#তুমি_আমি_দুজনে
#লেখিকা_হুমাইরা_হাসান
পর্ব- ১০
শুক্রবারের দুপুর। আহান আর ইনসাফ মাহবুব পবিত্র জুম্মার নামাজে গেছে, রাইমা নিজের ঘরে, রুবি, আমেনা আর মিনু খাতুন নিচে বসার ঘরে। সময়টা মধ্যাহ্নের কাটায় হেলে পরে মাঝ দুপুর ছাড়িয়েছে।
খাটের উপর গাঢ় সবুজ রঙের জামদানী শাড়ি টা এলোমেলো পরে আছে, আর তার চেয়েও এলোমেলো চিন্তাভাবনায় মগ্ন অষ্টাদশীর কিশোরীর মন।
ফর্সা গায়ে সবুজ রঙের ব্লাউজ আর পেটিকোটের উপর পাতলা ফিনফিনে একটা ওড়না মুড়িয়ে রেখে অনবরত পায়চারি করছে। কোমর ছাড়ানো এলোকেশী চুলগুলোর আগা টপকে বিন্দু বিন্দু জলকণা ঝরছে সারা ফ্লোরে।
খাট থেকে শাড়িটা হাতে তুলে নিলো তুরা,, গত আধ ঘন্টা ধরে পায়চারি করে চলেছে ঘরে,বার কয়েক চেষ্টা করেও শাড়ি পরতে পারিনি, কস্মিনকালেও শাড়ি পরে দেখেনি সে। আজ কিভাবে পরবে!
এই শাড়িটা তাকে দিয়েছে মিনু ফুফু, আজ সকালের ঘটনা,,সবার সাথে বসে যখন গল্প করছিলো তুরা মিনু মাঝখান থেকে বলে
-এ আবার কেমন কথা বউ,,তুমি নতুন বউ হয়ে এ কিসব সালোয়ার পরে ঘুরে বেড়াও বাচ্চাদের মতো। তোমার তো শাড়ি পরা উচিত
উত্তরে তুরা শুধু বরাবরের মতোই চুপচাপ তাকিয়ে ছিলো, তারপর মিনু নিজেই উঠে গিয়ে তার ব্যাগ থেকে কয়েকটা শপিং ব্যাগ এনে তুরার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো
-আহানের বউ এর জন্য শাড়ি গুলো কিনেছিলাম আমি। কিন্তু আহানের বউ তো শাড়িই পরে নাহ। এইটা নাও আজ এখান থেকেই একটা শাড়ি পরবে।
তুরা তখন বলদের মতো নিলেও সে যে শাড়ি পরতে পারেনা তা তো ফুফু জানে নাহ। বেশ অসহায় মুখ করে বলেছিলো
-কিন্ত আমি তো শাড়ি পরতে পারিনা ফুফুআম্মা।
-তুমি পারোনা তো কি হয়েছে, তোমার বর কে বলবা পরিয়ে দিতে।
-কিহ,,আমার বর মানে?
-বর মানে আবার কি,আহান! নাকি আরও কেও আছে?
বলেই কপালে ভাজ ফেলে তাকালো মিনু তুরার দিকে, তুরা এহেন কথা শুনে হকচকিয়ে জিহ্বায় কামড় দিয়ে বলে
-এমা ছি ছি,আস্তাগফিরুল্লাহ্,,আমার কেনো আর কেও থাকবে
-তাইলে যে আছে তাকেই বলবা বুঝছো? আজ কিন্তু তোমায় শাড়িতেই দেখতে চাই বউ
ব্যাস,হয়ে গেলো! তুরা সকালে মিনুর বলা কথা অনুযায়ী আধ ঘন্টা থেকে সেই চেষ্টায় করে যাচ্ছে কিন্তু কিছুতেই কিছু বুঝে উঠতে পারছে নাহ, একবার তো সাহায্যের জন্য রাইমার কাছেও গেছিলো, কিন্তু রাইমার সাথে মিনু বসে আছে সেই কখন থেকে। উঠার নাম গন্ধ নেই। সে থাকলে তো যেতে পারবে নাহ, তুরা পরেছে মহা মুশকিলে।
ফুফুর গম্ভীর মুখ খানা দেখলেও তুরা কেমন থতমত খেয়ে যায়, এখন যদি সে দেখে তুরা শাড়ি পরেনি না জানি কি বলে ফেলবে।
তাই সাত পাচ ভাবা বন্ধ করে শাড়িটা হাতে নিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ালো তুরা, যেভাবেই হোক পরে ফেলবে, শাড়িই তো,এমন কি!
