#তুমি_আমার_অভিমান❤
|| পর্ব – ৩ ||
#লেখনীতে_বিবি_জোহরা_ঊর্মি
নীরা যেমন সুন্দরী ঠিক তেমনি গুণবতী। একদিকে মানুষ যেমন নীরার সৌন্দর্যের প্রশংসা করে, অন্যদিকে নীরার কাজেরও প্রশংসায় পঞ্চমুখ। আশ্রমে থাকে বলে নিজের হাতে রান্নাবান্না করে সবাইকে খাওয়ায় নীরা। আশ্রমের বাচ্ছাদের নিজের হাতে খাওয়ায়। ওর মতো অনেক ছেলে মেয়ে এখানে পড়ে আছে। অনেকে লেখাপড়া করেছে, আবার অনেকেই করেনি। যারা চাকরি পেয়েছে তারা এই আশ্রম থেকে চলে গেছে। মাঝে মাঝে এসে দেখা করে যায়। আশ্রমের জন্য কিছু অর্থ দিয়ে যায়। আর নীরা এখনো আশ্রমেই পড়ে আছে। নীরার যাওয়ার মতো জায়গা নেই। এখানে একটা ছেলে নীরাকে ভিষণ বিরক্ত করে। ছেলেটা অনাথ বলে বের করে দিতে পারছে আশ্রম থেকে। কিন্তু রোজ রোজ এটা একটা বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। নীরা এতে অতিষ্ঠ হয়ে গেছে।
.
অফিসে এসে নীরা অভিকের জন্য অপেক্ষা করছে। নীরা অনেক ভেবে দেখলো, চাকরি ছেড়ে কোনো লাভ হবে না। উল্টো আশ্রমের একটা বোঝা হয়ে থাকবে সে। কিন্তু নীরা চায়না সে কারো বোঝা হয়ে থাকুক। তাই নীরা সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে অভিকের অফিসে চাকরি করবে। তবে নিজের সম্মান সে নিজেই রাখবে। কারো দয়ায় না। চাকরিটা সে নিজের যোগ্যতায় পেয়েছে।
.
নীরা ম্যানেজারের দেয়া কিছু কাগজ পত্রে সই করলো। অভিক সবসময়ই দেরি করে অফিসে আসে। এটা নীরার একদমই পছন্দ না। বস হয়েছে বলে কি যা খুশি তাই করবে? নিয়ম সবার জন্যই সমান হওয়া উচিৎ।
কিছুক্ষণ পর অভিক এলো। সাথে দুটো মেয়েও এসেছে। নীরা মেয়েগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে। ওদের চেনে না নীরা। অভিকের গার্লফ্রেন্ডও না।তাহলে এরা কারা?
অভিক সোজা তার কেবিনে চলে গেল ওদের নিয়ে। অফিসের সবাই বলাবলি করছে অভিকের চরিত্র সম্পর্কে। নীরারও বিরক্তি লাগছে। একটা মানুষ কতটা খারাপ হতে পারে তা অভিককে না দেখলে বিশ্বাসই করতে পারতো না নীরা।
নীরা ম্যানেজারের কথায় একটা ফাইল নিয়ে অভিকের কেবিনের দিকে যায়। দরজা খোলা ছিল। ভেতরে চোখ পড়তেই নীরা দরজার আড়াল হয়। নীরা দেখছে অভিকের কোলে বসে আছে দুটো মেয়ে। নীরার অস্বস্তি লাগছে।
‘ছিঃ’
নীরা দৌড়ে ওখান থেকে চলে গেল। এদিকে অভিক শুনতে পেয়েছে কেউ একজন দরজায় দাঁড়িয়ে ছিঃ বলেছে। অভিক ওদের কাছ থেকে উঠে দরজায় এসে দেখে কেউ নেই। নিচে কিছু একটা পড়ে থাকতে দেখে অভিক সেটা হাতে তুলে নেয়। অভিক দেখে কারো কানের ঝুমকো তার দরজার সামনে পড়ে আছে। পিছনে তাকিয়ে দেখে মেয়ে দুটোর মধ্যে কারো কানেই ঝুমকো নেই। অভিক ভেবে পাচ্ছেনা এই ঝুমকো টা কার আর কে-ই বা এসেছিল এখানে?
