেলবে।’ আয়েশা ওর কথা প্রথমে না বুঝলেও পরক্ষনে চিঠির হদিশ পেলে সেটা হাতে তুলে তিনি পড়তে থাকেন। ছেলের করুন দশায় তিনি চুরমার হয়ে ভেঙ্গে পরলেও পূর্ণতার জন্য নিজেকে শক্ত করেন। চোখ মুছে সকল যন্ত্রণা তিনি গুটি পাকিয়ে ভেতরে দমিয়ে রাখেন। পূর্ণতাকে জড়িয়ে ধরে অনবরত মাথায় হাত বুলিয়ে নানা সান্ত্বনা সূচক বাক্য শুনিয়ে ওকে শান্ত করার চেষ্টা করেন। পূর্ণতা এখনো চোখ খিচে নিচের ঠোঁট কামড়ে অবিরাম ধারায় অশ্রু ফেলছে। আয়েশা চিঠিটার উপর আরেকবার চোখ বুলিয়ে ব্যথিত মনে সেটা ভাঁজ করে বালিশের তলায় রেখে দিলেন। শাড়ির আচঁল টেনে পূর্ণতার চোখ মুছে নাক টেনে শান্ত কন্ঠে বললেন,
– কেঁদে লাভ আছে? ও কি তোমার কথা ভেবেছিলো? আমার কথা চিন্তা করেছিলো? কে বলেছিলো অন্যের জন্য নিজের জীবন ঝুঁকিতে ফেলতে? ও তো কারোর কথা শোনেনি। ও তো স্বার্থপরের মতোই নিজের মনমর্জি খাটিয়েছে। আমি-তুমি-আমরা সবাই জানি ও যে পথে কাজ করতে চায় সেখানে কষ্ট আর মৃত্যু ছাড়া কিছুই নেই। শান্ত হও। তুমি অসুস্থ হলে ভেতরের মানুষ তো সুস্থ থাকবেনা। অন্তত চিঠির মালিকের কথাটা মনে রাখো। ও নিশ্চয়ই তোমার এ অবস্থা সহ্য করবেনা।
কন্ঠ ভারি হয়ে আসছিলো আয়েশার। নিজেকে কান্না থেকে সংবরণ করা নিদারুণ কষ্টের ছিলো। চোখ থেকে টপটপ করে অশ্রুর বর্ষন হচ্ছিলো। মাতৃমনের বুকটা হাহা করছিলো চিঠিটা পড়ার জন্য। রূহটা রেখে দেহটা পুরো শেষ দিয়েছে ওরা। আয়েশার ফোপানো আওয়াজ শুনে এবার ধীরেসুস্থে চোখ খুলে তাকায় পূর্ণতা। অশ্রুজলে টলটল করতে থাকা পূর্ণতার চোখ আয়েশার দৃষ্টিতে নিবদ্ধ হলে আয়েশা তখন ব্যথাতুর কন্ঠে বলে উঠে,
– ওরা আমার সন্তানকে মেরে ফেললে ওই আল্লাহ্ মালিক ওদের ছাড়বেনা। আমি খোদার কাছে বিচার দিলাম। আমি বিচার দিলাম, ওই পাপিষ্ঠদের শাস্তি হোক। এই অসহায় মায়ের আকুতি আল্লাহ্ কোনোদিন ফিরিয়ে দিবেনা। ওই খোদা দেখছে তো! উনি কাউকে ছাড়বেনা! কোনোদিন ছাড়বেনা। আমার ছেলে আজ ধুকে ধুকে মরলে ওদের কঠিন শাস্তি চাই। আমার পূর্বের উপর জুলুম করা মানুষের বিচার …
কথাটুকু শেষ করতেই আয়েশা চোখে আচঁল চেপে হুড়মুড় করে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। ক্ষতবীক্ষত হৃদয় নিয়ে আয়েশাও আজ বুক ভাসিয়ে কেদেঁ দিলেন। স্থির হয়ে বসা থাকা পূর্ণতা অশ্রু নয়নে দরজার দিকে তাকিয়েছিলো। চোখের সীমানা ডিঙিয়ে বড় বড় অশ্রুফোঁটা গাল ভিজিয়ে পরছিলো। শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় শুধু মনেমনে বলছিলো ‘ নিশ্চয়ই কষ্টের সঙ্গে রয়েছে স্বস্তি ‘।
.
