তুমি ছিলে বলেই পর্ব ২

0
264

#তুমি_ছিলে_বলেই
#পর্বঃ২
#দিশা_মনি

স্নেহা দীপ্রদের বাসার মধ্যে এককোণে দাঁড়িয়ে ছিল৷ তখন ওতো বাজে ভাবে অপমানিত হবার পর সে নিজেকে একদম গুটিয়ে নিয়েছে। এখন সে অপেক্ষায় আছে যত দ্রুত সম্ভব এখান থেকে বেরিয়ে যাবার জন্য।

স্নেহা ভাবল দীপ্র নিপুণকে রিং পড়িয়ে দেবার পরই সে চলে যাবে। সেই ভেবেই দাঁড়িয়ে রইল সে। সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল এমন সময় দিলারা খাতুন তার সম্মুখে এলো৷ তার দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,
“এই মেয়ে তোমার মধ্যে কি কোন লজ্জা নেই? এত অপমানিত হবার পরেও তুমি এখানে পড়ে আছ কেন?”

স্নেহা লজ্জা পেল খুব। উত্তরে কি বলবে ভেবে পেল না৷ দিশা পাশ থেকে বলে উঠল,
“নিশ্চয়ই গান্ডেপিন্ডে গেলার জন্য পড়ে আছে। বাড়িতে তো ভালোমন্দ খেতেই পায় না।”

স্নেহা এবার আর সহ্য করতে পারল না৷ এতক্ষণ নিজের বাবার কথা ভেবেই চুপ ছিল সে৷ কারণ তার বাবা তাকে বলেছিল কারো সাথে কোন খারাপ ব্যবহার না করতে। কিন্তু এবার তার সহ্যের সীমা পেরিয়ে গেছে৷ স্নেহা দিশার মুখের উপর বলে দিলো,
“আমি এখানে খেতে আসিনি। তুমি ভুল ভাবছ দিশা আপু৷ আমাদের বাড়িতে না অনেক ভালো ভালো রান্না হয়। আমার আব্বু বাজার করে আর আমি নিজের হাতে সেসব খাবার রান্না করি। একদিন এসে খেয়ে দেখো।”

দিশা উপহাস করে বলল,
“তোদের বাড়িতে খেতে হবে এত দূর্ভাগ্য আমার আসে নি।”

“ভাগ্য বদলাতে কিন্তু সময় লাগে না৷ তোমরা যেমন আঙুল ফুলে কলা গাছ হয়েছ তেমনি কিন্তু আল্লাহ চাইলে এক পলকে আবার রাস্তায় এসে নামতে পারো।”

“স্নেহা!!”

দিলারা খাতুন ধমকে উঠলেন। স্নেহাও দমে না গিয়ে বলল,
“আমাকে ধমকাবেন না চাচি৷ আমি ভুল কিছু বলিনি সেটা আপনিও জানেন। আপনারাও তো আগে গ্রামে আমাদের মতো সাধারণ জীবনযাপন করতেন। তারপর হঠাৎ করে চাচা লটারি পাওয়ায় আজ আপনাদের ভাগ্য ঘুরে গেল। শহরে এসে ব্যবসা করে আজ আপনারা এত বড়লোক। শহরের চাকচিক্য বোধহয় আপনাদের নিজেদের শিকড় ভুলিয়ে দিয়েছে৷ তাই আমি মনে করিয়ে দিলাম।”

“তুমি এক্ষুনি বেরিয়ে যাও আমাদের বাসা থেকে। আর কক্ষনো এখানে এসো না।”

দিলারা খাতুনর এমন কথায় স্নেহা আর এক মুহুর্ত দাঁড়ালো না। তবে যাওয়ার আগে দিলারা খাতুনকে বলে গেল,
“আমি আজ এখান থেকে বেরিয়ে যাচ্ছি। আর কখনো আসব না। কথা দিলাম। আপনারা চাইলেও আর আসবো না।”

দ্রুত তাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে স্নেহা কাঁদতে থাকে৷ তার পুরো ২০ বছরের জীবনে এমনভাবে কখনো অপমানিত হয়নি সে। স্নেহার এই কান্নায় লুকিয়ে থাকা কষ্টগুলো আজ তাকে বুঝিয়ে দিলো অর্থ,সম্পদ মানুষকে কিভাবে বদলে দেয়। কিভাবে রক্তের সম্পর্ক হেরে যায় তথাকথিত স্ট্যাটাসের কাছে!

