#তুমি_আমার_অভিমান❤
|| পর্ব – ১৪ ||
#লেখনীতে_বিবি_জোহরা_ঊর্মি
এতক্ষণে আশ্রমে শোরগোল পরে গেল। বিয়ের কনে পালিয়েছে। তাও আবার দুজন বোরকা পরা মেয়ের সাথে। তারা কেউই বর পক্ষের ছিল না। মিথ্যা পরিচয় দিয়ে কনের রুমে ঢুকেছে, এরপর তাকে নিয়ে পালিয়েছে। একথা বর পক্ষের লোকেরা জানতে পেরে নীরার মাসিকে অনেক কথা শুনিয়ে আশ্রম থেকে চলে গেল। এদিকে নীরার মাসি ভাবছে, নীরা কার সাথে পালাবে? আর ওরাই বা কারা ছিল?
.
বেলা তখন তিনটা বেজে পয়ত্রিশ মিনিট। একটা বড় রেস্টুরেন্ট বুক করেছে অভিক। সবাই মিলে ওখানে দুপুরের খাবার খাচ্ছে। বিয়ে পড়ানো হয়েছিল দুপুর একটায়। তারপর বাকি কাজগুলো করতে করতেই দু ঘন্টা পেরিয়ে যায়। সকালে যা খাওয়ার খেয়েছে। এরপর কারো পেটে দানা পানিও পরেনি।
ফাহাদ, প্রীতি, শুভ্র ও তার দুই ফ্রেন্ড, নীরা আর অভিক এরা একাই ওই রেস্টুরেন্টে আছে। নতুন বউকে তার বর খাইয়ে দিচ্ছে, এরচেয়ে সুন্দর দৃশ্য আর কি হতে পারে? সবাই নীরা আর অভিকের দিকে তাকিয়ে আছে। শুভ্র মুচকি হেসে ছবি তুলছে। নীরার লাজুক চেহারাটার দিকে অভিক তাকিয়ে আছে। কি মায়া এই মেয়েটার চেহারায়। খেতে খেতে শুভ্র বলল,
‘প্রথমদিন নীরাকে দেখেই আমার খুব ভালো লেগেছিল। অবশ্য সবারই লাগার কথা। নীরা এতো সুন্দরী!’
অভিক শুভ্রর দিকে রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে৷ সবাই হাসতে থাকে। নীরা চোখ বড় বড় করে শুভ্রর দিকে তাকিয়ে আছে। শুভ্র ঢোক গিলে বলে,
‘আরে, এভাবে তাকাশ না ভাই৷ নীরা তোর জেনেই তো আগাইনি। নাও শি ইজ মাই সিস্টার।’
ফাহাদ হেসে বলে,
‘ইয়াহ! নীরা তো আমাদের বোনই। হসপিটালে যখন আমাকে ভাইয়া ভাইয়া বলে ডাকছিল, তখন সত্যিই নীরাকে আমার বোন মনে হচ্ছিল। আমার একটা বোন নেই। নীরাকে সেদিন থেকেই আমি আমার বোন মনে করি। আর শোন অভিক। আমার বোনকে তুই কষ্ট দিবি না। নইলে তোর খবর আছে।’
অভিক খেতে খেতে বলে,
‘এত প্ল্যান করে, কাঠ খড় পুঁড়িয়ে; বিয়ে করেছি কি কষ্ট দেওয়ার জন্য? কোনো কষ্টই ছুঁতে দেবনা।’
ফাহাদ খেয়ে মুখ মুছতে মুছতে বলে,
‘তোর মাথার টুপিটা কই রে?’
