তুমি অতঃপর তুমিই পর্ব:-১০

0
2069

তুমি অতঃপর তুমিই
২৮
Taniya Sheikh

মৌটুসী এখানে আসার পর থেকেই শুয়ে শুয়ে বেলাটা কাটিয়ে দিল। বহুদিন পর শান্তির ঘুম এলো এই বিছানায় শুয়ে। বহুদিন পর মনে হলো মনুষ্য জীবনে আছে। আজকাল তো ভুলেই যায় ও মানুষ। মনে হয় রক্ত মাংসে গড়া এক পিশাচী। নোংরা শরীর,নোংরায় ঢাকা আগাগোড়া সে। অথচ চার বছর আগেও সে পবিত্র ভাবত নিজেকে,নিজের ছোঁয়া প্রতিটি ব্যক্তি, বস্তুকে। আজ নিজেকে যেমন ঘৃণা হয় তেমনি ঘৃণা হয় সবকিছুকে। কিন্তু এই বাসায় এসে ঘৃণাভাব দমে আছে। ভালো লাগছে ওর৷ ভালোলাগাটা বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। মোবাইল ভাইব্রেট হচ্ছে। মৌ জানে কার কল। একজনই তো কল করে ওকে,মাহিব৷ মোবাইল বালিশের তলে রেখে চুপচাপ চোখ বন্ধ করে পড়ে রইল। হঠাৎ কী ভেবে তড়িঘড়ি মোবাইলটা হাতে নিল। চোখ দু’টো লাল হয়ে এসেছে ওর৷ কণ্ঠস্বর স্বাভাবিক রেখে জবাব দিল,

” হ্যাঁ, জান বলো।”

” কোথায় তুমি?”

” এক মিনিট।” মৌ সতর্কে আশপাশে দেখে দরজা লাগিয়ে পুনরায় বিছানার কাছে এসে বলল,

” প্লান মোতাবেক আমি এখন ঐ পুলিশ অফিসারের বাসায়।”

” সত্যি! থ্যাংক গড, ইভরিথিং ইজ ওকে?”

” হ্যাঁ, কেন ভয় পাচ্ছ বুঝি?”

আজ কেন যেন হঠাৎ জেগে ওঠা প্রেমানুভূতির মিশ্রণে এই আবেগটা লুকাতে চাচ্ছে না মাহিব। স্বভাব বহির্ভূত ভাবে মৃদু হেসে বলল,

“তা তো হতেই হয়। হাজার হোক অর্ধাঙ্গিনী বলে কথা!”

” অর্ধাঙ্গিনী!” বেশ অবাক হলো মৌ। হৃদয়টা খানিক কাপল দমকা হাওয়ায় দোলা কলা পাতার ন্যায়। মাহিব অযাচিত আবেগটার লাগাম তো টানলই না বরং নিজেই সেই সাথে ভাসতে লাগল। তার ভালো লাগছে এসব ভাবতে,বলতে। সহজে নিজেকে প্রকাশ করার মানুষ সে নয়, হচ্ছেও না ঠিক। আবেগ প্রকাশে বড্ড আনাড়ি সে। অসংলগ্ন কথা বলতে আরম্ভ করল অতি আবেগে। বলল,

” অর্ধাঙ্গিনী মানেই কিন্তু সেই অর্ধাঙ্গিনী নয়। বিশ্বস্ত সঙ্গী, সহচরী। শামীমের পরে তুমিই তো আমার তেমন একজন। যাকে সহজে বিশ্বাস করতে পারি,ভরসা করতে পারি। সেই বিশ্বস্ত সঙ্গীর জন্য চিন্তিত হওয়াটা তো স্বাভাবিক, তাই না?”

