#তুমি_আমার_অভিমান❤
|| পর্ব – ২২ ||
#লেখনীতে_বিবি_জোহরা_ঊর্মি
কিভাবে যেন এক মাস কেটে গেল। নীরার সারাটা দিন কাটে রান্নাবান্না করে, টিভি দেখে। আর অভিকের সারাটি দিন কাটে অফিস করে। বিকেল থেকেই দুজন একসাথে হয়। তারপর সারারাত গল্প করা, হাতে হাত রাখা, পাশাপাশি বসে চাঁদ দেখা, খুনসুটি আর ভালোবাসার মধ্যে দিয়ে কেটে যায়। এখন আর নীরা একা একা ভয় পায়না। বাসার বাইরে সিসি ক্যামেরা লাগিয়ে দিয়েছে অভিক।বেডরুমে লাগাতে চেয়েছিল। কিন্তু নীরার কড়া নিষেধ। তাই অভিকও বাড়াবাড়ি করেনি। এভাবেই কেটে যাচ্ছে দিন।
নীরা ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে মাথা আছড়াচ্ছে। অভিক মাত্রই অফিসে গেল। যাওয়ার সময় নীরার কপালে ভালোবাসার পরশ দিয়ে যায়। ভালোবাসি কথাটা বলতে ভুলে যায় না। অভিকের পাগলামি দেখলেই নীরার হাসি পায়। সাথে ভালো লাগে অনেক। একদিন ভালোবাসি না বললে নীরার দিনই ভালো কাটে না। রোজ রোজ অভিককে ভালোবাসি বলতেই হবে। নীরা চুল বেধে শাড়ি ঠিক করছিল। হঠাৎ করেই ওর মাথাটা ঘুরে উঠে। নীরা মাথায় হাত দিয়ে রাখে। চোখ মেলেও তাকাতে পারছে না। মনে হচ্ছে রুমটা ঘুরছে। ভেতর থেকে কেমন যেন করে উঠছে। নীরা ওয়াশরুমে তাড়াতাড়ি যায়। গড়গড় করে বমি করে দেয়। চোখে মুখে পানি দিয়ে রুমে আসে ও। কিছুক্ষণ শুয়ে থাকে। কি হলো কিছুই বুঝতে পারলো না সে। এখন তো আর কিছুই টেস্ট করতে পারবে না। করতে হলে কাল সকালে। নীরা চিন্তায় মগ্ন হয়ে আছে।
বিকালের দিকে অভিক যখন বাসায় আসে দেখে নীরা ঘুমিয়ে আছে। অভিক নীরাকে জাগায় না। নিজের ড্রেস চেঞ্জ করে ফ্রেশ হতে চলে যায়।
ফ্রেশ হয়ে এসে দেখে নীরা এখনো ঘুমে আছে। অভিক একটা টি-শার্ট আর একটা থ্রি কোয়াটার পেন্ট পড়ে নিল। টাওয়াল দিয়ে চুল মুছে বারান্দায় শুকাতে দিয়ে আসে। তারপর নীরার পাশে এসে বসে। আস্তে আস্তে নীরাকে ডাকতে থাকে।
‘নীরা। উঠো না। আর কত ঘুমিয়ে থাকবা?’
অভিকের ডাকে নীরা নড়ে চড়ে উঠে। অভিক নীরার কপালে একটা চুমু এঁকে দেয়। নীরা ধীরে ধীরে চোখ খুলতে থাকে। পিটপিট করে চোখ খুলে অভিককে দেখতে পায় নীরা। কিন্তু শরীর এতো দূর্বল যে সে চাইলেও উঠতে পারে না। ঘুমুঘুমু চোখ নিয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘কয়টা বাজে?’
অভিক ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময় দেখে নীরাকে জবাব দেয়।
‘সাড়ে পাঁচটা।’
নীরা অভিকের হাত ধরে বলে,
‘একটুও জোর নেই জানেন। আমার হাত ধরে একটু উঠাবেন?’