বারো হাত লম্বা পাতলা সবুজের শাড়িটার উপর সোনালী জরির কাজ, বেশ নজরকাড়া সৌন্দর্য কাপড়টার। তুরা এদিক ওদিক ঘুরিয়ে কোমরে গুঁজে নিলো শাড়ির একাংশ। একবার পেচিয়ে কাধের উপর রেখে কাঁচা হাতে এলোমেলো ভাবে কুচি করার চেষ্টা করছে,,ভীষণ আনমনা হয়ে একচ্ছত্র নিমগ্নতা দিয়ে চেয়ে আছে ঘাড় নামিয়ে, চিকন আঙুলের মাঝে মাঝে শাড়ির এলো মেলো ভাজ। এমন গভীর মনোযোগ দিয়ে পরিধানের চেষ্টা কালেই খট করে দরজা খোলার শব্দে ধ্যান ভাংলো,, একাগ্রতা ক্ষুন্ন হয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকালো তুরা।
আহান এখনো স্তব্ধ দাঁড়িয়ে, এক হাতে দরজার নবটার মুচড়ে এখনো ধরে আছে,, আরেক হাত থেকে টুপিটা খপ করে পরে গেছে সেদিকে তার বিন্দুমাত্র ধ্যান নেই। কেমন একটা মোহাগ্রস্তের মতো চেয়ে আছে এক ধ্যানে, এক ভাবে তার সামনেই দাঁড়ানো ভীষণ এলোমেলো ভয়ংকর মনোহর, কম্র কিশোরী ননন্দিনীর পানে,,চিবুক থেকে শুরু করে বক্ষস্থলের মধ্যাংশ জুড়ে কেমন রুক্ষতা ছেয়ে গেলো,, শুকনো একটা ঢক গিলার সাথেই কণ্ঠনালীর উচু অংশটার উঠানামা স্পষ্ট দৃশ্যমান হলো আহানের,, গলা টা হুট করেই শুকিয়ে খা খা করছে, অদ্ভুত পিপাসা অনুভূত হচ্ছে।
তুরার হাত থেকে শাড়ির ভাজ গুলোও খসে পরে গেলো। ধপ করে ঘুরে দাঁড়ালো অন্যদিকে,,দরজা যে সে লাগাইনি সে খেয়াল মাথায় ও ছিলো নাহ,, এই মূহুর্তে আহানের আগমন টা স্বাভাবিক হলেও তুরার নিকট তা অত্যন্তই অনাকাঙ্ক্ষিত ছিলো।
ধরজা টা সামান্য ভিড়িয়ে দিয়ে এগিয়ে এলো আহান। সামান্য গলা খাকারি দিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করে টুপিটা যথাযথ স্থানে রেখেই আবারও দরজার দিকে গেলো,
সে নিজেও বুঝতে পারছে যে সে ভীষণ ভুল সময়ে ঢুকে পরেছে,মোটেও উচিত হয়নি এসময়ে আসা। দরজা টা খুলে বাইরের দিকে পা বাড়াতে নিলেই পেছন থেকে নারী কণ্ঠের রিনিঝিনি স্বরে থেমে গেলো
-শুনুন?
