#তুমি_আমার_অভিমান❤
|| পর্ব – ২৫ ||
#লেখনীতে_বিবি_জোহরা_ঊর্মি
শীতের সকাল। শীতের সকালে মাঠ ঘাট সাদা কুয়াশার চাদরে ঢেকে যায়। শিশিরে ভেজা মাঠের ঘাস, গাছের পাতা সব থরথর করে কেঁপে ওঠে উত্তরের হাওয়ায়। কুয়াশা ভেদ করে অবিরাম সূর্য যখন জ্বলে তখন প্রকৃতি ভিন্ন রূপ ধারণ করে।
মাত্র ঘুম থেকে উঠেছে নীরা। কম্বল দিয়ে বাবুর শরীর ভালোভাবে চাপা দিয়ে রাখে৷ ঠান্ডায় কাঁপছে শরীর। অজু করে নামাজ পড়ে নিল সে। সূর্য এখনো উঠেনি। কিছুক্ষণ কোরআন তেলোয়াত করে নিজেও বাবুর সাথে কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লো।
সকাল আটটা বেজে দু মিনিট। নীরা শোয়া থেকে উঠে ফ্রেশ নিল। বাবুর জন্য খাবার রেড়ি করে তাকে খাইয়ে দিল। বাবুকে ঘুম পাড়িয়ে নিজে ব্রেকফাস্ট করে নিল। তারপর রেড়ি হয়ে অফিসের উদ্দেশ্যে বের হয়ে গেল। নীরা পুরো বাসায় সিসি ক্যামেরা লাগিয়ে রেখেছে। তাই আর বেশি ভয় নেই বাবুকে নিয়ে। অফিসে বসে সব দেখে বাবু কি করছে না করছে। সার্ভেন্টরা তাকে ঠিকভাবে দেখছে কিনা।
.
অফিসে বসে নীরা ম্যানেজারের সাথে কথা বলছে। তাদের নতুন প্রজেক্ট নিয়ে আলোচনা করছে। কিছুদূর কথা এগুতেই অফিসের নিচতলা থেকে বেশ শোরগোল শোনা গেল৷ নীরা আর ম্যানেজার দুজন দুহনের দিকে একবার তাকালো। তারপর দুজনেই ছুটলো নিচতলায়। সেখানে গিয়ে দেখে ফায়াজ আর তার দলবল এসে উপস্থিত। নীরা ভেবে পাচ্ছেনা এরা কেন এসেছে এখানে। ফায়াজ তো নিজের মুখেই স্বীকার করেছে সে অভিক নয়। তাহলে অভিকের অফিসে আসার কি মানে দাঁড়ায়?
ফায়াজ মাস্ক পড়ে এসেছে। নীরা এক ঝলকেই ফায়াজকে চিনে ফেলল। ম্যানেজারসহ বাকিরাও চিনেছে। কিন্তু ফায়াজের মুখ সরাসরি কেউ দেখেনি। নীরা বিরক্ত হলো। ফায়াজকে সরাসরি জিজ্ঞেস করলো।
‘কি চাই আপনার?’
ফায়াজ তার রিভালবার হাতের মধ্যে ঘুরাত্র ঘুরাতে বলল,
‘চাই তো অনেক কিছুই। দিবেন?’
নীরা বেশ রেগে গেল। ত্যাড়া কথা বলা মানুষকে একদমই ভালো লাগে না নীরার। ফায়াজকে তার কেবিনে আসার কথা বলল নীরা।
.
ফায়াজ নীরা আর ম্যানেজার বসে আছে নীরার কেবিনে। নীরা নিরবতা ভেঙে বলে,
‘কি জন্য এসেছেন বলুন।’
ফায়াজ বলে,
‘শুনলাম উত্তরার জমিটা আপনি নিয়েছেন? ওটা তো আমার জমি।’
‘আপনার কাছে কোনো লিগ্যাল পেপার আছে? যা ইচ্ছা তাই বলে যাবেন আর আমি বিশ্বাস করবো?’
‘আপনি ওটা নিতে পারবেন না। ওটা আমার পছন্দ হয়েছে।’
‘শাটআপ। আমি আপনাকে কিছুতেই ওই জমি দিবনা।’
‘ফায়াজের যেখানে একবার চোখ পড়ে তা ফায়াজের হয়েই ছাড়ে। সেটা কোনো জিনিস হোক কিংবা নারী।’
‘হোয়াট!’