রাতটা ভয়ংকর অন্ধকারে ঢেকে আছে। চাঁদের আলোটুকু আজ নেই। কোথাও কোনো শব্দ নেই, আওয়াজ নেই, শোরগোল নেই। চারিপাশ যেনো রাতের আধারে গা ঢাকা দিয়ে বসে আছে। ঠান্ডা বাতাস চলছে এখন। বারান্দা দিয়ে বাইরে তাকালে কুয়াশা মতোন দেখা যায়। সাগ্রত হাতভাঁজ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে আনমনে কিছু ভাবছে। মাথার মধ্যে শুধু একটাই প্যাঁচ, একটাই চিন্তা, কিভাবে ওয়াসিফ পূর্বকে জেল থেকে নির্দোষরূপে অব্যহতি দেওয়া যায়। ওর পেছনে যে ঘোরতর ষড়যন্ত্র লেগে আছে সেটা কিভাবে নিস্ক্রিয় করা যায়। রাতে এখন শান্তির ঘুম আসেনা। চোখ বন্ধ করলে পূর্ণতার সেই অশ্রু মাথা মুখটা শুধু ভাসে। গর্ভাবস্থায় মেয়েটা প্রচুর কষ্ট পোহাচ্ছে। চিন্তার প্রহর তিল তিল করে বাড়তে থাকলে কাধের উপর হাতের স্পর্শ অনুভব হলো। হাতটা কার সাগ্রত সেটা বুঝতে পেরেও চোখ পিছু করে দেখলোনা। সাগ্রতের এরূপ আচরণ দেখে হাতের মালিকটা একটু ক্ষুদ্ধ হলো যেনো। সে পেছন থেকে সরে গিয়ে তারের শুকনো কাপড়গুলো ক্লিপ সরিয়ে তুলতে লাগলো। সাগ্রত আড়চোখে সেটা বুঝতে পেরে চুপচাপ রুমের ভেতরে চলে যেতেই হুট করে ফিরে এসে তার পেছন থেকে কোমর জড়িয়ে কাধে মুখ গুঁজে দিলো। চমকে উঠে মৃদ্যু ভঙ্গিতে শিউরে উঠতেই সে আর তারের কাপড়গুলো হাতে নিতে পারলো না। সাগ্রত পেটের উপর শক্ত করে চেপে ধরে আছে। ইদানিং সাগ্রতের শক্তি যেনো আগের তুলনায় বেড়ে গেছে। নিজেকে তুলার মতো নরম অনুভব হয় সাগ্রতের বাহুবন্ধনে। স্নেহা মাথা ঘুরিয়ে সাগ্রতের মুখটা দেখতে চাইলো, কিন্তু সে দেখতে পারলো না। সাগ্রত আরো শক্ত করে চেপে ধরে নিচু গলায় বললো,
– একটু স্থির থাকো। নড়াচড়া করার দরকার নেই।
এমন উত্তরে আগাগোড়া কিছু না বুঝলেও স্নেহা পাল্টা প্রশ্ন করলো না। দুহাত ভর্তি শুকনো কাপড় নিয়ে সাগ্রতের উদ্ভট কাজে চুপ করে দাড়িয়ে রইলো। এদিকে ঠান্ডা বাতাসে শরীরের পশম কাটা দিয়ে উঠছে। সাগ্রতের গায়ে জিপার সিস্টেমের নরমাল জ্যাকেট থাকলেও স্নেহার গায়ে কিছুই নেই। কাপড় তোলার সময় মনে ছিলোনা শালটা গায়ে টানতে। স্নেহা অনেকক্ষন পর জিজ্ঞেস করলো,
– তুমি কি আবার কেস নিয়ে চিন্তা করছো?
