#তুমি_আমার_অভিমান❤
|| পর্ব – ২৭ – শেষ ||
#লেখনীতে_বিবি_জোহরা_ঊর্মি
নীরার খুব মন খারাপ। অভিক ওর সাথে এটা কি করে করতে পারল? বারবার অভিককে বলেছিল, অভিক ছাড়া নীরার কেউ নেই। সে যেন নীরাকে ছেড়ে না যায়। কিন্তু অভিক তার কথা রাখেনি। এতো পাষাণ হয়ে গেল যে নিজের সন্তানকেও দেখতে আসেনি। নিজের রুমে বসে কাঁদছে নীরা। এতো খারাপ কেন হয়ে গেল অভিক?
রাত নয়টা বাজতে চলল। শুভ্রকে খাইয়ে ওকে নিয়ে ঘরে ঘরে হাটছিল নীরা। এমন সময় কলিংবেল বেজে উঠে। নীরা শুভ্রকে কোলে নিয়ে দরজাটা খুলল। দরজার সামনে অভিককে দেখে নীরার রাগ উঠে যায়। নীরা এক হাতে শুভ্রকে ধরে রেখেছে। অন্য হাত দিয়ে দরজাটা বন্ধ করার আগেই অভিক দ্রুত ভিতরে ঢুকে যায়। নীরা পিছন থেকে চিৎকার দিয়ে বলে,
‘মিস্টার ফায়াজ। কোন সাহসে আপনি আমার বাসায় এসেছেন? কে অধিকার দিয়েছে আপনাকে ভিতরে ঢোকার?’
অভিক নীরার দিকে ফিরে বলে,
‘বাহ্! কি সুন্দর করে বললে মিস্টার ফায়াজ। আমি ফায়াজ নই তা ভালো করেই জানো।’
‘আপনি বলতে বাধ্য করেছেন? আপনাকে ফায়াজ হতে কি আমি বলেছিলাম?’
‘নীরা শোনো। তোমাকে অনেক কিছু বলার আছে আমার। সবকিছুর জন্য ক্ষমা চাইতে এসেছি আমি।’
‘ক্ষমা? কিসের ক্ষমা? যেই লোক নিজের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে একা রেখে চলে যায় তাকে কিভাবে ক্ষমা করবো আমি? যে লোক ছেড়ে যাবে না বলেও ছেড়ে চলে যায় তাকে কিভাবে ক্ষমা করবো আমি? যে লোক নিজের স্ত্রীর ডেলিভারির সময় তার পাশে থাকে না তাকে কিভাবে ক্ষমা করবো আমি? যে লোক নিজের সন্তানকে অস্বীকার করে, নিজের স্ত্রীকে অস্বীকার করে এবং নিজের অস্তিত্বকেই অস্বীকার করে তাকে কিভাবে ক্ষমা করবো? বলুন মিস্টার ফায়াজ আমি তাকে কিভাবে ক্ষমা করবো? ‘
‘আমি বুঝতে পারছি নীরা তোমার খুব কষ্ট হয়েছে। কিন্তু আমি কি করতাম বলো? আমি হারিয়ে না গেলে তোমার উপর আরও অনেক আঘাত আসতো। ওরা আমাকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল। তার জন্য তোমার উপর আক্রমন করেছিল। আমাকে বাঁচাতে গিয়ে শুভ্রকে চলে যেতে হয়েছে। আমি ভেবে পাচ্ছিলাম না কি করবো। নীরা প্লিজ ক্ষমা করে দাও আমায়।’
‘আপনি তাও স্বীকার আসেননি যে আপনি অভিক। যদি না আমি প্ল্যান করে ঐ গুন্ডাগুলো কে নিয়ে না আসতাম। আর না নিজেকে শেষ করার কথা বলতাম।’
‘তার মানে গুন্ডাগুলো তুমিই ভাড়া করেছ?’