মৌয়ের মাথা ধরে গেল মাহিবের এসব কথায়। তবুও প্রসন্ন হাসি হেসে বলল,

” হ্যাঁ, অবশ্যই।” মৌ বেশ বুঝতে পারছে লক্ষ্য অতি নিকটে। এমতাবস্থায় কোনো ভুল করা চলবে না। সুতরাং মাহিবের মন খারাপ হয় এমন কিছুই সে বলল না। হাসি,কথার ছলে মাহিবকে আরও কাবু করতে ব্যস্ত হলো। দূর থেকে মানুষকে চেনা যায়না। মানুষকে চিনতে হলে তার কাছে যেতে হয়। মৌ মাহিবের খুব বেশি কাছে গেছে। এতো কাছে যেখান থেকে মাহিবকে বশ করা যায়। নিষ্ঠুর, পাষণ্ড মাহিব আজ অস্ত্র,নারী, নেশা নিয়ে পড়ে নেই বরং মনের অনুভূতির জালে নিজেকে বাঁধতে চাচ্ছে। সারাক্ষণ ওর ইচ্ছা হয় মৌ-য়ের সাথে কথা বলতে। বাবা জীবিতকালে যে ইচ্ছা পোষণ করেছি আজ মাহিব নিজেও তাই চায়। সে একটা ছোট্ট সুখের সংসার চায়। যে সংসারের কর্তা সে হবে। তাকে ঘিরে থাকবে মৌ। যদিও এসব তার একান্ত ভাবনা। মৌ কিংবা কাওকেই বলা হয়নি। দরজার বাইরে কারো পায়ের আওয়াজ পেয়ে মৌ তড়িঘড়ি কল কেটে দেয়।মাহিবের মনের আকাশ জুড়ে ফের নেমে আসে নিঃসঙ্গের বিষাদ। মন খুলে কাওকে যদি এই আকাঙ্খার কথা বলা যেত! মাহিবের আজ খুব করে মনে পড়ছে শামীমকে। ছেলেটা শুধু ডান হাত নয় ওর পরম বিশ্বস্ত, আপন একজন ছিল। দু’বছর গত হয়েছে শামীম নেই। শামীমের শূন্যতা মাহিব কিছু দিয়েই পূরণ করতে পারে না, এমনকি মৌ-কে দিয়েও না।

দরজা নক পড়তেই ভাবনায় ছেদ পড়ে। গম্ভীরগলায় বলে,

” কে?”

দরজা ঠেলে যাকে রুমে প্রবেশ করতে দেখে সে আর কেউ নয়, সামিরা। উগ্র সাজ, এলোমেলো পায়ে এগিয়ে আসছে। বোঝায় যাচ্ছে সামিরা খুব বেশি নেশা করেছে। এমনটা সচারচর করে না সামিরা। খুব চতুর মেয়েটা। আগের মাহিব হলে উঠে যেত। এই সুযোগ কাজে লাগাত কিন্তু আজ উঠল না। ভ্রুকুটি করে তাকিয়ে রইল। আদিম উন্মত্তা জাগছে না, বিরক্তবোধ হচ্ছে সামিরাকে দেখে। সামিরা নগ্ন পদে ঢুলতে ঢুলতে এসে বসল ওর চেয়ারের সামনে,বিছানায়। পরনের টপসটার গলা নেমে গেছে সীমানা ছাড়িয়ে। মাহিব চেয়ে আছে ঐ স্পর্শকাতর স্থানে। অভ্যাস সহজে বদল হয়না। চোখের এই অভ্যাসটাও তাই না চাইতেও ওদিকে আকর্ষিত হলো। সামিরা ঝুঁকে বলল,

” হবে নাকি আজ?” মাহিব বিস্মিত হয়। ঘোর কাটে সামনে বসা রমণীর রক্ত মাংসের দেহের উপর থেকে। সে সামিরাকে চেনে। সামিরা স্বেচ্ছায় কোনোদিন ওর বিছানা সঙ্গী হয়নি,হয়তো কারোরই হয়নি শানকে ভালোবাসার পর। কিন্তু আজ এই অশোভন ইঙ্গিতের অর্থ কী দাঁড়ায়! বাবার পরে সেই এই এড়িয়ার অপরাধ জগতের গডফাদার। কাঁচা বুদ্ধি মোটেও তার নেই। সামিরাকে তাই কটাক্ষ করে বলল,