সাগ্রত অস্ফুট স্বরে উত্তর দিলো,
– হু।
স্নেহা শুকনো কাপড়গুলো আবার তারে ঝুলিয়ে দিলো। পেটের উপর রাখা সাগ্রতের হাতে নিজের দুহাত রেখে দিলো। মুখটা ডান দিকে ফিরিয়ে সাগ্রতের গালে ওষ্ঠ স্পর্শ করলো। সাগ্রত চোখ খুলে তাকালে ওই অবস্থায় দুজনের চোখাচোখি হয়ে যায়। স্নেহা যেনো গভীর দৃষ্টিতে সাগ্রতকে বোঝার চেষ্টায় আছে। সাগ্রত ওই ভঙ্গি দেখে দ্রুত স্নেহাকে ছেড়ে দিয়ে রুমের ভেতরে চলে গেলো। সাওদা বিছানায় ঘুমিয়ে আছে দেখে নিঃশব্দে ওর কাছে গিয়ে কপালে চুমু দিলো। স্নেহা ততক্ষণে সব কাপড় এনে সোফার উপর রেখে দিতেই সাগ্রতের দিকে তীব্রদৃষ্টিতে তাকালো। সাগ্রত সেদিকে ধ্যান না দিয়ে আইপ্যাড অন করে আবারও কেস সংক্রান্ত ঝামেলা নিয়ে বসলো। স্নেহা ইদানিং লক্ষ করছে, সাগ্রত বেশিরভাগ সময় প্রচুর দুশ্চিন্তায় ভুগছে। আগে কখনো কোনো কেস নিয়ে এমন বিবশ, বেহাল, বিমর্ষ অবস্থা দেখেনি। স্নেহা গায়ে মোটা শালটা জড়িয়ে নিতেই সাগ্রতকে খোঁচা মেরে বললো,
– সিরিয়াল কিলারকে এই অবস্থায় মানায় না ।
খোঁচা খেয়ে চকিত দৃষ্টিতে তাকালো সাগ্রত। দুই ভ্রুঁ খানিকটা কুঁচকে হাতের আইপ্যাডটা পাশে রেখে উঠে দাড়াতেই সন্দিগ্ধ গলায় বললো,
– কি অবস্থায় মানায় তাহলে? আমাকে কি অবস্থায় দেখতে চাচ্ছো?
কথার ভঙ্গি ও চোখের চাহনি দুটোই স্নেহাকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দিলো। এর মধ্যে সাগ্রত যেভাবে এগিয়ে আসছে এতে প্রচণ্ড লজ্জাবোধ হচ্ছে ওর। স্নেহার দুইহাতে শালটা আরেকটু চেপে ধরতেই চোখ নিচু করে থতমত করে বললো,
– না ওইযে, বলতে চাচ্ছিলাম, মানে আরকি, তুমি ওভাবে..
স্নেহা তার কাঙ্ক্ষিত কথাটা শেষ করতে পারলো না। সাগ্রত হেঁটে এসে স্নেহার একদম নিকটে দাড়িয়ে ভ্রুঁ কুন্ঞ্চন মুখভঙ্গিতে বলে উঠলো,
– আমার দিকে কি তুমি আগের মতো ধ্যান দাও? সাওদা আসার পর থেকে দুইমিনিট আমাকে সময় দিয়েছো? বলো স্নেহময়ী! তুমি কি আগের মতো আমাকে প্রোপার এ্যাটেনশ্যান দিচ্ছো?
স্নেহার মুখ ভীষণ কালো হয়ে গেলো সাগ্রতের কথা শুনে। সাওদা যত বড় হচ্ছে ততই সাগ্রতের সাথে সুক্ষ্ম একটা দূরত্ব না চাইতেই সৃষ্টি হচ্ছে। নিজের দিক থেকে বিশাল অপরাধ হয়েছে বলে স্নেহা পাল্টা কোনো উত্তর দিলো না। কিন্তু সাগ্রত একটা অভাবনীয় কাজ হিসেবে হালকা মতোন ধাক্কা দিয়ে স্নেহাকে ডিভানে ফেলে দিলো। গা থেকে শাল সরে গিয়ে স্নেহা ডিভানে বেকায়দায় পিঠ লাগিয়ে পরে গেলো। সাগ্রত ওর মাথার দুইপাশে হাত ফেলে ঝুঁকলে অভিযোগ ছুড়ে বললো,
– আমার গায়ে হাত দিয়ে তুমি শোও? আগের মতো কি আমার দিকে তাকাও? আমি টেনশন করছি , না কি করছি সেদিকে লক্ষ রাখো? ইউ আর ওয়ার্থলেস! জাস্ট হেইট ইউ স্নেহময়ী!