‘হ্যাঁ আমি। সত্যিটা আপনার মুখ থেকে জানার জন্য আমাকে এসব করতে হয়েছে। তবে আমি আপনাকে ক্ষমা করছিনা মিস্টার ফায়াজ। আপনি আমার কাছে একজন অপরিচিত ব্যক্তি।’
‘নীরা তুমি এমনটা বলতে পারো না। আমি সব ছেড়ে দিয়ে চলে এসেছি। প্লিজ নীরা ক্ষমা করে দাও।’
নীরা শুভ্রকে নিয়ে চলে গেল৷ অভিক নীরার পিছনে পিছনে গেল। নীরা বেডে আস্তে করে শুভ্রকে শুইয়ে দিল। অভিক এসে নীরাকে বলে,
‘নীরা শোনো…।’
নীরা ঠোঁটে হাত দিয়ে বলে,
‘শশশশ। শুভ্র ঘুমুচ্ছে। প্লিজ জোরে ডাকবেন না।’
নীরা মুখ গোমড়া করে নিচে চলে যায়। নীরা ভাবছে সে কি করবে। নিচে এসে সোফায় বসে পড়লো নীরা। অভিক এসে নীরার পাশে বসে। নীরা অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বলে,
‘আপনি যাচ্ছেন না কেন? এতোদিন যখন আপনাকে ছাড়া থাকতে পেরেছি বাকিদিন গুলো এমনিই কেটে যাবে। আর আপনিও যখন আমাদের ছাড়া থাকতে পেরেছেন। এখনও পারবেন। সময় নষ্ট করবেন না। চলে যান।’
অভিক এবার নীরার পায়ে ধরে কাঁন্না করতে থাকে।
‘এই! করছেন টা কি? পা ছাড়ুন!’
‘নীরা প্লিজ। শেষ বারের মতো একটা সুযোগ দাও।’
নীরা অভিকের হাত নিজের পা থেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে। নীরা যতই পা ছাড়ানোর চেষ্টা করে অভিক তত চেপে ধরে। এক সময় নীরা রেগে অভিককে কষিয়ে একটা থাপ্পড় দিয়ে বসে। অভিক নীরার পা ছেড়ে দেয়। নীরা উঠে অভিককে বলে,
‘সমস্যা কি আপনার? আমি অনাথ ছিলাম। বারবার আপনাকে বলেছিলাম যে আপনি ছাড়া আমার কেউ নেই। আমাকে ছেড়ে যাবেন না কখনো। কত কেঁদে আপনার বুক ভাসিয়েছি মনে নেই? রেখেছিলেন আপনি আপনার কথা? রাখেননি তো। আমার মনে কি আঘাত পেয়েছি তা কখনো উপলব্ধি করেছেন? পারবেন আমার আগের অভিককে ফিরিয়ে দিতে? পারবেন না। কারণ আপনি এখন গুন্ডা, খুনি, মাফিয়া। আমি আপনাকে ঘৃণা করি। চলে যান এখান থেকে। আর সহ্য হচ্ছে না আপনাকে।
নীরা অভিকের এক হাত ধরে দরজার বাইরে বের করে দেয়। নীরাকে একজন সার্ভেন্ট বলে।
‘ম্যাম খাবার রেড়ি করেছি। খাবেন চলুন।’
‘খিদে নেই। খাব না।’
নীরা উপরে চলে যায়। দরজা লক করে শুভ্রর পাশে শুয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে।
.
পরদিন অফিসে বসে কিছু ইম্পোর্টেন্ট ফাইল দেখছিল নীরা। এসময় সামনে কারো ছায়া দেখতে পায় সে। তাকিয়ে সে নিজেই হতভম্ব হয়ে যায়। নীরা দেখে অভিক তার সামনে ফরমাল লুকে দাঁড়িয়ে আছে। অভিককে সে-ই আগের মতো দেখাচ্ছে। এক মুহুর্তের জন্য নীরা অতীতে ফিরে যায়। যেন মনে হচ্ছে আগের অভিক ই নীরার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। হুট করে আবার নীরা কল্পনা করা বন্ধ করে দেয়। নীরা ধপ করে চেয়ার থেকে উঠে যায়। বিরক্ত না আসলেও জোর করে নিয়ে আসার চেষ্টা করে।
‘আপনি এখানে কি করছেন?’
