তুমি ছিলে বলেই পর্ব ১

0
243

১ .
“ছেঁ’ড়া শাড়ি পড়ে এত বড় অনুষ্ঠানে আসতে লজ্জা করল না তোর?”

নিজের চাচাতো ভাইয়ের মুখে এমন অপমানজনক কথা শুনে স্নেহার চোখে জল চলে এলো। ঠোঁট কামড়ে নিজের কান্না আটকানোর বৃথা চেষ্টা করল সে। অপরদিকে উল্টো পাশে থাকা দীপ্রর যেন খুব ভালো লাগল স্নেহাকে এভাবে অপমান করে। তাই তো সে আরো বলতে লাগল,
“তোর বাবা যে এত গরীব হয়ে গেছে জানতাম না। জানলে আমরা নিশ্চয়ই সাহায্য করতাম। কিন্তু তাই বলে আমার এনগেজমেন্টে তোকে এমন ছেঁ’ড়া শাড়ি পড়ে পাঠালো। আমাদের বললে তো আমরা আরো অনেক সুন্দর শাড়ি পাঠিয়ে দিতাম। তাও আমাদের এভাবে অসম্মানিত হতে হতো না।”

স্নেহা ধরে আসা গলায় বললো,
“আমার শাড়িটা ঠিকই ছিল ভাইয়া। হয়তো কোনভাবে..”

“থাক। আর শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে হবে না।”

এমন সময় দীপ্রর ছোট বোন দিশা একটা শাড়ি নিয়ে এলো। স্নেহার দিকে শাড়িটা ছু’ড়ে দিয়ে বলল,
“এই নে। যা শাড়িটা পড়ে নে। এমনিতেই আমাদের যথেষ্ট অপমানিত হতে হয়েছে তোর জন্য। আমরা আর অপমান চাই না। এই শাড়িটা পড়ে আমাদের ধন্য কর।”

স্নেহা অপমানে একদম মিলিয়ে যেতে লাগল। আগে যদি জানত শহরে নিজের চাচার বাড়িতে এসে এভাবে অপমানিত হতে হবে তাহলে কখনোই আসত না সে। নেহাৎ তার অসুস্থ বাবা নিজের ভাইয়ের নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে গিয়ে তাকে পাঠালো। কিন্তু সে তো আর জানত না এই যান্ত্রিক শহরে থেকে তার ভাই কতটা বদলে গেছে।

আজ তার এই অপমানে তার চাচি যে কিছু বলবে না সে জানে। কারণ তিনি এমনিতেই তাদের পরিবারের কাউকে পছন্দ করেন না। কিন্তু তার চাচা যে এভাবে নিশ্চুপ থাকবেন সেটা ভাবে নি।

স্নেহা মনে করে আজ তার সাথে কি কি হলো। দীপ্রর এনগেজমেন্টে আসার পথে তার শাড়ির আঁচলের দিকে একটু ছিড়ে যায়। স্নেহা এখানে শুধু আজকের দিনের জন্যই এসেছে তাই আর কোন ড্রেসও আনা হয়নি। এখন এতদূর এসে বাড়ি ফিরে যাওয়ারও উপায় নেই। তাই এই অবস্থাতেই সে দীপ্রদের বাড়িতে চলে আসে। আর এখানে আসার পর তার চাচা আজিজ খান বেশ আদর যত্নই করে। কিন্তু তার চাচী দিলারা খাতুন তাকে দেখেই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল৷ যদিও এতে সে কিছু মনে করে নি। কারণ চাচির থেকে এর থেকে বেশি কিছু আশাও করা যায়না। কিন্তু যখন দেখল দীপ্র আর দিশাও তাকে এড়িয়ে চলছে তখন বেশ খারাপ লাগল। কারণ তাদের সাথে স্নেহার ছোটবেলায় অনেক ভালো সম্পর্ক ছিল। ওরা যখনই গ্রামে বেড়াতে যেত কত কথা হতো তাদের মাঝে৷ একসাথে কত খেলাধুলা করত তারা। আজ সবই শুধু অতীতের পাতায় সীমাবদ্ধ।

