#তুমি_আমার_অভিমান❤
|| পর্ব – ৭ ||
#লেখনীতে_বিবি_জোহরা_ঊর্মি
নীরা খুব ভোঁরে উঠে ফজরের নামাজ পড়ে নেয়। এদিক ওদিক পায়চারী করছে আজ কি পড়বে সে। নীরার অনেক দিনের ইচ্ছে সমুদ্র দেখার। অবশেষে অভিকের জন্য সেটা পূরণ হবে। নীরা ভাবে সে আজ শাড়ি পরেই সমুদ্রের কাছে যাবে। তাই নীরা নীল শাড়িটি বেছে নিল। তারপর হ্যান্ডব্যাগ থেকে টুকিটাকি জুয়েলারি নিল, যেমন দুল, মালা ছোট ছোট দুটো আংটি। এগুলো গুছিয়ে রাখলো একপাশে।
নীরা ভাবছে একবার অভিকের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করবে তারা কখন বের হবে। তারপর আবার নিজের মত পরিবর্তন করে ফেলে। অভিক যদি এবার রেগে গিয়ে সমুদ্রে তাকে না নিয়ে যায়?
নীরা বারান্দায় গিয়ে দেখে সূর্য উঠে গেছে। নীরা তার হ্যান্ডব্যাগটা নিয়ে বাইরে এসেই দেখে অভিক তার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। নীরা চমকে যায়! অভিক নীরাকে দেখে প্রশ্ন করে,
‘কোথায় যাওয়া হচ্ছে?’
নীরা আমতা আমতা করে বলে,
‘ও-ও-ওই বাইরে একটু দরকার ছি-ছিল।’
‘কি দরকার শুনি?’
‘আসলে কিছু জিনিস নেওয়ার আছে আমার।’
অভিক হাই তুলতে তুলতে বলে,
‘আমরা আজ দুপুরেই ঢাকায় বেক করবো।’
‘আচ্ছা। আমি যাই তাহলে?’
নীরা অভিকের সামনে থেকে যেতে নিলেই অভিক নীরার হাত ধরে নেয়।
‘ব্রেকফাস্ট করে তারপর যেও। আসো আমার সাথে।’
অভিক নীরাকে নিয়ে নিচের রেস্টুরেন্ট এ ব্রেকফাস্ট করতে যায়। সেখান থেকে খাওয়া দাওয়া সেরে অভিক নীরাকে নিয়ে আশে পাশের মার্কেটগুলোতে যায়।
নীরা ওখান থেকে একটা চুড়ির দোকানে ঢুকে। রঙ বেরঙের চুড়ি সেখানে। নীরার চোখ জুড়িয়ে যায় এতো চুড়ি দেখে। সে বেছে বেছে কিছু চুড়ি নিল। অভিক এক পাশে দাঁড়িয়ে নীরার কাজ দেখছে। নীরা নীল রঙের খাঁচ কাটা চুড়ি দেখছে। হাতে নিয়ে পড়ার সময় দেখে পড়তে পারছেনা। চুড়ির সাইজ ছোট নয়, কিন্তু নীরার হাতে ঢুকছেনা। দোকানদার দেখে বলল,
‘ভাবি, ভাইয়াকে দেন, ভাইয়া পরিয়ে দিবে।’
নীরা দোকানদারের কথা শুনে অভিকের দিকে এক নজর তাকায়। তারপর দোকানদারের দিকে ফিরে বলে,
‘আমি কারো ভাবি নই। আমার এখনো বিয়ে হয়নি।’
দোকানদার বলল,
‘অহ্, তাহলে নিশ্চয়ই আপনারা প্রেমিক প্রেমিকা। নিন ভাইয়া, আপুকে চুড়িগুলো পরিয়ে দিন।’
নীরা রেগে গেল এবার,
‘আপনি না জেনে কথা বলছেন কেন? আমরা…’
নীরার কথার মাঝখানেই অভিক নীরাকে ধমক দিয়ে বলে,
‘চুপ থাকো। হাতটা দাও।’
নীরা অভিকের কথায় বোকা বনে গেল। অভিক নীরার হাত ধরে নীরার হাতে নীল চুড়ি পরিয়ে দিচ্ছে। নীরা অভিকের দিকে অপলকভাবে তাকিয়ে আছে। হোয়াইট শার্ট পরে আছে অভিক। সিল্কি চুলগুলো দু একটা কপাল স্পর্শ করেছে। গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি অভিকের। নীরা চোখ ফিরিয়ে নেয়। মনে মনে বলে,
‘কি করছিস তুই নীরা, এই লোকটাকে তোর জীবনেও ভালো লাগবে না।’
অভিক নীরাকে স্বযত্নে চুড়ি পরিয়ে দেয়। নীরা চুড়ির টাকা দিতে গেলেই অভিক নীরাকে থামিয়ে নিজেই টাকা দিয়ে চলে আসে। নীরা অন্য একটা দোকানে গিয়ে আলতা কিনে। এটার টাকাও অভিক দিয়ে দেয়।
অভিক নীরাকে নিয়ে যখন রাস্তায় চলে আসে, তখন নীরা রেগে পিছন থেকে এসে বলে,
‘এই আপনি কি মনে করেন হ্যাঁ? আপনার অনেক টাকা? আপনি কেন বিল পে করলেন? আমার কি টাকা ছিল না?’
