#তোকে_ঘিরে❤
#পর্ব_০৮
#ফাবিয়াহ্_মমো?
আমি কথা শুনে ভয়ের ক্রোশে আরো পিছিয়ে গেলাম ওমনেই পিঠে ঢুকে গেলো কাচ! আমি চোখ খিচে ‘উহ্’ করলে উনি হাত টান দিয়ে উনার দিকে ঘুরিয়ে ফেলেন। রাগান্বিত সুরে বলে উঠলেন,
– কথা বললে কানে যায় না! বারবার বলছি পেছাতে না তাও পেছালে! আমাকে এতো ভয় পাও কেন? আমি কি খেয়ে ফেলবো? আমি কি রাক্ষস নাকি ভ্যাম্পায়ার?
উনি রাগী গলায় ফোস ফোস করে পিঠের কাছ থেকে সরিয়ে চুল সামনে ঠেলে দিলেন। আমি তীব্র ব্যথায় দাত খিচ মেরে শক্ত হয়ে আছি। উনি শান্ত কন্ঠে কাঠিন্য ভঙ্গিতে বলেন,
– জাস্ট একটু শক্ত হও পূর্ণ!আমি এক্ষুনি কাচের টুকরোটা বের করছি।
পূর্ব জানালার বাইরে রক্ত মাখা কাচ টুকরা ছুড়ে পূর্ণতার ক্ষত জায়গায় মলম লাগিয়ে দিতেই পূর্ণতা হাত মুখ খিচুনি দিয়ে দাড়িয়ে রইলো।
– রাগের বশে আয়নায় মোবাইল না ছুড়লে তোমার এতো কষ্ট হতো না। সরি! আগে জানলে ছুড়ে মার….
পূর্ণয়ার কান যেনো তব্দা লেগে আছে। পূর্বের কোনো কথাই সে কান দিয়ে ঢুকাচ্ছেনা। পূর্বের আলতো আঙ্গুলের প্রতিটা স্পর্শ ঝাঝড়া করে দিচ্ছে ওর বুকে। পূর্ণতার শরীর ঝিমঝিম করে উঠছে ক্ষনে ক্ষনে। পূর্ব তুলোয় হাত মুছে পূর্ণতার পিঠে একটি ছোট্ট তিলের আবিষ্কার করলো। অত্যাশ্চর্যের মতো টানছে জিনিসটা! পূর্ব মৃদ্যূ হেসে পূর্ণতার তিলের উপর হাত রাখতেই পূর্ণতা শিউরে উঠে চোখ কুচকে তোতলাতে তোতলাতে বললো,
– ছেড়ে দিন প্লিজ!! ছেড়ে দিন!! আমি আর কক্ষনো পানিতে পরবো না!! আমাকে মারবেন না প্লিজ!! আপনার চড় খেয়ে বধির হওয়ার ইচ্ছা বা শখ কোনোটাই আমার নেই!!
পূর্ব ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো। পূর্ণতা কালকের বিষয় নিয়ে বিড়বিড় করছে কেন! এই পাগলী ভেবেছে আমি কালকের জন্য ওকে মারবো? ও কি পানিতে ইচ্ছে করে পরেছে যে মারতে যাবো? আমাকে এতো ভয় পায় কেনো ড্যাম! পূর্ব পূর্ণতাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে ওর ভয়ার্ত মুখপানে তাকাতেই ঘোর লেগে যায় দৃষ্টিতে। অসহ্য লাগছে অসহ্য! এখনি কিছু করে ফেলতে ইচ্ছে করছে! শাড়ি? এই মেয়ে শাড়ি পেচিয়েছে কেনো? শাড়ি পরলে এমনেই মাথায় আগুন ধরে যায়! পূর্বের মধ্যে একরাশ চাপা উত্তেজনা বাড়তে লাগলো করলো। নিজেকে কন্ট্রোল করতে যেয়ে আউট অফ কন্ট্রোলে উপেনিত হয়ে পূর্ব পূর্ণতার কোমর পেচিয়ে এক টান দিয়ে নিজের দিকে আনতেই পূর্ণতা রীতিমতো কৈ মাছের মতো কাপাকাপি ভিত্তিতে রণাঙ্গন শুরু করে দিয়েছে। পূর্ব পূর্ণতার গলায় হাত রেখে গালে নাক ঘষতেই পূর্ণতা আরো তীব্রতায় ওকে দূরে ঠেলতে লাগলো। পূর্ব নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে আবেগপূর্ণে বশীভুত হয়ে পূর্ণতার গালে গাল ঘষছে। পূর্ণতা ভয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে ফুপিয়ে কেদে দিলে সাথেসাথে পূর্ণতার মুখ চেপে নিচুস্বরে বলে উঠে পূর্ব,
– চুপ চুপ!! কি সাংঘাতিক! কাদছো কেন!! চুপ করো পূর্ণ!! কেউ শুনে ফেলবে !!