তুরার ডাকে থেমে দাড়ালেও পিছু ফিরে তাকালো না আহান। তুরা শাড়ির আঁচল কোনো রকম সামলে আবারও বললো
-আমায় একটু সাহায্য করবেন প্লিজ?
মাথা টা সামান্য কাত করে তুরার আনন পানে চেয়ে ভ্রু যুগল কুচকালো আহান, প্রশ্নবিদ্ধ চাহনি স্থির রেখেই সুধালো
-কিসের হেল্প?
এবার খানিকটা এগিয়ে এলো তুরা, কণ্ঠের খাদ আরও নামিয়ে সবিনয় অনুরোধ করে বললো
-অনেকক্ষণ ধরে চেষ্টা করেও এই শাড়িটা আমি কিছুতেই পরতে পারছিনা,,আমায় একটু পরিয়ে দিবেন প্লিজ!
তড়িৎ ঘাড়সহ নিজেও ঘুরে দাঁড়ালো আহান। এক নজর নিস্তব্ধে দেখলো তার সামনে দাঁড়ানো মেয়েটির পানে, মেয়েটা কি বলছে আদও কোনো ধারণা আছে তার! একটা মেয়ে কতখানি অবুঝ হলে এভাবে নিঃসংকোচে একটা পুরুষের কাছে এমন আবদার অবলীলায় করে দিতে পারে! নিজের চাপা বিব্রতবোধ টা দমিয়ে কিছু বলতে নিবে তার আগেই তুরা আবারও বললো
-দিন না পরিয়ে প্লিজ! আমি কখনো পরিনি তাই জানি না কিভাবে পরতে হয়
-জানোনা তাহলে পরতে নিলে কেনো, কে বলেছিলো তোমায় শাড়ি পরে সং সাজতে, নাকি বউগিড়ি আবার উতলে উঠেছে
বেশ ঝাঁঝালো কণ্ঠে একদমে কথা গুলো বললো আহান। তুরার অসহায়তা আরও বেড়ে গেলো, সে তো পরতে চাইনি!
-আমিতো পরতে চাইনি, ফুফুআম্মা দিয়ে বলেছে নতুন বউদের শাড়ি পরতে হয়, আজকে যেনো আমি শাড়িই পরি
আহানের মেজাজ টা আবারও বিগড়ে গেলো, যেখানে সে বিয়েটাই মানে নাহ, আর এই মেয়ে কি না নতুন বউ কি পরে না পরে সেই রীতি রেওয়াজ শুনাচ্ছে, ভীষণ মেজাজ খারাপ হলেও তা দমিয়ে নিলো, তার ফুফু ও যে কতখানি ভেজাল যুক্ত মহিলা সেটাও তার হাড়ে হাড়ে জানা।
-তো যে পরতে বলেছে তাকেই বলো পরিয়ে দিতে আমায় কেনো বলছো
আহানের ধমকেও না দমে তুরা বোকা বকা মুখ করে বললো
-ফুফু আম্মা বলেছে নিজে না পারলে বরকে পরিয়ে দিতে বলতে, আমিতো এর আগে বিয়েও করিনি,বর ও নাই, তাই আপনাকেই বলছি
তুরার এমন হতবুদ্ধিকর কথায় আহান চাপা স্বরে বললো
-তো আমিকি এর আগে আরও দু চারটে বিয়ে করেছি!
-সত্যিই করেছেন?
