#তোকে_ঘিরে ❤
#পর্ব_৬২.
#ফাবিয়াহ্_মমো
( অংশ – ০১.)
শান্ত স্নিগ্ধ ভেজা চোখদুটো অশ্রুপূর্ণে টলটল করে উঠলো। নিচের রক্তাক্ত ঠোঁটটা জোরে-জোরে কাঁপতে লাগলো। ঘন পাপড়ির সুন্দর চোখদুটো আচমকা বন্ধ করে কুচকে ফেললে ওমনেই গাল গড়িয়ে পানি পরলো ফ্লোরে। সাথে সাথে অশ্রুবিদ্ধ মুখখানা আড়াল করার জন্য পূর্ব মাথাটা নিচু করে ফেললো। পূর্ণতার পেটের উপর এখনো তার ক্ষতবীক্ষত হাত রাখা, যেটা থরথর করে আকস্মিক কান্নায় কাঁপছে। এ দৃশ্য দেখে চৌদ্দ শিকের বেড়িটা ভাঙতে ইচ্ছে করছিলো পূর্ণতার। আরো একবার পূর্ব প্রচণ্ড খুশিতে মনের যেখানে নরম মুখোশটা প্রকাশ করে ফেলেছে সেখানে গতবারের মতো আর জড়িয়ে ধরতে পারছেনা ও। নিজের ব্যর্থতায় কাতর হয়ে পূর্ণতা ঝাপসা চোখ মুছলো। লোহার চৌদ্দশিকের ফাঁক গলে পূর্বের এলোমেলো চুলের উপর হাত রাখলো। ওমনেই ছিটকে আসা কান্নায় পূর্ণতা হেচকির সুরে বললো,
– তোমাকে কি ওরা মেরে ফেলবে?
কন্ঠের মধ্যে থাকা তীব্র কষ্টটা যেনো পূর্বের বুকটা চিড়চিড় করে দিলো! কি করে বলবে রিমান্ডের নামে ওরা পূর্বের সাথে কি কি করছে! পূর্ব মাথা নিচু অবস্থায় খুব সাবধানে চোখ মুছে ওর দিকে তাকালো। ঢোক গিলে গলা ঠিক করে পূর্ণতার পেট থেকে হাত সরিয়ে ভেতরে আনলো। নিজেকে বহুকষ্টে সামলে নিয়ে জোরে নিশ্বাস ছাড়লেও চোখ ভরে আসছিলো ওর। তবুও ওই অবস্থায় ধাতস্থ কন্ঠে পূর্ব বললো,
– আমি চলে গেলে তো আর সমস্যা নেই পূর্ণ। ও তোমার সঙ্গে আছে। তুমি দয়াকরে ভুলেও আর এখানে এসো না। ওরা আমার সাথে যা করছে করুক, তোমার কিছু হলে আমি সত্যিই মরে যাবো, ওর কিছু হতে দিও না, আমার এই একটা ইচ্ছা তুমি যত্ন করে রেখে দিও। আমি আর কিছুই চাইনা। তুমি এসো না।
কথাগুলো বলতে বলতে পূর্ব ‘না’ সূচকে মাথা নাড়াতে থাকে। ওর চোখ থেকে বৃষ্টির মতো অশ্রু পরতে পরছিলো তখন। এভাবে কখনো পূর্বকে অশ্রুসিক্ত অবস্থায় বিধ্বস্ত দেখেনি পূর্ণতা। নিজেকে শক্ত করার মতো স্পৃহাটা যার কাছ থেকে পেতো আজ সে-ই যেনো দুইটুকরো হয়ে ভেঙ্গে পরেছে। এতোক্ষন যেই কঠোর মুখ ভঙ্গিতে মানুষটা ছিলো সেটা যেনো সন্তান আগমনের খুশিতে পাল্টে গিয়েছে। পূর্বের ওই অবস্থা দেখে পূর্ণতা ফোঁপানো অবস্থায় নিকাবের নিচটা ধরে টান মেরে খুলে। চোখের পলকে পূর্বের গালদুটো কাছে টেনে স্বল্প