পূর্ব ওকে ছেড়ে দিতেই পূর্ণতা ছো মেরে নিজেকে ছাড়িয়ে দরজা খুলে বাইরে পালালো। পূর্ব দৌড় দিতে যেয়েও দিলো না, পা থামিয়ে ফেললো। ধ্যাত! ধ্যাত! কি করে ফেললাম? ওকে ছুয়ে….শিট! ওর গালে গাল…ওহ্ মাই গড! কি করলি পূর্ব! ও আনিশার কাজিন! ইয়াক…এখন যদি আনিশা এ ব্যাপারে এককোনাও জানতে পারে! ড্যাম ইট!
.
বাকরুদ্ধ হয়ে ফ্লোরে বসে বিছানায় পিঠ লাগিয়ে সামনে লম্বা পা ছড়িয়ে থম মেরে বসে আছি। চোখ থেকে থেমে থেমে পানি পড়ছে। দরজায় দফায় দফায় কড়া পরলেও খুলিনি। বলেছি শরীর খারাপ, আমি ঘুমাবো। বাড়িতে প্রচুর মেহমান গিজগিজ করা সত্ত্বেও কেউ আমাকে বিরক্ত করেনি। একটু দূরেই সদ্য পুড়িয়ে ফেলা আপুর দেয়া শাড়িটা থেকে উৎকট পোড়াগন্ধ আসছে। এই গন্ধ বাইরেও গিয়েছে কিনা জানিনা। পূর্ব ভাইয়ের একেকটা দৃশ্য চোখের সামনে কেমন পরিস্কার হয়ে ভাসছে আমি চোখ বন্ধ করতে পারিনা! ড্রেস চেন্জ করতেও প্রচুর ভয় লেগেছে এই বোধহয় পূর্ব ভাই দেখছে। ঘুমাতেও পারছিনা আমি এই দ্বিধাপূর্ণে! মরে যেতে ইচ্ছে করছে! রুম ঘুটঘুটে অন্ধকার। চোখের সামনে হাত আনলেও দেখা যাবেনা এমন করুণ আধার!সন্ধ্যার পর রাতের বাতি জ্বালাইনি, শরীরের ভেতর নূন্যতম শক্তি পাইনি। শাড়িটা আমার জন্য অশুভকর! অগ্নিগর্ভে ভষ্ম করে দিয়েছি! আচ্ছা? কারো সরলতার সুযোগ এভাবে নেওয়া উচিত? কে উনাকে অনুমতি দিয়েছিলো আমাকে ওভাবে ছোয়ার? উনার জন্য ওটা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হলেও আমার জন্য ছিলো ভয়াবহ আকার! আমার প্রথম সম্পর্ক ছিলো সিয়াম আহমেদ নামের এক অতিসরল ছেলের সাথে যে ছিলো আমার কলেজ লাইফের প্রথম প্রেম। নতুন নতুন অনুভূতির কারিগর হিসেবে তার সাথে বাধতে চেয়েছিলাম ঘর। কিন্তু সে চেয়েছে দেহ, আমি প্রেমের নামে পেয়েছি ধোকা! সম্পর্ক রাখিনি বাদ দিয়েছি। নিজের দেহ বিলিয়ে ভালোবাসা পাওয়ার মতো মহৎ গুণ আমার নেই। আমি অতি সরল সহজ মেয়ে যে একটুখানি স্নেহ, ভালোবাসা, মায়া,মমতা পাওয়ার জন্যে কারো কাছে ফরমায়েশ করেছিলো। কিন্তু সিয়াম সেটা রাখেনি। আজ আমার জায়গায় তানিয়া হলে পূর্ব ভাইয়ের স্পর্শ পেয়ে নিজেকে ভাগ্যবতী