সাগ্রতের ক্ষিপ্ত কথায় প্রচণ্ড নিশ্চুপ হয়ে যায় স্নেহা। মেয়ের জন্য ঠিকই আগের মতো খেয়াল রাখা সম্ভব হয়না। কিন্তু সাগ্রতের মতো এতো ম্যাচিউর ব্যক্তির কাছে এই সুক্ষ ব্যাপারগুলো এতো ভয়ংকর হয়ে উঠবে সে সম্বন্ধেও ওর জানা ছিলো না। স্নেহা ঢোক গিলে আশ্বস্ত কন্ঠে নরম ভঙ্গিতে বললো,
– তোমার মেয়ের জন্যই তো পারিনা। আমরা কি আগের মতো আছি বলো? এখন তো আমাদের মাঝে সাওদা আছে। ওর দিকে কি ধ্যান দিতে হবেনা?
স্নেহার যৌক্তিকতা শুনে কিছুটা নরম হলো সাগ্রত। কিন্তু তখনও সে স্নেহার উপর ঝুঁকেছিলো। স্নেহা ওকে উপর থেকে সরতে বলে বিছানায় শুয়ে পরতে বললো। আজ কেসের চিন্তায় রাত না জেগে ঘুমাতে বলে যেই উঠতে নিবে ওমনেই সাগ্রত ওর উপর ভর ছেড়ে দিয়ে ওষ্ঠযুগল আবদ্ধ করলো। স্নেহা প্রচণ্ড মাত্রায় অবাক হয়ে বিস্ফোরিত চাহনিতে তাকিয়ে থাকলে সাগ্রত নিজের ওষ্ঠকার্য সম্পাদনে মগ্ন ছিলো। ধু ধু মরুভূমিতে একফোঁটা জলের আভাস দেখলে মনে যে পুলকের উচ্ছাস জন্মে ঠিক তেমনই উদ্দীপ্ত অবস্থায় সাগ্রত ছিলো তখন। পরিচিত উষ্ণতায় নিজের ভারী গা ছেড়ে দিয়ে ওষ্ঠমায়ায় নিমত্ত ছিলো সাগ্রত। শ্বাস টানের জোগাড় হলে সাগ্রত দ্রুত স্নেহাকে ছেড়ে দিয়ে লম্বা নিশ্বাস ফেলতে লাগলো। স্নেহা এমন পরিস্থিতিতে সুপ্ত লজ্জায় পরলে তাড়াতাড়ি সাগ্রতকে সরিয়ে ডিভান থেকে উঠে দাড়ালো। সাওদার পাশে গিয়ে তৎক্ষণাৎ কম্বলের ভেতরে ঢুকে মাথা মুড়ে শুলো। সাগ্রত ডিভানে বসে শ্বাসকার্য চালাতেই এ দৃশ্য দেখে ঠোঁটের কোণে কিন্ঞ্চিত হাসি ফুটালো। জ্যাকেটের জিপারে হাত রেখে সেটা উপর থেকে নিচের দিকে টান মেরে খুললো। গা থেকে ধূসরবর্ণের জ্যাকেট খুলে কালো টিশার্টটা একটু ঠিকঠাক করে নিলো। বিছানার ডানপাশে স্নেহা, মাঝখানে সাওদা, তারপর সাগ্রত শুয়ে থাকে। সাগ্রত হেঁটে এসে যেদিকে ঘুমায় সেদিক থেকে আইপ্যাড তুলে ডিভানে গিয়ে বসে। স্নেহা মাথা থেকে চোরের মতো কম্বল সরিয়ে উঁকি মারতেই সাগ্রতের চাহনির সাথে চোখাচোখি হয়ে যায়। তাড়াতাড়ি আবার আগের মতো কম্বল মুড়ে মাথা ঢাকতেই সাওদা অস্ফুট আওয়াজে কেদেঁ উঠে। ঘুমের ঘোরে ছোট্ট সাওদার বুকে হাত বুলিয়ে দিতেই সাওদা ঘুমিয়ে পরে। কিন্তু সাওদার দিকে খেয়াল দিতে গিয়ে কখন