” অবশ্যই, তবে তার আগে শানকে একটা কল করলে জিনিসটা আরো ইনজয়বেল হবে,কী বলো?” সামিরা নেশায় বুঁদ হয়েও চোখ কঠিন করে তোলে। সে এমন জবাব প্রত্যাশা করেনি। শানকে পাওয়ার ব্যাকুলতা তাকে অধৈর্য্য করে তুলেছে কিন্তু পরাজয়ও স্বীকার করবে না। গোপন সূত্রে জেনেছে মাহিবের জীবনে স্পেশাল কেউ এসেছে। সামিরা সহজে বিশ্বাস করার দলে নয়। কথাটা কতখানি সত্যি তার যথার্থতা প্রমাণের জন্যই সামিরা এখানে এসেছে। নয়তো এ ঘরে ওর জুতা পর্যন্ত আসে না। মাহিবের দিকে তাকিয়ে মুখ বিকৃত করে তোলে। মাহিব মৃদু হাসছে৷ এর অর্থ সে সামিরার চালাকি ধরে ফেলেছে। সামিরাও কম নয়। চট করে আবার আগের অবস্থায় ফিরে আসে। এই মাহিব তার দূর্বলতার সুযোগ নিয়ে বহুবার জোর খাটিয়েছে। অজ্ঞাতে তাকে ভোগ করেছে। এইবার মাহিবের শাস্তির পালা। তবে তার আগে সত্যিটা উৎঘাটন করতে হবে। এরপর পুরোপুরি শানের সে। আজ সামিরা অগ্নিপরীক্ষার জন্য প্রস্তুত হয়ে এসেছে। কষ্টগুলোকে ভোদকার জলে বিক্ষিপ্ত করেছে। মাহিব হার মানে না৷ সে নিজেও সামিরাকে আর চাচ্ছে না, কিন্তু আগ বাড়িয়ে প্রত্যাখ্যান করাটা পরাজয়ের। তাছাড়া বাবা তার এই ভাতিজির নামে অর্ধেক সম্পত্তি উইল করে গেছেন। মাহিবের সেটাও চায়। মাহিব দ্বিধান্বিত এই মুহূর্তে। একদিকে মৌ- তার ভালোবাসা,অন্যদিকে পাওয়ার,সম্পদ- যা এই সামিরাকে ছাড়া পাওয়া সম্ভব নয়। তাদের এই অপরাধের জগতের অন্যতম মাস্টারমাইন্ড সামিরা। সে যদি শানের হয়ে যায় তবে মাহিবের পরাজয়। শানের আধিপত্য কিছুতেই মানতে পারবে না মাহিব৷ এই সামিরাই ছিল, যে পদে পদে শানকে দেখিয়ে তাকে অপমান, অপদস্থ করেছে। শাস্তির যোগ্য তো সামিরাও। মৌ আজও তার আছে,কালও থাকবে। না হোক স্ত্রী হয়ে সমাজের চোখে! মনের চোখে সেই হবে মাহিবের স্ত্রী, সহধর্মিণী। মাহিব পুরোনো স্বত্বায় ফিরে আসে। ঝাপিয়ে পড়ে নেশায় দূর্বল সামিরার উপর। সামিরার বুদ্ধির সাথে পেরে ওঠা মাহিবের পক্ষে সম্ভব নয়। সামিরা আজ বুঝে সুঝেই ঢুকেছিল এ ঘরে। মাহিবের হিংস্র রূপ দেখে দরজার ওপাশে দাঁড়ানো বডিগার্ডকে সংকেত দেয়। বিবস্ত্র হবার পূর্বেই গার্ড মাহিবকে ধাক্কা দিয়ে সামিরাকে উদ্ধার করে। আশানুরুপ ফল না পাওয়ায় নেশাচ্ছন্ন অবস্থায় রাগে জ্বলতে লাগল সামিরা৷ শরীরে বল পাচ্ছে না। ক্ষিপ্র হয়ে কোনোকিছু ভাঙতে পারছে না। অচিরেই গার্ডের বাহুতে অচেতন হয়ে পড়ে। সামিরার গার্ডের সাথে পেরে ওঠেনি মাহিব। বিশালদেহী, দীর্ঘকায় দানবটার এক হাতের ধাক্কায় সে ফ্লোরে ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। বা’কাঁধে যথেষ্ট ব্যথাও পেয়েছে অনুভব করল। তবুও হাসল। বলল,

” সামিরা,সামিরা, তুমি যা ভেবেছ তা কোনোদিন হবেনা৷ এই পিশাচের পিশাচী তুমি৷ তোমাকে ছাড়া আমার পিশাচ রাজ্য অসম্পূর্ণ। আমাকে অসম্পূর্ণ করে আমার জাতশত্রুকে তুমি সম্পূর্ণ করতে পারো না,সামিরা। তুমি আমার এবং আমারই হবে শেষপর্যন্ত। হোক স্বেচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায়। সেদিন তোমার ঐ দানবটাও আমার বিছানা থেকে তোমাকে তুলে নিতে সাহস করবে না। তোমার এক একটা দিন হবে নরক সমতুল্য। হা! হা! হা।” বাড়ি কাঁপিয়ে অট্টহাসি হাসে মাহিব।