অভিক চোখের সানগ্লাসটা ঠিক করে বলে,
‘আমার অফিসে আমি থাকবো নাতো কে থাকবে মিসেস চৌধুরী।’
‘এটা এখন আর আপনার অফিস নয়।’
‘অফিসের সব স্টাফরা আমাকে বস হিসেবে মেনে নিয়েছে। যেহেতু এটা আমার অফিস, আর আমি এখনো বেঁচে আছি; সেহেতু তোমার এখানে আর কোনো হস্তক্ষেপ নেই নীরা।’
নীরা ডেস্ক থেকে বেরিয়ে অভিকের সামনে এসে দাঁড়ায়। তারপর অভিকের দিকে তাকিয়ে বলে,
‘আমি আপনাকে অভিক বলে মানি না।’
‘মানো না মানো সেটা তোমার ব্যপার নীরা।’
অভিক নীরার সামনে থেকে সরে নিজের চেয়ারে বসে। ল্যাপটপটা হাতে নিয়ে আগের সব প্রজেক্ট চেক করতে থাকে। নীরা জড়বস্তুর মতো দাঁড়িয়ে আছে। প্রায় পনেরো মিনিটের মতো ঘাটাঘাটি করে ল্যাপটপ বন্ধ করে দেয় অভিক৷ তারপর নীরার দিকে তাকিয়ে বলে,
‘বাহ্! এই আঠেরো মাসে তো ভালোই সামলেছো তুমি। অনেক বড় বড় ডিল করেছ। কোম্পানিকে অনেক এগিয়ে নিয়ে গেছ। আই প্রাউড অফ ইউ নীরা। তোমার জন্য অনেক গ্রো করেছে আমার বিজনেসটা। থ্যাঙ্কিউ।’
‘অভিক প্লিজ আপনি সরুন। আমি যখন দায়িত্ব নিয়েছি তখন আমাকেই সামলাতে দিন সব।’
‘সেটা আর হচ্ছেনা মিসেস চৌধুরী। না আমি এই চেয়ার ছাড়বো আর না তোমাকে।’
নীরা রাগে গজগজ করতে থাকে। বাইরে চলে আসতে নিলেই অভিক রিমোট দিয়ে দরজা লক করে দেয়। নীরা থমকে যায়।
‘আমি আগের অভিক হয়ে যাবো। একদম টাইটে রাখবো তোমাকে।’
অভিকের এই কথা শুনে নীরা পিছনে তাকিয়ে বলে।
‘কি শুরু করেছেন আপনি এসব? সামলান আপনি আপনার কোম্পানি। আমাকে যেতে দিন।’
‘তোমাকে ছাড়বো না বললাম না।’
অভিক চেয়ার থেকে উঠে যায়। আস্তে আস্তে করে নীরার দিকে এগুতে থাকে। নীরা অভিকের এগুনো দেখে পিছুতে থাকে।
‘আপনি কি করছেন?’
‘দেখতেই পাবে।’
‘এগুবেন না একদম।’
‘কেন? কি করবে শুনি?’
অভিক নীরাকে দেয়ালের সাথে চেপে ধরে। নীরা অভিকের দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে আছে।
‘আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলোতো নীরা। ঘৃণা করো এখনো? একটুও ভালোবাসো না?’
অভিকের কথা শুনে নীরা চোখ সরিয়ে নেয়। অভিক কড়া গলায় বলে।
‘আমার দিকে তাকাও নীরা।’
নীরা ভয়ে অভিকের দিকে তাকায়। অভিক বলে,
‘আমাকে ক্ষমা করবে না নীরা? প্লিজ ক্ষমা করে দাও। আর পারছিনা। খুব কষ্ট হচ্ছে নীরা।’
অভিক নীরাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। অভিক জড়িয়ে ধরার পর নীরা আর কথা বলার শক্তি পাচ্ছেনা। সেও অভিককে জড়িয়ে ধরে। চোখ বন্ধ করে চোখের পানি ছেড়ে দেয়।
কিছুক্ষণ এভাবে অতিবাহিত হওয়ার পর অভিক নীরাকে ছেড়ে দেয়। নীরা নিজের চোখের পানি মুছে নেয়। অভিক বলে,
‘বলোনা নীরা। ক্ষমা করেছ তো?’