ফাঁকের মধ্যেই ওর রক্তাক্ত ক্ষতবীক্ষত ওষ্ঠজোড়া দখল করে। পূর্ব বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে থাকলেও পূর্ণতার সাথে এইটুকু সঙ্গ যেনো অনন্তকালের সুখ ছিলো। এতোদিনের সকল দুঃখ যেনো একটু একটু করে কেটে যাচ্ছিলো। পূর্ণতার স্পর্শে ব্যকুল হয়ে উঠা পূর্বের মনটা অনিমেষ শান্তিতে বিমুগ্ধ হচ্ছিলো। ক্ষতযুক্ত ঠোঁটে পূর্ব প্রচণ্ড যন্ত্রণা অনুভব করলেও হাতের মুঠো শক্ত করে খিচে থাকলো। অন্তত এইটুকু সুখের মূহুর্তে সে ব্যথাটুকু পাত্তা দিবেনা। আরেকটু ব্যথা সহ্য করলে সে মরে যাবেনা। পূর্ণতার জন্য যার সবকিছু হাজির, সেখানে এই যন্ত্রণার ক্লেশটা একফোঁটা তিল মাত্র। এদিকে জেলার আসতে নিলে পূর্ব আড়চোখে সেটা দেখতে পেয়ে তাড়াতাড়ি পূর্ণতাকে সরাতে চেষ্টা করলো। কিন্তু আজ যেনো নিজের শরীরের চেয়ে পূর্ণতার শক্তিটাই ঢের ছিলো। পূর্ণতার মুখ যদি জেলার দেখে ফেলে তাহলে বিপদের আশঙ্কা থাকতে পারে। পূর্ব নিরুপায় হয়ে দ্রুত পূর্ণতার মাথা থেকে নিকাবটা টেনে জেলার যেদিক দিয়ে আসছে সেদিকটার কাছে কাপড়টা ফেলে দেয়। পদধ্বনির আওয়াজটা তীব্র থেকে তীব্রতর হলে পূর্ণতা সৎবিৎ ফিরে পাওয়ার মতো পূর্বকে ছেড়ে দেয়। দ্রুত নিকাব ঠিক করে চোখ ফিরিয়ে বামে তাকিয়ে দেখে বাইরে চেয়ার-টেবিলে বসা যেই পুলিশকে দেখেছিলো তার সঙ্গে দুটো দারোগা জুটেছে। তারা একদৃষ্টিতে ওদের দিকে তাকিয়ে হো হো করে ব্যাঙ্গাত্মক সুরে হাসছে। পূর্ণতা গরম চোখে তাকিয়ে এরপর দৃষ্টি ফেরালো পূর্বের দিকে। ওমনেই পুলিশটা খোচা মেরে বললো,
– হুজুরনি আফা, এটা জেল। আপনাদের লুতুপুতু খানা না। একটু আগে যেইটা করছেন ওটা চিপাচাপায় করবেন। ভালো উপদেশ দিলাম। এখন বিদায় হন।
পূর্ণতা যেই পুলিশের উদ্দেশ্যে মুখ ঘুরিয়ে কিছু বলবে ওমনেই পূর্ব অস্ফুট শব্দে বলে উঠে,
– পূর্ণ না, চুপ…
পূর্ণতা নিকাবের আড়ালে নাক ফুলিয়ে তপ্তকর নিশ্বাস ছাড়লো। পূর্বের আদেশসূচক বার্তা শুনে আর কিছুই বললো না। অন্যদিকে সাগ্রত গোপন তথ্য জোগার করার জন্য ‘ আসছি ‘ বলে একটু ভেতরে চলে গেলে, আয়মান চুপচাপ পূর্ণতার কাছে ফিরে আসে। এসেই দেখে জেলার পূর্ণতাকে এক্ষুনি উঠার জন্য জোর তাগাদা দিচ্ছে। আরেকটু হলে যেনো পুলিশ পূর্ণতার গায়ে হাত দিয়ে জোরপূর্বক তুলবে! আয়মান দ্রুতবেগে পূর্ণতার কাছে এসে ফ্লোরে ঝুঁকে ওর হাত ধরলো। নিচু কন্ঠে বললো,