খাবার টেবিলে সবার সাথে মৌটুসীও বসল।মনের কপটতা যেন এই সুখী, আন্তরিক মানুষগুলোকে দেখেই ম্লান হচ্ছে। না চাইতেও এদের সাথে মিশে গেল একসময়। ইমরোজের বাবা বেশ মজার মানুষ। মৌটুসী খুব হাসল তার কথায়। হাসতে হাসতে চোখের কোনে জল চলে এলো। নিজের বাবার কথা মনে পড়ে গেল হঠাৎ। বাবাও খুব মজার ছিল। একসাথে পাটি বিছিয়ে যখন ওরা খেতে বসত, বাবা এমন এমন কথা বলত না হেসেই পারত না। সবচেয়ে বেশি হাসত আয়ুশী৷ ঠিক আশার মতো। ইমরোজের চোখ পড়ল সামনে বসা মৌটুসীর উপর। মেয়েটার চোখ ছলছল। ইমরোজ অপলক চেয়ে আছে। এমন মায়াভরা মুখ থেকে দৃষ্টি ফেরাতে পারেনা ও। আশাসহ সবাই বিষয়টা খেয়াল করে। বাপ- মেয়ে ঠোঁট টিপে হাসলেও আমেনা বেগম হাসেন না।

” কী হয়েছে তোমার,মেয়ে?”

মায়ের গম্ভীরগলা শুনে তন্ময়তা কাটে ইমরোজের। আশার দিকে তাকাতেই দেখল সে মিটিমিটি হাসছে। চোখ রাঙাতেই আশা হাসি বন্ধ করে মা’কে বলল,

” মনে হয় বাড়ির কথা মনে পড়েছে। আপু, আপনার বাড়িতে কে কে আছে?”

” কেউ নেই।” মৌটুসী সবাইকে অবাক করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। আহসান সাহেব বলেন,

” আরে করছ কী মা, বসো খেয়ে নাও।”

মৌটুসী একচিলতে ম্লান হেসে বলল,

” পেট ভরে গেছে আঙ্কেল।” শান্ত ভঙ্গিতে রুমে চলে যায় মৌ। খাবার টেবিলে কিছুক্ষণের জন্য নীরবতা নেমে আসে। আমেনা বেগম এই মেয়ের আধিপত্য খাবার টেবিলে বেশিক্ষণ স্থায়ী হতে দেয় না। সবাইকে খাবার তাগাদা দিতে দিতে ইমরোজের জন্য ঠিক করা মেয়েটার প্রসঙ্গ তোলে। আমেনা খেয়াল করছে ছেলের এসবে মনোযোগ নেই। সে বার বার আশার রুমে তাকাচ্ছে। রাগে ফুঁসতে থাকেন ভেতরে ভেতরে তিনি।

রাত ঘন হচ্ছে অথচ শানের ফেরার নাম গন্ধ পাচ্ছে না ইমা। মনটা কু গাইছে। অস্থির হয়ে পায়চারি করছে লিভিং এড়িয়ায়। আজ নিজ হাতে ভালোমন্দ রান্না করেছে শানের জন্য। অপেক্ষা করছে কখন শান ফিরবে। ভুল যারই হোক আজ সব মিটিয়ে ফেলবে সে। শানকে আর কষ্ট দেবে না৷ সব জানার পর তো একেবারেই না৷ যা হারিয়েছে তা আর ফিরে পাবার নয়,কিন্তু যা আছে তাকে হারাতে দেওয়া বোকামি ছাড়া আর কি! মোবাইল বেঁজে ওঠায় ছুটে আসে ইমা। নিরাশ হয় স্ক্রিনে মোবারকের নাম দেখে।

” জি,মোবারক ভাই।”

” স্যার ফিরেছে?”

অভিমানে কন্ঠ ধড়ে আসে ইমার।

” না।”

মোবারক বলে,

” আপনি চিন্তা করবেন না,আমি আসছি।”

কিছুক্ষণ পর আসমা এবং মোবারক আসে। ইমাকে চিন্তিত দেখে দু’জনই সান্ত্বনা দেয়। এই মুহূর্তে সান্ত্বনা না শানকে চায় ইমার। সে বলে,

” সে কোথায়?”