সুশ্রী ভাবতো! কিন্তু আমি পারছিনা! বুক ফেটে কান্না চলে আসছে বারবার ঘটনাটা স্মরণ করে। একাকীত্বের প্রহরে সময় কতদূর গেলো জানিনা হঠাৎ খিড়কির কাছে দ্বিতীয় দরজার বিকট শব্দ শুনতে পেয়ে আমি হাটু থেকে মাথা উঠালাম। জানালার দুই পার্ট খুলে দুইদিকে চলে গেছে। রুমের এই দ্বিতীয় দরজাটা আধভেজানো হয়ে খুলে আছে। ভেতরে কি কেউ ঢুকেছে? বিড়াল ঢুকলো? জানালা দিয়ে আকাশের কালো চাদরে ঝিলিক দেওয়া নক্ষত্রালোকে চোখ পরতেই কেউ আমার পাশে যেনো বসলো। আমি শিউরে উঠে সর্তক ভঙ্গিতে গলা তুললাম,
– কককে?
ঘন করে ছাড়া দুটো দীর্ঘশ্বাস শুনতে পেলাম। আমার বুকটা মোচড়ে এলো। অন্ধকার রুমে কে আমার পাশে এসে বসলো? আমি উপায়ন্তর না পেয়ে দোয়া যে জপবো সে খেয়াল আমার নেই হঠাৎ কেউ হালকা কেশে গলা নম্র করে বলে উঠলো,
– আই এম সরি পূর্ণ, আ’ম এক্সট্রেমলি ভেরি সরি।
আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম অন্ধকারময় রুমে আমার পাশে পূর্ব এসে ক্ষমাবাক্য উচ্চারন করবেন। আমি বিচলিত হয়ে ঝট করে উঠে দাড়াতে গিয়ে হাতে টান অনুভব করলাম। টানাসেতুতে ফেসে আমি ধপ করে পা মুচড়ে বসে পড়লাম। কোথায় বসেছি বুঝতে পারছিনা, পাকা মেঝের মতো শক্ত কিছু লাগছেনা। তার অস্থির কন্ঠ,
– এগেইন সরি। এটাও ইচ্ছাকৃতভাবে করিনি। তোমার সাথে ইর্ম্পট্যান্ট ম্যাটারে কিছু আলোচনা ছিলো তাই কনফার্ম করতে খোদ এসেছি। প্লিজ বি কাম এন্ড সিট কোয়াইট!
বুঝতে পারলাম আমি উনার কোলের উপর বসে আছি। যেখান থেকে আমার উঠার চান্স একদম নেই। অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাধ্য হয়ে চুপ করে দেখছি উনি কিসের ইর্ম্পট্যান্ট কথা বলে!
– পূর্ণ প্লিজ তুমি আনিশাকে আজকের ব্যাপারে কিছু বলো না। আমি বিরাট ঝামেলায় ফেসে যাবো।
তার মানে আমার সাথে করা উটকো কাজের ব্যাপারে উনার বিন্দুমাত্র আফসোস নেই? বাহ্! উনার জন্য আমি রাগে ঘেন্নায় শাড়ি পুড়িয়ে ফেলেছি উনি আমার কাছে আনিশা আপু যেনো না জানে সেই ব্যাপারে রিকুয়েস্ট করতে এসেছেন! ওয়াও এক্সিলেন্ট!
– আপনি এখানে আনিশার আপুর জন্য এসেছেন? আমার সাথে যে ঘটনাটা ঘটালেন তা নিয়ে কিছুই বলার নেই?