যে সাগ্রত স্নেহার পিছনে যেয়ে শুয়ে পরে সে ধ্যান অবশ্য স্নেহার নেই। স্নেহা ঠিক করে শুতেই দেখে চোখের উপর কবজি তুলে সটান হয়ে শুয়ে আছে সাগ্রত। এদিকে মেয়ের পাশে বামদিকটা শূন্য। স্নেহা আর কথার তলব না টেনে সাওদার পাশে কোল বালিশ রেখে সাগ্রতের দিকে ফিরলো। চোখের উপর থেকে কবজি সরিয়ে ওর মুখের দিকে এগোলো। সাগ্রত চোখ বন্ধ করে থাকলেও স্নেহা জানে সাগ্রত ইচ্ছে করেই এমনটা করছে। স্নেহা ধীরেসুস্থে কম্বলটা টেনে সাগ্রতের পা থেকে বুক পযর্ন্ত ঢাকলো। শীতের জন্য হাতের তালু বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে গেছে। হাত গরম করার দুষ্টু বুদ্ধি মাথায় চাপলে স্নেহা চুপচাপ সাগ্রতের টিশার্ট উঠিয়ে দুহাত ঢুকিয়ে দেয়। উষ্ণ বুকের উপর ঠান্ডা হাতের তালু বসিয়ে দিতেই সাগ্রত হকচকিয়ে চোখ খুলে আর্তনাদে চেঁচিয়ে বলে,
– স্নেহময়ী হাত সরাও, সরাও! কি খারাপের খারাপ ! নিজের ঠান্ডা হাত এনে আমার বুকের উপর রাখছো? হাত সরাও বলছি। বরফের মতো ঠান্ডা হাত!
সাগ্রতের এমন অপ্রতিভ আচরণ দেখে খিলখিল করে হেসে দেয় স্নেহা। সাগ্রতের গরম গায়ে ঠান্ডা হাত বসিয়ে উষ্ণতা নিতে চরম লাগছে তার। স্নেহার চালবাজি বুঝতে পেরে সাগ্রত কিছুক্ষণ কপাল কুঁচকে শক্ত চাহনিতে তাকিয়ে থাকলে পরক্ষনে কিছু না বলে স্নেহার দিকে ঘুরে কম্বলটা গলা অবধি টেনে চোখ বন্ধ করে। বুকের উপর থেকে ঠান্ডা হাত তখনও সরায়নি স্নেহা। পিটপিট করে হাস্যোজ্জল চাহনিতে দেখছিলো সাগ্রতকে। সাগ্রত চোখ বন্ধ করে স্নেহার একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকাটা বুঝতে পেরে চট করে সেও স্নেহাকে ঠান্ডার শিহরনে কাঁপিয়ে দেয়। নিজের ঠান্ডা হাত স্নেহার কামিজ উঠিয়ে পেটের উপর রাখতেই স্নেহা চিৎকার দিতে যেয়ে মেয়ের জন্য কন্ঠ নিচু করে বলে উঠে,
– এ কি করছো! তোমার হাত খুব বেশি ঠান্ডা! বরফের চাকা যেনো রাখছো। হাত সরাও প্লিজ।
সাগ্রত ত্যক্ত ভঙ্গিতে বলে উঠলো,
– এখন কেমন লাগে? নিজের বেলায় ফিটফাট, অন্যের বেলায় বাজিমাত? ন্যাকড়া না দেখিয়ে চুপচাপ শুয়ে থাকো। বেশি চিল্লাচিল্লি করলে কি করতে যেয়ে কি করবো নিজেও জানিনা! আমার হাত কিন্তু খুবই খারাপ স্নেহময়ী। এলার্ট থাকাটা তোমার কর্তব্য।
.