– চল পূর্ণতা। পুলিশ বেটায় যথেষ্ট টাইম দিছে। তেড়িবেড়ি করিস না। তুই কিছু করলে পূর্ব ভাইরে ছাড়বো না। উঠ রে বইন, আর ঝামেলা বাড়াইস না।
পূর্বের দিকে স্থিরদৃষ্টি রেখে পূর্ণতা আয়মানের হাত ধরে উঠে দাড়ালো। এদিকে সাগ্রত এখনো আসলোনা। পুলিশগুলো আরো কিছু বলার জন্য উদ্যত হলে তাদের থামিয়ে দিয়ে পূর্ব শান্ত কন্ঠে বলে,
– মেয়েদের সাথে সভ্য আচরণ করুন। যা করার আমার সাথেই করবেন। ওদের কাউকে কিছু বলার দরকার নেই।
পুলিশ চোখ মুখ রাঙিয়ে পূর্বের দিকে তাকিয়ে থাকলে পূর্ব সেখান থেকে দৃষ্টি সরিয়ে পূর্ণতার দিকে তাকায়। শুষ্ক মরুভূমিতে এক পশলা বৃষ্টির মতো হাসে পূর্ব।বিদায় মূহুর্ত এসে গেছে জেনেও পূর্ণতার ইচ্ছা করছিলো না এখান থেকে যেতে। পূর্ণতা বিহ্বল হয়ে পরতে নিলে অতি দ্রুত আয়মান ওকে ধরে সেখান থেকে নিয়ে যায়। চোখের পানিতে ভিজে উঠা নিকাব আবারও অশ্রুধারায় চুপচুপে হয়ে যায়। পূর্ণতাকে গাড়িতে বসিয়ে সাগ্রতকে কল করে আয়মান। কলটা কেটে দেয়ার একমিনিটের মাথায় সাগ্রত জেল থেকে বেরিয়ে এসে গাড়িতে চড়ে বসে। পুরো রাস্তায় পূর্ণতা হু হু করে কেদেঁ দিয়ে ওয়াসিফ ভিলায় পৌঁছে। আয়মান কিছুক্ষণ পূর্ণতাকে সান্ত্বনা দিয়ে চুপ করিয়ে বাসায় ফিরে। সাগ্রত থম মেরে সোফায় বসে থাকে। কিছুক্ষণ নিজের চিন্তায় ডুবে থেকে পূর্ণতার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। পূর্ণতা তার ঠিক সামনের সোফায় মাথা নিচু করে বসে আছে। আয়েশা মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। সাগ্রত একটু হালকা কেশে গলা পরিস্কার করে বললো,
– আমার কাছে ঘটনাটা খুবই জটিল লেগেছে। একে তো রিমান্ডের ঘটনার সাথে কিছু বিষয়বস্তুর তেমন মিল পেলাম না। তবে পূর্ণতা, এখানে কিছু একটা রহস্য আছে।
সাগ্রত তার কথা শেষ করে অন্যমনষ্ক হলে আয়েশা ও পূর্ণতা দুজনই বিষ্ময়সূচকে চোখ তুলে তাকায়। পূর্ণতা চোখ মুছে নাক টেনে কৌতুহল গলায় জিজ্ঞেস করে,
– আপনার কথার মানে বুঝিনি। কি বলতে চাইছেন ভাইয়া? আমরা সবাই জানি সবুজ নয়তো কৈলেশ পূর্বের শত্রুর সাথে হাত মিলিয়ে ক্ষতিটা করেছে। আর এজন্যই ওরা গুম। মানে কাজ সেরেই পালিয়েছে। এখানে রহস্যের কি আছে?