– হোয়াট? কি বলতে চাচ্ছো তুমি?
– আপনি আমার সাথে কি করলেন ভুলে গেছেন? ছাড়ুন আমায়! আমায় ছেড়ে কথা বলুন!
– ওভাবে ছেলেদের সামনে পিঠ বের করে শাড়ি পেচিয়ে আসাটা তোমার ভুল ! চুপচাপ বসে থাকো কথা শেষ হয়নি!
– আমার ভুল? পিঠ দেখাইনি গায়ে এক্সট্রা চাদর ছিলো! কিন্তু ওভাবে গালে গাল…ছি বলতেও তো লজ্জা করে আপনি আনিশা আপুর প্রাক্তন!
– এখানে ছি ছি করার তো কোনো কারন দেখছিনা।আনিশার সাথে তো বন্ধুর মতো চলেছি, প্রেমিকের মতো না। ও যদি নিজেকে বিশ্বনেত্রী প্রেমিকা মনে করে দ্যান আই হেভ টু স্যা সে খুবই ছ্যাঁচড়া!
– লজ্জা থাকা উচিত আপনার! ছাড়ুন বলছি! উফ আপনি ছাড়ুন!
– মেয়ে হিসেবে কি তোমার কাজিনের সামান্য লজ্জা থাকা উচিত ছিলো না? স্বামী ঘরে রেখে কিভাবে রাতের এগারোটা বাজে পর পুরুষকে ব্ল্যাকমেইল করে ডাকে? জাস্ট শেমফুল! পূর্ণ আমি হাত মুচড়ে ধরবো কিন্তু ! বসে থাকো বলছি!
– মিথ্যা বলার জায়গা পাননা? একটা মেয়ে ব্ল্যাকমেইল করতে যাবে? আসলে আপনি খুবই নোংরা! সব ছেলেরা নোংরা! আপনি আর সিয়াম একই পদের! সবার শুধু চাহিদার জন্য ভালোবাসার নামে অন্যজিনিস প্রয়োজন! আপনিও আজ তাই করেছেন! নোংরা কোথাকার!
– কি? ওয়েট…আমি তোমাকে ভালোবাসি কখন বলেছি! স্ট্রেন্জ তো! আর এই সিয়াম কে?
– কোন সাহসে! কিসের অজুহাতে! আপনি আমার গালে স্পর্শ করেছেন? আমি বলেছি আমায় টাচ করুন?
– তুমি কি মোবাইলের টাচস্ক্রিন যে টাচ করার জন্য উতলা হয়ে যাবো ! আমি পূর্ব একটা শিষ বাজালে মেয়েরা আমার জন্য লাইন ধরে থাকবে তুমি বলছো আমি তোমার জন্য…মাই গড! কি বিনোদন!! লাস্ট কোয়েশ্চ্যানের আন্সার দাও!
‘চোরের মায়ের বড় গলা’ – কথাটা গুরুজন পূর্ব ভাইয়ের মতো লোকদের জন্যেই বানিয়েছেন। উনার গায়ে পড়া কথাবার্তা আমার গা পিত্তি জ্বলিয়ে দিচ্ছে। হঠাৎ নিভুনিভু ঝাপসা অন্ধকারে উনার কাছ থেকে অন্যরকম একটা ঘ্রাণ পাচ্ছি। এই ঘ্রাণটা তখন পেয়েছি যখন উনি আমার গালে উনার গাল লাগিয়েছিলেন। ঘ্রাণটা খুবই মাতাল করার মতো বেশিক্ষন টিকা যাবেনা এখন! আচ্ছা? আমি কি ধাক্কা দিয়ে চিৎকার করবো? নাকি চিৎকার দিয়ে ধাক্কা দিবো? দুটোর একটাও যদি করি কোনোভাবেই ছাড় পাবোনা, কারন বাইরে ওয়াকিল ভাই বিয়ের আমেজে ফুল বিটে গান ছেড়েছে। হঠাৎ উনি পিঠের উপর হাত রেখে কি অনুমান করলে জানিনা আমি ধস্তাধস্তি শুরু করলে উনি আমাকে বন্দী শিবিরের মতো উনার কোলে আটকে ধরে বললেন,
– শাড়ি খুলে ফেলছো? সত্যি করে বলো সিয়াম কে?