‘আরে ছবি তোলার সময় পাঞ্জাবির পকেটে রেখেছি এখনো পরা হয়নি।’
প্রীতি সবার উদ্দেশ্যে বলে,
‘তোমরা তোমরাই কথা বলছ, নতুন বউকে কিছু বলতে দাও।’
‘ও আর কি বলবে। ও তো কেঁদে কেঁদে লাশ হয়ে গেছে দেখছ না? শোণ, আজকে আমরা সবাই রিক্সা নিয়ে আমার বাসায় যাবো। খেয়ে নাও।’
শুভ্র একটু চিন্তা করে বলে,
‘সন্ধ্যা পেরিয়ে যাবে। অনেক লেইট হবে দোস্ত।’
অভিক বলে,
‘হোক! আমার প্রব্লেম নেই।’
রেস্টুরেন্ট থেকে ওরা সবাই রিক্সা করে অভিকের বাসার উদ্দেশ্যে বের হয়। রিক্সা চারটা নিয়ে ওরা খোলা আকাশের নিচে এই মুহুর্তটাকে উপভোগ করছে। ফাহাদ গান গাইছে পিছন থেকে, আর বাকি সবাই হাততালি দিচ্ছে। শুভ্র একাই একটা রিক্সায় বসেছে। বাকি গুলোয় দুজন করে। শুভ্র যতটুকু দেখা যায় ক্যামেরা বন্দী করছে। অভিক নীরার হাতটা শক্ত করে ধরে রাখে। নীরা তার ক্লান্ত শরীরের সমস্ত ভর অভিকের কাঁধের উপর দিয়ে দিয়েছে। অভিক মুচকি হেসে নীরাকে জড়িয়ে নেয় পরম আবেশে।
কয়েক ঘন্টা পর ওরা অভিকের বাসার সামনে এসে পৌঁছায়। রিক্সা থেকে নেমে গেইট দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে। বাসার দরজার সামনে আসতেই অভিক নীরাকে কোলে তুলে নেয়। এটা দেখেই বন্ধু মহল জোরে চিৎকার দিয়ে উঠে। এদিকে নীরা লজ্জায় অভিকের পাঞ্জাবী খামচে ধরে আছে। শুভ্র ভিডিও করতে থাকে। শুভ্র ভিডিও করতে করতে আগে যাচ্ছে, অভিক নীরাকে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠছে। শুভ্রর উল্টো হাটতে কষ্ট হচ্ছে, কিন্তু সে নিজেকে সামলে নিয়ে অভিক আর নীরার ভিডিও করছে। অভিকের রুমে গিয়ে অভিক নীরাকে নামিয়ে দেয়। অভিকের রুমটা গোলাপ আর গাদা ফুল দিয়ে অনেক সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। ফুলের সুভাস চারিদিকে ছড়িয়েছে। অভিকের বিছানাটার দিক থেকে চোখ সরানোই যাচ্ছেনা। অসম্ভব রকমের সুন্দর। ফাহাদ বলে,
‘বাহ্ ভালোই তো বাসরঘর সাজিয়েছে দেখছি। দোস্ত আমরা চলে যাবো। আমাদের সম্মানিটা দে।’
অভিক পকেট থেকে ক্রেডিট কার্ডটা বের করে ফাহাদের হাতে দিয়ে বলে,
‘চিল কর।’
ওরা সবাই অভিকের রুম থেকে বেড়িয়ে পরে। অভিক আস্তে গিয়ে দরজা লক করে দেয়। তারপর ওয়ারড্রব খুলে একটা শাড়ি বের করে নীরার হাতে দিয়ে বলে,
‘ফ্রেশ হয়ে আসো। সারাদিন অনেক ধকল গেছে। ফ্রেশ হয়ে অজু করে আসো। তারপর আমি যাবো।’
নীরা কোনো কথা না বলে শাড়ি নিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়। যাওয়ার আগে জুয়েলারিগুলো খুলে যায়।
প্রায় আধা ঘণ্টা পর নীরা ফ্রেশ হয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হয়। নীরা বের হওয়ার সাথে সাথেই অভিক ফ্রেশ হতে চলে যায়। নীরা বেডের উপর বসে আছে চুপ করে।
পাঁচ মিনিট পর অভিক বেরিয়ে আসে। কালো একটা পাঞ্জাবি পরেছে অভিক। সাথে সাদা পায়জামা। অভিককে দেখেই নীরা উঠে দাঁড়ায়। অভিক নীরার সামনে এসে বলে,