পূর্ণতার প্রশ্নাত্মক কথাগুলো শুনে সাগ্রত মৃদ্যু ভঙ্গিতে হেসে দেয়। এটা দেখে পূর্ণতার কুঁচকানো ভ্রুঁ আরো খানিকটা কুঁচকে যায়। সাগ্রত টেবিলের উপর থেকে ধোয়া উঠা কফির মগটা তুলে সরল গলায় বলে উঠে,
– গতবার যা ভেবেছিলাম এবার তার ঠিক উল্টোটা পেয়েছি। আমরা চোখে যা দেখছি সেগুলো কেউ ইচ্ছে করে আমাদের দেখাচ্ছে।প্রথমত, পূর্বের বিশ্বস্ত সহযোগী ছিলো কৈলেশ, সবুজ, সাব্বির, ওমর ও বিজয়। আর পার্সনাল গাড়ির ড্রাইভার ছিলো মোমিন। মোমিন এখনো ড্রাইভার রূপেই এ বাড়িতে আছে। কিন্তু পূর্ব যাদের কাছে তোমার নিরাপত্তার জন্য সবচেয়ে বড় দায়িত্বটি দিয়েছিলো তারাই এখন গুম।
সাগ্রতের কথা শুনে মাথার ভেতর ছোটখাট জট লেগে যায় পূর্ণতার। এখানে এতোগুলো নাম কেনো আসছে এখন? গতবার শুধু তিনজন ছিলো আর এখন এতোগুলো নাম হলো? পূর্ণতা কিছুই ভাবতে পারছিলোনা। এলোমেলো চিন্তায় সে আবারও সাগ্রতকে প্রশ্ন করলো,
– এখানে মূল ব্যক্তি হলো দুজন। কৈলেশ আর সবুজ। সাব্বির আপাতত পূর্বের নির্দেশে হয়তো কোথাও চলে গেছে। কিন্তু এখানে এমন প্যাঁচটার মানে কি? আর মোমিনও যে করবেনা, তা তো জানা কথা। কারন ও বাড়িতেই। পালায়নি।
সাগ্রত কফিতে ছোট্ট চুমুক দিয়ে গলায় ঢোক ফেলে গাঢ় কন্ঠে বললো,
– এখানে বাইরের মানুষ জড়িত আছে। আচ্ছা, পূর্ব কি কখনো এমন কোনো ব্যক্তির নাম বলতো যাকে ও সহ্য করতে পারতো না?ছিলো কেউ?
পূর্ণতা একটু ভেবেচিন্তে হঠাৎ কিছু মনে পড়ার ভঙ্গিতে বললো,
– হ্যাঁ, আছে। চ্যার্টাজী নামের একটা লোক। লোকটা বামপন্থী করে শুনেছিলাম। আর লোকটা খুবই খারাপ। পূর্ব কখনোই ওই লোকটাকে সহ্য করতে পারতো না।
– কি একটা অবস্থা! কমিউনিজম করা পার্টিগুলার মধ্যেও এমন দু/একটা কিট পতঙ্গ ঢুকে আছে। মার্কসের আর্দশগুলো এদের মতো নিচুশ্রেণীর মানুষের জন্য দিনদিন ধ্বংস হচ্ছে। আচ্ছা বাদ দাও। চ্যার্টাজীর খবর বের করছি। চিন্তা করো না। আর সবচেয়ে বড় কথা নিজের হেল্থের দিকে ধ্যান দাও। আমি আজ আসি। কিছুদিন ব্যস্ত থাকবো হয়তো। কিন্তু যেকোনো প্রয়োজনে তুমি আমাকে কল দিবে। ঠিক আছে? আসি তাহলে।
পূর্ণতা মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ সূচকে সম্মতি জানালে সাগ্রত বিদায় জানিয়ে চলে গেলো। দিনটা আর ভালো কাটলো না। চোখের সামনে পূর্বের আহত অবস্থাটা ভাসছিলো। ঠোঁট কাটা, সমস্ত শরীর জুড়ে কালচে ছাপ, চুল এলোমেলো, হাতের তালু ক্ষতবীক্ষত। তবুও রুক্ষ চেহারায় একটুকরো আলোর দেখা দিয়ে পূর্ব হেসেছিলো।
.
