তুমি অতঃপর তুমিই
৩৪
Writer Taniya Sheikh
মুখোমুখি বসে আছে শান,সামিরা। সামিরার চোখ সরছে না শানের উপর থেকে। বার বার কপাল কুঁচকে আসছে। শান মনোযোগ হারাচ্ছে। চোখের সামনে ভেসে উঠছে ইমার ক্রন্দনরত মুখচ্ছবি। এক ছুটে ইমার কাছে চলে যেতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু সে উপায় যে নেই। মেজাজ প্রচণ্ড খারাপ হচ্ছে। অবশেষে সামিরা গলা ঝেড়ে বলল,
” আমার কারনে তুমি বিরক্ত হচ্ছ, তাই না শন?”
” হ্যাঁ, তাই। তোমার উচিত হয়নি কাল ড্রাঙ্ক হয়ে এখানে আসা৷ তুমি ভালো করেই জানো এসব একদম পছন্দ করিনা আমি।” রেগে বলল শান। সামিরা এমন একটা ভাব করল যেন সে অনুতপ্ত। এগিয়ে বসে শানের হাতটা ধরে নিচু গলায় বলল,
” আ’ম সরি শন।বিশ্বাস করো,,” শান হাত ছাড়িয়ে দাঁড়ায়। মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে বলে,
” ওসব বিশ্বাসের কথা তোমার মুখে মানায় না সামিরা।”
” মানে!” চমকে উঠে দাঁড়ায়। শান নিজেকে সংযত করে তৎক্ষণাৎ। কপালের একপাশ চেপে ধরে বলে,
” আ-আ’মিন তুমি তো জানো বিশ্বাস শব্দটা এখন আর এক্সিস্ট করে না আমার জন্য।”
” ওহ! সব ঐ ইমার কারনে৷ অযোগ্য পাত্রে কখনো ভালোবাসা দিতে নেই দেখলে তো। তোমার ভালোবাসা পাবার যোগ্য কেবল,,” সামিরার হাত শানের বুকের উপর। ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়াতেই সরে যায় শান। গম্ভীর গলায় বলে,
” আই থিংক ইউ শুড গো নাও।” শানের প্রত্যাখ্যানে আহত এবং ক্রোধিত হয় সামিরা। মনে মনে ইমাকে অজস্র খারাপ কথা বলে৷ ইমার কারনেই শানকে সে নিজের করতে পারছে না। তাউ বলে হাল ছাড়ার পাত্রী সে নয়। মাথা ব্যথার ভান ধরে কাউচে বসে গোঙায়,
” আহ!”
শান ভ্রুকুটি করে ঘুরে দাঁড়ায়।
” কী হয়েছে? ”
” ব্যথায় মাথাটা ফেটে যাচ্ছে। ভ’মিট হবে মনে হয়। ওয়াক,,ওয়াক।” সামিরা মাথা ধরে শানের রুমে ছুটে গেল। রাগে হাত মুঠ করে দাঁড়িয়ে রইল শান। এখান থেকে সামিরার বমি করার শব্দ শুনতে পেল। শান বুঝে নিয়েছে গতকালের মতো আজও সামিরা এখানে থেকে যাওয়ার প্লান করছে। কিন্তু শানকে সেটা রুখতে হবে। তার আগে ইমার সাথে কথা বলা প্রয়োজন। রাতে কতবার কল করেছে আন্সারই করল না। ইমার অভিমান সম্পর্কে পরিচিত শান। মনে মনে মৃদু হাসল ইমার গাল ফুলানো মুখটা ভেবে। খারাপ লাগল ইমা কষ্ট পাচ্ছে ভেবে। সতর্কে একবার রুমে দিকে তাকিয়ে মোবাইল নিয়ে চলে গেল গেষ্টরুমের দিকে।
সকাল আটটা বাজে অথচ ইমার ঘুম ভাঙার নাম নেই। আমেনা বেগম আশাকে নিষেধ করেছে ঘুম ভাঙাতে। বাচ্চাকে কোলে নিয়ে আশা তাই মায়ের রুমে গেছে। শান এবং নিজেদের সন্তানকে নিয়ে মিষ্টি একটা স্বপ্ন দেখছিল ইমা। হঠাৎ কোথা থেকে একটা দানবীয় নারী মূর্তি এসে ওদের বাচ্চা এবং শানকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। ইমা পাগলের মতো ছুটছে। শান, শান বলে চিৎকার করে বিছানায় উঠে বসে। আমেনা বেগম ছুটে আসেন। ইমার পাশে বসে বলেন,
” দুঃস্বপ্ন দেখেছিস মা?”
বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে ইমার কপালে। শরীর ভার ভার লাগছে। এখনো কাঁপছে সে। তাই সাথে সাথে জবাব দিতে পারল না। ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে রইল আমেনা বেগমের দিকে। আমেনা বেগম মাথায় হাত রেখে বিড়বিড় করে দুআ পড়ে ফু দিলেন। বললেন,
” বা’দিকে থু থু দিয়ে অজু করে নে।” ইমা ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে অজু করে এসে বসে। আমেনা বেগম গায়ে হাত বুলিয়ে বলেন,
“এসময় এমন দুঃস্বপ্ন আসে। আমিও দেখতাম। ভয় নেই। আল্লাহ ভরসা। শোয়ার সময় দোয়া পড়ে শুবি ডান কাত হয়ে। মনে দুঃশ্চিন্তা আনিস না,দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে।”
আমেনা বেগম বেরোতেই আশা হাসিমুখে রুমে ঢুকল। ইমার দিকে মোবাইল বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
” তুমি কী বলো তো ইমা ভাবি। আমার ভাইটা তোমার সাথে কথা বলতে না পেরে পাগল হয়ে যাচ্ছে আর তুমি আরামসে ঘুমাচ্ছিলে।”
ইমা মোবাইল না নিয়ে নিস্পৃহ কন্ঠে বলে,
” আমি কথা বলব না।” ইমা উঠে চলে যেতেই আশা পথ আগলে দাঁড়ায়।
” তোমাদের মান- অভিমানের মধ্যে আমি নাই। এই রেখে গেলাম মোবাইল, যা খুশি হয় করো।”
ইমার হাতে মোবাইল গুঁজে আশা মুচকি হেসে বেরিয়ে যায়। ইমা ওভাবেই দাঁড়িয়ে কাঁদে নিঃশব্দে। কিছুক্ষণ পর নিজেকে স্বাভাবিক করে মোবাইল কানে ধরে বলে,
” হুম,শুনছি।”
” হুম,শুনছি বলে এহসান করেছ। তোমার কাছে একটু বুদ্ধিমতির মতো আচরণ আশা করাই বৃথা। এতো বুঝানোর পরও তুমি একগুঁয়েমি করেই যাচ্ছ। গতকাল কতবার কল করেছি জানো? ”
” না, জানব কী করে? আমি তো বুদ্ধিমতি না,গাধি,বেক্কল সব। আমার মতো মেয়েকে নিয়ে পড়ে আছেন কেন তবে? বুদ্ধিমতি কাওকে খুঁজে নিন।” রাগে ফুঁসতে থাকে ইমা৷ শান ইমার নাক টানার শব্দ পেয়ে নিজেকে রাগ দমন করে। কঠিন ব্যবহার করায় অনুতপ্ত হয়।
” ইমা।” নরম গলায় ডাকে শান
” আমার নাম ধরে ডাকবেন না৷”
” আচ্ছা ডাকব না তোমার নাম। আমার বাবুর আম্মু! ”
” আমি আপনার বাবুর আম্মুও না। আমি আমার বাবুর আম্মু। আপনি অনেক খারাপ শান,অনেক।আপনার একটুও কষ্ট হলো না ওভাবে চলে যেতে। সারারাত আমি ঘুমাতে পারিনি। এক পৃথিবী শূন্যতা ঘিরে ধরেছে আমাকে। আমার কত কষ্ট হচ্ছে জানেন?”
” আমার বুঝি হচ্ছে না? আমিও কী গতরাতে ঘুমিয়েছি? সামিরা নেশা করে সারারাত বাসায় ছিল। তার মধ্যে তোমাকে আমি একটার পর একটা কল করেছি। কিন্তু তুমি তো নিজের কষ্ট ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাও না৷ আচ্ছা বাদ দাও এসব। আমারই ভুল। এখন বলো খেয়েছ সকালে?”
” না।”
” না! ক’টা বাজে ইমা? আমি তোমাকে কী বলে এসেছিলাম বলো?” চেঁচিয়ে ওঠে শান৷ ইমা নিচু গলায় বলে,
” মাত্র ঘুম থেকে উঠলাম।এখনই যাচ্ছি।”
” আমি কী করলে কথা শুনবে তুমি? বার বার বলেছি অনিয়ম করবে না তবুও করছ।” হতাশ শোনায় শানের গলা। ইমা বলে,
” সরি। আর এমন হবে না।”
শান চুপ করে আছে। ইমা আহ্লাদিত স্বরে বলে,
” বললাম তো সরি!”