মোবারক সোজা জবাব না দিয়ে বলে,

” স্যার ঠিকই আছে। দেখবেন কালই ফিরে এসেছে।”

ইমা বুঝতে পারে মোবারক শানের খবর জানে, হয়তো কোথায় গেছে সেটাও জানে। অধৈর্য্য গলায় বলে,

” আমি তার কাছে যাব মোবারক ভাই।”

মোবারক চমকে তাকায়। বলে,

” না, না। পাগলামো করবেন না৷ ধৈর্য্য ধরেন সময় হলেই স্যার ফিরে আসবে।”

” আপনি আমাকে নিয়ে যাবেন নাকি তাই বলুন।”

ইমা হঠাৎই রেগে যায়। আসমা শান্ত করতে গেলে কাঁদো কাঁদো হয়ে আসমার হাতদুটো ধরে বলে,

” বোন, তোমার স্বামীকে বলো আমাকে যেন তার কাছে নিয়ে যায়। আমি আর এক মুহূর্ত তাকে ছাড়া থাকতে রাজি না। জেনে না জেনে অনেক ভুল হয়েছে আমাদের। এবার সবকিছুর সমাপ্তি টানব আমি। শানকে একা ছাড়ব না কিছুতেই আর।প্লিজ, তোমার স্বামীকে বলো আমাকে সত্যিটা বলতে।”

আসমা কী বলবে ভেবে পায়না। মোবারকের দিকে তাকাতেই মোবারক উঠে দাঁড়ায়। গম্ভীর মুখে বলে,

” ভাবি সবসময়ই অধৈর্য্য মানায় না। একটু তো সবুর করুন। বললাম তো রাগ পড়ে গেলে ফিরে আসবে স্যার, আর যদি না ফেরে আমি কাল নিয়ে যাব আপনাকে। এখন শুয়ে পড়ুন।”

আসমা স্বামীর এহেন রূঢ়তায় রুষ্ট হয়। ইমা কাঁদছে। অনুরোধ করেও যখন ফল হলো না সে টর্চ হাতে বাইরে বেরিয়ে এলো। ইমাকে থামাতে পিছু পিছু আসমা এবং মোবারকও গেল। গেটের সামনে এসে ইমা মতিনকে বলল,

” গেট খুলুন।”

শানের অবর্তমানে মোবারকের কথাতেই মতিন চলে। এখনো তাই সেদিকে তাকিয়ে আছে। ইমা সেটা দেখে ধমকে বলল,

” কী হলো খুলুন।”

মোবারকের সাড়া না পেয়ে মাথা নত করে দাঁড়িয়ে আছে মতিন। ইমা ক্রোধে কাঁপছে সবার দিকে তাকিয়ে। একসময় চোখের জ্বলে গলে ক্রোধ দূর্বল হয়ে পড়ে। মোবারককে ফের অনুরোধ করে ইমা। এবার আসমাও ইমার সাপোর্ট করল। মোবারক অবশেষে রাজি হয়। কিন্তু সমস্যাও তাতে কম নয়। সে শেষবারের মতো ইমাকে বোঝায়। এই নিশুতে উত্তর দিকে যাওয়াটা বিপদেরও হতে পারে। ওদিকটা একেবারে নির্জন। শ্বাপদসংকুলে ঘেরা। উত্তর দিকের কথা শুনে আসমাও ভয় পেল। সে নিজেও এবার এখন ওদিকে যাবার বিপক্ষে। সবকিছু জানার পরও ইমা নিজের সিদ্ধান্তে অটল রইল। সে শুধু পথটা দেখিয়ে দিতে বলল। মোবারক একথা শুনে বলে,

” পথ দেখিয়ে দেবো মানে?”

” হ্যাঁ, আমি একাই যাব। আপনার যাবার প্রয়োজন নেই।” পাশে দাঁড়ানো আসমার মুখে ভয়ের রেখা দেখেই কথাটা বলেছে ইমা। আসমা সেটা বুঝতে পেরে লজ্জিত হলো। মোবারক রেগে বলল,

” ভাবি, এটা কোনো সাধারণ স্থান নয়। লোকালয় ছাড়িয়ে একেবারে নির্জন বনজঙ্গলে ঘেরা স্থান। উত্তর দিকে একেবারে নির্জন। মাটির এবড়োথেবড়ো রাস্তা। গাড়িও যাবার সাধ্য নেই। এই রাতে পায়ে হেঁটে মাইল খানেক পথ পাড়ি দিয়ে শান স্যারের কাছে পৌঁছানো হিমালয় জয় করার সমান। বিপদ প্রতি মুহূর্তে সেখানে।”