পূর্ণতা চলে যাওয়ার পর পূর্বের উপর নির্মম আচরণ শুরু হলো! পুলিশকে মুখের উপর ওইটুকু বলাতে আজ তার শরীরে আবারও রোলারের আঘাত পরলো! দুইহাত দুইদিকে বেধে কয়েক ঘন্টা পিটিয়েছে তারা। গতবারের চেয়ে এবারের ডোজটা বেশি ছিলো যেনো। পূর্ব ব্যথা সহ্য করতে না পেরে বেঁহুশ হয়ে যায়। নাক-মুখ দিয়ে তরল রক্ত বেরিয়ে গলগল করে পরতে থাকে। তারা পিটিয়ে যখন হাপিয়ে উঠে তখন ওর হাতের বাধন খুলে ফ্লোরে ফেলে দেয়। অবচেতন পূর্ব যখন ব্যথায় নিষ্প্রভ হয়ে যায় তখন ওরা আর ভুলেও ওর কাছে দেখতে আসেনা। পুরোটা রাত পূর্ব জ্ঞানহীন ছিলো। সকালের দিকে যখন আধো আধো চোখে ঝাপসা দৃষ্টি মেললো তখন কানে কিছু মানুষের আলাপালোচনা শোনা গেলো। তারা হেসে হেসে পূর্বের ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলছে। সঙ্গে সেই পুলিশের কন্ঠ এবং জেলারের গলাও শোনা যাচ্ছিলো। পূর্ব স্পষ্ট চোখে কিছু দেখতে না পেলেও কানে যতদূর শুনছিলো তাতে এটুকু বুঝে যায়, এখানে জেলার ও পুলিশ-সহ আরো তিনজন ব্যক্তি যুক্ত। সেই তিনজন ব্যক্তির হাস্যোজ্জ্বল গলা শুনে বুকের ভেতরটা ছিড়ে আসছিলো ওর। কি পাপ করলো ওদের সাথে? কেনো এতো বড় ক্ষতি করলো? পূর্ব অসাড় শরীরে চোখ বন্ধ করে পরে থাকলেও চোখের কোল থেকে অবিরামভাবে পানি পরছিলো। জীবনে ব্যর্থতা সহ্য করা যায় কিন্তু প্রতারণার আঘাত না। নিজের আর্দশ নীতিতত্ত্বে যারা অটল থাকার ওয়াদা করেছিলো তারা এমন ধোকা দিলো, পূর্বের অশ্রুগুলো যেনো সেই কষ্টের সাক্ষী ছিলো।
জীবনটা যখন বিষের মতো বিষাক্ত হয়ে উঠছিলো তখন আয়মান নিজেই যেনো সবকিছু উলোটপালোট করে ফেলছিলো। কখন খাওয়া, কখন নাওয়া, কখন ঘুম, কখন যাওয়া – এসবই যেনো বিশৃঙ্খলায় চলতে লাগলো। সাবিহা আগ বারিয়ে কিছুদিন ওর যত্ন নেওয়া বন্ধ রাখলো। বাড়ির টুকটাক কাজ ও রান্নার দিকটা আফিয়ার অনুমতিতে সাবিহাই সামলাতো। কাজেই আয়মানের রুমে সে একপ্রকার যাওয়া বন্ধ করে দিলো। আয়মান রাত এগারোটার দিকে স্যূট খুলতে খুলতে নিজের রুমে চলে যায়। ক্লান্ত মুখটা দূর থেকে দেখতে পেয়ে সাবিহা অনেকক্ষন পর বাধ্য হয়ে আজ আয়মানের রুমের কাছে আসলো। কি মনে করে যেনো বারান্দার দিকে তাকালো ওমনেই সাবিহা শিউরে উঠে দৌড় দিয়ে বারান্দার দিকে চলে যায়!আয়মান রেলিংয়ে উপর বসে পা বাইরে ঝুলিয়ে বসে আছে! বারান্দাটা আদি যুগের মতো গ্রিল ছাড়া এবং রেলিংয়ের দেয়ালটা সুন্দর করে কারুনৈপুণ্যে বাধাই করা। সাবিহা দ্রুত আয়মানের পাশে দাড়িয়ে ওর বাহুটা পেঁচিয়ে অস্থির কন্ঠে বললো,
– আপনি পরে যাবেন প্লিজ নামুন! এভাবে পাগলামি করবেন না! অঘটন ঘটতে সময় নেই!!