‘আল্লাহর কাছে তোমায় চেয়েছিলাম, পেয়ে গেছি। এখন শুকরিয়া আদায় করবো দুজন মিলে। আল্লাহ যেন আমাদের আগামী দিনগুলো সুন্দর করে। আসো নামাজ পড়ি।’
নীরা আর অভিক একসাথে নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে দোয়া করে। অভিক উঠে নীরাকে বেড এ বসতে বলে। অভিক ডেসিং টেবিলের ড্রয়ার থেকে কি যেন একটা বের করে নিয়ে আসে। তারপর বেড এ বসে নীরাকে বলে,
‘হাতটা দাও।’
নীরা কাঁপা কাঁপা হাত অভিকের দিকে বাড়িয়ে দেয়। অভিক নীরার আঙুলে সেই ডায়মন্ডের রিংটা পরিয়ে দেয়। নীরার হাতের উল্টো পিঠে একটা চুমু দেয়। অভিক বলে,
‘নীরা, তুমি তাহলে শুয়ে পরো। অনেক ধকল গেছে তোমার উপর দিয়ে। আমার একটা কাজ আছে। সেটা সেড়ে আসবো। বায়।’
অভিক উঠে দরজার কাছে যেতেই পিছন থেকে নীরা ডেকে উঠে।
‘শুনুন।’
নীরার ডাকে অভিক পিছন ফিরে। নীরা চোখে টলমল পানি নিয়ে অভিকের দিকে দৌড়ে এসে অভিককে ঝাপটে জড়িয়ে ধরে। হুঁ হুঁ করে কেঁদে উঠে নীরা। অভিক তাজ্জব বনে যায়। কিন্তু নীরা কাঁদছে কেন সেটাই বুঝতে পারছেনা। নীরা কেঁদে কেঁদে বলে,
‘আমার কেউ নেই অভিক স্যার। প্লিজ আমায় ছেড়ে যাবেন না কখনো।’
অভিক নীরার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
‘আরে বোকা মেয়ে! কাঁদছ কেন? আমি তোমার পাশে সবসময়ই থাকবো।’
নীরা বলে,
‘আমার কপালে সুখ সইবে না অভিক স্যার। আমার আপনি ছাড়া কেউ নেই। আমাকে এভাবেই সারাজীবন ভালোবাসবেন তো?’
‘সারাজীবন তোমাকেই ভালোবেসে যাবো৷ এখন ঘুমাও তো।’
অভিক নীরার মাথাটা তার কাছ থেকে সরিয়ে নীরার কপালে একটা চুমু এঁকে দেয়। তারপর মুচকি হেসে রুমের বাইরে চলে যায়। নীরা চোখ মুছে ফুলে ফুলে সজ্জিত বিছানায় গুটিসুটি হয়ে শুয়ে পরে।
.
অভিক গাড়ি নিয়ে একটা হোটেলে যায়। রুম নাম্বার ১৭ হবে। সেখানে তার ম্যানেজারকে অন্য একটা কোম্পানির সাথে কথা বলতে দেখা যায়। অভিক সোজা সেখানে গিয়ে ম্যানেজার এর কলার চেপে ধরে।
‘ইউ লায়ার! আমার কোম্পানির গোপন তথ্যগুলো অন্য কাউকে দিতে তোর লজ্জা করলো না? প্রতারক।’
অভিক সবার সামনে ম্যানেজারকে মারতে থাকে। এই ম্যানেজার এর উপর তার অনেক দিনের সন্দেহ ছিল। আজ খবর পেয়েই তাকে শিক্ষা দিতে হাজির হয় অভিক। অভিক অনেক মেরেছে ম্যানেজারকে। অভিক তার অফিসে আসতে না করে দিয়েছে ম্যানেজারকে৷ অভিক বেরিয়ে যায় হোটেল থেকে। ধোকা জিনিসটা একদমই মেনে নিতে পারেনা অভিক। সে যে-ই করুক। তার শাস্তি অভিক দিবেই।
.
বাসায় এসে নিজের রুমে ঢুকে অভিক। বিছানার দিকে চোখ পড়তেই দেখে নীরা গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে। অভিক বাঁকা হাসে। ওয়াশরুম থেকে হাত মুখ ধুয়ে নীরার পাশে শুয়ে পরে। নীরা তখন গভীর ঘুমে আছন্ন। অভিক নীরাকে নিজের কাছে টেনে নেয়। নিজের বুকে নীরার মাথাটা রেখে নীরাকে জড়িয়ে ধরে অভিক। অভিকের মনে কতটা শান্তুি অনুভব হচ্ছে তা শুধু অভিকই জানে। চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করে অভিক। আজ তার শান্তির ঘুম হবে।
চলবে…