কেপে উঠলাম উনার কন্ঠস্বর শুনে। এই কন্ঠে মাদকতার ন্যায় কিছু নেশাক্ত জিনিস মেশানো ছিলো। উনি হাত এনে আমার মাথার পেছনে এক খাবলা চুল মুঠিতে চেপে ধরলেন। আমি ঠোট কামড়ে কুকড়ে উঠি। চোখ বেয়ে অজস্র ফোটায় পানি গড়িয়ে পরছে। উনি টর্চার করছেন কেনো?
– মুখ বন্ধ করে থাকলে তোমার সিচুয়েশন আরো বাজে হবে পূর্ণ! সিয়াম কে?
– শাড়ি পুপুড়িয়ে ফেলেছি
– দ্যাটস নান অফ মাই বিজনেস! আমি সিয়ামের ব্যাপারে আস্ক করেছি!
-…….
আমি চুপ করে থাকলে উনি চুল আরো শক্ত করে ধরলেন। তপ্তকর নিশ্বাসের সাথে উনার রাগের উত্তপ্ততা প্রকাশ পাচ্ছে। উনি রাগে তেজঃপূর্ণ কন্ঠে বললেন,
– রিলেশন করছিস? ওই ছেলে তোর প্রেমিক?
‘তুমি’ থেকে ‘তুই’ তে যখন নেমেছেন এর মানে আমি শেষ! উনি আমাকে মেরে পিষে ফেলবেন! আমি কাপা গলায় বহুকষ্টে আস্তে আস্তে বলি,
– ছিছিলো ছিলো, এখখন নেনেই
উনি ধাক্কা দিয়ে আমাকে ফ্লোরে ফেলে আগের মতোই খিড়কির পাশে দ্বিতীয় দরজার রাস্তা দিয়ে চলে গেলেন। দরজার ঝাপটানিতে জানালাটা ক্যাচ ক্যাচ করে নড়ছে। দরজা, জানালা সব ঠিকমতো লাগিয়ে আমি তাড়াহুড়ো করে বাতি জ্বালিয়ে একগ্লাস পানি খেয়ে বিছানায় স্থির হয়ে বসলাম। তুমুল অস্থিরতায় আমার হৃৎপিন্ড এতো জোরে জোরে ধকধক করছে যেনো মাটিতে ফেটে গিয়ে বিশ্রী কিছু করে ফেলবে! আমি নিশ্বাস টানতে টানতে বিছানায় হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে পরলাম। একটু ঘুম দরকার আমার! ঘুমাতে কি পারবো?উনি রাতে যদি আবার আসে তখন কি করবো?
.