আহানের ইচ্ছে করছে নিজের চুল নিজের টেনে ছিড়তে, এ কোন হাবাগোবা মেয়ের পাল্লায় পরলো সে,, তবুও নিজেকে সামলে বললো
-তোমার এসব বাজে কথা রাখো, গিয়ে রাইমা আপিকে বলো ও পরিয়ে দেবে
বলেই আবারও প্রস্থান করতে নিলে তুরা এগিয়ে এসে খপ করে আহানের হাত ধরে বললো
-যাবেন না প্লিজ, আমি গিয়েছিলাম আপুর কাছে কিন্তু ওখানে ফুফু আছে, আমায় দেখলে আপুকে তো শাড়ি পরাতে দিবেনই না বরং আরও হাজার টা প্রশ্ন করবে, আর উনার প্রশ্ন কেমন জানি, আমি কিছুই বুঝিনাহ
তুরার এমন আকস্মিক হাত ধরায় আহান বেশ অবাক হলেও ওর কথায় কপালে ভাজ ফেলে জিজ্ঞাসা করে
-কি প্রশ্ন করে
-ওই তো কতসব প্রশ্ন করে, আজ সকালেই তো জিজ্ঞাসা করছিলো আমি সকালে উঠে গোসল করিনি কেনো, আমিতো বললাম আজ আমার ভার্সিটি নেই তবুও বুঝলো না কেমন জহুরি চোখ করে আমায় বলছিলো ‘তোমাদের মাঝে সব ঠিকঠাক আছে তো?’
কোনো রকম আগামাথা না বুঝেই তুরা হড়বড়িয়ে কথা গুলো বলে ফেললো। আহান হা করে চেয়ে আছে ওর দিকে, কোন রূপ প্রতিক্রিয়া দেবে সে এখনো বুঝে উঠতে পারছে নাহ, তার ফুফু একটু মুখচোখা মানুষ,, সব কথায় মুখের উপরই বলে দেয়, তা বলে এইসব! আর বলেছেও কি না এই বলদের কাছে? এই মুহূর্তে আহানের ইচ্ছে হলো নিজের মাথা নিজেই দেওয়ালে ঠুকতে। সে বেশ বুঝতে পারছে ফুফুর মনে একবার যখন সন্দেহ ঢুকেছে এবার একদম উঠেপড়ে লাগবে জল ঘোলা করতে, আহান আপাতত কোনো কাহিনি চাইনা। তাই ফুফুর সন্দেহ আর বাড়তে দিলো নাহ। ভেতরে এসে দাঁড়ালো তুরার সামনে।
ফ্লোর থেকে শাড়ির আঁচল টা তুলে কতক্ষণ এপাশ ওপাশ করে দেখেই পকেট থেকে ফোনটা বের করলো।
তুরা ভ্রু কুচকে চেয়ে আছে আহানের দিকে। সে তো বললো শাড়ি পরাতে৷ এই লোকটা ফোন কেনো ঘাটছে আজব!
-একটু পরিয়ে দিন না, ফোন কেনো দেখছেন?
-শাট আপ!
বলেই ধমকে তুরাকে চুপ করিয়ে দিলো আহান। ইউটিউবে শাড়ি পরার টিউটোরিয়াল ভিডিও অন করে পাশের টেবিলে রেখে সেই অনুযায়ী শাড়িটা ধরলো। বার দুয়েক রিপিট দেখার পর ভিডিওর মতো কুচি গুলো ধরে এক এক করে তার বলিষ্ঠ হাতের আঙুলের ভাজে ভাজে কুচি গুলো গেঁথে নিলো, এক এক করে কুচি ঠিক করে তুরার হাতে দিয়ে বললো
-এবার এটা গুঁজে নাও
তুরা এতক্ষণ এক ধ্যানেই চেয়ে ছিলো আহানের দিকে। গৌড়বর্ণের শরীরে সাদা শুভ্র পাঞ্জাবিটা একটু বেশিই চোখে ধরছে, নামাজ পরে এসে যেনো গম্ভীর মুখ খানার স্নিগ্ধতা আরও বেড়ে গেছে কয়েক ধাপ, ঘন প্রসারিত ভ্রু যুগল কুচকে,কপালে কিঞ্চিৎ ভাজ ফেলে এই যে ভীষণ মনোযোগ দিয়ে কুচি গুলো ধরছে এতে যেনো আরও বেশি ভাল্লাগছে তুরার
-কি হলো ধরো?