আয়মানের চক্ষুদৃষ্টি দোতলার উপর থেকে নিচের দিকে থমকে আছে। বাতাসও শো শো করে সাবিহার রেশমী কেশ উড়িয়ে দিচ্ছে। কিন্তু মনের উপর আক্ষেপটা হঠাৎ করে উদয় হতেই আয়মান অদ্ভুত কন্ঠে ওই অবস্থায় বলে উঠলো,
– এখান থেকে ঝাপ দিলেও পারতো, হাত কেন কাটতে গেলো? ওর হাতে কি ব্যথা হয়নাই? আমার একটু খানি কাটলেই তো কি পরিমাণ জ্বলে। ওর কি কবজিটা আগুনের মতো জ্বলেনাই? কেন ওইদিন মরতে গেলো? আমার চিন্তাও কেউ করলো না? কে আমার জন্য ভাবলো? মা-ও আমার জীবনে বোঝা চাপিয়ে দিলো। প্রত্যেকটা দিন আমার কাছে একেকটার যুগের মতো যন্ত্রণা লাগে। আহা দুনিয়ার মানুষ রে… আমাকে একটা বার বুঝতি? আমারও তো বুকটা ফাটে।
সুরের মধ্যে কান্না, কন্ঠের মধ্যে যন্ত্রণার প্রকাশ ছিলো। আয়মান চোখ ভিজিয়ে স্থিরদৃষ্টিতে রাতের অন্ধকার আকাশে তাকিয়েছিলো। পাশে চুপ করে দাড়িয়ে থাকা সাবিহার দৃষ্টি এই অশ্রাব্য ভাষার লোকটার দিকে আবদ্ধ ছিলো। লোকটার ডানপাশটা কেবল দেখতে পাচ্ছিলো সাবিহা। সংক্রামনের মতো সাবিহার মধ্যেও যন্ত্রণার রেশটা ঢুকে গেলো। সাবিহা দাঁত শক্ত করে নিশ্বাস আটকে কান্না সংবরন করছিলো ঠিকই, কিন্তু চোখের ভেতর বড় বড় বৃষ্টিফোঁটা জমেছিল। কানে শুধু বারবার বাজছিলো ‘ আমারও তো বুকটা ফাটে ‘। কয়েক মূহুর্ত যেনো বাতাসের শো শো ধ্বনিটা চললো, এরপর ঝড়ের মতো তুমুল বাতাসে সাবিহা দম ছেড়ে আয়মানের ডানকাধে কপাল ঠেকিয়ে কেদেঁ উঠলো। হাতদুটো আয়মানের ডানবাহুটা পেঁচিয়ে আঙ্গুলের চাপে খামচে ধরা। আয়মানের দৃষ্টি তখনও তারা-নক্ষত্রের ঝিকিমিকি আকাশে নিবদ্ধ। সাবিহা কান্না জড়িত কন্ঠে বললো,
– শ্রেয়াকে কেনো এখনো মনে করতে যান? উনি কি আপনার কথা কখনো চিন্তা করেছে? আপনাকে কখনো ভালোবাসি বলেছে? কেনো উনার জন্য আপনি প্রতিটা দিন কষ্ট পান? উনি তো চলেই গেছে। যদি আপনার কথা চিন্তা করতো, তাহলে ওইভাবে নিজেকে হত্যা করতো না। উনি তো আর ফিরবে না। উনি তো আজীবনের জন্য চলে গেছে। আপনাকে একা করে দিয়েই উনি বিদায় নিয়েছেন। আপনার কথা উনি চিন্তা করেনি।
রাতের ঝিকিমিকি তারাগুলো দেখতে যেয়ে চোখের উপর সব ঝাপসা হয়ে এলো আয়মানের। ফিসফিসিয়ে মৃদ্যু শব্দে কেদেঁ দিয়ে অনেকটা জোর গলায় বললো,
– সবাই তো স্বার্থপর। সবাই আমাকে দোষী বানিয়ে দিছে গেছে। আমি যেন নিজেরে মাফ না করতে পারি ওমন আকামই সবাই করছে। শ্রেয়া পারলে আমার সাথে আরেকবার যোগাযোগ করতো, খালি আরেকটা বার! ও করেনাই। মা আমাকে আরেকটা বার বুঝতো! মা-ও বুঝেনাই! তুমি হুটহাট আমার বাড়িতে বউ হয়ে আসলা কিন্তু মানুষের কাছে আমাকে অপরাধী বানিয়ে দিছো। কি দোষ আমার? আমি তো কাউকে বিয়ে করে কষ্ট দিতে চাইনি। তাও কেন এই অবস্থাটা হলো?