পরদিন দুপুরে খেতে বসে জানতে পারলাম আনিশা আপু পূর্ব ভাইকে বোঝানোর জন্য রাতে ডেকেছিলেন। পূর্ব ভাই হরহামেশার মতো ‘না’ করে দিয়েছেন। সেদিনের ঘটনার পর পূর্ব ভাই আর কখনো নিজ থেকে আমার সাথে কথা বলতে আসেননি। নানার বন্ধু অর্থাৎ পূর্ব ভাইয়ের দাদাসহ ফুয়াদ, জাওয়াদ, মিথুন ভাইয়া, পূর্বিকা ও সায়মাপুকে নিয়ে আমাদের বাড়িতে ঘুরে গেছেন। পূর্ব ভাই তখনো আসেননি। বাবার অফিসের ছুটি ফুরিয়ে যাবে আজ। মা বিকেল থেকে আমাদের যাওয়ার জন্য লাগেজ গুছাচ্ছেন। কাল আমাদের ঢাকাগামী ব্রহ্মাপুত্র এক্সপ্রেস ট্রেন। নানী মারা যাওয়ার পর নানাভাই দেওয়াণগন্জের ভিটেমাটিতে ফিরে আসেন বলেই আজ আমরা আনিশাপুর বিয়ে উপলক্ষে সব সদস্যরা গ্রামে একত্র হলাম। খালুর মজার মজার কান্ড, খালামনির ঝাড়ি, মামীর আদর্শপূর্ণ নীতি, মামার বাজার ভর্তি ব্যাগগুলোকে প্রচন্ড মিস করবো। গ্রামের পরিবেশে নিজেকে এতোদিন ধরে মত্ত রাখতে পেরে মন ও মস্তিষ্ক পুরোটাই ডিপ্রেশনমুক্ত। পড়ালেখার চাপ, শহুরে শব্দদূষন, মানুষের হিংসাত্মক হিংস্রতা সব ভুলিয়ে জামালপুরের দেওয়াণগন্জে পুরো এক সপ্তাহ কাটালাম। কাল ভোরে চলে যাবো দেখে ওয়াকিল ভাই, সুহাস ভাই, তানিয়ার মন খারাপ। তাই সবাইকে নিয়ে ঈদগাহ মাঠের ঘাসের উপর বসতেই দেখি ফুয়াদ ভাইয়াদের গ্রুপ এসে হাজির। ওয়াকিল ভাই উনাদের ডেকে আমাদের সাথে বসতে বললেন। আমাদের আড্ডা জমে উঠলো। মিথুন ভাই বলে উঠলেন প্রথমে,
– ওয়াকিল তোরা কবে চলে যাবি?পূর্ণতাকে ছাড়া তোদের মন টিকবে?
ওয়াকিল ভাই উদাস গলায় ঠোঁটে প্লাস্টিক হাসি ঝুলিয়ে বললেন,
– পূর্ণতাকে ছাড়া তো আমাদের সন্ধ্যার আড্ডা জমবেই না। টিকিট পাইনিরে তাই যাবো কবে সিউর না। আসলে আমরা সব কাজিনরা বিয়ের মৌসুম ছাড়া কখনো এক হতে পারিনা।এটাই কষ্ট।
ফুয়াদ ভাই দুষ্টুমি গলায় বলে উঠলেন,
– আরে ভাই ফিকার নট! জলদি একটা বউ এনে বিয়ে করে ফেলো!! বয়স তো কম হয়নি।।
– তোমাদের চেয়ে কমই আছে। তোমরা বিয়ে করো না কেন !!
জাওয়াদ ভাই পাশ থেকে হাসির ফোড়ন কেটে বলে উঠলেন,
– শোন্ ভাই! আমগোর বহুত দুঃখ আছে! আমাগোর বড় ভাই যদি বিয়ে না করে বাপ আমগোর বিয়ে দিবোনা।
– কি বলিস? পূর্ব ভাইয়ের জন্য তোদের বিয়ে আটকে আছে!! আলে কি দুঃখ!! নে টিস্যু নে, এল্লা কাইন্দা মুখ মুছ্।
খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো সবাই। হাসির দোটানা চলতেই পূর্বিকা আপু বলে উঠলেন,
– পূর্বের পূর্ববতীকে খুজতে খুজতে আমরা পাগল হয়ে যাচ্ছি। পূর্বের জন্য দাদাভাই এত্তোগুলা মেয়ের ছবি এনেছে ও কি করেছে জানো? মার্কার পেন দিয়ে সবগুলা ছবিকে বীভৎস চেহারা করে দিয়েছে।
তানিয়া চমকে উঠে বললো, ‘হায় খোদা? মেয়েদের ছবিতে চিত্রকর্ম? ওইযে আমরা বাচ্চাকালে আইনস্টাইনের ছবিকে মেয়েদের মতো টিপ লিপস্টিক লাগিয়ে দিতাম ওই আকিঝুকি ?’