নীরার কথায় অভিক অস্থির হয়ে যায়।
‘কি হয়েছে? শরীর খারাপ? ব্যথা করছে? বলো না।’
‘তেমন কিছুনা। ওই একটু মাথা ঘুরছে। আর দুপুরেও খাইনি।’
‘কিহহ। তুমি খাওনি? নীরা তুমি এতো বেখেয়ালি কেন?’
‘আরে, আপনি এতো অস্থির হয়ে যাচ্ছেন কেন? কিচ্ছু হয়নি তো।’
‘তুমি শুয়ে থাকো। আমি তোমার জন্য খাবার নিয়ে আসছি।’
অভিক দ্রুত কিচেনে যায়। দেখে রান্নাবান্না কিছুই হয়নি। তার মানে নীরা সারাদিন না খেয়ে ছিল? অভিক চট জলদি আটা ধরে। তিনটি পরোটা বানিয়ে নেয়। তারপর দুটো ডিম একসাথে ভেজে উপরে নিয়ে আসে। নীরাকে উঠিয়ে খাইয়ে দিতে থাকে। কিন্তু নীরার গন্ধ লাগে। সহ্য করতে না পেরে বমি করে অভিকের টি-শার্ট ভরিয়ে ফেলে। অভিক নীরাকে শুইয়ে নিজের টি-শার্টটা খুলে ছুড়ে ফেলে দেয়। নীরা চোখ মেলেও তাকাতে পারছেনা। অভিক ভিষণ ভয় পেয়ে যায়। অভিক আর এক মুহুর্ত দেরি না করে জামা কাপড় চেঞ্জ করে নেয়। নীরার চোখে মুখে পানি দেয় অভিক৷ তারপর নীরাকে কোলে নিয়ে নিচে নেমে গাড়িতে বসায়। তারপর গাড়ি স্টার্ট করে হাসপাতালের দিকে রওনা হয়।
বেশ কিছু সময় নিয়ে নীরাকে চেকাপ করেন একজন মহিলা ডাক্তার। উনি অভিকের কাছে এসে বলেন।
‘ভয় পাবেন না। আপনাদের ঘরে নতুন অতিথি আসতে চলেছে। স্ত্রীর যত্ন নিবেন। খাবারের রুটিন দিয়ে দিচ্ছি।’
অভিক ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করে,
‘বুঝিনি ডক্টর।’
‘আল্লাহ! আপনি কি বাংলা ভাষা বুঝেন না? আপনি বাবা হতে যাচ্ছেন।’
এ কথাটা শুনে অভিকের মনে একটা অন্যরকম অনুভূতি হয়। বাবা হওয়ার অনুভূতি। একটা পুচকে আসবে। তার ছোট ছোট হাত পা হবে। আদো আদো বুলিতে বাবা বলে ডাকবে তাকে। এই দৃশ্য সে দেখতে চলেছে?
নীরাকে নিয়ে বাসায় ফিরতে রাত হয়ে গেল অভিকের। বাসায় এসেই নীরাকে খাইয়ে দিয়েছে সে। তারপর ঔষধ খাইয়ে নীরাকে শুইয়ে দেয়। নীরার মন খারাপ। অভিক গিয়ে নীরার পাশে শুয়ে পড়ে। নীরাকে নিজের দিকে ফিরিয়ে বলে,
‘কি হলো? মন খারাপ কেন?’
‘ভেবেছিলাম সকালে টেস্ট করে সিউর হয়ে আপনাকে সারপ্রাইজ দিব। কিন্তু আপনি আমার প্ল্যান এর বারোটা বাজিয়ে দিয়েছেন। কি দরকার ছিল ডাক্তারের কাছে যাওয়ার?’