আহানের ডাকে ধ্যান ভাংলো তুরার, আগামাথা না বুঝেই বললো
-এ্যাঁহ?
-তোমাকে বলেছি না এই ওয়ার্ড টা আমার সামনে ইউস করবা নাহ, দিস ইজ ডিসগাস্টিং!
ধরো এটা গুঁজো
বলেই শাড়ির কুচি গুলো তুরার হাতে ধরিয়ে দিলো, তুরা কাচুমাচু মুখ করে কোনো রকম অপরিপক্কভাবে গুঁজে নিলো, এবার আহান আঁচল টা হাতে নিয়ে এক এক করে ভাজ ফেললো। তুরার এবার বেশ লজ্জা লজ্জা লাগছে,যতই হোক এভাবে একটা পুরুষের সামনে! বুকের ভেতর কেমন দ্রিমদ্রিম শব্দে তোলপাড় হচ্ছে, ভীষণ অসস্থি, আর অস্থিরতায় ঘিরে ধরলো তুরাকে, চুপচাপ নিচের ঠোঁট কামড়ে মাথা ঝুকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো
বেশ সময় নিয়ে আহান আঁচল ঠিক করে তুরার কাঁধে রাখতে গেলেই দেখতে পেলো ঘাড় ঝুকিয়ে রাখা তুরার লজ্জামিশ্রিত লালাভ মুখটা, হঠাৎ করে আহানের ও যেনো অন্যরকম প্রগাঢ়তায় ছেয়ে গেলো ভেতরটা, তুরার এভাবে লজ্জা পেয়ে থাকা টা যেনো আহানের অসস্থির পরিসীমা আরও পরিব্যাপ্ত করলো। তারও আচানক ই দ্বিধাবোধ হতে লাগলো
-আ’আম এএটা ঠিক করে নাও
বলেই তুরার আঁচল কাঁধে ফেলেই বড় বড় পা ফেলে বেড়িয়ে গেলো ঘর থেকে। আহান যেতেই তুরা দু’হাতে মুখ ঢেকে ফেললো। ইশ,, কি লজ্জা কি লজ্জা! শেষে কি না ওই লোকটার কাছেই তার শাড়ি পরতে হলো। লজ্জায় আর সংকোচে তুরার সারা মুখ গরম হয়ে এলো, সে তো বলার সময় ও এতসব ভেবে দেখিনি!
-আহান, বাবু এদিকে আই
মিনু ফুফুর ডাকে আহান সিড়ি বেয়ে নেমেই এগিয়ে গেলো বসার ঘরে সোফার দিকে, সেখানে আপাতত তার দাদী আমেনা খাতুন আর ফুফু মিনহ বসে আছে। আহান গিয়ে তাদের মাঝে বসতেই মিনু বললো
-কই থাকিস বলতো বাবু, তোকে তো পাওয়াই যায়না। এসে থেকে আমার পাশে দুদন্ড বসার সময় তোর হলো না
ফুফুর কথায় আহান স্মিত হেসে বলে
-এইতো আসলাম। ব্যাস্ত থাকি বলে খুব একটা সময় পাইনা তো
-হ্যাঁ এখন তো ছেলে বড় হয়ে গেছে,, বিয়েও হয়েছে ব্যস্ত তো হবেই। এখন কি আর ফুফুর কথা মনে পরবে!