অভিক নীরার দিকে ফিরে বলে,
‘আমি থাকতে তুমি কেন টাকা দিবে? তোমাকে যখন আমি নিয়ে এসেছি, তখন সব দায় আমার। এতো কথা বলো না। চলো সমুদ্রে যাবে না? রেড়ি হতে হবে তো। তোমার তো আবার কয়েক ঘন্টা লেগে যাবে।’
‘মোটেও না। আমি মাত্র দশ মিনিটে রেড়ি হয়ে আপনার সামনে আসবো দেখে নিবেন।’
ওরা হোটেলের ভিতরে চলে আসে।
.
অভিক তার অফিসের ম্যানেজার এর সাথে ফোনে কথা বলছে। অফিসে কি হচ্ছে না হচ্ছে সেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করছে। এমন সময় নীরা পিছন থেকে অভিককে ডাক দেয়৷ অভিক পিছনে তাকিয়ে নীরাকে দেখেই থ মেরে যায়।
নীরা নীল শাড়ি পরেছে। দু’হাত ভর্তি নীল চুড়ি। গলায় সাদা পাথরের মালা। কানে টানা দুল। চোখে গাঢ় কালো কাজল দিয়েছে। ঠোঁটে লাল লিপস্টিক। হাতের তালুতে আলতা লাগিয়েছে। আর খোলা চুল কোমর পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে। নীরাকে অপ্সরীর চেয়ে কম লাগছে না। অভিক যেন কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলছে। ম্যানেজার এদিকে হ্যালো হ্যালো করতে করতে কল কেটে দেয়। নীরা অভিকের তাকানো দেখে ঢোক গিলে বলে,
‘কি দেখছেন?’
অভিকের কোনো ধ্যান নেই। ওর চোখ নীরাতেই আটকে আছে। অভিক আস্তে আস্তে নীরার দিকে এগুতে থাকে। নীরা অভিকের এগুনো দেখেই পিছুতে থাকে। পিছুতে পিছুতে নীরা একদম দেয়ালের সাথে মিশে গেছে। অভিক নীরার খুব কাছে চলে এসেছে। অভিক নীরার দুপাশে দেয়ালে হাত রাখে নীরাকে তার মধ্যে আটকে দিয়েছে। নীরা ঢোক গিলছে বারবার। অভিকের দিকে তাকিয়ে দেখে অভিক একটা ঘোরের মধ্যে আছে। অভিক আস্তে আস্তে নীরার ঠোঁটের কাছে আসতে নিলেই নীরা চোখ বন্ধ করে জোরে একটা চিৎকার দিয়ে উঠে।
নীরার চিৎকারে অভিকের ঘোর কাটে। নীরার দিকে তাকিয়ে দেখে সে চোখ বন্ধ করে আছে। জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। অভিক নিজের কপালে হাত দিয়ে বলল,
‘অহ শিট!’
অভিক নীরার কাছ থেকে দূরে সরে দাঁড়ায়। নীরা চোখ খুলে দেখে অভিক অনেকটাই দূরে দাঁড়িয়ে আছে। অভিক নীরাকে বলে,
‘আমি নিচে যাচ্ছি। আর সরি, আমি তখন নিজের মধ্যে ছিলাম না। সরি ফর দ্যাট।’
অভিক চলে যায় ওখান থেকে। নীরার এতক্ষণে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার অপেক্ষায় ছিল। কিভাবে অভিক ওর এতোটা কাছে এলো ভাবতেই নীরার গা শিউরে উঠে। নীরা দরজা লক করে নিচে অভিকের কাছে চলে গেল।
.
সমুদ্রের কাছে এসে নীরার যে কি আনন্দ লাগছে সে কাউকে বুঝাতে পারবেনা। সমুদ্রের পানিতে পা ভেজাচ্ছে, হাতে পানি নিয়ে উপরে ছুঁড়ে মারছে। অনেক ছোটাছুটি করছে নীরা। অভিক নীরার এমন কাণ্ড দেখে হাসছে আর ছবি তুলছে। নীরা অভিকের পাশে একটা ক্যামেরাম্যানকে দেখে বলে উঠে,
‘ভাইয়া আমার কয়েকটা ছবি তুলে দেননা প্লিজ।’
এ কথা শুনেই অভিকের রাগ উঠে। সে নীরাকে বলে,
‘চোখের সামনে জল জ্যান্ত ক্যামেরাম্যান দেখে অন্যজনকে কিভাবে বলো?’