নীরা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,
‘হুম। ক্ষমা করে দিয়েছি আপনাকে।’
অভিক খুশি হয়ে বলে,
‘চলোনা আমরা আগের মতো জীবন শুরু করি। তুমি আমি আর আমাদের শুভ্র।’
নীরা কিছু বলে না। অভিক নিজের মতো করে কথা বলে যাচ্ছে নীরাকে। নীরা শুধু শুনে যাচ্ছে। আসলে ও হাফিয়ে গিয়েছে অভিকের সাথে রুড ব্যবহার করতে করতে।
.
সন্ধ্যায় অভিক নীরা আর শুভ্র বসে আছে তাদের রুমে। শুভ্রকে কোলে নিয়ে পাগলের মতো চমু দিতে থাকে অভিক। অনেক আদর করতে থাকে শুভ্রকে। এটা দেখে নীরা মুচকি মুচকি হাসছে। এতোদিনে মনে হচ্ছে তাদের একটা সুন্দর পরিবার হয়েছে। যেমনটা নীরা চেয়েছিল। নীরা এসব ভাবতে ভাবতে বেলকনিতে চলে যায়।
শুভ্রকে ঘুম পাড়িয়ে অভিক নীরাকে খুঁজতে থাকে। একসময় সে বেলকনিতে এসে দেখতে পায় নীরাকে৷ অভিক তখন নীরাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে। তারপর নীরার চুলে মুখ গুজে থাকে কিছুক্ষণ। নীরা চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। কতদিন পর ভালোবাসার মানুষের স্পর্শ পেয়েছে সে৷ এই সুন্দর অনুভূতিটা সে চোখ বন্ধ করে নিচ্ছে।
অভিক নীরার হাত ধরে রুমে নিয়ে আসে। তারপর নীরাকে একটা চেয়ারে বসিয়ে ওর সামনে ক্যানভাস আর রং তুলি নিয়ে বসে পড়ে। একমনে নিজের প্রিয়তমার ছবি আঁকতে বসেছে সে।
কিছুক্ষণ পর নীরার ছবি এঁকে নীরাকে দেখায় অভিক। নীরা নিজের ছবি দেখে নিজেই অবাক হয়ে যায়। কতটা নিখুঁতভাবে তার ছবি এঁকেছে অভিক। নীরা অভিকের দিকে তাকালেই অভিক বলে উঠে।
‘যদি কোনো চিত্র আঁকি, পৃথিবীর সবচেয়ে দামী।
সেই চিত্রতে তুমি পার্ফেক্টলি বসো। কেন লাগে শূন্য শূন্য বলো, তোমায় ছাড়া এতো; তুমি কি তা বলতে পারো?’
নীরা ঠোঁট চেপে ধরে কাঁন্না আটকিয়ে অভিককে জড়িয়ে ধরে। অভিক নীরার কপালে একটা গভীর চুমু দিয়ে নীরাকে নিজের বাহুডোরে আগলে নেয়।
‘ছেড়ে যাবো না আর কখনো নীরা। আই প্রমিস। অভিক আর নিজের ওয়াদা ভঙ্গ করবে না।’
‘আমিও আপনাকে ছাড়া শূন্য অভিক। আর যাবেন না কোথাও। ভালোবাসি আপনাকে।’
‘প্রচন্ড ভালোবাসি তোমাকে।’
সমাপ্ত।
লেখনীতে – বিবি জোহরা ঊর্মি
[পাশে থাকার জন্য ধন্যবাদ। জানিনা কেমন লেগেছে গল্পটা। তবুও চেষ্টা করেছি ভালো লেখার। ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। ধন্যবাদ।]