অন্ধকার জেলে সময়গুলো খুবই জঘন্য হিসেবে কাটছিলো। কখন সকাল হয়ে রাত হয়, কখন ভোরের আলো ফুটে রাতের আধার নামে কিছুই জ্ঞাতব্য ছিলো না পূর্বের। একেকটা দিন একেকটা অভিশাপের মতো যাচ্ছিলো ওর। চব্বিশ ঘন্টার অর্ধেকটা সময় অর্ধচেতন হিসেবেই থাকতো। বেঁচে থাকার আশা এবং জেল থেকে নির্দোষ হিসেবে বের হওয়া সবকিছু পূর্ব ত্যাগ করেছিলো বহু আগেই। জীবনের দূর্বিসহ দিনগুলো নিজের অন্তিম সময় বলে বিবেচনা করতো। যেকোনো মূহুর্তে মৃত্যুর আগমন চলে আসতে পারে এ নিয়ে প্রচণ্ড সজাগ ছিলো। শরীরের উপর নূন্যতম শক্তি ছিলো না ওর। খাবার চিবিয়ে খাওয়ার মতো অবস্থাও ফুরিয়ে গিয়েছিলো। চোখের উপর স্বচ্ছ পানির আভাস সর্বদা অনুভূত হতো। টলটল করে চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পরতো। ঝাপসা দৃষ্টি দিয়ে জেলের সিলিংয়ের দিকে ঘন্টার পর ঘন্টা তাকিয়ে থাকতো। প্রচণ্ড মাথাব্যথায় দেয়ালে কতবার বারি মেরেছে সে হিসেব নেই। কপাল ফেটে কানের পাশে তরল জিনিসের অস্তিত্ব অনুভব হয়েছে সে হদিশ নেই। যখন কানের পাশে চিপচিপে লাগতো তখন হাত দিয়ে বুঝতো তাজা রক্ত বেয়ে পরছে। সেই সেলে একাকিত্বের মধ্যে থেকে কতগুলো দিন পেরিয়ে যাচ্ছিলো পূর্ব সে হিসেব টুকে-টুকে মস্তিষ্কের ভেতর জমা করছিলো। পূর্ণতার মুখচ্ছবি দেখার জন্য মনেমনে আকুলিবিকুল করতো। অনাগত অতিথি নিয়ে একটু সুখকর অনুভূতি শেষ যাত্রার স্মৃতি হিসেবে পেতে চেয়েছিলো, কিন্তু ভাগ্য যেনো সহায় হয়নি। সেই অন্ধকার সেলে হাত পা ছড়িয়ে ক্ষতবীক্ষত দেহ লুটিয়ে পূর্ব স্মৃতির দুয়ার মেলে নিজের সাথে আত্ম কথা চালাতো। সবটা ঘিরে, সবটা জুড়ে শুধু পূর্ণতা ছিলো। আজ পাশে কেউ নেই ভাবতে গেলেই চোখের কোটর অসহ্য যন্ত্রণায় ভিজে উঠতো।
আমার নির্মলচিত্তের পূর্ণতা, আজ আমি তার কাছ থেকে বহু দূরে আছি। এখন শুধু মৃত্যুর জন্য সময় গুনছি। নিজের ভুলের শাস্তি হিসেবে আমি তাকেও কষ্ট দিচ্ছি। ওকে যেদিন আমার সামনে প্রথম দেখেছিলাম সেদিন বুঝিনি ওই রাতের অন্ধকারে নির্জন সড়কে রক্তাক্ত, চেতনাহীন মেয়েটি আমার শক্ত হৃদয়ের সবটা জুড়ে বিচরণ করবে। আমি ভাবিনী আমার বিক্ষিপ্ত, কঠোর, উষ্ণ হৃদয় কখনো মায়াময় স্নিগ্ধপূর্ণ মুখচ্ছবিতে নিবিষ্ট হয়ে শীতলতা ছড়িয়ে দিবে।