” হু।”
” হু কী?”
” তোমার সরি চায়না মালের মতো। সহজ লভ্য কিন্তু স্থায়ীত্ব কম। ঐ সরি তোমার কাছেই রাখো আমার লাগবে না। যাও খেয়ে নাও।”
” খেয়ে আসলে কল করবেন তো?”
” পারব না।”
ওপাশে ইমার নীরবতায় শান বলে ওঠে,
” পারব না মানে, সামিরা এখনো বাসায়। ও গেলেই আমি চলে আসব। তারপর তোমার কী করি শুধু দেখবে।”
” ঐ শয়তান ছেরি এখনো আপনার বাসায় কী করে? লাথি দিয়ে বের করে দেন।”
” তোমার অপেক্ষায় বসে আছি তো৷ আসো আর লাথি দিয়ে বের করে দিয়ে যাও ওকে।”
” সত্যি! আসব আমি?”
” বেশি না জাস্ট একটা থাপ্পড় দিবো। যাও খেয়ে নাও।”
” কাইষ্টা। তুই জীবনে ভালো হবি না। সামিরাকে কোলে করে বসে থাক হারামি।”
” ইমা!” শান ধমকে উঠতেই ইমা ভেংচি কেটে কল কাটে। মুচকি মুচকি হেসে বেরিয়ে যায় ডায়নিং এর দিকে। প্রচণ্ড ক্ষুধা পেয়েছে। খাবার সামনে নিয়ে মনে পড়ল,শান খেয়েছে কি! ইমার খাওয়া হলো না ভালোমতো সেই চিন্তায়।
ইমরোজ সকালে বাসায় ফেরেনি। সোজা অফিসে এসে ফ্রেশ হয়ে চা-নাস্তা অর্ডার করে। সবে চায়ে চুমুক দেবে এমন সময় ইমার্জেন্সি কল আসে- মাহিব খানের বিভৎস লাশ পাওয়া গেছে। মাহিব খানের বাসা থেকে কয়েক মিনিটের দুরত্বে রাস্তার উপর পাওয়া গেছে একটি মেয়ের লাশ। ধারণা করা হচ্ছে বিষক্রিয়ায় তার মৃত্যু ঘটেছে। ইমরোজ চা-নাস্তা ফেলে ছুটে যায় ঘটনাস্থলে। যা ভেবে সারা রাস্তা ভয় পেয়েছে তাই হয়েছে। রাস্তার উপর মৌ-র নিথর দেহখানি দেখে ইমরোজ পাথর হয়ে গেল। দু-চোখ ভরে ছলছল। এক পা এক পা করে হাঁটু মুড়ে বসল মৌ-র লাশের পাশে। দু’হাতে মৌ-র মুখটা তুলে চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
” আমি তোমাকে ভালোবাসি মৌ। তোমার সবটা জানার পরও আমি নিজের মনকে তোমার থেকে ফেরাতে পারিনি। কেন এমন হলো আমার সাথে? কেন করলে এমন তুমি? আমার মন ভেঙে কী সুখ পেলে মৌ,বলো মৌ। কথা বলো,আমাকে ছেড়ে যেতে পারো না তুমি। এই মৌ।”
” স্যার!” কনস্টেবলের ডাকে সম্বিৎ ফেরে ইমরোজের। আগের জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে সে। চার পাঁচ হাত দুরুত্বে পড়ে থাকা মৌ-র শরীর সাদা কাপড়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। কনস্টেবল ইমরোজের চোখে জল দেখে বলল,
” আপনি কী চেনেন মেয়েটাকে?”
” না।” ইমরোজ একপলক সাদা কাপড়ে ঢাকা মৌর লাশের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে মাহিবের অ্যাপার্টমেন্টের দিকে দ্রুত পদে এগিয়ে গেল। বুকের ভেতর ভাঙচুর হচ্ছে। শরীর অসাড় অসাড় বোধ করছে। নিজের সাথে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ভাঙবে তবু মচকাবে না সে। আজ নিজেকেই অভিসম্পাত করে। কেন সেদিন মৌ-কে দেখেছিল? কেন নিয়ে এসেছিল বাসায়? কেনইবা এই ভালোবাসার জন্ম হলো? এতো কেন’র জবাব শূন্য।
চলবে,,,,