ইমা একটুও ভয় পেল না নিজেকে নিয়ে বরং তার ভয় হচ্ছে শানের জন্য। এ পথ যদি এতোই ভয়ের হয় তবে শান কেমন আছে? তার কিছু হলো না তো! ইমা আগের চেয়ে বেশি অস্থির হয়ে ওঠে। সে দৃঢ় কণ্ঠে বলে,

” আমি এক্ষুনি বেরোব মোবারক ভাই। আপনাদের কারো যাবার প্রয়োজন নেই। দারোয়ানকে বলুন গেট খুলে দিতে।”

” ভাবি আপনাকে আমি কী ভাবে বোঝাব? পৃথিবীতে এমন কিছু জিনিস আছে যার ব্যাখ্যা নেই,অস্তিত্ব থেকেও নেই। শুধু অনুভব করা যায়। এই অনুভবেই মানুষ শেষ হয়ে যায় ভয়ে। আপনারা শহরের মানুষ। আপনাদের বললেও আপনারা এসব বিশ্বাস করবেন না। কিন্তু তাতে তাদের উপস্থিতি নাই হবে না মোটেও।”

” মানে।”

আসমা ভয়ে ভয়ে ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিল ওদিকটায় নির্জন স্থান,দিন কিংবা রাতে অশরীরী থাকার কথা শুনেছে ওরা৷ দিনে তাদের দৌরাত্ম্য যতটা কম রাতে ততটাই বেশি। ইমা এবার সত্যিই ঘাবড়ে গেল। সে বলল,

” তাহলে তো তারও বিপদ।”

” না, মোটেও না।”

” আপনি কী করে বুঝলেন?” মোবারক মতিন,আসমার দিকে তাকিয়ে সে-কথার জবাব দিল না। শুধু বলল,

” ওতো কথা বলতে পারব না। শুধু জানুন শান স্যার ঠিক আছে। ভালো হবে আপনি ওদিকে এখন না গেলে।”

অবশেষে ইমার যাওয়া হলো না। মোবারক আশ্বস্ত করলো শান ঠিক আছে। ইমা ফিরে এলো রুমে। রাত যত বাড়ছে ওর চিন্তাও সেই সাথে সাথে বাড়ছে। ঘড়ির কাঁটায় চারটা ছুঁই ছুঁই। ইমা তাহাজ্জুদে বসল। দু’হাত তুলে প্রার্থনা করে মহান আল্লাহর দরবারে। মিনিট খানেক বাদে উঠে এলো ছাঁদে। মনটাতে সাহস পাচ্ছে এখন। উত্তর দিকে যতদূর চোখ যায় ঘন অন্ধকার। সারি সারি জানা অজানা বৃক্ষ, গুল্মে ঘেরা জঙ্গলের মাথায় আঁধার নেমেছে। তাকালেও বুকটা ধ্বক করে ওঠে। ভোরের আযান শুনতে পায় ইমা। আশ্চর্য! আযান উত্তরদিক থেকেই আসছে। ইমার কৌতূহল হলো। মনে হতে লাগল মোবারক মিথ্যা বলেছে। ফজর আদায় করে ইমা সতর্কে বাইরে এলো। খামারের মুখে বাঁধা জার্মান শেফার্ডগুলো শুয়ে আছে। একটা পাতা পড়লেও কান খাড়া করছে ওগুলো। ইমা সাবধানে গেটের কাছে এলো। সারারাতের পাহারার পর ভোরবেলাটায় মতিনের কাকনিদ্রা গাঢ় হয়ে আসে। ইমা ওর নাক ডাকার শব্দ শুনতে পায়। গেট তালাবন্ধ। খুব সাবধানে চাবির গোছা থেকে চাবি তুলতেই মতিন চোখ মেলে। মতিন কিছু বোঝার পূর্বেই হাতের চাকু দেখিয়ে সরিয়ে দেয়। চাবি দিয়ে তালা খুলে ফেলে চট করে ইমা। মতিন থতমত খেয়ে যায় কিছুক্ষণের জন্য। স্বাভাবিক হতেই গলা ছেড়ে মোবারককে ডাকে,

” ও মোবারক ভাই, ও ভাই দেখেন ম্যাডাম উত্তর দিকে যায়।”