এতকিছুর পরে যখন এনগেজমেন্টে উপস্থিত সব গেস্টদের সাথে স্নেহার পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন আজিজ খান, বিপত্তি বাঁধে তখনই। একজন মহিলা স্নেহার ছে’ড়া শাড়ি লক্ষ্য করে উপহাস করে বলেন,
“আপনার ভাতিজির শাড়িটা তো বেশ ইউনিক। এমন ডিজাইন কোথায় পাওয়া যায়।”

তখন সবাই শাড়ির আঁচলের দিকে খেয়াল করে ছেঁ’ড়া অংশটি দেখতে পায়। ব্যস, শুরু হয়ে যায় হাসাহাসি। সবার সামনে স্নেহা ব্যাপক লজ্জায় পড়ে। এত অপমানিত বোধ আগে কখনোই করে নি সে।

স্নেহার এসব ভাবনার মধ্যেই দীপ্র চিৎকার করে বলে উঠল,
“দাঁড়িয়ে আছিস কেন? যা শাড়িটা চেঞ্জ করে আয়। আমাদের এত অপমান করে কি তোর শান্তি হয়নি?”

এমন সময় হঠাৎ সেখানে উপস্থিত হলো দীপ্রর বাগদত্তা নিপুণ খান। নিপুণ এসেই দীপ্রকে উদ্দ্যেশ্য করে কড়া গলায় বলল,
“কি হচ্ছেটা কি দীপ্র? তোমার থেকে এরকম ব্যবহার আশা করিনি। ও তো তোমাদের গেস্ট। গেস্টের সাথে কেউ এমন ব্যবহার করে কখনো?”

দীপ্র কিছু বলতে যাবে তার আগেই দিশা বলে ওঠে,
“এ আবার কেমন গেস্ট? ওর জন্য আজ সবার সামনে আমাদের কত অপমানিত হতে হলো সেটা তো তুমি দেখলেই নিপুণ আপু। তারপরও এমন কথা বলছ কিভাবে?”

“আমি সবটাই দেখেছি দিশা। তাই এমন কথা বলছি। ওর তো এখানে দো”ষ নেই। দো’ষ হলো মানুষের চিন্তাভাবনায়। ও তো বলল শাড়িটা ছেঁ’ড়া ছিল না দূর্ঘটনাবশত ছিঁ’ড়ে গেছে। তারপরেও এত কথা হচ্ছে কেন আমি বুঝতে পারছি না।”

কথাটা বলতে বলতেই নিপুণ স্নেহার কাছে চলে আসে। স্নেহা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিল৷ নিপুণ এসে তার মাথাটা আলতো করে তুলে ধরে বলে,
“মাথা নিচু করে থাকার মতো কাজ তুমি করো নি স্নেহা৷ তাই এভাবে একদম মাথা নিচু করে থাকবে না। সবসময় চুপ থাকা কোন সমাধান নয়৷ মাঝেমধ্যে একটু প্রতিবাদ করতেও জানতে হয়। নিজের সম্মানের জন্য কিন্তু লড়াইটা নিজেকেই করতে হয়।”

স্মেহা তাকালো নিপুণের দিকে। নিজের নামের মতোই নিপুণ মেয়েটা। দেখতে অসম্ভব সুন্দরী, ধবধবে ফর্সা গায়ের রং, টানা টানা চোখ, মুখে লেগে থাকা সুশ্রী হাসি সবমিলিয়ে সৌন্দর্য যেন উতলে পড়ছে। স্নেহা শুনেছিল দীপ্রর হবু বউ নাকি একজন উকিল। বেশ স্পষ্টভাষী, চাচা অনেক প্রশংসাও করত এই মেয়েটার। আজ সে বুঝল কোন প্রশংসাই মিথ্যা নয়। নিপুণ সত্যিই অনেক ভালো মেয়ে।

এতক্ষণ মৌন থাকা আজিজ খান এতক্ষণে মুখ খুললেন। নিপুণের উদ্দ্যেশ্যে তিনি বললেন,
“নিপুণ মা, দীপ্র তোমরা নিচে যাও। একটু পর তোমাদের এনগেজমেন্ট। আমি এদিকটা সামলে নিচ্ছি।”