★★★
দীপ্রর সাথে নিপুণের এনগেজমেন্ট হয়ে গেছে। অতঃপর নিপুণ ও দীপ্র একসাথে আলাদাভাবে সময় অতিবাহিত করছিল। দুজনে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে ছিল। দীপ্র নিপুণকে নানারকম কথা বলছিল কিন্তু নিপুণ শুধু হা হু করছিল। দীপ্র বিরক্ত হয়ে বলে ওঠে,
“তুমি আমার কথার গুরুত্ব দিচ্ছ না কেন নিপু?”

“আজ তোমাকে আমার ভীষণ বিরক্ত লাগছে!”

“তোমার কথার মানে কি?”

“তোমার এইরকম ব্যবহার দেখতে হবে সেটা ভাবিনি।”

দীপ্র এগিয়ে এসে নিপুণের হাতটা শক্ত করে ধরে বলে,
“এসব কথা না বললেই নয়৷ তুমি কেন ব্যাপারটা ভুলতে পারছ না?”

“কিভাবে ভুলব বলো? নিজের ভালোবাসার মানুষের এই রূপ তো আমার কাছে অচেনা। তুমি একটু রাগী, জেদি সেটা আমি জানি। তাই বলে তুমি একজনের সাথে এতটা খারাপ ব্যবহার করবে?”

“তুমি ঐ স্নেহার ব্যাপারে কিছু জানো না তাই এভাবে বলছ।”

“আমার কেন ওর ব্যাপারে জানতে হবে দীপ? আমার তো নিজের জীবনসঙ্গীর ব্যাপারে জানতে হবে। নিজের জীবনসঙ্গী হিসেবে আমি একজন ভালো মানুষকে দেখতে চাই। যে ইহকাল এবং পরকাল উভয় স্থানে আমার সঙ্গী হবে।”

“আমি তোমার যোগ্য জীবনসঙ্গী হবো নিপু। কথা দিলাম। আমি জানি আমার মধ্যে কিছু ভুল ত্রুটি আছে। কিন্তু তুমি তো আছ আমাকে ঠিক পথ দেখানোর জন্য। কি বলো তুমি আমাকে নিজের মতো করে গড়ে তুলতে পারবে না?”

নিপুণের গোমড়া মুখে এতক্ষণে হাসির দেখা মেলে। সে দীপ্রর চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,
“কেউ কাউকে গড়ে তুলতে পারে না দীপ৷ কোন মানুষই পার্ফেক্ট নয়৷ মানুষের মধ্যে কিছু দোষ থাকবে এটা স্বাভাবিক। তবে আমাদের উচিৎ যথাসম্ভব ভালো মানুষ হওয়ার চেষ্টা করা। আমি যেহেতু তোমার জীবনসঙ্গী হতে চলেছি তাই অবশ্যই আমি তোমার পথপ্রদর্শক হবো। তোমাকে জীবনের সঠিক পথ দেখাবো৷ তবে সেই পথে কিন্তু তোমার নিজেকেই চলতে হবে।”

“আমি চেষ্টা করব।”

★★★
সন্ধ্যা নামার একটু আগে স্নেহা এসে পৌঁছায় তাদের গ্রামে। রাজশাহী শহরের বাঘা উপজেলার ছোট্ট একটি গ্রাম কুসুমপুর। সেখানেই স্নেহার পৈত্রিক আবাস। দীপ্ররা অবশ্য এখন রাজশাহী শহরে স্থায়ী হয়েছে। সেখানে দীপ্রর বাবা আজিজ চৌধুরীর বড় একটি শপিংমল রয়েছে। যার দরুণ আজ তারা এত ধনী হতে পেরেছে৷ অন্যদিকে, স্নেহার বাবা আহমদ আব্বাস খান শিকড়ের টানে গ্রামেই রয়ে গেছেন। গ্রামে কৃষিকাজ করেন এছাড়া তাদের একটি গরুর খামার আছে। সেখান থেকে যা রোজকার হয় তাতে তাদের বাবা-মেয়ের ভালোই চলে যায়৷ স্নেহার মা বছর দুয়েক আগে হঠাৎ করে স্টোক করে মারা যান৷ তারপর থেকে নিজের বাবার সাথে একাই থাকে স্নেহা।