– হ্যাঁ হ্যাঁ ওভাবেই। দাদু লজ্জায় আর ওই ছবিগুলো ফেরত পাঠাতে পারেনি। এইসব করেছে পূর্ব।
আমি পাশ থেকে ভিজা বিড়ালের মতো সব শুনেও চুপচাপ কথা গিলছি। পূর্ব ভাই ছয়নয় ঝামেলা যতোই করুক আমি উনার সামনে ভুলেও আর যাবো না। দ্যাটস ফাইনাল! সায়মা আপু অনেকক্ষন পর মুখ খুলে বললো,
– আমার মনে হয় পূর্ব কাউকে লাভ করে।
সায়মার কথা শেষ না হতেই মিথুন ভাই চেচিয়ে বলে উঠলো,
– ইম্পসিবল কথাবার্তা বলবিনা সায়মা। পূর্ব ভাই যদি লাভ করতোই তাহলে উনি এক্সকে ছাড়ার মতো মিস্টেক করতো না।
আমি ঢোক গিলছি উনাদের কথাবার্তা শুনে। ঘটনা যদি আরো তলিয়ে যায় ওয়াকিল ভাই আর সুহাস ভাই আনিশা আপুর ব্যাপারে সব জেনে যাবে। এটা এখনো উনাদের কাছে গোপন! এটা জানলেই দুই পরিবারে ঝড় উঠবে!! ঝড়!! সুহাস ভাই চাপাকন্ঠে একঘেয়েমি সুরে বলে উঠলেন,
– গাইজ? আমার প্রচুর বোর ফিল হচ্ছে। প্লিজ মন্ডলবাজারে চল!! স্পেশাল এক কাপ মালাই চা খেয়ে চাঙা হয়ে আসি।
সবাই মাটির রাস্তা ধরে মন্ডলবাজারের ভেতরে ঢুকে চা নাস্তা খেয়ে বাড়িতে চলে আসলাম। মা সবার সাথে শেষবারের মতো আড্ডা দিচ্ছেন। আবার কবে না কবে আসি!! বাবা বাইরে যেতেই বললেন,
– মা তুই রুমে যেয়ে একটু ঘুমিয়ে নে। কাল খুব ভোরে উঠতে হবে তো। রাত নাহয় জেগে জেগে সুহাসদের সাথে আড্ডায় কাটিয়ে দিস। কেমন?
আনিশা আপু গ্রামের সব রেওয়াজ এবং ঐতিহ্যবাহী নিয়ম পালন করে শ্বশুরবাড়ি চট্টগ্রামে চলে গিয়েছেন। আমি রুমে যেয়ে দরজা লাগিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছি। আচ্ছা পূর্ব ভাই একবার দেখা করে যাবেন না? কাল তো চলে যাচ্ছি কখনো দেখা হয় কিনা কে জানে? দেখা না হওয়ার চান্সই বেশি। চোখবন্ধ করে দুইহাত দুইপাশে ছড়িয়ে দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়লাম। চোখে এই বেটাইমে ঘুম আসার কোনো চান্স নেই। হঠাৎ মনে হলো কেউ আমার শরীরে কাথা দিয়ে দিয়েছে। আমি চোখ খুলতেই অবাক! পূর্ব ভাই উশকো খুশকো চুলে, ম্লান চেহারায়, ট্রাউজারের পকেটে হাত ঢুকিয়ে তাকিয়ে আছেন। আমি উঠে বসতেই বলে উঠলাম, আপনি এখানে? কখন এলেন?
উনি কোনো জবাব দিলেন না।ট্রাউজারের বাঁ পকেট থেকে হাত বের করে মুঠোয় রাখা ফোনে কিছু একটা দেখে সেটা পকেটে ঢুকিয়ে বলে উঠলেন, জানিনা।
আমি গায়ের উপর থেকে কাথা সরিয়ে নামতে যাবো উনি বাধা দিয়ে বললেন,
– শুয়ে থাকো। আমি চলে যাচ্ছি। বায়।
– না না কেনো যাবেন?
উনি আমার কথা না শুনার ভঙ্গিতে চলে যাচ্ছেন। আমি ঝটপট পা ফেলে উনার সামনে দাড়িয়ে দুহাত প্রসার করে আটকে বললাম,
– আমি কি যেতে বলেছি? যাচ্ছেন কেন?