মিনু খাতুন বললেন বেশ অভিমানের সুরে। ইনসাফ মাহবুব তার খালাতো ভাই হলেও তাদের সম্পর্ক টা নিজ ভাই বোনের মতই ছিলো বরাবর,, আর আহান তাদের বংশের প্রথম পুত্র সন্তান হওয়ায় সকলের সাথে মিনুর ও অতি আদরের, আহানের ছেলেবেলার অধিকাংশ সময় কেটেছে মিনুর আদরে, তাই অন্য ছেলে মেয়েদের থেকে আহানই মিনুর অতি আদরের। স্বভাবে একটু কড়াভাষী হলেও ছেলেমেয়েদের প্রতি তার অগাধ ভালোবাসা।
-মিনু, আই খেতে বসি,, মা আসো
ইনসাফ মাহবুব নিচে এসেই ডাকাডাকি শুরু করলো, রাইমা আর রুবি রান্নাঘর থেকে খাবার এনে একে একে টেবিলে সাজাচ্ছে। আহান দিদুনের হাত ধরে উঠে দাঁড় করিয়ে নিয়ে আসলো ডাইনিং টেবিলের কাছে, দিদুন কে বসিয়ে দিলে মিনুও এসে বসলো পাশে।
-আহান তোর বউ কই রে! সেই যে ঘরে ঢুকলো আর তো বেরনোর নাম ও নিলো নাহ
মিনুর কথায় আহান কোনো উত্তর দিলো নাহ, বারবার বউ বলায় তার ভীষণ অসস্থি হচ্ছে, এভাবে বাবা মায়ের সামনে শুনতেও কেমন লাগছে।
-ও এসে যাবে আপা আপনি খেতে বসুন
রুবি খাতুনের কথা শেষ হতেই রাইমা বললো
-ওই তো এসে গেছে তুরা
রাইমার কথা শুনে আহান এক পলক চাইলো সিড়ির দিকে। আলগা খোপা করা আধভেজা চুলগুলো ঘাড়ে লেপ্টে আছে, এক হাতে শাড়ির কুচি ধরে নেমে আসছে তুরা, অধর জুড়ে সামান্য হাসির রেখা। আহানের হঠাৎ মনে হলো মেয়েটা সুন্দর, একটু বেশিই সুন্দর!
-বাহহ আজ তো তোকে পাক্কা নববধূ লাগছে রে তুরা দেখি দেখি
বলেই রাইমা তুরার হাত ধরে এগিয়ে আনলো। তুরা মাথা নিচু করে সামান্য হাসলো।
-তা তো লাগবেই। মেয়েদের সৌন্দর্যই তো শাড়িতে৷ আর কিসব জামা কাপড় পরে থাকো তোমরা বাপু। আজ থেকে যেনো ওসব না পরা দেখি তোমায়
হাসিখুশি মুখটা চুপসে গেলো তুরার মিনুর কথা শুনে, একটু আগের ঘটনা মনে পরতেই তার মাথা গুলিয়ে আসছে, একদিন শাড়ি পরেই যা অবস্থা রোজ রোজ পরতে গেলে তো সে পাগল হয়ে যাবে।
-আই তুরা, তুই ও আমার সাথে খেতে বস
ইনসাফ মাহবুব তুরাকে ডেকে বললেন। সবাই একে একে বসলে রুবি খাতুন সবাইকে দিয়ে নিজেও বসলো টেবিলে। খাবারের কয়েক লোকমা মুখে পুরেই মিনু বেশ গম্ভীর মুখ করে বললো
-বউ! এ খাবার সত্যিই তুমি রেঁধেছো তো?
মিনুর কথায় তুরা হকচকিয়ে গেলো,, সকালের কথা অনুযায়ী আজ সকলের রান্না সে নিজে হাতেই করেছে, চাচীর ভয়েই হোক গত কয়েক মাসে রান্না টা সে বেশ করেই রপ্ত করেছে, তাই কোনো রকম অসুবিধা হয়নি। রাইমা আর রুবি খাতুন সাহায্য করতে চাইলেও সে একাই সবটা করেছে। কিন্ত এখন ফুফুর কথায় তার বেশ ভয় হচ্ছে, খাবার খারাপ হয়নি তো?