“আমি তো এতক্ষণ এখানে ছিলাম না আঙ্কেল। তখন তো আপনি এখানে উপস্থিত ছিলেন। মাফ করবেন, একজন গুরুজন হিসেবে আপনি নিজের দায়িত্ব পালনে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছেন। আপনার সামনে আপনাদের বাড়ির গেস্টকে আপনার ছেলে-মেয়েরা কত অপমানজনক কথা বলল আর আপনি কোন প্রতিবাদ না করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব দেখলেন! আপনার থেকে এটা আশা করিনি।”

দিলারা খাতুন নিপুণের এমন ত্যাড়া কথা শুনে রেগে গেলেন। মেয়েটাকে এমনিতেই ছেলের বউ হিসেবে তার বেশি একটা পছন্দ নয় এই স্পষ্টভাষী স্বভাবের কারণে। নেহাতই তার স্বামী ও ছেলের খুব পছন্দ নিপুণকে তাই কিছু বলতে পারেন নি। কিন্তু তার মানে এই নয় যে তিনি নিপুণের সব কিছু মেনে নেবেন। তাই তো তিনি নিপুণের মুখের উপরেই বলে দিলেন,
“এটা আমাদের ফ্যামিলি ম্যাটার নিপুণ। তুমি কিন্তু এখনো আমাদের পরিবারের কেউ হও নি। তাই আশা করব তুমি এর মধ্যে ইন্টারফেয়ার করবে না।”

নিপুণ মৃদু হেসে ব্যাঙ্গাত্মক স্বরে বলল,
“একজনকে অপমান করা কারো ফ্যামিলি ম্যাটার হতে পারে না আন্টি। এভাবে একটা মেয়েকে অপমান করার কোন রাইট আপনাদের কারো নেই।”

দীপ্র এগিয়ে এসে নিপুণের হাত ধরে বলে,
“এই বিষয় নিয়ে আর কোন কথা নয়। চলো আমাদের এনগেজমেন্টের টাইম হয়ে যাচ্ছে।”

“কোন এনগেজমেন্ট হবে না।”

নিপুণের স্পষ্ট জবাব। বাড়ির সকলে তার কথায় প্রচণ্ড অবাক হলো৷ আজিজ খান উত্তেজিত হয়ে বললেন,
“এসব তুমি কি বলছ নিপুণ? এনগেজমেন্ট হবে না মানে!”

“হুম। ঠিক বলেছি। যতক্ষণ পর্যন্ত না দীপ্র স্নেহার কাছে ওর করা ব্যবহারের জন্য ক্ষমা চাইছে ততক্ষণ পর্যন্ত কোন এনগেজমেন্ট হবে না।”

দীপ্র রাগী গলায় বলে ওঠে,
“ক্ষমা তাও আবার এই মেয়েটার কাছে! নো নেভার।”

” ঠিক আছে। তাহলে আমি চলে যাচ্ছি।”

বলে যেই না নিপুণ চলে যেতে নেবে ঠিক সেই সময়ই একদম দীপ্র বলে ওঠে,
“থামো। আমি ওর কাছে ক্ষমা চাইতে রাজি। তুমি প্লিজ যেও না।”

নিপুণ থেমে যায়। দীপ্র পকেটে হাত গুজে স্নেহার সামনে এসে দাঁড়ায়। বেশ দায়সারা ভাবে বলে,
“সরি।”

স্নেহা কিছু বলে না৷ দিলারা খাতুন ভীষণ রেগে যান এই দৃশ্য দেখে। নিজের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা দিশার উদ্দ্যেশ্যে বলেন,
“এই মেয়েটা কি দিয়ে বশ করল আমার ছেলেটাকে? আমার যেই ছেলেটা এতটা দম্ভ নিয়ে চলে সে কিনা এই মেয়ের এক কথায় সরি বলে দিল! আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না।”

দিশা ভাবলেশহীন ভাবে বলে,
“এজন্যই তো লোকে বলে, ভালোবাসা অন্ধ।”

চলবে ইনশাআল্লাহ ❤️✨

#তুমি_ছিলে_বলেই
#পর্বঃ১
#দিশা_মনি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here