শেফার্ড গুলো ইতোমধ্যে ঘেউ ঘেউ শুরু করে শিকল সহ লাফাতে লাফাতে। ইমা ভয়ে ওদিকে তাকিয়ে আবার মতিনের চেঁচানো দেখছে। কানে হাত দিয়ে ধমকায় মতিনকে,

” ঐ চুপ! একদম চুপ।”৷ ধমকে মতিনের গলার স্বর সাময়িক নিচু হলেও ফের আগের মতো চড়া হয়। সেই সাথে তাল মিলিয়ে শেফার্ডগুলোও ডাকে। ইমা সময় ব্যয় না করে গেট পার হয়ে বেরিয়ে গেল। মতিন বাঁধা দেওয়ার যথাসাধ্য চেষ্টা করেও বিফল হয়। স্যারের বউ না হলে চ্যাংদোলা করে ভেতরে ঢুকিয়ে আনত কিন্তু এ যে সয়ং কর্তী। তাকে চ্যাংদোলা তো দূরে থাক ছুঁতেও সাহস পায় না মতিন। এমন অসহায়ত্বে নিজেকে ধিক্কার দেয়। তাড়াতাড়িতে ভেতরে ঢুকে মোবারককে খবর দিতে ছোটে। ইমা দ্রুত পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে। রাতের আঁধার এখনো খানিকটা চারপাশে। খামার বাড়ি থেকে যত এগোচ্ছে ততই নির্জনতা চোখে পড়ে। ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শুনতে পাচ্ছে ঝোপের মধ্যে থেকে। হঠাৎ ভারী কিছু পড়ার শব্দে গা ছমছম করে ওঠে। পা নড়তে চায়না। পেছন ফিরে তাকায়। খাবার বাড়ি ভোরের কুয়াশায় অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। মোবারকের ডাক ভেসে আসতেই ইমা আরও জোরো পা চালায়। ভয়কে জয় করতে মনে মনে সৃষ্টিকর্তার নাম জপে। হঠাৎ ঝুপ করে কিছু পড়তেই ইমা দাঁড়িয়ে পড়ে। ঘোরে মধ্যে সে অনেকটা পথ চলে এসেছে। ভোরের আলো বড়ো বড়ো গাছের ফাঁকে উঁকি দিচ্ছে। ইমা খেয়াল করল সে ফাঁকা রাস্তা ছেড়ে বনের মধ্যে ঢুকেছে। সামনে পায়ে হাঁটার রাস্তা নেই। এদিকে বসতি নেই এটাই বোঝা যাচ্ছে। কোনদিকে গন্তব্য তারও চিহ্ন ঠাহর করতে পারল না ইমা। চারিধারে বড়ো বড়ো শাল,মেহগনি, জারুল সহ বন্য গাছের সারি। লোকালয়ের মতো অন্ধকার সহজে কাটবে না এখানে। ইমা নিজের বোকামি বুঝে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। বার বার বিপদ দূরের দোয়া দরুদ পড়ছে। মাথা কাজ করছে না ভয়ে। দোয়ার আয়াত আঁটকে যাচ্ছে মাঝে মাঝে। ঠিক তখনই বা’পাশ থেকে গা হিম করা কিছুর শব্দ পেল। মেয়েলী হাসি না অন্য কিছু সঠিকভাবে বুঝতে পারল না ইমা। ওর মনে হচ্ছে কেউ ওর দিকে সন্তর্পণে এগিয়ে আসছে। না দেখেও বুঝতে পারছে সেই অশরীর বিভৎস মুখের ক্রুর হাসি। ইমা অনেক সাহস করে ঘুরে তাকাল। না, কেউ নেই। তবুও স্বস্তি পেল না। শিকারী ভীত শিকার নিয়ে খেলছে। খেলা শেষ হলেই বুঝি ঘাড় মটকে রক্ত শুষে নেবে। তারপর ছুঁড়ে ফেলে দেবে কোনো গাছের মগডালে। কেউ খুঁজে পাবে না ওকে। শানের সাথে আর দেখা হবে না ভাবতেই ইমার কান্না পায় এবার। ঠক ঠক করে কাঁপছে তিন কুলহু পড়তে পড়তে। শব্দটা ফের শুনতে পেয়ে ইমা দিশাহীন দৌড়াতে লাগল, শান, শান ডাকের চিৎকার করে।

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here