.
নীরা ওয়াশরুমে এসে চোখে মুখে পানি ছিটালো। ছিঃ ছিঃ! তার অফিসের সিইও এমন খারাপ সে কল্পনাও করতে পারেনি। নীরা এখন কোথায় যাবে চিন্তায় মগ্ন সে। ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে দেখে ওই মেয়েগুলো চলে যাচ্ছে। নীরা দ্রুত অভিকের কেবিনে যায়। একটা ফাইল অভিকের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,
‘ম্যানেজার বলল এখানে আপনার একটা সই লাগবে।’
অভিক নীরার দিকে তাকিয়ে দেখে সে অন্যদিকে তাকিয়ে কথা বলছে। তার দিকে তাকাচ্ছেই না। মুখে কেমন বিরক্তির ছাপ। তারপর অভিকের চোখ পড়ে নীরার খোলা চুলের দিকে। এতো লম্বা চুল? আঁচড়ায় কিভাবে? যে নারীর চুল সুন্দর সে নারী নাকি পৃথিবীর সবচেয়ে রূপবতী হয়। আর পুরুষ মানুষ সৌন্দর্যের পূজারী হয়। তবে কি নীরা পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর নারী? আর অভিক কি সেই পুরুষ যে নীরার সৌন্দর্যেই বিমোহিত হয় বারবার? অভিকের চোখ পড়ে নীরার কানের দিকে। একটা দুল নেই। অন্যপাশে তাকিয়ে দেখে সেই দুল যেটা সে কিছুক্ষণ আগে পেয়েছিল। তারমানে কি নীরাই ছিল তখন?
অভিক নীরাকে প্রশ্ন করে,
‘অন্যদিকে তাকিয়ে আছো কেন?’
নীরা অভিকের দিকে তাকিয়ে খিটখিটে গলায় বলে,
‘আপনার সৌন্দর্য কি বেয়ে বেয়ে পড়ছে যে আপনার দিকে আমায় তাকিয়ে থাকতে হবে?’
‘এই তুমি এতো ত্যাড়া ত্যাড়া কথা বলো কেন? ফাইলটা দাও আর যাও আমার জন্য কোল্ড কফি নিয়ে আসো।’
অভিক ফাইলটায় সই করে দিলে নীরা গিয়ে ম্যানেজারকে দিয়ে আসে। নীরা নতুন তাই অফিসের অনেক কিছুই সে বোঝে না। নীরা অভিকের জন্য কফি নিয়ে আসে। অভিক কফি খেয়ে নীরাকে বলে এখানে বসে থাকতে। নীরাও বাধ্য মেয়ের মতো অভিকের কেবিনে বসে থাকে। অভিক ল্যাপটপে কাজ করছে আর আড়চোখে নীরাকে দেখছে। নীরার নাকের ঢগায় ঘাম এসে জমে আছে। ফর্সা মেয়েদের আবার এসবে সুন্দরই লাগে। খোলা চুলগুলো হাত দিয়ে খোঁপা করে নিয়েছে ইতিমধ্যেই। অভিক নিজেও জানে না কেন সে বারবার নীরার দিকে তাকাচ্ছে।
অভিক নীরার দিকে একটা কাগজ এগিয়ে দিয়ে বলে,
‘এটা নাও। এখানে আমাদের কোম্পানির সব ক্লায়েন্টের নাম্বার, অ্যাড্রেস প্রিন্ট করা আছে। তোমাকে একটা সিম দিচ্ছি। এটা মোবাইলে ঢুকিয়ে নাও, আর সব নাম্বার সেভ করে রাখো।’
অভিক নীরাকে একটা সিম দিল। নীরা চটজলদি সেটা ফোনে ঢুকিয়ে সবার নাম্বার সেভ করে নিল। অভিক আর একটা কাগজ এগিয়ে দিয়ে বলে,
‘এটা দেখো, এখানে আমরা কার কাছ থেকে টাকা পাই, আর কে/কারা আমাদের কাছ থেকে টাকা পায় সেগুলোর ডিটেইলস দেওয়া আছে। তুমি চেক করে আমাকে বলবে। সাথে এটাও খেয়াল রাখবে যে কার সাথে কখন মিটিং আছে।’
অভিক নীরাকে কাজ বুঝিয়ে দিয়ে অফিস থেকে কিছুক্ষণের জন্য বেরিয়ে গেল। নীরা সব কিছু বুঝে নিচ্ছে, কেউ টাকা পায়না ওদের কোম্পানির কাছে, বরং ওরাই অন্যদের কাছে পায়।
.