রাজনীতির অঙ্গনে দূর্দান্ত গতিতে চলার পথে কোনো সুন্দরী ললনা আমাকে ক্ষণিকের জন্য আর্কষিত করতে পারেনি। কখনো অজস্র নিয়মের গতিবেগ রোধ করে আমার মন গলাতে পারেনি, সেই আমিই কিনা নিজের মৃত্যুটা চোখের সামনে পেয়েও তার জন্য কেদেঁ মরছি। এখনো তার বীভৎস ঘটনার স্মৃতিগুলো আমাকে অপরাধী বানাতে আসে। স্বল্প সময়ের জন্য তাকে একা রেখে যাওয়ার কষ্টগুলো খুব পীড়া দেয়। হাসপাতালের বেডে শুয়ে থাকা সেই মলিন মুখের চেহারা আমার হৃদয়ের রুদ্ধদ্বারে এখনো কঠিনভাবে আঘাত করে। আমি সেদিন তাকে আগলে রাখতে পারিনি। তার সব যন্ত্রণা আমি কোনোভাবেই নিজের করতে পারিনি। যতবার দূরে গিয়েছি, আমি নিজের ক্ষতি করেছি। আমি নিজেকে ধ্বংস করেছি। আমার নিজের বানানো নিয়মকানুন আমি নিজেই ভেঙ্গে ফেলেছি।
তার আগমনের প্রথমদিকে আমি তখনো জানতে পারিনি তার জন্য আমার মধ্যে কিসের অনুভূতি হচ্ছিলো। বুঝতে পারিনি আমার মনের রাজ্য জুড়ে তার রাজত্ব ইতিমধ্যে একটু একটু করে শুরু হতে যাচ্ছিলো। তার মোহময় মুখটা দেখার জন্য আমার দৃষ্টি প্রতিনিয়ত তাকে খুজেঁ বেড়াতো। তার প্রতিটি পাগলামিপূর্ণ অভিব্যক্তি শোনার জন্য আমার মনপ্রাণ ব্যাকুল হয়ে উঠতো। তার নরম স্পর্শ পাবার আকাঙ্ক্ষায় প্রচণ্ড উন্মাদ, উন্মুখ, উন্মত্ত হয়ে যাবো, আমি কখনো ভাবিনি। আজ আমি শঙ্কিত পূর্ণ। এ নির্জন জেলের মধ্যে কোথাও তুমি নেই। তোমার স্পর্শ নেই, তোমার দেখা নেই, তোমার আগমন নেই। তোমার জন্য নিজ থেকেই আমি শেষ হয়ে যাচ্ছি। আজও এই অন্ধকার সেলের ভেতর অদ্ভুত আলোর জন্য প্রতীক্ষায় আছি। আমার বিশ্বাস তুমি আমার ব্যর্থ জীবনের সবচেয়ে স্বার্থক ব্যক্তি হিসেবে আসবে। এক নতুন দিনের উন্মোচন করে আমার শেষ চিহ্ন নিয়ে তুমি আবারও নিজেকে গড়বে। ভুলিয়ে দিবে সমস্ত ঈর্ষা, কলুষতা, যন্ত্রণা, স্বার্থপরতার প্রহর। আমি শুধুই স্বপ্ন দেখি তোকে ঘিরে, সমাজকে ঘিরে, দেশ ও রাজনীতিকে ঘিরে।
একদিন হবে দেখা, যেদিন ভেঙ্গে যাবে সব মিথ্যার পরিকল্পনা। হয়তো একদিন বীরবেশে ফিরবো, নয়তো সত্য আকড়ে লাশ হয়ে অগোচরে হারিয়ে যাবো।
.
সকাল দশটা বিশ। নাস্তার টেবিলে মগের হ্যান্ডেলে আঙ্গুল পেচিয়ে ঠোঁটের কাছে আনতেই বিশ্রী রিংটোনে ফোন বাজতে লাগলো। মগটা টেবিলে আগের জায়গায় রাখতেই ফোনটা রিসিভ করে কানে রাখলো। ওমনেই ওপাশ থেকে সর্তক ভঙ্গিতে কেউ বললো,
– সাগ্রত স্যার, পেয়ে গেছি।
উত্তরটা শুনে মুখের পাউরুটি আর চিবাতে পারলো না সাগ্রত। এক চিৎকার দিয়ে চেচিয়ে উঠতেই কফি ফেলে দৌড় লাগালো।
– ‘ চলবে ‘
#FABIYAH_MOMO
গ্রুপ — ❤ মমোর গল্পভ্রমর-Fabiyah Momo❤
( নোটবার্তা: অর্ধেক টাইপে ছিলো সেটার সাথে আজকের অর্ধেক এবং গতকাল+রাতের অর্ধেক মিলিয়ে এটুকু সম্ভব হয়েছে। জানিনা ফোনজনিত সমস্যা কবে শেষ হবে। আমার জন্য দুয়া রাখবেন। নানাভাইয়ের মৃত্যুশোক ও ফোনের ঝামেলা যেনো কাটিয়ে উঠতে পারি।)