উনি আমার পিছনে থাকা জানালা দিয়ে আকাশে চোখ রেখে নির্লিপ্ত গলায় বললেন,
– আমায় কখনো আসতে বলো নি। থাকার কোনো মানে হয়না।
কথাগুলো বিষযুক্ত ছুড়ির মতো কোথাও যেনো ক্ষত করলো। আমি দুইপাশ থেকে হাত নামিয়ে ফেলি। উনি এখনো আকাশ দেখতে স্থির। আমি মাথা নিচু করে স্তব্ধ কন্ঠে নিরবে বললাম,
– রেগে আছেন?
– আমায় তুমি নোংরা বলেছিলে। নোংরার মানেটা খুবই খারাপ ভাবে নিক্ষেপ করেছো আমার উপর।
মাথা তুলে উনার দিকে তাকাতেই দেখি উনি উপর ঠোট দিয়ে নিচের ঠোট চেপে অপলকে আকাশের শেষ বিকেলটা দেখছেন। গালের কোণায় বাচ্চাদের মতো টোল। হূমায়ুন আজাদ একবার বলেছিলেন,’ আমি হয়তো খুব ছোট্ট কিছুর জন্যে মারা যাবো! শিশুর গালের একটি টোলের জন্যে।’ উনি যদিও শিশু না কিন্তু আজ শিশুর মতোই অভিমান নিয়ে দাড়িয়ে আছেন সামনে। উনাকে নোংরা বলার অভিমানে আমার দিকে একটুও তাকাচ্ছেন না। উনার টোল দেখে তো সত্যিই মরে যাওয়ার উপক্রম!! চুলগুলোতে কদ্দিন ধরে চিরুনি লাগায়নি আল্লাহ্ জানে। মনে হচ্ছে চুল আরো বড় হয়েছে।আগে কপালের উপর ছেয়ে থাকতো এখন ভ্রুয়ের কাছে হাবুডুবু খায়। গাল আগে ক্লিন শেভড ছিলো এখন ছোট ছোট দাড়িতে এখন মুখ দু’দফা বেশি সুন্দর লাগে। তানিয়া দেখলে কি বলবে? ‘ ইয়া আল্লাহ্! পূর্ব ভাইয়া কি হট হয়েছে! পুরোই ফার্স্ট ক্লাস রসগোল্লা! খেয়ে খেলতে ইচ্ছে করছে!’ আমি কিছুকালব্যাপী নিশ্চুপ থেকে নিচু গলায় বলে উঠলাম,
– কাল চলে যাচ্ছি।
– আর দেখা হবে না। তুমি তো এখন খুশি। ভালো থাকো।
উনি আমাকে পাশ কাটিয়ে পকেটে হাত গুজে চলে যাচ্ছেন আবারো! আমি পেছন থেকে টিশার্ট টেনে বলে উঠি, ‘মিস করবেন না?’
উনি পকেট থেকে একহাত বের করে আমার হাত উনার পিঠের উপর থেকে ছাড়িয়ে নিলেন। তবুও মুখ ঘুরিয়ে আমার দিকে একবারো তাকালেন না। বকের মতো লম্বা পা গুলো দিয়ে চলে গেলেন বাইরে। উনি কি মিস করবেন না? হয়তো না। কেননা, মিস করার মতো আমি আদৌ কিছু করিনি। যদি করেও থাকি তা ছিলো নিজের ইচ্ছাবিরোধী। পূর্ব আমাকে শেষবারের মতোও কিছু বলে গেলেন না। উনার ভেতরে খুব বেশি অভিমান? অভিমানভরা বিষন্ন মুখটা নিয়ে কেনো একবার দেখলেন না? খারাপ লাগছে পূর্ব। কাল চলে যাচ্ছি তো।
-চলবে
(ডাটা প্যাক হুট করে শেষ হওয়াতে গল্প দিয়ে লেট হয়েছে। সরি!!)