সাবিহা হাত আলগা করে বাহু ছেড়ে দিয়ে আয়মানের মুখ ধরে নিজের দিকে ডানে ফেরালো। আয়মানের সিক্ত বিষন্ন দৃষ্টির পানে চোখ রেখে সাবিহা ঢোক গিলে বললো,
– আমি তো আপনাকে অপরাধী বানিইনি। কে বলেছে এমন কথা? মা বলেছে? আপনি উনার কথায় কেনো কষ্ট পাবেন বলুনতো? মা কি আপনার সুখ দেখার অধিকার রাখেন না?
আয়মান স্থির দৃষ্টিতে কোনো শব্দ উচ্চারণ না করে মাথা নাড়িয়ে ‘হ্যাঁ’ বোধক বোঝালো। সাবিহা গাল থেকে হাত সরিয়ে আসমানী রঙের সুতির শাড়িটার আচঁল খানিকটা সামনে টানলো। আঁচলটা হাতে নিয়ে আয়মানের চোখ ও গাল মুছে দিয়ে নাক টানতেই বললো,
– শ্রেয়া আপুর জন্য দুঃখ পেতে থাকলে আপনার সুন্দর জীবনটা ভালো ভাবে কাটাতে পারবেন না। একবার ভাবুন? আজ যদি আপু বেঁচে থাকতো তাহলে আপনার কান্না কি দেখতে পারতো?
আয়মান সম্মোহন দৃষ্টিতে মাথা নাড়িয়ে ‘না’ জানায়। সাবিহা হাত ধরে ওকে ভেতরে টেনে আনলে আয়মান বাইরে থেকে পা দুটো ভেতরে ফেলে। সাবিহা আবার শান্ত কন্ঠে বলে উঠে,
– শ্রেয়া আপু পরেও কখনো ভালোবাসতো কিনা এটার কোনো গ্যারান্টি ছিলো?
আয়মান ফ্লোরে পা ফেলে মাথা নাড়িয়ে দ্বিতীয় দফায় ‘না’ জানায়। সাবিহা ওকে দাড় করিয়ে রুমের ভেতরে নিয়ে যেতেই বলে উঠে,
– আপু যদি আপনাকে রিজেক্ট করতো তাহলে আপনি দেবদাস হয়ে থাকতেন? বিয়ে কি পরে করতেন না? মায়ের জন্য হলেও তো করতেন ঠিকনা?
আয়মান চুপচাপ ভঙ্গিতে মাথাটা উপর-নিচ নাড়াতেই সাবিহাকে ওকে বিছানায় শুইয়ে দেয়। ঠান্ডাটা নিবারনের জন্য পায়ের কাছে ভাঁজ করা কম্বলটা খুলে আয়মানের গা ঢেকে দিতেই সাবিহা ওর পাশে বসে। নরম সুরে বলে উঠে,
– পাশের রুমটায় আছি। দরকার পরলে ডেকে দিবেন। কখনো বারান্দায় গিয়ে ওরকম কাজ করবেন না। আপনাকে জন্ম দিতে মা যেই কষ্ট করেছে সেই কষ্টের কাছে আপনার এই কষ্টগুলো কিছুই না। অন্তত মায়ের জন্য ভাববেন।
সাবিহার কথা শুনে চুপ করে রইলো আয়মান। কিছুই বললো না এর বিপরীতে। বিছানা ছেড়ে সাবিহা যেই উঠতে নিবে ওমনেই সে পুনরায় বসে পরলো। আয়মানের দিকে মুখ ফিরিয়ে দেখলো ও এখনো ড্যাবড্যাবে তাকিয়ে আছে। সাবিহা মিচকি হাসি দিয়ে হুট করে আয়মানের গালে চুমু দিয়ে ওমনেই উঠে চলে যায়। আচমকা এমন কাজে হতভম্ব হয়ে যায় আয়মান। গালে হাত দিয়ে চোখ বড় করে অবাক কন্ঠে বলে উঠে,
– কি করলে তুমি !