স্নেহা যখন বাড়িতে গিয়ে পৌঁছালো তখন ঘড়ির কাঁ/টায় ৭ টা বাজে৷ স্নেহা বাড়িতে ঢোকামাত্রই দেখতে পায় তার বাবা আব্বাস খান চেয়ারে বসে টিভিতে নিউজ দেখছেন। স্নেহা পিছন থেকে নিজের বাবাকে জড়িয়ে ধরে। আব্বাস খান মৃদু হেসে বলেন,
“তুই এসেছিস মা? আমি তো ভাবলাম তোর চাচা আজ তোকে আসতেই দেবেন না।”

স্নেহার মুখে হঠাৎ আঁধার নেমে এলো। আব্বাস খান একদম মাটির মানুষ। তিনি এতটাই সহজ সরল যে তার যেই ভাই বছরে একবার তাদের খোঁজ নেয় না তার কাছ থেকে বেশি কিছু আশা করে ফেলছে। স্নেহার এখন আর বুঝতে বাকি নেই নেহাতই দায়িত্বের খাতিরে তাদের এনগেজমেন্টে দাওয়াত দিয়েছিল ওরা।

স্নেহা যখন প্রতিত্তোরে কিছু বলল না তখন আব্বাস খান পিছন ফিরে নিজের মেয়ের দিকে তাকালেন। স্নেহার মলিন মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“কিরে তোর মুখ এমন শুকনো লাগছে কেন? কিছু খাস নি নাকি?”

স্নেহার ইচ্ছা করলো তার বাবাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে৷ বাবার বুকে লুটিয়ে পড়ে সব কথা তাকে জানাতে৷ কিন্তু স্নেহা নিজের সেই ইচ্ছাকে দমিয়ে রাখল৷ এমনিতেই আব্বাস খান একজন হার্টের পেশেন্ট। একবার হার্ট এট্যাক হয়েছে ওনার৷ ডাক্তার ওনাকে কোন স্ট্রেস নিতে মানা করেছেন। স্নেহাকেও সতর্ক করে দিয়েছেন যেন উনি এমন কোন কথা জানতে না পারেন যা ওনাকে আঘাত দেবে৷ তাই স্নেহা নিজের বাবার কাছ থেকে লুকিয়ে গেল সমস্ত কথা। মুখে মেকি হাসি ফুটিয়ে বলল,
“খাবো না কেন? খেয়েছি তো। অনেক কিছুই খেয়েছি। এত খেয়েছি আমার পেটে তো আর যায়গাই নেই৷ চাচা নিজে দায়িত্ব নিয়ে আমাকে খাইয়েছে। আচ্ছা, আমি অনেক ক্লান্ত। তুমি থাকো। আমি নিজের ঘরে যাচ্ছি। কাল আবার সকাল সকাল ভার্সিটি যেতে হবে।”

আব্বাস খান ভাবুক স্বরে বললেন,
“ভার্সিটি বলতে মনে পড়ল, তুই আর কতদিন এখান থেকে শহরে যাতায়াত করবি বল তো? সামনে নাকি তোর এক্সাম। তোকে না বলেছিলাম তোর চাচার সাথে কথা বলতে যে পরীক্ষার ক’দিন যদি ওখানে থেকে….”

“তার কোন দরকার নেই আব্বু। শুধু শুধু ওনাদের বিব্রত করতে যাব কেন? আমি বরং হোস্টেলেই উঠব। প্রজ্ঞার সাথে আমার কথা হয়েই আছে। ও বলেছে আমাকে হোস্টেলে একটা রুম ম্যানেজ করে দেবে।”

“আচ্ছা। যা ভালো ভাবিস কর৷ এখন যা বিশ্রাম নে।”

স্নেহা আর কথা না বাড়িয়ে কলতলায় গিয়ে পরিস্কার হয়ে নিলো। অতঃপর ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লো বিছানায়। ঘুম এলো না তার চোখে৷ অপমানের কথা ভেবে শুধুই অশ্রু এলো তার চোখে

চলবে ইনশাআল্লাহ ✨

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here