লোকটি দাঁড়িয়ে না থেকে চলে যায়।
নীরা এদিক ওদিক তাকিয়ে বলে,
‘কই, কাউকে দেখছিনা তো।’
অভিক বলে,
‘কেন তুমি আমাকে দেখছ না? জানো আমি কত ভালো ছবি তুলি?’
নীরা ভাব নিয়ে বলে,
‘আপনি অফিসের সিইও, আমার ক্যামেরাম্যান না যে আপনাকে আমার ছবি তুলে দিতে বলবো।’
অভিকও নীরার কথার পাল্টা জবাব দিয়ে বলে,
‘সমুদ্র পাড়ে কেন এসেছেন ম্যাম? আমিও তো আপনার বয়ফ্রেন্ড বা হাসব্যান্ড নই যে বললেন আর সমুদ্র পাড়ে নিয়ে এলাম।’
নীরা অভিকের কথা শুনে নিচের দিকে তাকিয়ে থাকে। সত্যি তো। কোনো অফিসের সিইও কখনো এভাবে ঘুরাতে নিয়ে আসে? অভিক তাও নীরার কথা রেখেছে, তাকে ঘুরতে নিয়ে এসেছে। নীরাকে ভাবতে দেখে অভিক বলে,
‘পোজ দাও। ছবি তুলি।’
অভিক নীরাকে বিভিন্ন অ্যাঙ্গেলে দাঁড়াতে বলে। নীরা সেভাবেই দাঁড়িয়ে পোজ দিচ্ছি আর অভিক নীরার ছবি তুলছে। অভিক নীরার সাথে দু একটা সেল্ফিও তুলেছে। অবশ্য নীরা কিছু বলেনি এতে। ওরা অনেক্ক্ষণ সমুদ্র পাড়ে ঘুরে।
.
বিকেলের দিকে গাড়িতে উঠে তারা ঢাকার দিকে রওনা হয়। নীরা ক্লান্ত থাকায় পুরো রাস্তায় সে ঘুমিয়েছে। অভিক নীরাকে আর বিরক্ত করে না। একমনে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছে সে। রাত সাড়ে আটটায় তারা ঢাকায় পৌঁছায়। বিশ মিনিটের মতো জ্যামে আটকে ছিল অভিকের গাড়ি। তাই একটু লেইট হয়। অভিক প্রথমে নীরারদের আশ্রমে এসে গাড়ি থামায়।
তারপর আস্তে আস্তে নীরাকে ডাকতে শুরু করে। নীরা চোখ খুলে দেখে অভিক গাড়ি থামিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। নীরা বলে,
‘গাড়ি থামিয়েছেন কেন?’
‘কারণ, তোমার আশ্রমে চলে এসেছি।’
নীরা বাইরে তাকিয়ে দেখে সত্যি তারা এখন আশ্রমের সামনে। অভিক বলে,
‘তুমি জানো তুমি কতক্ষণ ঘুমিয়েছ? চার ঘন্টা।’
‘আল্লাহ! গাড়িতে আমি এতক্ষণ ঘুমিয়েছি? আচ্ছা, এখন দরজা খুলুন। আমি ভেতরে যাবো।’
অভিক গাড়ি থেকে নেমে নীরাকে গাড়ির দরজা খুলে দেয়। নীরা আশ্রমে যাওয়ার সময় অভিক পিছন থেকে ডাক দেয়। নীরা থেমে অভিকের কাছে এসে বলে,
‘পিছন থেকে ডাকলেন কেন? কি হয়েছে?’
‘কাল আমার জন্মদিন নীরা। বাসায় কাল সন্ধ্যায় একটা পার্টির আয়োজন করছি। তুমি এসো।’
নীরা বলে,
‘অফিসের কোনো কাজ থাকলে বলতে পারেন। আমার এসব পার্টি টাটি পছন্দ না। আমি যেতে পারবো না সরি।’
অভিক রিকুয়েষ্ট করে বলে,
‘আমার জন্য প্লিজ কাল এসো৷ সবাই আসবে। আর আমি চাই তুমি অবশ্যই থাকো সেখানে।’
‘স্যার আমি পারবো না বললাম তো।’
‘আমি না শুনবো না। কাল তোমাকে আসতেই হবে। আর যদি কাল তোমায় আমি আমার বাসায় না দেখি, তাহলে আমার চেয়ে খারাপ আর কেউ হবে না বলে রাখলাম।’
এই বলে অভিক গাড়ি নিয়ে সাই করে নীরার সামনে দিয়ে চলে গেল। নীরা গুরুত্ব না দিয়ে আশ্রমে ঢুকে গেল।
চলবে…