.
দেয়ালের দিকে চিন্তিত মুখে তাকিয়ে আছে সাগ্রত। সাদা দেয়ালটার সর্বত্র জুড়ে ছোট ছোট নোটচিট লাগানো। পূর্বকে কেন্দ্র করে যতো মানুষ ছিলো সবার নাম ওই নোটচিটের ওপর স্থান নিয়েছে। প্রায় চার ঘন্টা যাবৎ একাধারে দাড়িয়ে থেকে ভাবনায় ডুবে আছে। পূর্বকে দ্রুত রেহাইয়ের জন্য যেটা বিশেষ প্রয়োজন সেটা হলো সলিড প্রমাণ-সহ সাক্ষী। নয়তো যে এই ঘটনার পেছনে মূলহোতা তার কাছে সোজাসুজি আলাপ করতে হবে। এই মূলহোতাটা কি চ্যাটার্জী? নাকি পূর্বের দলের কোনো নেতা? নাকি অন্যকেউ? এখানে পলিটিক্যাল পাওয়ারে টর্চার চলছে সেটা সাগ্রত ইতিমধ্যে বুঝে গিয়েছে। কিন্তু জেলার বা পুলিশ কেউ মুখ খুলতে চাইছেনা। ভালোই বন্দোবস্ত করে পূর্বকে ফাসানো হয়েছে, কিন্তু আসল ব্যক্তিটা কে সেটাই ধরা যাচ্ছেনা। হঠাৎ নিবরতার জালে ছিদ্র করে সাগ্রতের ফোনটা বাজতে লাগলো। দেয়ালের দিকে স্থির দৃষ্টি রেখে সে পকেট থেকে ফোনটা নিয়ে রিসিভ করলো। কথা শুরু যেই করবে ওমনেই বিপরীত দিকের বার্তা শুনে সাগ্রতের স্বাভাবিক মুখটা অস্বাভাবিক হয়ে কপালে ভাঁজ পরলো। সাগ্রত আশ্চর্য হয়ে চেঁচিয়ে উঠতেই টেবিলে এক ঘুষি মেরে বললো,
– ওরা আবার মারার প্ল্যান করেছে কেন? রিমান্ডের ডেট তো কবেই শেষ। আদালত তো..
কথা শেষ না করতেই ওপাশ থেকে যে কথাগুলো শুনলো সাগ্রত এক হুঙ্কার মেরে ফোন কেটে দিলো। তাড়াতাড়ি দৌড়ে বেরিয়ে যেতেই দরজার কাছে টেবিলের উপর থেকে রিভলবার নিয়ে বেরিয়ে গেলো! অস্থির হয়ে উঠা সাগ্রত, অকল্পনীয় অবস্থার কথা চিন্তা করে ভয়ংকর উৎকন্ঠায় ছটফট করে উঠলো…
– ‘ চলবে ‘
#FABIYAH_MOMO
( নোটবার্তা : আরেকটু চলবে। এরপর ‘ অন্তিম ‘ লেখাটায় যাত্রা শেষ করবে। ধৈর্য্য রাখুন ততোদিন। ভালো কিছু দেয়ার পরিকল্পনায় আছি, ইনশাআল্লাহ ভালো কিছু দেয়ার চেষ্টা চলবে। ভালোবাসা ❤ )