অভিক আসে লাঞ্চের সময়। কেবিনে ঢুকে দেখে নীরা কাঁদছে। অভিক অস্থির হয়ে উঠে। ফর্সা গালদুটো লাল হয়ে গেছে। অভিক নীরার কাছে গিয়ে বলে,
‘কি হয়েছে? কাঁদছ কেন?’
নীরা ঠোঁট উল্টিয়ে বলে,
‘খিঁদে পেয়েছে।’
অভিক বলে,
‘তো ক্যান্টিনে যাও। এভাবে বোকার মতো কাঁদছ কেন?’
নীরা অভিকের দিকে তাকিয়ে বলে,
‘আপনার জন্যই তো যাইনি। যদি এখানে না দেখে কিছু বলেন?’
অভিক হাসে। নীরা বোকার মতো অভিকের দিকে তাকিয়ে আছে। অভিক বলে,
‘তুমিতো দেখছি একদম বাচ্চা। আচ্ছা যাও খেয়ে এসো। আচ্ছা থাক যেতে হবে না। আমি তোমার জন্য খাবার নিয়ে আসছি।’
অভিক নীরার জন্য খাবার নিয়ে আসবে এটা নীরা কল্পনাও করতে পারেনি। অভিক দু প্লেট খাবার নিয়ে আসে। একটা নিজের জন্য আর একটা নীরার জন্য। অভিক চামুচ দিয়ে খাচ্ছে, আর নীরা হাত দিয়ে। অভিক খেয়াল করে নীরা হাত দিয়ে খাচ্ছে। হাত দিয়ে খাবার খায়না অভিক। নীরাকে দেখে সে নিজেও হাত ধুয়ে হাত দিয়ে খাবার খাওয়া শুরু করলো। নীরা তা দেখেই অবাক।
.
অফিস ছুটি শেষে নীরা রিক্সার জন্য দাঁড়িয়ে ছিল। অভিক তখন গাড়ি নিয়ে নীরার সামনে আসে।
‘উঠো, তোমাকে পৌঁছে দেই।’
নীরা বলে,
‘আপনার সাথে যাওয়ার ইচ্ছে আমার নেই। আপনি আপনার রাস্তা মাপুন।’
অভিক চড়া গলায় বললো,
‘বেশি সাহস পেয়েছ না? যাবে না বললেই তো হয়। ত্যাড়া ত্যাড়া কথা বলো কেন? একদিন তোমাকে এর উচিৎ জবাব দিবই।’
অভিক রেগে গাড়ি নিয়ে চলে যায়। নীরা মনে মনে বলে,
‘একেই তো চরিত্রের ঠিক নেই। আবার বলে কিনা আমাকে পৌঁছে দিবে। যত্তসব।’
নীরা একটা রিক্সা নিয়ে আশ্রমে চলে যায়।
চলবে…