‘তোমাকে নিয়ে আমার কতটা ভয় লাগে তুমি জানো না? তাইতো নিয়ে গেলাম।’
নীরা অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে রাখে। অভিক নীরাকে টেনে আবারও নিজের দিকে ফেরায়।
‘ছাড়ুন আমায়। ভালো লাগে না।’
‘আহারে আমার বউটা রাগ করেছে। আচ্ছা স্যরি। এবারের মতো ক্ষমা করে দাও।’
‘নাহ্।’
‘কি মুসকিল।’
‘কষ্ট পেয়েছি।’
অভিক বাঁকা হেসে নীরার গালে আলতো করে চুমু দেয়। তারপর নীরার ঠোঁটে নিজের ঠোঁট ছোঁয়ায় সে। নীরা ধাক্কা দিতেই দূরে সরে যায় অভিক।
‘দিলে মুডটা নষ্ট করে।’
‘একদম কাছে আসবেন না আপনি। অসভ্য লোক একটা।’
অভিক নীরার কথা শোনে না। সে ইচ্ছে করেই নীরার কাছে আসে। নীরার পেটের উপর থেকে শাড়ি সরিয়ে তার উপর হাত রাখে সে। নীরা কেঁপে উঠে। অভিক নীরার দিকে তাকিয়ে বলে,
‘এখানে আমাদের সন্তান আছে। আমার যে কি খুশী লাগছে নীরা তোমায় বলে বুঝাতে পারবো না। খুব যত্ন নিব তোমার আর আমাদের সন্তানের। আচ্ছা বলতো কি হবে?’
‘আমি জানিনা।’
‘আরে, এখনো রাগ? বলোনা প্লিজ!’
‘ছেলে হবে।’
‘উঁহু মেয়ে হবে। ঠিক তোমার মতো।’
‘না, ছেলেই হবে।’
‘মেয়ে হবে।’
‘আমি চাই ছেলে হোক। আর তার নাম…’
‘তার নাম? কি নাম রাখবে নীরা?’
‘শুভ্র!’
অভিক এক মুহুর্ত চুপ থাকে। তারপর নীরাকে ঝাপটে জড়িয়ে ধরে। চোখ দিয়ে কয়েক ফোটা পানি বের হয়ে গেছে ওর।
‘কাঁদছেন কেন? পুরুষ মানুষ কাঁদে নাকি?’
‘আমার জন্য আমি শুভ্রকে হারিয়েছি নীরা। আমি নিজেকে কখনোই ক্ষমা করতে পারবো না।’
‘আপনি কেন নিজেকে দায়ী করছেন? ওটা একটা অ্যাকসিডেন্ট।’
‘নীরা, আমি যদি কখনো হারিয়ে যাই তাহলে তুমি কি পারবে শক্ত হয়ে একা চলতে?’
‘এসব কি বলছেন? কোথায় যাবেন?’
‘আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দাও। আমি যদি নাও থাকি, তাহলে তুমি কি পারবে শক্ত হয়ে থাকতে? আমার ব্যবসার হাল ধরতে? নিজেকে সুস্থ রাখতে?’
নীরা অভিকের শার্ট খামছে ধরে শক্ত করে।
‘প্লিজ অভিক। এসব বলবেন না। আমি পারবো না। আমি কিচ্ছু চাইনা। আমি শুধু আপনাকে আমার পাশে চাই। প্রতিটি দিন আপনাকে আমার পাশে চাই অভিক। আপনি ছাড়া আমি শূন্য। আমি নিঃস্ব। প্লিজ এসব বলবেন না। খুব ভালোবাসি আপনাকে।’
‘আমিও খুব ভালোবাসি।’
অভিক নীরার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। নীরা এর কিছুক্ষণ পরই ঘুমিয়ে যায়। কিন্তু অভিকের ঘুম আসেনা। অভিক ততদিন ঘুমাবে না। যতদিন শুভ্রর খুনীকে শাস্তি দিচ্ছে।
চলবে…