নীরা এক থাবা দিল টেবিলের উপর৷ ফায়াজ মাস্ক খুলে সিগারেট ধরালো। লম্বা টান দিয়ে সিগারেটের ধোঁয়া উড়াচ্ছে সে। নীরা শ্বাসকষ্ট হতে থাকে। নীরা ভাবছে, নীরার শ্বাসকষ্ট দেখে হয়তো ফায়াজ সিগারেট ফেলে দিবে। কিন্তু না। ফায়াজ মনের সুখে সিগারেট টান দিতে থাকে। নীরার শ্বাসকষ্ট ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে। কাশতে কাশতে নীরা ফায়াজকে বলে,
‘সিগারেট খাওয়া বন্ধ করুন প্লিজ৷ আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছিনা।’
ম্যানেজার ফায়াজকে দেখে চমকে যায়। সত্যি অভিকের মতো দেখতে। সে নীরার কন্ডিশন দেখে নীরাকে কেবিন থেকে সোফায় বসায়। ফায়াজ এখনো ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে সিগারেটে ফুক দিচ্ছে। ম্যানেজার তখন বলে,
‘মিস্টার ফায়াজ! আপনি দেখছেন না ম্যাম নিঃশ্বাস নিতে পারছেনা। তাও কেন আপনি এসব করছেন? কেন সিগারেটটা ফেলছেন না?’
ফায়াজ সিগারেট শেষ করে ম্যানেজারের দিকে তাকিয়ে বলে,
‘কার কি হলো না হলো সেদিকে চোখ দেওয়ার সময় আমার নেই।’
নীরা নিজেকে কন্ট্রোল করে উঠে দাঁড়িয়ে বলে,
‘মিস্টার ফায়াজ চৌধুরী। আপনি হয়তো ভুলে যাচ্ছেন এটা আমার অফিস। আমার অফিসে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাওয়ার অধিকার কে দিয়েছে আপনাকে? এক্ষুণি বেরিয়ে যান আমার অফিস থেকে।’
ফায়াজ বাঁকা হেসে চোখে সানগ্লাস লাগিয়ে বলে,
‘কাউকে হুটহাট করে জড়িয়ে ধরা কোন দিক দিয়ে ভদ্রতা মিস নীরা? কাল আপনি আমাকে হুট করে জড়িয়ে ধরেছেন। আজ এতো বিরক্ত লাগছে কেন আমাকে?’
‘আমি যাকে ভেবে আপনাকে জড়িয়ে ধরেছিলাম সেটা আপনি নন। তার ধারে কাছেও আপনি আসতে পারবেননা মিস্টার ফায়াজ।’
‘অহ হো। তার নাম কি যেন? অহ হ্যাঁ! অভিক! বেচারা! নিজের ওয়াইফ কে রেখে কোথায় মাস্তি করতে চলে গেল।’
‘জাস্ট শাটআপ মিস্টার ফায়াজ৷ অভিক কেমন আমি তা ভালো করেই জানি। আপনি আমাকে ওকে চেনাতে আসবেন না। আর আপনি অভিকের মতো দেখতে হলেও অভিক নন। অভিক কিছুতেই আমাকে অবহেলা করতো না। অভিক আমার সামনে বসে সিগারেট খেতে পারতো না। আমার কপালে বন্দুক ধরতে পারতো না। আপনি একটা গুন্ডা। চলে যান এখান থেকে।’
‘ওয়েল মিস নীরা৷ আমি কিন্তু ছাড়ছিনা। না ওই জমি আর না আপনাকে। বললাম না, আমার যেখানে চোখ পড়ে সেটা আমার হয়েই ছাড়ে।’
ফায়াজ মুখে মাস্ক লাগিয়ে চলে গেল৷ নীরা শ্বাসকষ্ট হওয়ার ঔষধ খেয়ে নিল। চোখ বন্ধ করে সোফায় বসে পড়লো। অনেক্ক্ষণ বসে থাকার পরে ওর শ্বাসকষ্ট কমে যায়।
.
সন্ধ্যার দিকে বাসায় ফিরে নীরা আরেকদফা চমকে যায়। ফায়াজ তার বাসায় এসে সোফায় বসে আছে। হাতে থাকা রিভালবার দিয়ে কপাল চুলকাচ্ছে। সঙ্গে তার লোকজন। নীরা দরজায় দাঁড়িয়ে পড়লো। সার্ভেন্ট দুটোকে আটকে রেখেছে তারা। নীরার হঠাৎ মনে পড়লো শুভ্রর কথা। নীরা চৌকাঠ পেরিয়ে ভিতরে ঢুকে। ফায়াজ নীরাকে দেখেই মুচকি হেসে বলে,
‘ওয়েলকাম মিস নীরা। আপনার অপেক্ষাই করছিলাম।’
‘আপনারা কি করছেন এখানে? ওদের আটকে রেখেছেন কেন?’