-জ্বি আমিই করেছি
তুরার উত্তর শুনে ইনসাফ মাহবুব বেশ উচ্ছ্বসিত হয়ে বললো
-বাহ দারুণ রেঁধেছিস তো মা,, আমিতো ভাবতেও পারিনি তুই এতো ভালো রান্না জানিস
ইনসাফ মাহবুব এর কথার সাথে সাথেই মিনুও বললো
-আমিতো ভেবেছিলাম তুমিও এখনকার মেয়েদের মতো অষ্টরম্ভা, কিন্তু তোমার ভালো গুণ আছে দেখছি। বাহ বেশ ভাল্লাগলো
বলেই আবার খেতে শুরু করলেন। মা রাইমা দিদুন সহ সকলে তার রান্নার প্রশংসা করলেও আহান নামক লোকটা একটা শব্দও বলেনি, তুরা জানতো এই লোক হতে প্রশংসা আশা করাও বোকামি,তবুও তার অজান্তেই তার মন চেয়েছিলো হয়তো কিছু বলবে। কিন্তু তার ধারণা কে সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণিত করে আহান পুরোটা সময়ই নিঃশব্দে রইলো। খাবারের পাঠ চুকিয়ে কিছুক্ষণ পরেই উঠে গেলো আহান। ইনসাফ ও তার জরুরি কল আসায় ঘরে গেলো।
খাবার শেষ করেই ঘরে যেতেই নিজের জামা কাপড় গুলো ফ্লোরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা দেখে তুরার চোখ চড়কগাছ হয়ে গেলো। পাশেই গম্ভীর মুখ করে রাখা লোকটা ল্যাপটপ টিপে যাচ্ছে যেনো কোনো ভ্রুক্ষেপ ই নেই।
-এসব কি করেছেন, আমার জামাকাপড় নিচে ফেলেছেন কেনো?
আহান স্ক্রিন থেকে মুখ তুলে ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বললো
-বলেছি না,আমার কোনো জিনিসে হাত দেবে নাহ? আমার আলমারিতে কব্জা করার সাহস কি করে হলো
-দেখুন এসব আমি রাখিনি, মাই রেখেছে৷ আমি বলেছিলাম না রাখতে উনি শোনেননি
-তাহলে এখন শুনিয়ে দাও,আমার আলমারিতে আমি অন্য কারো জিনিস এ্যালাও করবো নাহ
-তাহলে আমি জিনিস গুলো কোথায় রাখবো, রোজ রোজ লাগেজ থেকে বের করে ব্যবহার করা যায়?
-অতসব আমি জানি নাহ, আমার জিনিসের সাথে রাখতে পারবে নাহ দ্যাটস ইট!
বলেই ল্যাপটপ রেখে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। তুরা কিছুক্ষণ থ দাঁড়িয়ে থেকে, নিচ থেকে জামা কাপড় গুলো তুলে এক পাশে রেখে দিলো। লাগেজ টা রাইমা আপুর ঘরেই আছে। ওটা আনা দরকার৷ ভেবেই দরজা দিয়ে বেরতে নিলেই ওই মুহুর্তে আহান দরজার সামনে আসলেই তুরার মাথার সাথে আহানের জোরে ধাক্কা লাগে, থপ করে মেঝেতে পরে গেলো তুরা, আহান থুতনিতে হাত দিয়ে ঘষতে ঘষতে বললো
-চোখে দেখো না? সবসময় বাঁদরের মতো ছুটাছুটি করো কেনো?
-আপনিও তো দেখে চলতে পারতেন।
-এক তো নিজে দৌড়াচ্ছিলে আবার আমাকেই বলছো, স্টুপিট
বলেই নিচের দিকে হাত বাড়ালো। তুরাও খুশি হয়ে হাত বাড়াতে নিলেই ওকে সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণিত করে আহান নিচে পরে যাওয়া ওর ফোনটা তুলে গটগট করে বেরিয়ে গেলো,,তুরা আহানের যাওয়ার পানে চেয়ে মুখ ভেংচি কেটে বললো
-লোকটা আস্ত ব’জ্জাত গোমড়ামুখো হনুমান
.
.
.
চলবে ইনশাআল্লাহ
Humu_♥