‘কুল৷ এতো হাইপার হলে চলে?’
‘আমার শুভ্র! শুভ্র কোথায়?’
নীরা চিৎকার দিয়ে উঠে। অমনি শুভ্রর কাঁন্নার আওয়াজ সবার কানে আসে। শুভ্রকে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়েছিল সার্ভেন্টরা। এখন উঠে গেছে। নীরা দৌড়ে উপরে চলে যায়। শুভ্রকে কোলে নিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে। তারপর নিচে নেমে আসে।
‘আপনি কি চান?’
‘আপনাকে চাই।’
‘কিহ?’
‘অহ স্যরি! আপনার ওই জমিটা চাই।’
‘পাবেননা। আমি নিজের উপার্জনে ওটা কিনেছি। আপনি ফ্যাক্টরি করবো ওখানে।’
‘আমি আপনাকে ভালো দাম দিব।’
‘লাগবে না।’
‘তাহলে তো আমাকে আমার কাজ করতেই হয়।’
‘কি করবেন আপনি?’
ফায়াজ তার লোকদের ইশারা করে। লোক দুটো নীরার কাছে গিয়ে শুভ্রকে নিয়ে টানাটানি করে।
‘ছাড়ুন আমার বাচ্চাকে। ছিঃ শেষমেষ না পেরে একটা বাচ্চাকে টানছেন?’
নীরার কাছ থেকে শুভ্রকে নিয়ে ওরা ফায়াজের কাছে আসে। নীরার দু’চোখ পানিতে ভেসে যায়। লোকগুলো ফায়াজকে বলে,
‘বস, এই নিন বাচ্চাটাকে।’
নীরা ভাবছে, ফায়াজ যদি অভিক হয় তাহলে নিশ্চয়ই নিজের বাচ্চাকে একবার হলেও ছুঁয়ে দেখবে। কিন্তু না। ফায়াজ উল্টো নাক ছিটকিয়ে বলে,
‘আমার কাছে দিচ্ছিস কেন? আমি বাচ্চা পছন্দ করিনা।’
নীরার এই আশাটাও শেষ হয়ে যায়। কিন্তু নীরা হাল ছাড়ে না। এটাই যে অভিক নীরা তা আজীবন বিশ্বাস করবে।
‘আমার বাচ্চাকে দিন। লজ্জা করে না? একজন মায়ের কাছ থেকে তার সন্তানকে কেড়ে নিচ্ছেন?’
‘আপনি আগে এই পেপারে সাইন করে দিন মিস নীরা। তারপর আপনার বাচ্চাকে আপনার কাছে দিয়ে দিব।’
নীরা কাঁদছে। ফায়াজের নিকট একটুখানি তাকিয়ে বলে,
‘আপনি এতো নিষ্ঠুর কেন?’
‘আমি এমনই। নিন সাইন করে দিন।’
নীরা পেপারে সাইন করে দেয়। ফায়াজ মুচকি হেসে বলে,
‘থ্যাঙ্কিউ মিস নীরা। আপনি জানেন আপনি কিসে সাইন করেছেন?’
নীরা অবাক হয়ে তাকিয়ে বলে,
‘কিসে?’
‘এটা একটা কন্ট্রাক্ট পেপার। আপনাকে আমার সাথে থাকতে হবে।’
‘পাগল হয়ে গেছেন আপনি? কি যা তা বলছেন? আমি বিবাহিত!’
‘আই ডোন্ট কেয়ার! আপনাকে আমার ভালো লেগেছে।’
‘মিস্টার ফায়াজ! আপনি কিন্তু লিমিট ক্রস করছেন। আমার দূর্বলতার সুযোগ নিয়ে আপনি আমাকে এমন একটা পেপারে সাইন করিয়েছেন এর সম্পর্কে আমি অবগত নই।’
ফায়াজ লোকদের বলে শুভ্রকে সার্ভেন্ট এর কোলে দিতে। তারপর লোকগুলো চলে গেলে ফায়াজ নীরার কাছে এসে বলে,
‘খুব শীগ্রই দেখা হবে মিস নীরা।’
‘সামনে থেকে সরুন!’
ফায়াজ হাসতে হাসতে চলে যায়। নীরা শুভ্রকে কোলে নিয়ে বুকে চেপে ধরে। খুব শীগ্রই ফায়াজকে অভিক রুপে নিয়ে আসবে নীরা। ফায়াজ যাই বলুক না কেন।
চলবে…